প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ২৫
জান্নাত নুসরাত
জায়িনের চোখ মুখ শান্ত। গম্ভীর মানুষ অতিরিক্ত শান্ত ঝড় আসার পূর্বাবাস।
“দাদি নাটক বন্ধ করুন। আমি দেখেছি আপনি ঠিক আছেন। একটু আগে ও নুসরাতের সাথে কথা বলছিলেন। আমাকে দেখেই আবার শুয়ে পড়লেন।
মেহেরুন নেছা নাক ফুলিয়ে বালিশে ভর দিয়ে উঠে বসলেন। নুসরাতের দিকে তাকিয়ে ভংঙচি কাটলেন। ইরহাম হু হু করে হেসে উঠল। রুহিনি মুখ চেপে হেসে দিলেন।
” হ খুব হাসি আইতাছে হাইসা লও। হাইসা আমার ঘর থাকি বিদায় হও। আমার সহ্য হইতাছে না তোমাগো। তোমাগো জন্য আমি ধরা পইরা গেলাম। যাও বিদায় হও!
রুহিনি বললেন,
“চলো চলো, এখানে আর থাকতে হবে না তোমাদের।
রুহিনিদের পিছন পিছন জায়িন বের হতে যাবে মেহেরুন নেছা ডেকে উঠলেন। জায়িন আবার মেহেরুন নেছার কাছে ফিরে গেল। মেহেরুন নেছা কিছুটা সরে গিয়ে বিছানা হাত দিয়ে বসার জন্য ইশারা করলেন। জায়িন বসলো!জায়িনের পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন মেহেরুন নেছা।
” তুই আমারে একটু ও ভালোবাসছ না!
“কে বলেছে দাদি?
” কেন কেউ বইলতে হইব? আমি বুঝবার পারি।
জায়িন কথা বলল না। মেহেরুন নেছা ছাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকলেন। কি মনে করে এবার কথা তুললেন?
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“তোর দাদার সাথে আমার বিয়া আমার শাশুড়ী মানে তোর দাদার আম্মা জোর কইরা করাইছিল। তোর দাদা রাইগা মাইগা আগুন হইয়া এক সপ্তাহ বাড়ি থাইকা উধাও। আমি চিন্ডায় চিন্ডায় শেষ! আমার শাশুড়ী কইতো এমনেই বাড়ি চইলা আইবো সময় হইলে। এক সপ্তাহ পর হডাঢ একদিন তোর দাদা আইল বাড়ি ফিইরা প্রথম আমার সাথে সাথে রাগারাগি করত। আমার দেখলেই চিল্লা চিল্লি কইরা পুরো পাড়া এক জাইগায় কইরা ফালাইতো। পরে ধীরে ধীরে দেখি আমারে দেখলে চিল্লা পাল্লা করে না। এর পরে তোর বাপের জন্ম হইল তারপর ইসরাতের বাপের, এইভাবে সবগুলার জন্ম হইল আমার শাশুড়ী আরেক পোলা আছিল হেডি ভেঙ্গা তো তোর দাদারে। বলত,”কি কইছিলা ভাই তুমি আর করলা কি?
মেহেরুন নেছা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। আগের দিনগুলা কত সুন্দর ছিল। এখনো উনার চোখে ভাসে। দেখতে দেখতে কত বছর কেটে গেল স্বামী ছাড়া।
” হঠাৎ এই কথা আমাকে কেন বললেন দাদি?
