প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৫৩
তানিশা সুলতানা
দুই দিনের এই জীবন। অথচ কতো কিছু ঘটে যায়। মানুষ নির্দিষ্ট সময় নিয়ে দুনিয়াতে আসে। তার সময় ফুরিয়ে গেলে আপনাআপনি দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে। কেউ জোর করে, কান্নাকাটি করেও আটকে রাখতে পারবে না। তবুও কতো আয়োজন, কতো অভিমান, কতো রাগ, কতো অভিযোগ।
আচ্ছা মানুষ কি চিন্তা করে না?
দুনিয়ার কৃতকর্মের হিসেব দিতে হবে?
হয়ত করে না। করলে কখনোই পাপ করতো না।
সেলিনা পাথরের মূর্তির ন্যায় বসে আছে। সেলিম এবং পাপনকে গোসল করানো হচ্ছে। সেলিমের দেহখানা কেউ ধরতে চাচ্ছিলো না। দুই দিন হয়ে গেছে মৃ ত্যু হয়েছে। শক্ত হয়ে গিয়েছে লাশ। কা টা জায়গায় মাছিও পড়েছিলো।
ইমন ইশান কবর খোঁড়ার কাজে লেগে পড়েছে। পাড়াপ্রতিবেশিরা কানাঘুষা করছে। তাদের মতে সব দোষ পূর্ণতার। অথচ কেউ একবার চিন্তা করছে না “সেই অমানুষদের ভিড়ে পূর্ণতা কেমন ছিলো।”
সেলিনার কানেও অনেকেই অনেক কিছু বলছে। সেসবে তার মন নেই।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
বাড়ির পশ্চিম পাশে কবর দেওয়া হয়েছিলো পাখিকে। এখন পাখির পাশেই দুটো কবর খোঁড়া হচ্ছে। পাশাপাশি রাখা হবে তিনজনকে। এই সিদ্ধান্ত সেলিনার।
গোসল শেষ করে সাদা কাফনে মোড়ানো হয় ওদের। খাটিয়াতে শুয়িয়ে শেষ বারের মতো সাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেলিনা মনোযোগ দিয়ে দেখে সবটা।
সব শেষে যখন মাথার পাশের কাফন বাঁধা হবে তখন সেলিনা ইমনের হাত শক্ত করে ধরে এবং চিৎকার করে বলে
“আমি মরলে আমারে আমার স্বামীর পাশে কবর দিও। নিষ্ঠুর দুনিয়াতে কিছুই পাই নি আমি। পাইছিলাম শুধু হাতে গোণা কয়ডা বছর।
সকলেই আশ্বস্ত করে সেলিনাকে। ইমন কথা দেয় তাকে তার স্বামীর পাশেই কবর দেওয়া হবে।
সেলিম এবং পাপনকে কবরে শোয়ানো হয়ে গেলেই সেলিনা ভিড় ঠেলে বেরিয়ে যায়। পাগলে মতো ছুঁটে যেতে থাকে সব কিছুর হিসেব মেলাতে।
” মিষ্টির জন্মের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ছোটমায়ের সাথে বাবার ঝগড়া হয়। সামান্য ঝগড়া। ছোটমা শুধু বলেছিলো “নারীর সঙ্গ ত্যাগ করতে পারবেন না”
ব্যাসস। কুকুরের মতো পিটিয়েছিলো ছোটমাকে। তারপরের দিনই টেনে হিঁচড়ে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। রেখে এসেছে পতিতালয়ে। এবং তারপরেই শিউলি বেগমকে বিয়ে করেছেন তিনি। শিউলি বেগম মিষ্টির খেয়াল রাখতো ভালোবাসতো। আমারও খেয়াল রাখতো। তবে মায়ের মতো না। দিনশেষে মিষ্টির দায়িত্ব আমাকেও পালন করতে হতো। ইফাদ এবং ইফতিও বেশ খেয়াল রাখতো মিষ্টির।
আমার ছোট্ট বোনটাকে এই দুই হাতে মানুষ করেছি আমি। অনেক আগেই বাড়ি ছাড়তাম। শুধু মিষ্টির জন্য পারি নি।
আমার কলিজাকে কে দেখে রাখবে?
