প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৫২

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৫২
জান্নাত নুসরাত

সারা রাস্তা ইসরাত চুপ করে বসে ছিল গাড়ির বাহিরের দিকে তাকিয়ে। নুসরাত মাঝ রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে প্যা পু করা বাঁশি কিনল। গাড়ি চালাতে চালাতে ইসরাতের কানের গোড়ায় বাঁশি নিয়ে বাজালো। গাড়ি সোসাইটির ভিতর ঢুকতেই ইসরাতের ভিতর কম্পন শুরু হলো। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে বসে রইলো। গাড়ি বাড়ির সামনে এসে থামলো। হর্ণ বাজাতেই রহমত গেইট খুলে দিলেন।
নাজমিন রুহিনি, ঝর্ণা রান্না ঘরে কাজ করছিলেন,হেলাল সাহেব ও লিপি বেগম নিজেদের রুমে রেস্ট করছিলেন। নাছির, সোহেব,শোয়েদ সাহেব আজ বাড়িতে আছেন কেউ কাজে যান নি।

ইসরাত এখন ও গাড়িতে বসে আছে। ওর কেন জানি বাড়ির ভিতরে যেতে ইচ্ছে করছে না। নুসরাত গাড়ি থেকে নেমে প্যা পু বাঁশি বাজাতে লাগলো। বাঁশির শব্দে বাড়ির ভিতর থেকে সবাই বের হয়ে আসলেন।
নাছির সাহেব নুসরাতকে বাঁশি বাজাতে দেখে জোড়ছে একটা ধমক দিলেন ।নুসরাত এক দৌড় দিয়ে আরশের পিছনে লুকালো। হেলাল সাহেব নাছির সাহেবকে উল্টো ধমক দিয়ে বললেন, “ওকে এরকম ধমক দিচ্ছিস কেন?
হেলাল সাহেব নুসরাতের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কিরে মা,এইরকম বাঁশি বাজাচ্ছিস কেন? কি হয়েছে?
হেলাল সাহেবের আশকারা পেয়ে নুসরাত একলাফে গাড়ির কাছে গেল, গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে ইসরাতকে টেনে গাড়ি থেকে বের করলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” সারপ্রাইজ!
সবাই ইসরাতের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সবার এইরকম দৃষ্টি দেখে ইসরাতের কেমন জানি লাগলো?
নাজমিন বেগম ইসরাতকে দেখে আবেগে আপ্লূত হয়ে ইসরাতকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলেন। ধীরে ধীরে সবাই এসে ইসরাতের সাথে কুলশ বিনিময় করলো। নুসরাতের বাঁশির শব্দে মেহেরুন নেছা ও বাড়ির বাহিরে এসেছেন তিনি ইসরাতকে দেখে প্রথমে অবাক হলে ও পরে চারিদিকে জায়িন কে খোঁজতে লাগলেন।
“এই মাইয়া আমার নাতিডা কই?

মেহেরুন নেছার প্রশ্নে সবাই ইসরাতের দিকে তাকালো জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে। ইসরাত কোনো প্রতিউত্তর করলো না। তাকে কোনো কথা বলতে না দেখে আরশ বলল,”ও অনেক জার্নি করে এসেছে। ওকে কি তোমরা এইভাবে দাঁড় করিয়ে রাখবে? পরে না হয় জেনে নিবে ভাইয়া কোথায়? বা কেন আসেনি?
হেলাল সাহেব ও তাড়া দিলেন ইসরাতকে ভিতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আরশ ইসরাতের লাগেজ নিয়ে ওর রুমে রেখে আসলো।