মেহেরুন নেছা সেই কথার উত্তর না দিয়ে বললেন,
“তোর জন্ম হওয়ার পর আমি কি পরিমাণ খুশি হইছিলাম তোরে কইয়া বুঝাইতে পারতাম না। আমার মাইয়া সন্তান বেশি পছন্দ না যখন ইসরাতের জন্ম হইল, দাই আইয়া কইল মাইয়া হইছে আমার ইচ্ছা হইতাছিল না দেখবার। নাছির আইয়া আমারে লইয়া গেল তার ঘরে । আমি যাইবার চাইছিলাম না, পোলা রাগ করব এইজন্য গেলাম। যখন আমি ইসরাতডার মুখ দেখলাম। মুখডা দেইখা কি এক শান্তি লাগছে জানে, তোরে কইয়া বুঝাইবার পারুম না। এই বাড়ির ওই বাড়ির মানুষ যখনি ইসরাতরে দেখত আর বলত পুরা আমার মতো দেখতে বড় হইয়া আমার থেকে বেশি সুন্দর হইব পরান্ডা জুরাই যাইত। এখন মনে করিছ না তোরে আমি ভালোবাসি না। তোরে আমি ভালোবাসি এইডা সত্যি কডা। কিন্তু, তোর থাইকা আমি বেশি ভালোবাসি ইসরাতরে।
” এতো কথা আমাকে বলছেন কেন দাদি? আর এসব জেনে আমি কি করব?
মেহেরুন নেছা কথার উত্তর দিলেন না। এতোক্ষণে জায়িনের পিঠে বুলানো হাত থেমে গিয়েছে।
“বিয়া কইরানে জায়িন, রাজি হইয়া যা,দেখবি ঠকবি না তুই।
” দাদি সম্ভব না! আমি আপনাকে আগে ও বলছি, এখনো বলছি সম্ভব না!
জায়িন মেহেরুন নেছা আর কোনো কথা না শোনে রুম থেকে বের হয়ে গেল। মেহেরুন নেছা করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন জায়িনের যাওয়ার পথে।
রাতের বেলা,
লিপি বেগম সন্ধ্যার দিকে মেহেরুন নেছার পাশে কতক্ষণ বসে ছিলেন। মেহেরুন নেছা আজ চুপচাপ! যখন লিপি বেগম জিজ্ঞেস করলেন শরীর খারাপ করেছে কি না তিনি চুপ ছিলেন। অন্যদিনে কথা বলে নিজে গল্পের আসর রমরমা করে ফেলেন আজ আর কথা বললেন না।
মেহেরুন নেছা রাতের খাবার কোনোদিন নিজের রুমে বসে খান আবার কোনোদিন টেবিলে বসে সবার সাথে খাবার খান। রাতের খাবার দিতে গেলেন নাজমিন বেগম। মেহেরুন নেছাকে অসময় শুয়ে থাকতে দেখে ডাক দিলেন। ডাক দেওয়ার পর মেহেরুন নেছার নড়চড় না দেখে ঘাবড়ে গেলেন কিছুটা। পাশে বসে শরীরে ধাক্কা দিলেন! মা, বলে ডাক দিলেন! মেহেরুন নেছার কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে চিৎকার করে স্বামীকে ডাক দিলেন।
” বড় ভাবি, ঝর্ণা, রুহিনি দেখে যাও, আম্মার কোনো সারাশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
নাজমিন বেগমের গলা শুকিয়ে কাঠ। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।! বাড়ির সবাই এসে জটলা বাঁধল মেহেরুন নেছার ঘরে। আরশ ডাক্তারকে কল দিল, যত দ্রুত সম্ভব আসার জন্য। জায়িন কাছে বসে পালস চেক করলো।
ইতিমধ্যে বাড়ির মহিলারা কান্না করা শুরু করেছেন। হেলাল সাহেব উনার স্ত্রীকে ধমক দিয়ে মুখ বন্ধ করালেন। ঝর্ণা বাল্টিতে করে পানি নিয়ে আসলেন। মাথায়, চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দিলেন। মেহেরুন নেছার জ্ঞান ফিরল। তিনি নিভু নিভু চোখ খুলে তাকালেন সবার দিকে। উঠে বসার চেষ্টা করলেন। নাছির মায়ের পাশে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন।
“আম্মা শুয়ে থাকো।
ডাক্তার আসলো পনেরো মিনিট পর। মেহেরুন নেছাকে চেকআপ করে বললেন, ” অতিরিক্ত চিন্তার ফলে প্রেশার হাই হয়ে গিয়েছে। উনার শরীর দূর্বল, প্রেশার হাই হওয়ায় জন্য শরীর সহ্য করতে পারে নাই তাই উনি বেহুশ হয়ে গিয়েছেন। উনাকে চিন্তা থেকে রিলিফ রাখার চেষ্টা করবেন। আর কোনো বিষয় নিয়ে যেন মাথায় চাপ না নেন সেই দিকে খেয়াল রাখবেন।
ডাক্তার কিছু ঔষধ দিয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে বার বার বলে গেল চিন্তা মুক্ত রাখার জন্য।
সোহেদ বললেন,
“আম্মা আপনাকে এতো চিন্তা করার কথা কে বলেছে? আপনার যদি কিছু হয়ে যায় আমাদের কি হবে?