যখনই ইফতিয়ার মিষ্টির দায়িত্ব নিলো আমি নিশ্চিত হলাম। বুঝে গেলাম এবার সময় এসেছে ওই বাড়ি ত্যাগ করার। তাই তো সুযোগ বুঝে মনাকে পুঁজি করে বেরিয়ে এসেছি।
পূর্ণতার বেশ হাসি পেলো এবার। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো
“আপনার কলিজা আর নেই এমপি সাহেব। সে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে।
তবে কথাগুলো বলতে পারলে না।
অভি ফের বলতে শুরু করে
” জানো না পূর্ণতা
কতো মেয়েকে এই দুই হাতে খু ন করছি তার হিসেব নেই। কতো মেয়েকে বাবা মায়ের বুক থেকে কেড়ে নিয়েছি।
তবে তুমি ছাড়া কোনোদিনও কোনো নারীকে স্পর্শ করি নি। কোনো নারীর দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাকাই নি।
পূর্ণতা দাঁড়িয়ে পড়ে। মাথা ঝিমঝিম করছে। আঁখিপল্লব ভাড়ি হয়ে আসছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
“সাত সমুদ্র পাড়ি এসেছিলো রাজপুত্রের নিকট। বড্ড আশা নিয়ে এসেছিলো স্বপ্নের রাজ্যের খোঁজে। ভেবেছিলো রাজপুত্র শুদ্ধ পুরুষ এবার দুঃখ গুলোকে তাড়িয়ে দিবে। কিন্তু হায়য়য়
রাজপুত্র জাহান্নামের আগুন জ্বালিয়ে দিলো”
এটাই লেখা ছিলো কপালে?
এটাকেই বুঝি বলে “ভাগ্য”
“পূর্ণতা আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। আমি যাই করি তোমার গায়ে একটা ফুলের টোকাও লাগতে দিবো না। কথা দিলাম৷
সুখের রাজ্য বানিয়েছি আমি তোমার জন্য। সেখানে তুমি আমি মা মিষ্টি আমাদের পুচকু সবাই মিলে থাকবো।
পূর্ণতা এগিয়ে যায় অভির নিকট। পায়ের গোড়ালি উঁচু করে দুই হাতে আঁজলে ধরে অভি শক্ত চোয়াল। আদূরে স্বরে বলে
” আপনি সব ছেড়ে দিবেন? আমার শুদ্ধ পুরুষ হয়ে যাবেন?
পূর্ণতার হাতের ওপরে নিজের হাত রাখে অভি। মাথা নুয়িয়ে চুমু খায় পূর্ণতার কপালে। তারপর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে
” সম্ভব নয়৷
এবার নারীর শরীরে স্বাদ পাওয়া পুরুষ কখনো একা থাকতে পারে না।
আর টাকার গন্ধ শুকতে জানা পুরুষ কখনো তার পেশা ছাড়তে পারে না।
টলমল করে ওঠে পূর্ণতা আঁখিপল্লব। স্থির নয়নে দেখতে থাকে স্বামী নামক পুরুষটিকে। কি অবলীলায় বলে দিলো কথা গুলো। স্পষ্ট স্বীকার উক্তি তার। কালচে রংয়ের ওষ্ঠ নেরে বললো। এবারও কেঁপে উঠলো না ওষ্ঠ দুটো? অভির গাল থেকে হাত সরায় পূর্ণতা। সরে আসতে নেয়। সবে অভি সরতে দেয় না। কোমর জড়িয়ে আটকে রাখে নিজ বক্ষদেশের নিকট।
মনার লা শ কিছুক্ষণ আগেই দুটো লোক এসে নিয়ে গেছে। পরিষ্কার করে দিয়েছে র ক্ত। একটু আগেই যেখানে ঘন লাল র ক্ত লেগে ছিলে এখন সেখানটা ফকফকে পরিষ্কার। যেনো কিছুই হয় নি৷ মনার মৃ ত্যুতে পূর্ণতার আক্ষেপ নেই৷ সে যা করেছে তাতে তার মৃ ত্যুই পাপ্য।
তবে আক্ষেপ হচ্ছে নিজ স্বামীকে নিয়ে
আহহহা শখের পুরুষ। তাকে ভালেবেসে উচ্চস্বরে মানুষকে বলেছে “আমার এমপি সাহেব এই দুনিয়ায় সব থেকে শুদ্ধ পুরুষ”
সেই শুদ্ধ পুরুষ ঠকিয়েছে তাকে।
যখন শুনেছিলে অভি বিয়ে করেছে। তখন কান্না পেলেও ভেঙে পড়ে নি৷ ঠিক জানতো তার স্বামী এমনটা করবে না৷ তাই তে তীব্র বিশ্বাসের জোরে পাড়ি জমিয়েছিলো অচেনা শহরে।
তবে এবার কি করে অবিশ্বাস করবে? শুদ্ধ পুরুষের স্পষ্ট স্বীকারোক্তি।
অবিশ্বাস করার জোও নেই।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পূর্ণতা। তাচ্ছিল্য হেসে বলে
“পাপ করা ছাড়তে পারবেন না আবার সুখের স্বপ্ন দেখেন? বাহহহ
” সুখে তোমরা থাকবে। আমি ম রে গেলেও আফসোস থাকবে না। তোমাদের সুখের জন্যই আমার এতো আয়োজন।
পূর্ণতার সহ্য হয় না এবার। ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয় অভিকে। চিৎকার করে বলে ওঠে
“আপনাকে কখনো বলেছি আমরা ” আমাদের কারি কারি টাকা লাগবে? রাজপ্রাসাদ লাগবে?”
