প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৫৭

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৫৭
তানিশা সুলতানা

এই শহরের এক মুঠো ভাতের বড্ড দাম।মানুষ ভাত ফেলে দিবে তবুও কোনো ক্ষুধার্থ ব্যক্তিকে খেতে দিতে নারাজ। এই যে এই হোটেলে এক গামলা ভাত বেঁচে গিয়েছে। সে টা কাল সকালে পঁচে যাবে। তবুও হোটেলের ম্যানেজার বীণা পরিশ্রমে খেতে দিবেন না। নিজের পকেটে পয়সা না থাকলে পৃথিবী চেনা যায়। অভিও চিনছে। এই সুন্দর পৃথিবীর ভিন্ন রূপ দেখছে। বড্ড স্বার্থপর। ঠিক অভিরাজের মতো। থালাবাসন মাজতে মাজতে একটা ঘটনা মনে পড়ে অভির।

তখন তার বয়স ছিলো সতেরো বছর। মায়ের ভীষণ অসুখ করেছিলো সে বার। টাকার প্রয়োজন অনেক। অতি দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। টাকা কোথায় পাবে অভি? পাগলের মতো কিছু দিন এগিয়ে ওদিক ছুঁটেছে টাকার খোঁজে। একটা টাকাও জোগাড় করতে পারে নি।একদিন জমিদার সাহেব নিজ লোক দ্বারা গ্রামের মাঝারি আকারের কিছু মেয়ে ধরে আনে। এবং তাদের বিদেশে পাচার করার পায়তারা শুরু করে দেয়। অভি পুরো ঘটনা বুঝে ফেলে। এবং সে বুদ্ধি খাঁটিয়ে তার দাদাভাইয়ের পাতা ফাঁদ থেকে মেয়েগুলোকে উদ্ধার করে নিজে চড়া দামে পাচার করেছিলো। পনেরো কি ষোল বছরের একটা মেয়ে গাড়ি থেকে নামার আগ মুহুর্তে অভিকে বলেছিলো “আমার খুব খুধা লেগেছে৷ এক মুঠো ভাত দিবেন?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অভির ইচ্ছে করছিলো মেয়েটাকে খাওয়ানোর কিন্তু সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। এখুনি প্লেন উড়াল দিবে আকাশে। যেতে হবে তাদের। তাই খেতে দিতে পারে না।
আল্লাহ কি সেই দিনের হিসেব নিচ্ছে? বোঝাচ্ছে পেটের ক্ষুধা কতোটা ভয়াবহ?
এটা তো সামান্য একটু পাপ। এর থেকেও বড়বড় পাপ করেছে। তাহলে সেই পাপের হিসেব কতোটা কঠিন হবে?
বুক কেঁপে ওঠে অভির। হাত ফসকে পড়ে যায় প্লেট খানা। ইট সিমেন্টে তৈরি ফ্লোরে স্টিলের প্লেট পড়াতে ঝুনঝুন করে শব্দ হয়ে ওঠে উচ্চস্বরে। পূর্ণতার কান ওবদি পৌঁছে যায় সেই শব্দ। সে আতঙ্কিত নয়নে তাকায় অভির পানে। পাশে রান্না করতে থাকা বাবুর্চি বিরক্ত হয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বলে
“কাম করতে মন চায় না তো গিলতে মন চায় কেন?

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে অভি। ফের তুলে নেয় প্লেট খানা। এবার অতি সাবধানে ধুঁতে থাকে। এবং ক্ষণে ক্ষণে দৃষ্টি ফেলে সেই ম্যানেজারের পানে। সেখানেই পূর্ণতা বসে আছে। দৃষ্টি তার পানেই৷ অভি চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলে পূর্ণতাকে। বোঝায় ” আমি ঠিক আছি”
সব গুলো থালাবাসন মেজে দিতে পারলেই এক মুঠো ভাত দিবেন। এমনটাই শর্ত দিয়েছেন ম্যানেজার। অভিও মেনে নিয়েছে। এই শহরে বীণা পরিশ্রমে কেউ এক ফোঁটা পানিও দিবে না। আর অভিও চায়ও না।
পূর্ণতা অভির পানে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টি। একে একে মনে পড়ে যায় সমস্ত ঘটনা। অভি প্রথম থেকেই তাকে ইশারা ইঙ্গিতে জানিয়েছিলো ” জমিদারের পাপের রাজ্যের রাজা সে”
পূর্ণতা কখনো বুঝেছে তো কখনো বুঝে নি।

