প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ১২

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ১২
জান্নাত নুসরাত

বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা। হালকা হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির জন্য পরিবেশ ঠান্ডা হয়ে আছে। এই ঠান্ডা শীতল দিনে কারবা ইচ্ছা করে পড়াশোনা করতে। বিছানার দিকে থাকালেই ইচ্ছে করে শুয়ার জন্য। অসহায় চোখে একবার বিছানার দিকে তাকিয়ে আবার বইয়ের পাতায় চোখ রাখল নুসরাত ।
এই শীতল সন্ধ্যায় গরম গরম স্ন্যাক’স তৈরি করছে ইসরাত। পাশে দাঁড়িয়ে সকল ইনগ্রিডিয়েন্স এগিয়ে দিচ্ছেন নাজমিন বেগম। আরিশার কিছুদিন পর মডেল টেস্ট পরীক্ষা হওয়ায় জোর করে পড়াতে বসিয়েছে রুহিনি। তাই সে আজ কিচেনে নেই।

আহান ইসরাতের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ঝর্ণা অনিকাকে নিয়ে সুপার শপে গিয়েছেন। ইরহাম নিজের রুমে বসে মোবাইল দেখছে। বাড়ির কর্তারা অফিসে। হেলাল সাহেব এই বৃষ্টি মুখঢ় দিনে বারান্দায় বসে বই পড়ছেন। লিপি বেগম ভারতীয় বাংলা সিরিজ দেখছেন।
বাড়িতে বেশি মানুষজন নেই বলে কোনো প্রকার শব্দ শোনা যাচ্ছে না। ঘড়ির কাটায় সন্ধ্যায় ৬:৩৩ মিনিটে যেতেই সৈয়দ বাড়ির ভিতর সাদা রঙের কার প্রবেশ করল। হালকা বৃষ্টি থেমে গিয়ে এখন মুষুলধারে বৃষ্টি হচ্ছে।
কলিং বেলের শব্দ শোনে কিচেন থেকে আসলো আহান দরজা খোলার জন্য। দরজা খুলে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে হা করে তাকিয়ে তাকলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” এই আহান! সর সামনে থেকে। হা করে তাকিয়ে আছিস কেন? হা বন্ধ কর! মাছি ঢুকে যাবে।
কথা বলতে বলতে ভিতরে প্রবেশ করলো জায়ান। হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ তার।
আহান হা করে তাকিয়ে রইলো জায়ানের হাতের ব্যাগের দিকে। আহানকে হা করে তাকিয়ে তাকতে দেখে জায়ান ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো কি? আহান মাথা নাড়িয়ে না করে কিচেনে চলে গেল।
হাতের ব্যাগগুলো সোফার উপর রেখে জায়ান নিজের রুমের দিকে চলে গেল ফ্রেশ হতে। নিচ তলা থেকে কলিং বেলের শব্দ শোনে রুম থেকে বের হলো ইরহাম।
রুমে যাওয়ার পথে ইরহামের সাথে দেখা হলো জায়ানের। ইরহামকে বলে গেল নিচ তলায় ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসার জন্য। ফ্রেশ হয়ে এসে আড্ডা দিবে ইরহামের সাথে। কাপড় চেঞ্জ করে জায়ান আসছে দশ মিনিটের ভিতর।
ইরহাম চুপচাপ সোফায় গিয়ে বসল।

কিচেন থেকে নাজমিন বেগম ডাকলেন নুসরাতকে নিচ তলায় আসার জন্য। এরপর রুহিনি ও আরিশাকে ও ডাকলেন। ধীরে ধীরে সবাই ড্রয়িং রুমে এসে জমা হলো। টি-টেবিলের উপর ইসরাত আলুর চপ,পকোড়া এনে রাখলো।
বাহিরে বৃষ্টির শব্দ, বাসার ভিতর নিস্তব্ধ। ষোলো কলা পূর্ণ করে কারেন্ট নিয়ে নিল। বাসার ভিতর ভুতুড়ে ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। পকোড়া আর চপ ভাজা শেষে ড্রয়িং রুমে এসে বসলেন নাজমিন বেগম ও ইসরাত।
লিপি বেগম ও হেলাল সাহেবকে তাদের রুমে পকোড়া ও চপ দিয়ে আসা হয়েছে।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জায়ান বলল,