ইসরাতকে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওর রুমে পাঠিয়ে দিলেন নাজমিন বেগম। নিজে লেগে পড়লেন রান্নার কাজে কতদিন পর মেয়েটাকে কাছে পেয়েছেন তাই আজ তিনি মেয়ের পছন্দের রান্না করবেন বলে ঠিক করলেন।
ইসরাতের ট্রলি টেনে উপরে নিয়ে গেল ইরহাম। আরশ ইসরাতের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল অফিসের উদ্দেশ্যে। নুসরাত কে টেনে নিয়ে যেতে চাইলো কিন্তু নুসরাত গেল না। সে আজ বাড়িতে থাকবে। কোনোভাবে বাড়ির বাহিরে এক পা ও ফেলবে না। ইরহামের এক কথা, নুসরাত না গেলে সে ও যাবে না। নুসরাত তার ডুড! তার ডুড এক পা না ফেললে সে ও এক পা ফেলবে না। অগত্যা আরশ অফিসে একা গেল!
ইসরাত ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ল। নিজের বাড়ি, নিজের রুম, নিজের বিছানাতে,শুয়ে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলল।চোখ বুজতেই নুসরাতের ঝড়ের গতিতে রুমে এসে প্রবেশ করলো। নুসরাত কোনো কুশল বিনিময় ছাড়া কথা শুরু করলো,” জানিস কি হয়েছে?

ইসরাত চোখ বুজে থেকে নির্লিপ্ত গলায় বলল,
“না বললে জানবো কীভাবে?
” হ্যাঁ তাই তো তাই! দাঁড়া বলছি।
ইসরাত হাসি আটকে বলল,
“দাঁড়াতে পারব নাো। এভাবেই বল!
নুসরাত বিরক্ত হয়ে থাপ্পড় মারল ইসরাত কে। ইসরাত হালকা শব্দ করে হাসল। হাতের বাহুতে ঘষতে ঘষতে বলল,” আচ্ছা কি বলবি বল? আমি শুনছি!
“জায়িন জানে তুই দেশে আসছিস?
ইসরাত সময় নিল। চোখ খুলে একবার নুসরাতের পানে তাকিয়ে আবার চোখ বুজে নিল। ধীর কন্ঠে বলল,”না!
নুসরাত ওও বলে মাথা নাড়ালো। হঠাৎ কিছু মনে হতেই তড়াক করে ইসরাতের দিকে তাকালো। ব্যথিত গলায় জিজ্ঞেস করলে, “তোর পড়াশোনা তো মাঝ নদীতেই ডুবে গেছে!

“কেন?
“লাস্ট সেমিস্টার তো দিলি না তুই!
“তো কি হয়েছে? আবার প্রিপারেশন নিয়ে দিব পরীক্ষা! এতে নৌকা ডুবার কি আছে?
নুসরাত হাসল। হেসে ইসরাতের পাশ ঘেঁষে শুয়ে পড়ল। বিড়বিড় করে বলল,”কথার কথা বললাম!
ইসরাত কে ছেড়ে দিল তার মতো। কথা বলল না আর।

দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে এসে নাজমিন বেগম ফিরে গেলেন। কারণ ইসরাত ঘুমিয়ে আছে এখনো। দীর্ঘ আটারো ঘন্টা জার্নি করার জন্য শরীর ছেড়ে দিয়েছে। ভালো করে পর্দা টেনে দিলেন যাতে বাহিরের আলো রুমে প্রবেশ করতে না পারে। শান্তি মতো ঘুমাতে দিলেন দুই বোনকে।
রাতের বেলা,

ইসরাত ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হলো। ঠান্ডা পড়ে গিয়েছে পুরো দমে। শরীরে গরম কাপড় জড়িয়ে খাবার টেবিলে আসলো। খাবার টেবিল আজ খাবারে ভরপুর। ইসরাতের পছন্দের সব খাবার রান্না করা হয়েছে। ডিম বোনা, কালা বোনা,খাসির মাংস, গলদা চিংড়ি, মুরগীর মাংসের রোস্ট, মাছ ফ্রাই, আরো অনেক কিছু।
নুসরাত চোখ বড় বড় করে তাকালো খাবারের দিকে। নাজমিন বেগম দই এনে রাখলেন টেবিলে। মায়ের দিকে ব্যথিত নয়নে তাকিয়ে দুঃখি গলায় বলল,”তুমি এতো কিছু রান্না করলে ইসরাতের জন্য, আর আমার জন্য রান্না করলে করো করলা ভাজি, শাক ভাজি,ছোট মাছ,শুটকি আর হাবিজাবি যা আছে সব। তুমি আমার মা হতেই পারো না!

