প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৬
জান্নাত নুসরাত
আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে নুসরাত ভার্সিটি তে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। এক সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে ভার্সিটিতে যায়নি। পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছে মেয়েটা। এটা কোথায়? সেটা কোথায়? বলে বলে!
“আম্মা আমার মাস্ক কই?
নাজমিন বেগম নিচ তলা থেকে চিৎকার করে বললেন,
“কাবার্ডে রাখা আছে দেখ?
“আম্মা আমার হিজাবের ক্যাপ কোথায়?
” আমার মাথায়। জিনিস ঠিক জায়গায় রাখিস না কেন?ঠিক জায়গায় রাখলে তো আর এভাবে খুঁজতে হয় না।নিজে খুঁজেনে! আমি পারব না! আমার কাজ আছে।
মুখ চুপসে হিজাবের ক্যাপ খুঁজতে লাগলো নুসরাত। খুঁজে না পেয়ে ইসরাতের কাবার্ড থেকে তার হিজাবের ক্যাপ বের করে পড়ে নিল।
নিচ তলায় ড্রয়িং রুমে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন হেলাল সাহেব। সিঁড়ি বেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নুসরাত কে নামতে দেখে হাত দিয়ে কাছে ডাকলেন। উনার পাশ দেখিয়ে ইশারায় বসতে বললেন।
“ভার্সিটি তে যাচ্ছো?
” জি!
“নাস্তা করা শেষ?
” জি না!
“গতকাল সন্ধ্যায় শুনলাম আরশের সাথে ঝগড়া হয়েছে।
” তেমন কিছু না বড় আব্বু!
হেলাল সাহেব নুসরাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
কিছুক্ষণ চুপ করে নুসরাতের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকলেন।
ধীরে সুস্তে বললেন হেলাল সাহেব ,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“মা শুনো! মেয়েরা আস্তে ধীরে হাঁটে,এরকম লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটলে মানুষ খারাপ বলবে। আমাদের সামনে এভাবে হাঁটলে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু বাহিরের মানুষের সামনে এভাবে করবে না। আর মাথায় সব সময় ওড়না রাখবে।
নুসরাত হ্যাঁ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো। হেলাল সাহেব বললেন, “চলো মা নাস্তা করে নাও।
নুসরাত হেলাল সাহেবের পিছন পিছন হেঁটে গিয়ে খাবার টেবিলে বসলো। ৮:১৫ বাজতেই সবাই এক এক করে খাবার টেবিলে হাজির হলো ।
এদিক সেদিক তাকাতে গিয়ে নুসরাতের চোখ পড়ল আরশের উপর। যে তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে।মুখের অভিব্যক্তি স্পষ্ট একা পেলে কাঁচা চিবিয়ে খাবে।আলগোছে নিজের চোখ নিচের দিকে নামিয়ে নিল নুসরাত। ইসরাত এসে নুসরাতের ডান পাশের চেয়ারে বসলো। আরশ ফোনে কথা বলতে বলতে এসে নুসরাতের বাঁ- পাশের চেয়ারে বসলো। ওপাশের লোক কি বলল শোনা গেল না?
” ঠিক আছে। চলে আসুন অফিসে। ওখানে দেখা হচ্ছে আপনার সাথে মিস ডেলা আমান।
তারপর ফোন রেখে দিয়ে নুসরাতের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো আরশ। জুসের গ্লাস হাতে নেওয়ার বাহানা করে নুসরাতের কানের কাছে মুখ নিল।
“বলেছিলাম না আমার চোখের সামনে পরবি না? পরেছিস তো, এবার শুধু তোকে একা পেয়ে যাই দেখিস কি করি?
জুস হাতে নিয়ে সরে আসার সময় নুসরাতের হিজাবের কাছে নিজের মুখ নিল। নাক মুখ কুঁচকে নুসরাত কে ধমকে বলল,” চুলে শ্যাম্পু করিস না? কি বাজে গন্ধ তোর চুলে,ছিহ…। মেয়ে মানুষ এতো অপরিষ্কার হয় তোকে না দেখলে জানতেই পারতাম না।
নুসরাত কোনো কথার উত্তর দিল না। নিজের খাবার খাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে গেল। এমন ভাব করলো যেন, কোনো কিছু শুনতে পায়নি। হঠাৎ মনে হলো, “আরে ভাই আমি তো হিজাব করেছিস তাহলে চুলের সুভাস পেল কীভাবে?