” বাহ এই শীতল পরিবেশে গরম গরম পকোড়া মিস করছিলাম। আজকের সন্ধ্যা জমে যাবে।
কথা বলতে বলতে গিয়ে ইরহামের পাশে বসলো জায়ান।
” জায়িন আর আরশ আসেনি এখনো?
ইসরাত বলল,
“না ভাইয়া!
পকোড়া একটা মুখে পুরে নিল জায়ান। টিস্যু দিয়ে হাত মুছে হাসি মুখে বলল,” পকোড়াটা জাস্ট ওয়াও হয়েছে।
সোফা থেকে শপিং ব্যাগ হাতে নিয়ে এক এক করে ব্যাগের ভিতরের কাপড়গুলো বের করতে শুরু করলো জায়ান। প্রথম ব্যাগ থেকে বের করলো ডাবল এক্সসেল সাইজের একটা টি-শার্ট ও ফ্লেয়ার প্যান্ট।

“এটা কে নিবে?
নুসরাত কোনো কথা বলল না। একবার তাকিয়ে কাপড়ের থেকে চোখ সরিয়ে নিল।
ইসরাত বলল,
” মেজ ভাইয়া আরিশাকে দিয়ে দিন।
জায়ান বলল,
” কিন্তু ওর হবে না তো এগুলো। ওর সাইজ থেকে অনেক বড়।
জায়ান বলল,
” আচ্ছা থাকুক পরে দেখা যাবে কে নিবে? ওই পাশে রেখে দাও ইরহাম।
হালকা ল্যাভেন্ডার কালারের একটা কামিজ বের করল জায়ান।
“এটা কে নিবে?
নুসরাত বলল,
” ইসরাতকে দিয়ে দিন। এখানে যতোটা কামিজ আছে সবগুলো ওকে দিয়ে দিন। ও আর অনিকা ভাগ করে নিবে।
জায়ান বলল,

” ঠিক বলেছ নুসরাত। ইসরাত নিয়ে নাও! আর ওভার সাইজড টি-শার্ট গুলো নুসরাত নিয়ে নাও। আর কেউ তো এসব পরে না।
নুসরাত বলল,
“হঠাৎ আমাদের জন্য শপিং করলেন রহস্য কি জায়ান ভাইয়া?
জায়ান আমতা আমতা করতে লাগল। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল,” আমার ফ্রেন্ড কিনে দিয়েছে। আর বলেছে ফ্যামেলিকে দিয়ে দেওয়ার জন্য।
নুসরাত সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল,
“ওহ!
” কিন্তু এখানে কোন কিছুই তো আমার না। আমার জিনিস কই? মেজ ভাইয়া আমাকে দিবা না কিছু?
“তোর ও লাগবে! আচ্ছা তোকে নিয়ে একদিন শপিং করতে যাব। সেদিন যা ইচ্ছা হয় তাই কিনিস। এবার খুশি!
জায়ান আহানের ফোলা ফোলা গাল টেনে দিল।
“জি!

অন্যদিকে,
কপাল কুঁচকে বসে আছে আরশ। গত চার বছরে ব্যবসায় কতগুণ লাভ ও লোকসান হয়েছে তা দেখার জন্য স্টোর রুম থেকে এক এক করে পুরোনো হিসাব নিকাশের সকল ফাইল এনে রাখছেন আরশের টেবিলের উপর আরশের এসিস্ট্যান্ট ডায়না।
আরশ জিজ্ঞেস করল ডায়নাকে,
“মিস ডায়না গত চার বছরের সকল ফাইল এখানে আছে?
ডায়না আমতা-আমতা করে বলল,
” জি স্যার! কিন্তু স্যার গত চার বছরের ফাইল দিয়ে আপনি কি করবেন?
” মিস ডায়না আপনাকে প্রশ্ন করার জন্য আমি রাখিনি! আমি যা জিজ্ঞেস করবো আর যা করতে বলব তার জন্য রাখা হয়েছে। তাই বাড়তি প্রশ্ন না করে নিজের কেবিনে যান।