কখনো বলেছিলাম?
আমি বলেছি? মিষ্টি বলেছে?
আমরা আপনার কাছে একটু সময় চেয়েছিলাম। ভাঙা ঘরে থেকেও আপনাকে পাশে চেয়েছিলাম।
কার জন্য এতো আয়োজন করলেন এমপি সাহেব? কাকে নিয়ে থাকবেন রাজপ্রাসাদে?
মিষ্টি মা রা গেছে। একবুক হতাশা আর আক্ষেপ নিয়ে দুনিয়া ছেড়েছে। আপনার রাজপ্রাসাদ দেখার শোভাগ্য হয় নি তার। ম রার আগে বারবার করে দাভাই দাভাই বলে দাপড়িয়েছে। শেষবার আপনাকে এক পলক দেখবে বলে শ-খানিক মেসেজ লিখেছে। জীবনে দুজন মানুষকে মিষ্টি ভরসা করেছিলো। শেষ সময়ে একজনকেও পাশে পায় নি।
কি করবেন এবার এতো বড় রাজপ্রাসাদ দিয়ে?
অভির কানে বাজছে শুধু একটা লাইন ” মিষ্টি মা রা গিয়েছে”
স্থির হয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে পূর্ণতার মুখ পানে। অতঃপর কাঁপুনি উঠে যায় শরীরে। নিজের শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে হিমশিম খায়। ধপ করে বসে পড়ে ফ্লোরে। পরপরই আঁখিপল্লব বন্ধ করে ফেলে।
অস্পষ্ট স্বরে বোধহয় কিছু বলছিলো তবে সেটা শুনতে পায় না পূর্ণতা।
জমিদার বাড়ির বসার ঘরে উপস্থিত হয় সেলিনা। জরুরি বৈঠক চলছে। রাজকীয় সিংহাসনে বসে আছে জমিদার সাহেব। তার দুই পুত্র বসেছে দুপাশে। ইফাদ দাঁড়িয়ে আছে মনোয়ারের পাশে। জমিদার গিন্নিরাও সেখানে উপস্থিত। তারই সাথে উপস্থিত হয়েছে গ্রামের কিছু সনামধন্য ব্যক্তিরা।
সেলিনাকে দেখে কপাল কুঁচকায় জমিদার সাহেব। ছেলেদের পানে তাকিয়ে চোখে চোখে প্রশ্ন করে “ঘটনা কি”
তারা জবাব দিতে পারে না। উপস্থিত সকলের দৃষ্টি এবার সেলিনার পানে।
তাতে একটুও বিচলিত হলো না সেলিনা। বরং ধীর পায়ে এগিয়ে যায় জমিদারের নিকট। পায়ের কাছে বসে পড়ে। হতদম্ভ হয় জমিদার।
প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৫২
সেলিমা মিষ্টি করে হেসে বলে
“আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ আমি। আপনার জন্যই জীবনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শিখেছে।
নিজ প্রশংসা শুনে অধর কোণে হাসি ফুটে জমিদারের। কিছু বলবে বলে মুখ খুলবে তখনি সেলিনা আঁচলের আড়াল হতে ধাঁড়ালো ছু ড়ি বের করে মুহুর্তেই ঢুকিয়ে দেয় জমিদারের পেটে।