মেহেরুন নেছা অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
” আমার আবার কি হইবে? আমি মইরা গেলে কার কি?
শোহেব বললেন,
“আম্মা আজ বলেছেন, বলেছেন অন্য কোনো দিন এসব কথা মুখে ও আনবেন না।
” আমি মইরা গেলে তুমরা আদায় পাইবা। আমি তো তোমাগোরে ডিস্ট্রির্ব দিতাছি।
হেলাল সাহেব বললেন,
“আম্মা এসব তোমাকে কে বলেছে? খারাপ কথা মুখে আনবে না। আনলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। আপনার কোন কথা আমরা শুনিনা। সব কথা তো শুনি তারপর ও এসব কথা কেন আম্মা?
সকলে সহমত পোষণ করলেন। মেহেরুন নেছা জায়িনের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
” আম্মা এইটা তোমার আর তোমার নাতির ব্যাপার এসব সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না। আপনারা দুজন বুঝুন কি করবেন?
“দুইদিন পর মইরা যাইমু বুড়ি মানুষ আমি। আর তো কিছু বলুম না। বাপ তুই তোর পোলাডারে বোঝা, আমি মরার আগে ওগো বিয়ে দেখে যাইবার চাই।
” দাদি দুই-দিন পর সেই তো মরবে তাহলে আমার বিয়ে দেখলে কি আরো দুই-দিন বেশি আপনি বেঁচে থাকবেন।
লিপি বেগম ছেলের পিঠে থাপ্পড় মারলেন।
“এসব কি অসভ্যের মতো কথা বলছ? ভদ্রতা বজায় রাখো জায়িন।
হেলাল সাহেব বললেন,
” আম্মা এখানে আমার কি বলার আছে? আর এটা তো আপনার আর আপনার নাতির ব্যাপার। আমরা কি বলব এখানে?
“আমি জায়িনের সাথে একাইন্ত কথা কইতে ছাই। তোমরা একডু বাইরে যাও।
সবাই চুপচাপ বাহিরে বেরিয়ে গেল। নুসরাত না যাওয়ার জন্য গাইগুই করল ইরহাম টেনে নিয়ে গেল বাহিরে।
” জায়িন এইখানে আইয়া ব?
জায়িন বসল। মেহেরুন নেছা প্রচুর চতুর একজন নারী। এবার তিনি প্রথমে বললেন না জায়িনকে বিয়েতে রাজি হয়ে যাওয়ার জন্য। এতক্ষণ ধরে এতো ইমোশনাল কথা বললেন তবুও গলল না, তাই অন্য পন্থা অবলম্বন করলেন।
পন্থা টা তাকে নুসরাতই দিয়েছে।
“তুই কেন বিয়া করতে চাস না? কারণ টা আমারে ক?
” দাদি আমি বলেছি তো কোনো দিন বিয়ে করব না?
“আবার বল! বুইলা গেছি আবার ক।
” আমি ডেলাকে ভালোবাসি। ওকে ছাড়া আমি আর কাউকে জীবন সঙ্গী হিসেবে চুজ করতে পারব না। আর আমাকে জোর করবেন না দাদি। আমি পারব না কাউকে বিয়ে করতে।
“ওতো বিয়া কইরা নিছে। তাইলে তুমি বিয়া কইরা ফালাইলে কি সমস্যাডা ওইব?