নুসরাত অবাক হয়ে তাকালো। চোখের পাতা ফেলে আরশের দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো।
” কি?
“আমি হিজাব করেছি আপনি কীভাবে চুলের সুভাস পেলেন?
আরশ আমতা আমতা করলো। কোন যুতসই উত্তর না-পেয়ে যা মুখ আসলো বলে দিল।
” তোর চুলের গন্ধ এতো বাজে আর ঝাঁঝালো যে হিজাবের উপর দিয়ে ও গন্ধ ছড়াচ্ছে।
“মিথ্যা কথা বলার জায়গা পান না। মুখে যাতা আসলো বলে দিলেই হলো।
সন্ধ্যা বেলায় জায়িন ইসরাতের রুমের দরজায় ধাক্কা দিল।ভিতরে থেকে আসছি বলে উত্তর আসলো। পাঁচ মিনিট পর যখন আসলো না বিকট শব্দে ধমক দিল জায়িন।
“কি করছো তুমি? দরজা খুলতে এতো সময় লাগে?তাড়াতাড়ি আসো! আমার কাজ আছে? তোমার মতো বসে নেই।
রুমের দরজা খুলে তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসলো ইসরাত। ধমক খাওয়ার পর ও মেয়েটা সুন্দর করে উত্তর দিল,
” জি ভাইয়া বলুন।
জায়িন কর্কশ গলায় বলল,
“ওয়াইফাই এর পাসওয়ার্ড টা দাও?
” আসলে,ভাইয়া আব্বু ওয়াইফাই লাগায়নি বাড়িতে।
জায়িন নাক মুখ বিকৃত করে আবার ধমক দিল,
“এতো দিন ধরে বলনি কেন? বাসায় ওয়াই-ফাই নেই, তোমরা তো আগের মতো ব্যাকডেটেট রয়ে গিয়েছ! চাচা লাগায়নি কেন?
“অনিকা, আহান,আর আরিশার পড়ার ক্ষতি হবে বলে।
হাত দিয়ে চুল মুঠোয় বন্ধী করলো। হাতের তালু দিয়ে মুখের সেদ জল মুছলো জায়িন।
” এই তোমরা কি পাগল? পড়ার ক্ষতি হওয়ার হলে এমনিতেই হবে। এসব ফাউল লজিক কে দিয়েছে তোমাদের?
জায়িন বিড়বিড় করলো,
“কুল জায়িন কুল।
“এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার মুখ দেখছো কেন? যাও পড়তে বসো!
আরেকটা ধমক খেয়ে ইসরাতের মুখ চুপসে গেল। সুন্দর মুখটা কালো হয়ে গেল।
” এই শুনো,চাচা বাসায় আছে?
“জি আছে আব্বু বাসায়।
জায়িন আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করলো না। ব্যস্ত ভঙ্গিতে নাছির সাহেবের রুমে দিকে চলে গেল। নাছির সাহেবের সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ডিসকাস শেষ করে,ফোন কানে লাগিয়ে হ্যালো হ্যালো বলে নিজের রুমে ভিতর চলে গেল জায়িন।
রাত আটটার সময় ওয়াইফাই লাইন লাগানোর জন্য কিছু লোক আসলো। ওয়াইফাই লাগানো শেষ করে জায়িন কে জিজ্ঞেস করল কানেকশন কোথায় পর্যন্ত রাখবো?
জায়িন কে কথা বলতে না দিয়ে মেহেরুন নেছা বললেন,
“কমহইলে সিলেট বাজার পইরর্যন্ত ওয়াই-ফাই এর নেটওয়ার্ক রাখো।
ওয়াইফাই এর লোকেরা মেহেরুন নেছার দিকে হা করে তাকিয়ে তাকলো।
” এই হা কইরা তাকাইয়া আছোছ ক্যা? মুখ দিয়া তো মশা ডুইকা যাইবো। যেইডা বলছি ওইডা করো?