তবে এটা ভালো করেই বুঝে ছিলো অভি রাজ পাপী হলেও তার চরিত্র পবিত্র। এক পূর্ণতা ছাড়া গোটা জগত সংসারে তার দ্বিতীয় কোনো দুর্বলতা নেই। এটাই পূর্ণতার ছোট্ট হৃদয়টাকে শান্ত করে।
হোটেল বন্ধ হয়ে যাবে। রাত এগারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট। অভির বাসন মাজা শেষ। ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের দুটো থালায় ভাত এবং ডাল দিয়েছেন বাবুর্চি। ম্যানেজারের নির্দেশে তাতে আধভাঙা এক টুকরো পাঙ্গাশ মাছের টুকরোও দিয়েছে। ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের গ্লাসে একটু পানি। হোটেল বন্ধ করে দিবে বলে অভি পূর্ণতাকে বের করে দিয়েছে। আপাতত বাজারের পূর্ব পাশে বড় বটগাছটার নিচে বসে আছে দুজন। অভি যত্ন সহকারে ভাত মেখে তুলে দিচ্ছে পূর্ণতার মুখে। এবং নিজের মুখেও পুরছে। যথেষ্ট পরিমাণে ভাত দিয়েছিলো। অনায়াসে দুজন পেট পুরে খেয়ে নেয়। বাজারের টিউবওয়েল থেকে পানিও পান করে নেয়।

শুনশান নিরবতা বিরাজ করছে চারিপাশে। মাঝেমধ্যে কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। ঝিঝি পোকারা আজকে বোধহয় ঘুমচ্ছে। নাহলে ঝি ঝি করে মাথা কেনো ধরিয়ে দিচ্ছে না?
বিশাল বাজার আলোকিত। সাদা লাইটের আলোতে চারিপাশে চকচকে ফকফকে। পূর্ণতা মনে হচ্ছে এটা একটা রাজ্য আর সেই রাজ্যের রাণী তিনি। রাজা অভিরাজ। জীবনে প্রথমবার নিজেকে বড্ড সুখী মনে হচ্ছে পূর্ণতার। এই যে সুখের ঢেকুর তুললো। এতো তৃপ্তি নিয়ে কোনোদিনও খাবার খায় নি সে। এই যে অভিরাজের কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করে আছে। বুকের ভেতরটা শীতলতায় ছেড়ে যাচ্ছে। শান্তিতে দুচোখে ঘুম নামছে। কতো রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে বালিশ ভিজিয়েছে।

সেইদিন একটা চিরকুট পেয়েছিলো পূর্ণতা। মনার লেখা। অভি চেতনা হারানোর পরপরই পেয়েছিলো। যত্ন সহকারে রেখে দিয়েছিলো নিজের কাছে। এবং।অভি সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরে সেই চিরকুট খানা পড়েছেও।
“আমি সারাটা জীবন তোমাকে পাওয়ার লোভে কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে গেলাম। কিন্তু তোমায় পেলাম না। কি করি নি আমি তোমার জন্য?
সিঙ্গাপুরে খুব সুন্দর জীবন কাটাতে পারতাম আমি। তোমার টানে ছুঁটে এলাম। ইফাদের সাথেও খুব শান্তিতে সংসার করতে পারতাম। তোমাকে পাওয়ার লোভে ইফাদকেও ছাড়লাম। আমার একটা জীবন নষ্ট করলাম তোমায় পেছনে ছুঁটে।

তুমি শুধুমাত্র পূর্ণতাকে পাওয়ার জন্য সুন্দর ভাবে বাঁচার জন্য আমাকে আর ইফতিয়ারকে ব্যবহার করলে। আমাকে স্বপ্ন দেখিয়ে নিজে জমিদারদের নজরের বাইরে চলে আসলে। ইফতিয়ারকে দিয়ে পূর্ণতাকে আনাচ্ছো।
অভিযোগ নেই তোমার প্রতি। তবে আফসোস রয়ে গেলো। একটা জীবন শুধু তোমাকে পাওয়ার লোভে দাঁপড়াতে দাঁপড়াতেই পার করলাম। না তোমায় ছুঁতে পারলাম আর না একটু সুখের মুখ দেখলাম”