অপমানে মুখ থমথমে হয়ে গেল ডায়নার। আরশের অগোচরে ভেংচি কেটে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল ডায়না।
আরশ ফাইল চেক করতে করতে রাত ১০:০০ টা বেজে গেল। একটানা বসে থাকায় কোমরে ব্যথা হয়ে গিয়েছে আরশের। হাত উপরের দিকে তুলে শরীরের আড়মোড়া ভাঙলো আরশ। যে গুলো ফাইল দেখা বাকি রয়েছিল সেগুলো হাতে নিয়ে গাড়ির দিকে চলে। ব্ল্যাক কালার অডি আর-এস-সিক্সস পাকিং এড়িয়া থেকে বের করে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

বৃষ্টি এখনো থামেনি। অফিস থেকে ধীরে ধীরে সবাই বাড়িতে আসছেন। রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডায়নিংয়ে এক এক করে ডিস এনে রাখছেন বাড়ির কর্তীরা।
গাড়ি গ্যারেজে রেখে বাড়ির ভিতরের প্রবেশ করার আগে ভিজে জবজবে হয়ে গেল আরশ। কলিং বেলের শব্দ শুনে দরজা খুললেন লিপি বেগম। শাড়ির আঁচল দিয়ে আরশের ভিজে যাওয়া চুলগুলো মুছে দিলেন।
লিপি বেগম চুল মুছে দিতে দিতে বললেন,

” তাড়াতাড়ি কাপড় চেঞ্জ কর! নাহলে ঠান্ডা লেগে যাবে।
আরশের ভিজে চুল কিছুটা শুকিয়ে যাওয়ার পর সে নিজের রুমে যাওয়ার জন্য সিঁড়ির দিকে হাঁটা দিল। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠার সময় এক এক করে শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো।
নুসরাত ডায়নিং এ যাওয়ার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছিল। আরশকে শার্টের দিকে তাকিয়ে উপরে উঠতে দেখে সেদিকে তাকালো নুসরাত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। উপরের দুটো শার্টের বোতাম খোলার জন্য উজ্জ্বল শ্যামলা লোমশহীন বুক শার্টের উপর দিয়ে উঁকি দিল।
নুসরাত চোখ সরিয়ে নেওয়ার আগেই আরশ চোখ তুলে তাকাল নুসরাতের দিকে। দু-জনের চোখাচোখি হলে, ভ্রু কুঁচকে নেয় আরশ।
বিড়বিড় করল নুসরাত।,

“ছি্হ ছি্হ ছি্হ কি দেখে ফেললাম? আমার চোখের বিনষ্ট হয়ে গেল।
” এই পার্ভাটের মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছিস কেন? তুই কি আমার ইজ্জত হরণ করতে চাইছিস?
বিরক্তিতে নুসরাতের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো,”কিসব ননসেন্স কথাবার্তা? আমি কেন আপনার দিকে পার্ভাটের মতো তাকাব। আমার কি চোখে পট্টি বাঁধা যে আপনার মতো ব্যাক্তির দিকে তাকাবো? হুহ!
শেষের কথাগুলো কিছুটা আস্তে করে বলল নুসরাত।
“কি বললি? আবার বল! শুনতে পাইনি।
” কিছু বলিনি।
কথাটি বলে এটিটিউড দেখিয়ে নুসরাত নিচে নেমে গেল। আরশ দু কাধ উপরের দিকে তুলে মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল ফ্রেশ হওয়ার জন্য নিজের রুমে ।

” নুসরাত, ইসরাত মা খেতে এসো?
হেলাল সাহেব টেবিলে বসতে বসতে নিচ থেকে হাক ছাড়লেন নুসরাত ও ইসরাতকে।
নিজের রুম থেকে চিৎকার করে বলল ইসরাত,
“আসছি বড় আব্বু। এক মিনিট!
ইসরাত মাথায় ভালো করে ওড়না পেঁচিয়ে নিচে নেমে আসলো। কিচেন থেকে নুসরাত খাবারের বাটি হাতে নিয়ে টেবিলে আসলো। হেলাল সাহেব নিজের দু-পাশের দুটো চেয়ার টেনে দিলেন দুজনকে বসার জন্য। ইরহাম, অনিকা, আরিশা এসে চেয়ার টেনে বসে পড়ল। আহানকে আগে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন রুহিনি।
খাবার টেবিলে চামচের টুং টাং শব্দ। নাজমিন বেগম এবং লিপি বেগম দু পাশে দুজন দাঁড়িয়ে। খাবার টেবিলে কিছু প্রয়োজন হলে এগিয়ে দিচ্ছেন।
হেলাল সাহেব বললেন,