জায়িন ইশারা দিয়ে বলল হ্যাঁ বলতে! জায়িনের কথা মতো সবাই হ্যাঁ বলল। নুসরাত এসে মেহেরুন নেছাকে টেনে নিয়ে চলে গেল।
“বাসার সামনে পর্যন্ত নেট থাকলেই হবে।
ওয়াই-ফাই লাগানোর পর লোকেরা চলে গেল।
রাতের বেলা,
” ইসরাত চিংড়ি মাছের তরকারি টা এদিকে দাও?
ইসরাত নিজের খাবার খেতে তাকলো। জায়িনের কথার কোনো উত্তর দিল না। এমনভাব করলো যেন ও শুনেই নি জায়িনের কথা।
মেহেরুন নেছা পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে বললেন, “এই ছ্যাঁমড়ি, বড় ভাই কী কয় শুইনতে পাস না? বেয়াদব ছ্যাঁমড়ি ওইডার সাথে থাইকা নষ্ট হই যাইতাছে।
জায়িন আর ইসরাত মেহেরুন নেছার প্রিয় নাতি। জায়িনের কথা না শুনলে মেহেরুন নেছা নাক ফুলিয়ে ফেলেন। মেহেরুন নেছার বকা খেয়েও যখন তরকারির বাটি দিল না তখন তিনি ঠাস করে নুসরাতের পিঠে থাপ্পড় মারলেন।
ইসরাতের উপরের রাগ নুসরাতের উপর প্রকাশ করলেন। নুসরাত ভ্রু কুঁচকে তাকালো মেহেরুন নেছার দিকে। তাকে কেন থাপ্পড় মারলেন মেহেরুন নেছা জানতে চেয়ে?
কিছু জিজ্ঞেস করতে হলো না! মেহেরুন নেছা নিজেই বললেন,” এইডার সাথে থাইকা আমার ভালো নাডিন টা খারাপ হই যাইতাছে। নাছির তোরে না করছিলাম দুইডারে এক রুমে দিস না,তুই আমার কথা হুনলি না। আইজ আমার কথা হুনলে এই দিন দেখতে হইতো না।
বিলাপ করতে লাগলেন মেহেরুন নেছা।
হেলাল সাহেব বিরক্ত হলেন। খাবারের সময় এই কি নতুন নাটক?
“আহ মা, কী শুরু করেছ? চুপচাপ খাবার খাও! আর জায়িন কে তো ওর মা খাবার দিয়ে দিয়েছে! ইসরাত হয়তো শুনতে পায়নি।
মেহেরুন নেছা কিছু বলতে গেলে হেলাল সাহেব চোখ দেখালেন আর কিছু না বলে চুপ হয়ে গেলেন মেহেরুন নেছা। যাকে নিয়ে এতো সব সে চুপ হয়ে বসে আছে। জায়িন এসবে ভ্রুক্ষেপহীন! কে কি করল না করল তার কিছু যায় আসেনা?
খাবার টেবিলে চামচের টুং টাং শব্দে মুখরিত। সাজিদার ছেলে শুভ্র খাবার খাওয়ার মাঝখানে উউহ উউউ শব্দ করছে। মাঝে মাঝে আম্মা আব্বা বলে ডাকছে।
” নাইইইনা
হেলাল সাহেব বললেন,
“জি নানা! কি হয়েছে?
” নামনাম।
“খাবার অনেক মজা নানা।
” উম উম।
লুৎফা বেগম বললেন,
“ভাইয়া আগামীকাল চলে যাব।
” কেন? আরো দু-এক সপ্তাহ থাক।
” আর থাকা যাবে না। আশিক টা চলে গিয়েছে। কি খাচ্ছে না খাচ্ছে কিছুই জানি না? আর কিছু দিন পর তো মমোর ও পরীক্ষা তাই দু-দিন বাদে যাওয়ার থেকে আগামীকালই চলে যাই।
“আচ্ছা তোর ইচ্ছা! আমি তো আর কিছু বলতে পারি না।
রাত ২:৪৫ শনশন বাতাসের শব্দ। ঝিঝি পোকার ঝিঝি শব্দে পরিবেশ মুখরিত। যান্ত্রিক গাড়ি দু-একটা চলাচল করছে। দু -তলার বারান্দায় বসে খেয়াল করছিল ইসরাত। সন্ধ্যা বেলার কথা মনে হলেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।আকাশে তারার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ইসরাত।
” কি করছিস?