রাতের খাবারটা সবাই এক সাথে বসেই খাচ্ছে। ইতোমধ্যেই ইফতিয়ারের কানে পৌঁছে গিয়েছে তার পূর্ণতা ভালো নেই। প্রাসাদ ছেড়ে বেড়িয়ে গিয়েছে। ইফতিয়ারের গলা দিয়ে খাবার নামছে না। প্লেটে আঙুল চালিয়ে আঁকিবুঁকি করছে আর গভীর ভাবে কিছু চিন্তা করছে।
নিশা কাচুমাচু হয়ে বসেছে ইফতিয়ারের পাশের চেয়ারে। মূলত এটা ছাড়া আর ফাঁকা কোনো চেয়ার নেই। সেও খেতে পারছে না। একবার খাবার মুখে তুলছে তে আবার ঝিমচ্ছে। ইফতিয়ারের শরীর হতে কড়া সুগন্ধ ভেসে আসছে। সেই সুগন্ধই মূলত নিশার ঝিমানোর কারণ।
ইরিন তৃক্ষ দৃষ্টিতে ভাইকে ফলো করছে। ও ভেবে পায় একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে এতোটা ভালো কি করে বাসতে পারে?

এটা কিভাবে সম্ভব? আর এতোটাই যখন ভালোবাসে তখন সৃষ্টি কর্তা কেনো তাদের মেলালো না?
কপালে রাখে নাই ঠিক আছে। এটলিস্ট মায়াটা একটু কমিয়ে দিক হৃদয় থেকে।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ইরিন।
শান্ত স্বরে বলে
“ভাই খাচ্ছিস না কেনো?

চমকায় বোধহয় ইফতিয়ার। এক নজর ইরিনের পানে তাকিয়ে এক লোকমা ভাত মুখে পুরে। আমেনা বেগম ইফতিয়ারের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত স্বরে বলে
“আমি তোমার বিয়ে দিতে চাই ইফতিয়ার।
উত্তর যেনো ইফতিয়ারের জিব্বার আগায় এসে ছিলো।
” আমি বিয়ে করতে চাই না মা।
রাগ হয় আমেনার৷ হিসহিস করে বলে
“আমাকে রাগিয়ে দিবি না একদম। তুই তো বিয়ে করবিই করবি তোর বাপও বিয়ে করবে।
” তাহলে বাবাকেই করাও। আমার আপত্তি নেই।
ইব্রাহিম পানি পান করছিলো। স্ত্রী এবং সন্তানের কথপোকথন শুনে বিষম খায়। পানি সিঁটকে পড়ে মুখ থেকে। কোনোরকমে নিজেকে একটু শান্ত করে
কাঁদোকাঁদো স্বরে বলে

” আমি একটাই সামলাতে পারি না। মা ই রের ওপরে রাখে সবসময়। আরেকটা আসলে ক ব রে পাঠাবে আমায়। আকালে ম র তে চাইনা বাপ।
উচ্চস্বরে হেসে ওঠে ইরিন। নিশাও ঠোঁট কামড়ে হাসে। হাসির দেখা মেলে ইফতিয়ারের অধরেও। আমেনা স্বামীকে কড়া ভাষায় কিছু বলবে ভেবেছিলো। কিন্তু ছেলের ঠোঁটে হাসির ঝিলিক দেখে কথা গিলে ফেলে। ইফতিয়ারের মাথাখানা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে। ধরে আসা গলায় বলে
“তোকে এভাবে দেখতে ভালো লাগে না আমার৷ আমি চাই তোরও একটা সংসার হোক। তুইও একটু ভালো থাক। তোকে সামলানোর জন্য একটা মানুষ দরকার।

ইফতিয়ার মায়ের হাতে চুমু খায়। উদাস স্বরে বলে
” মনটা দখলে রেখে এক নারী। মস্তিষ্কে বিচরণ করছে আরেক নারী। এই দুই নারীর স্মৃতি নিয়েই বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো মা। আমি বেশ ভালো আছি। সুখে আছি।
আর আমাকে সামলানোর জন্য মিষ্টি রয়েছে। সে রোজ আমার সাথে কথা বলে।
আর কিচ্ছু লাগবে না আমার।

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৫৬

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে সবেই। কিছুক্ষণ আগেই আজানের প্রতিধ্বনিতে চারিপাশ মুখরিত হচ্ছিলো। অভি সারা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারে নি। কোথায় যাবে? কি করবে? এসব চিন্তায় দুচোখের পাতায় ঘুম ধরাই দিলো না। তবে পূর্ণতা ঘুমিয়েছে। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে সারা রাত। এমনকি এখনো অভির বুকে ঘাপটি মেরে শুয়ে ঘুমচ্ছে। মৃদু হাসে অভি। ঝুঁকে চুমু খায় পূর্ণতার মাথায়।

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৫৮