” শোহেব ব্যবসা কিরকম চলছে?
শোহেব উত্তর দিলেন,
“এইতো আলহামদুলিল্লাহ ভালো চলছে বড় ভাই।
সোহেদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আর তোমার!
” জি ভাই ভালো চলছে।
নাজমিন বেগম ইশারা দিলেন নাছিরকে। নাছির চোখ দিয়ে ইশারা দিয়ে বললেন, একটু পরে বলি। নাজমিন বেগম চোখ রাঙালেন। গ্লাস হাতে নিয়ে এক চুমুকে সব পানি পান করলেন নাছির সাহেব। হেলাল সাহেবের দিকে তাকিয়ে গলা পরিস্কার করে নিলেন।
” সবাই যখন এখানে আছে তাই একটা কথা বলতে চাইছিলাম। আসলে রাতের খাবার ছাড়া একসাথে কমই খাবার খাওয়া হয়। আর এখন তো কাজের চাপে কারোর সাথে কথা বলার সময়ই খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই ভাবছিলাম এখনই বলে দেই!
হেলাল সাহেব বললেন,

“এতো বনিতা না করে কি বলবি সেটা বল?
নাছির সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকালেন। নাজমিন চোখ দিয়ে বললেন বলার জন্য। সুক্ষ্ম গলায় ভিজানোর জন্য ঢোক গিলে নিলেন নাছির সাহেব।
” আসলে ভাই, ইসরাতের জন্য একটা সম্বন্ধ এসেছে।
প্রথমে সবাই এতো মনযোগ না দিলে নাছির সাহেবের কথা শুনে খাবার থামিয়ে সবাই তাকালেন নাছির সাহেবের দিকে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলেন নাছির সাহেব। খাবার খাওয়া থামিয়ে দু হাত এক জায়গায় এনে সম্পূর্ণ দৃষ্টি ফেললেন নাছির সাহেবের দিকে।
এবার হেলাল সাহেব বললেন,
“কি বলছিলি বল? আমি শুনছি!
নাছির সাহেব কিছুটা আমতা-আমতা করতে লাগলেন।নাজমিন বেগমের দিকে তাকালে তিনি চোখ দিয়ে ভরসা দিয়ে বলার জন্য বললেন।

” আসলে ছেলে আমেরিকায় থাকে। সেখানে নিজের গাড়ি, বাড়ি, ব্যবসা আছে। তাই ইসরাতের মা আর আমি চাচ্ছিলাম সম্পর্কটাকে নিয়ে ভাবার জন্য।
হেলাল সাহেব বললেন,
“অব্যশই তোমাদের মেয়ে তোমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু, আম্মার সাথে কথা বলেছিলি এ বিষয়ে। আর ছেলের বিষয় খোঁজ নিয়েছিলি।
সকল নিরব হয়ে চুপচাপ শুনছিল নাছির ও হেলালের সাহেবের কথোপকথন। কিন্তু এমন সিরিয়াস মুহুর্তে নুসরাতের পেট ফেটে হাসি আসছে। নুসরাত কে নিচের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে দেখে ইরহাম চিমটি কাটলো। ফাটা বেলুনের মতো নুসরাতের মুখ চুপসে গেল ইরহামের চিমটি খেয়ে।
নাছির সাহেব বললেন,

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ১১

” না এখনো কথা বলিনি! কাল সকালে কথা বলব। মেয়ে দেখতে আসার আগে খোঁজ নেব।
হেলাল সাহেব বললেন,
“আম্মা যা বলবে তাই হবে। আমার কিছু বলার নাই। ছেলে ভালো হলে আর পরিবার ভালো হলে বিয়ে দিয়ে দাও! যদি সবার সম্মতি থাকে।
নাছির শোহেব ও সোহেদের দিকে তাকালেন তারা দুজন মাথা নাড়িয়ে না করলো তাদের কোনো সমস্যা নেই এই বিষয়ে। তারপর আবার খাবার টেবিল নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ১৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here