” দাদি এসব কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আমি ওকে ভালোবাসি ওকে ছাড়া আমার হৃদয়ে কাউকে জায়গা দিতে পারব না।
মেহেরুন নেছা হাসলেন।
” ডেলা তো তোরে ছাইরা আশিকরে বিয়া কইরা ফালাইছে। তুমি ওর জন্য বিয়া করবা না আর তুমি এইভাবে বইয়া রইবা।
“তো কি হয়েছে দাদি? ও বিয়ে করলে আমাকে করতে হবে এরকম কোন কথা নেই।
” ডেলা তোমারে ওইদিন কইছিল না তুমি রইবা সারাজীবন এইরকম। কেউ তোমারে বিয়া করব না! তোমার এই চরিত্র লাইগা। তোমার মতো ফাটাকেস্টরে কে বিয়া করব। লও ওর কথা হাছা হইয়া যাইতাছে।
“কখন বলল দাদি এই কথা? আমি তো শুনিনি।
” তুই হুনবি ক্যা? এইসব তোর কানে ঢুকব না। তোর কানে ঢুকব ডেলার মিষ্টি মিষ্টি কডা।
জায়িন কিছুটা চিন্তিত হলো। কখন ডেলা এই কথা বলেছে তাকে? সুযোগের সৎ ব্যবহার করলেন মেহেরুন নেছা। ভাবুক জায়িনকে আরো ভাবার্ত করে বললেন, “এই সুযোগ তোমারে নিজেরে প্রমাণ করার। সুযোগ এইকবার আয় বার বার আয় না। এই সুযোগ ব্যাবহার কর জায়িন।
জায়িন মেহেরুন নেছার কথার মারপ্যাচ বুঝলো না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো করে বলল,” কি সুযোগ দাদি?
“আরে,নিজেরে প্রমাণ করার। ডেলা মেলারে চোখে আঙুল দিয়ে দেইখাইয়া দাও ওর থেকে ভালো মাইয়া তুই বিয়া কইরা ফালাইছস। যখন দেখব তুই ওর তাইকা ভালো মাইয়া বিয়া কইরা সুখে সংসার করছিস তখন দেখব আর জ্বলব ডেলা।
জায়িন আশ্চর্য হয়ে বলল,
” দাদি সত্যি!
“হ সত্যি, নিজেরে প্রমাণ কইরা দেখাইয়া দে তুই ওর থাইকা ভালা মাইয়া বিয়া করছত। তোরে বিয়া না করা ডেলার জীবনের সব থাইকা বড় ভুল ছিল।
জায়িন মাথা নাড়ালো। হিংসা হলো আশিককে! এতোবছর ডেলাকে আগলে ও রেখেছে আর মাঝখান থেকে আশিক এসে সব কেড়ে নিয়েছে। ও সিদ্ধান্ত নিল ও ডেলাকে দেখিয়ে দিবে, ডেলার থেকে সুন্দর মেয়ে বিয়ে করে।
” এইবার ক তুই রাজি বিয়া করতে?
জায়িন উপর নিচ মাথা নাড়ালো। মেহেরুন নেছা চুপিসারে নিজের মোবাইল হাতে নিলেন। রেকর্ড অন করে আবার জিজ্ঞেস করলেন, “মুখ দিয়ে বল আমি বুঝবার পারছি না। কি কথাছস? তুই কি রাজি বিয়া করবার লাগি?
জায়িন মাথা নিচের দিকে রেখে বসে রইলো। ঘড়ির কাটার টিকটিক শব্দ! হঠাৎ ঘড়ির ঘন্টা বিকট শব্দে বেজে উঠলো। মেহেরুন নেছা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন এগারোটা বাজছে।
জায়িনের ভারী স্বরের আওয়াজ আসলো,
প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ২৪ (২)
” আমি রাজি।
“পরে কিন্তু পল্টি মারতে পারবা না। জোরে বল জায়িন আমি ঠিক শুনতে পাইনি। তুই কিসে রাজি?
” আমি রাজি দাদি। এই বিয়ে করতে আমি রাজি।