” তারা গুণছি।
কথাগুলো শান্ত শুনালো নুসরাতের কানে।
নুসরাত হেহে করে হাসলো।
“ফাউল কথা বলার জায়গা পাস না। তারা আবার গণা যায় নাকি?
ইসরাত কথার উত্তর দিল না। নিশ্চল হয়ে বসে রইলো। যান্ত্রিক গাড়ির দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলো,”আমি কি ব্যাকডেটেট?
“কে বলেছে? তুই ব্যাকডেটেট! এতো বড় সাহস কার? আমাকে বল আমি ওর মুখ ফাটিয়ে দিব। ওই আরশের বাচ্চা বলছে তোকে তুই ব্যাকডেটেট! শালাকে সুযোগে পেলে আছাড় দিয়ে মেরে ফেলবো।
নুসরাত বকবক করতে লাগলো। এতো বকবক করার পর যখন দেখলো ইসরাত কথা বলছে না মন খারাপ করে আছে, নুসরাত নিজেও চুপ হয়ে গেল। জোরে নিঃশ্বাস ফেলল! বারান্দার দেয়ালের সাথে লেগে বসে ইসরাত কে ইশারা করে তার কাছে বসার জন্য।
” আচ্ছা যেই বলুক না কেন কথাটা মন খারাপ করিস না? দাদা ওতো আমাকে কতো কি বলে আমি কখনো মন খারাপ করি?
“কিন্তু দাদি দেখেছিলি জায়িন ভাইয়ের পক্ষ পাতিত্য করে আমাকে ধমক দিয়েছিল।
” তুই জানিস না, দাদার পছন্দের নাতি আরশ ভাই, জায়িন ভাই আর তুই। এই দু জনের কথা না শুনলে দাদা গাল ফুলায়। তোর কথা আমি না শুনলে দাদি গাল ফুলায়? তুই আর মন খারাপ করিস না।
“কিন্তু,
” আর কোনো কথা নয়,চল শুয়ে পরি। আজ অনেক ঘুমআসছে। সারাদিন ধরে অনেক পরিশ্রম করছি!
শরীর ব্যাথা হয়ে গিয়েছে।
বিছানায় শুয়ে পড়ে নুসরাত মুখ দিয়ে ব্যাথাতুর শব্দ করল, “আয় হায়! কোমর ব্যথায় কোমর ফেটে যাচ্ছে।
সকালবেলা যখন ইসরাত বাগানে পানি দিচ্ছিল তখন দু-তলার বারান্দা থেকে জায়িন ইসরাত কে ডাকলো।
ইসরাত শুনতে পেয়েও প্রতিউত্তর করলো না।
জায়িন মনে করল হয়তোবা শুনতে পায়নি তাই তাড়াতাড়ি করে নিচে এসে বাগানে গেল। গিয়ে দেখলো বাগানে পানি দেওয়া শেষ করে ইসরাত পানির পাইপ বাড়ির পিছনের ঘরে রাখার জন্য নিয়ে যাচ্ছে।
জায়িন ডাকলো,
” ইসরাত।
প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৫
নাহ মেয়েটা এবার ও প্রতিউত্তর করলো না। জায়িন দৌড়ে গিয়ে পিছন থেকে হাত চেপে ধরলো মেয়েটার। ইসরাত হাত আলগোছে ছাড়িয়ে নিল। শান্ত অথচ গম্ভীর চোখে তাকালো জায়িনের দিকে। আঙুল তুলে শাসালো,” পারমিশন ছাড়া আমার হাত ধরবেন না ভাইয়া। আমি পছন্দ করি না কেউ আমার হাত আমার পারমিশন ছাড়া স্পর্শ করছে।
জায়িনের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে থেকে চলে গেল ইসরাত। জায়িনের মুখ থেকে বেড়িয়ে আসলো, “মেয়েটা কি আমাকে ইগনোর করছে? আমাকে বলছে তার পারমিশন ছাড়া থাকে স্পর্শ না করার জন্য। নিজের দিকে আঙুল তুলে বলল, ” আমাকে! এই জায়িনকে? হাউ ডেয়ার সি?
তারপর বিকট শব্দে চিৎকার আসলো,
” হাউ ডিয়ার সি?