নাজমিন বেগম ক্ষেপে গেলেন। নুসরাতের মাথায় গাট্টা মেরে বললেন,”সবসময় উল্টা পাল্টা কথা বলা। তোকে তো সবসময় রান্না করে খাওয়াই! মেয়েটা আজ পাঁচ মাস পর বাড়ি ফিরল। একটু তো ভালো মন্দ রান্না করে খাওয়াবো তাই না। এরকম উল্টো পাল্টা কথা বললে শশুড় বাড়ি থেকে লাত্তি মেরে বের করে দিবে। ভালো মানুষের মতো কথা বল! আমরা বলে সহ্য করছি অন্য কেউ হলে দু-একটা লাগিয়ে দিবে।
“এই তো আসল কথায় এসোছ! তুমি আমার চাচি শাশুড়ী তার প্রমাণ তোমার কথায় পাওয়া যাচ্ছে। তুমি আমার মা হতে পারো না!

নাজমিন বেগমের চোয়াল ঝুলে গেল। একে এক বললে দুই বুঝে! এটাকে বুঝানোই বৃথা! নাজমিন বেগম চলে গেলেন কিচেনের দিকে নুসরাত কে ইগনোর করে। নুসরাত পিছন থেকে সতর্ক গলায় বলল,”এই তো প্রমাণ হয়ে গেল তুমি আমার মা না! তুমি হলে ইসরাতের মা। সত্যি করে বলো তুমি কোথা থেকে আমাকে এডোপ্ট করেছো।
নাজমিন বেগম শুনলেন না কথা। নুসরাত আরো কিছু বলতে যাবে ইসরাত বলল,”আব্বু আসছে! চুপ কর। শুনলে একটা মার মাটিতে পড়বে না। সব তোর পিঠে পড়বে।

হেলাল সাহেব সোহেদের সাথে কথা বলতে বলতে নিজ জায়গায় এসে বসলেন। ইসরাত কে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে নিজের পাশে বসালেন। প্লেটে ভাত বেড়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
“কী রে মা এতো শুকিয়ে গেছিস কেন? জায়িন কি তোর খেয়াল রাখে না?
ইসরাত কোনো কথা বলল না হালকা করে শুধু হাসল।
ভাত মাখিয়ে ইসরাত প্রথম লোকমা ভাত মুখে নিতেই লিপি বেগমের ফোন বিকট শব্দে ভেজে উঠলো।
হেলাল সাহেব বিরক্তির গলায় বললেন,

“এই সময় আবার কে কল দিয়েছে?
লিপি বেগম কর্কশ গলায় বললেন,
“তোমার বড় ছেলে কল দিয়েছে!
হেলাল সাহেব আদেশের স্বরে বললেন,
” কল ধরো তো। দেখো কি বলে? আজ ওর একদিন কি আমার একদিন?
কল ধরলেন লিপি বেগম। জায়িনের কল দেখে ইসরাত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। নিজের মনের সুখে খেতে লাগলো। কল ধরতেই জায়িন লিপি বেগমকে কিছু বলতে না দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ইসরাত কি বাসায় এসেছে?
অজ্ঞাত লিপি বেগম না জেনে জায়িনকে ধমক দিয়ে বললেন,” কখন তুমি ওকে এয়ারপোর্টে রেখে এসেছো, আর এখন কল দিয়ে জিজ্ঞেস করছো ইসরাত বাসায় এসেছে কি না? আমাদের একবার কল করে বলা গেল না ইসরাত বাংলাদেশে আসছে। নুসরাত না গিয়ে আনলে তো কেউই জানতো না ইসরাত বাংলাদেশে এসেছে!
হেলাল সাহেব লিপি বেগমের কাছ থেকে ফোন নিয়ে নিলেন। জায়িনকে ব্জ্র কন্ঠে ধমক দিয়ে বলতে লাগলেন,”জায়িন তুমি এতো বেখায়ালি পানা কখন থেকে শুরু করলে? একে তো তুমি ওর যত্ন নিতে গাফিলতি করেছো? এখন আবার স্ত্রী কে কোনো ভরসা ছাড়া বাংলাদেশ পাঠিয়ে দিয়েছ। তারপর আমাদের সাথে একবার ও এই বিষয় নিয়ে ডিসকাসন করলে না।
হেলাল সাহেব থেমে শ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

” ওর এই অবস্থা কেন? ও এতো রোগা হয়ে গেল কীভাবে? আমাদের ঘরের মেয়েকে তুমি ভালোভাবে, স্বাস্থ্যবান নিয়ে গেলে আর ফিরিয়ে দিলে কীভাবে? আমি তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি জায়িন।
নাছির সাহেব ভাইয়ের উপর বিরক্ত হয়ে বললেন,
“আহ ভাই কি শুরু করেছো? স্বাস্থ্য কমে গিয়েছে আবার বেড়ে যাবে, এতো কথা বলার কি আছে? ছেলেটা কে ভালো মন্দ তো আগে জিজ্ঞেস করবে,তা না জিজ্ঞেস করে ধমকা-ধমকি শুরু করেছো?
জায়িন হেলাল সাহেবের এতো প্রশ্নের বিপরীতে একটা উত্তর দিল না। চুপ করে বাবার কথা হজম করে নিল। ভিন্ন একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো,” ইসরাত কোথায়?
হেলাল সাহেব কিছুটা অবাক হয়ে গেলেন। এতো কথার বিপরীতে ছেলেটা অন্য আরেকটা প্রশ্ন করছে। নিজের বিস্ময় নিজের ভিতর রেখে বললেন, “এইতো আমার পাশে বসে খাবার খাচ্ছে।

” ইসরাতের কাছে ফোন দাও।
ফোন লাউডে ছিল বিধায় ইসরাত জায়িনের সব কথা শুনতে পাচ্ছিল। ইসরাত নির্লিপ্ত অথচ ধীর কন্ঠে বলল,
“আমি অনেক ট্রায়াড ফিল করছি। এখন আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না পরে কথা বলে নেব। আপনারা কথা বলুন!
খাবারে পানি ঢেলে ইসরাত খাবার টেবিল থেকে উঠে চলে গেল।
হেলাল সাহেব বলে উঠলেন,
” আরে মা খাবারটা তো শেষ করে যা।
“আমি অনেক ট্রায়াড ফিল করছি বড় আব্বু। এখন আর খেতে পারবো না। একটু রেস্ট নেওয়া প্রয়োজন! শরীর ছেড়ে দিচ্ছে।

ইসরাত কোনোরকম কথাগুলো বলে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো। চোখে অন্ধকার দেখছে, নাক পিট পিট করছে, সেই সাথে যোগ দিয়ে আবার মাথা যন্ত্রণা শুরু হচ্ছে। মাথা খুলে ফেলে দিতে ইচ্ছে করলো ইসরাতের।
জায়িন ইসরাতের কথা শুনল। তবুও চুপ করে বসে রইলো ফোনের ওপাশে। সে সবকিছুর শোধ নিবে খুব তাড়াতাড়ি ইসরাতের কাছ থেকে।
জায়িনের সাথে বাড়ির সবাই আর কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিল। নুসরাত প্লেটে থাকা খাবার একসাথে সব মুখে পুরে হাত ধুয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো। হেলাল সাহেব ধমক দিলেন, “তোর আবার কি হয়েছে? খাবার রেখে উঠে দাঁড়ালি কেন? আরো একটু ভাত নে! এতো কম খাবার খাচ্ছিস কেন?

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৫১

নুসরাত মুখের ভাত গিলার চেষ্টা করলো। ভাত চাবাতে চাবাতে হু হু করে কিছু বলল হেলাল সাহেব বুঝলেন না। ইরহাম পানির গ্লাস নুসরাতের দিকে এগিয়ে দিল। নুসরাত পানি দিয়ে ভাত গিলে নিয়ে গলা কিছুটা পরিস্কার করে বলল,”পেট ভরে গেছে আমার! আর খাব না।
হেলাল সাহেব কিছু বলতে যাবেন লিপি বেগম ইশারা করে না করলেন কিছু বলার। গলার কাছে আসা কথা গুলো গিলে নিলেন হেলাল সাহেব। নুসরাত সিঙ্কে হাত ধুয়ে ইসরাতের রুমের দিকে দৌড় দিল।

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৫২ (২)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here