প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৬৬

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৬৬
জান্নাত নুসরাত

মে মাস! সাধারণত মে মাসে বসন্তের শেষ পর্যায় চলতে থাকে এবং গ্রীষ্মের আগমনী বার্তা শুরু হয়। প্যারিসের আবহাওয়া উষ্ণ ও আরামদায়ক হয় মে মাসে। আবহাওয়া এই সময় দিনের বেলা উষ্ণ থাকে এবং সন্ধ্যার দিকে মৃদু ঠান্ডা হতে পারে। গাছপালা পুরোপুরি সবুজ হয়ে ওঠে এবং ফুলগুলো পূর্ণ বিকশিত থাকে। শহরের বিভিন্ন পার্ক ও বাগান খুব সুন্দর দেখায় এই সময়ে।

বড় বড় দানব আকৃতির ওক গাছ, পাইন গাছ, পুরোনো পাতা ঝড়ে পড়ে নতুন রঙে রঙিন হয়। এই সময় বৃষ্টির সম্ভনা বেশি থাকে। তাই বাহিরে বের হওয়ার সময় রেইন কোট বা ছাতা সাথে রাখা ভালো।
মেঘলা আকাশ! কিছুক্ষণ পর পর মেঘ ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। থাই গ্লাসের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল ইসরাত। হালকা হালকা বাতাস বইছে বাহিরে যা এপার্টমেন্টে ও প্রবেশ করছে। মোবাইলের অন বাটনে চাপ দিয়ে ইসরাত আজকের আবহাওয়া দেখল। চোখে ভাসল ১৫° সেলসিয়াস!
এর মধ্যে জায়িনের কল আসলো। ইসরাত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কল পিক করল। ওপাশ থেকে পুরষালি গলার আওয়াজ আসলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“রেই রেডি হয়ে থেকো! আমি আসছি হাফ এন হাওয়ারের ভিতর।
ইসরাত মৃদু স্বরে বলল,
” ওকে!
ফোন রেখে দিয়ে ইসরাত এসে বসল ড্রয়িং রুমের সোফার উপর। হিটার অন করে দিল। মৃদু বাতাস আর সাথের ঠান্ডায় শরীরের পশম দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। তারপর ও থাই গ্লাস লক করল না। এই পরিবেশ তার কাছে উপভোগ্য মনে হচ্ছে!

সোফায় বসে থাই গ্লাসের দিকে তাকিয়ে রইল। এখান থেকে বিশেষ কিছু দেখা না গেলে ও বড় বড় ওক গাছের শাখা-প্রশাখা দেখা যাচ্ছে। ইসরাত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল এক পানে। জীবনের কাছে সে যা চেয়েছে জীবন থাকে অনেক বেশি দিয়েছে। সে জায়িনের প্রথম ভালোবাসা নয় কিন্তু, জায়িনের জীবনের সবথেকে কাছের জায়গা সে পেয়েছে। জায়িনের মতো একজন মানুষের সুখ দুঃখের সাথী হতে পেরেছে এটাই অনেক বেশি তার কাছে।
আজ তারা বাহিরে যাবে। গত এক মাস থেকে জায়িনের পিছন ধরেছে ইসরাত। ঈদে সালামি হিসেবে দেওয়া ডলার গুলো দিয়ে শপিং করবে। এগুলো বাসায় পড়ে রয়েছে। জায়িন আইডিয়া দিল ডায়মন্ডের কোনো জিনিস কিনে ফেলার জন্য।

দেশে থাকতে নাজমিন বেগম ও বলেছিলেন টাকা দিয়ে গোল্ডের কোনো জিনিস বানিয়ে নেওয়ার জন্য। ইসরাতের গোল্ডের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ না থাকায় অতোটা গুরুত্ব দেয়নি কথাটায়। জায়িনের কথা ইসরাতের কাছে গ্রহণ যোগ্য মনে হয়েছে। গোল্ডের তোলনায় সে ডায়মন্ডের প্রতি একটু উইক। তাই ডায়মন্ড নিলে টাকাগুলো ওয়েস্ট হবে না! আবার জায়িনের টাকা গুলো কাজে লাগলো। বিয়ের প্রথম সালামি ও অক্ষত থাকল। তাই গত এক সপ্তাহ ধরে জায়িনের পিছন নিয়েছে মলে যাওয়ার জন্য। আজ বাহিরে যাওয়ার আগে বলে গিয়েছে নিয়ে যাবে মলে!।
ইসরাত প্রায় পনেরো মিনিট এক ধ্যানে বসে থেকে উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ উঠে দাঁড়াতেই পুরো শরীর দোলে উঠল। চোখ বন্ধ করে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে ধাতস্ত করে পা বাড়াল রুমের দিকে। রুমের দরজা ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই নাকে লাগলো ব্ল্যাক টাই সেলিন ম্যান পারফিউমের গন্ধ। ইসরাত নাক টেনে নাসারন্ধ্রের ভিতরে গ্রাণ টা টেনে নিল।

রুমের ভিতর অন্যরকম মন মাতানো সুগন্ধি। এই গ্রাণটা ইসরাত জায়িনের শরীর থেকে পায়! দীর্ঘ শ্বাস ফেলে রুমের ভিতর এগিয়ে গেল। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই নিজের কাছে লাগলো আগের তোলনায় আরো একটু মোটা হয়ে গিয়েছে।
কাবার্ড থেকে স্কার্ফ বের করে পরে নিল। মোটা ওভার কোট গায়ে চাপিয়ে, ঠোঁটে লিপ গ্লোস লাগিয়ে নিয়ে অগ্রসর হলো রুমের বাহিরের দিকে।
পাশের রুমে উঁকি দিল একবার। গতকাল রাতে এসে ঘুম দিতে শুয়েছে আর এখন পর্যন্ত ঘুমাচ্ছে। ইসরাত দীর্ঘ শ্বাস লুকিয়ে রুমের দরজা লক করে দিল। ড্রয়িং রুমে এসে সোফায় বসতেই জায়িনের কল আসলো। ইসরাত কল পিক করে কানে লাগেতেই ওপাশ থেকে গমগমে স্বরে ভেসে আসলো,”রেই নিচে অপেক্ষা করছি চলে আসো!
ইসরাত মিনমিন গলায় বলল,

“আসছি!
মোবাইল কোটের পকেটে ঢুকিয়ে দরজার বাহিরে গেল। দরজা লক করে নিয়ে বড় বড় পা ফেলে অগ্রসর হলো এলিভেটরের দিকে। পায়ে শর্ট হাই হিল। এলিভেটর গ্রাউন্ড ফ্লোরে গিয়ে থেমে গেল। ইসরাত এলিভেটর থেকে বের হতেই চোখের সামনে দেখল সুঠাম দেহের পুরুষটাকে। যে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার অপেক্ষায়। ইসরাত ধীরে ধীরে পা বাড়িয়ে গাড়ির কাছে গেল। জায়িন দরজা খুলে দিল! ইসরাত আলগোছে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। ঠোঁট কামড়ে হাসল ইসরাত।

জায়িন থমথমে মুখে এসে বসল ড্রাইভিং সিটে। ইসরাতের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে নিল। দন্ত দিয়ে ঠোঁট চাপল। হুইল ঘুরাতে ঘুরাতে ইসরাতের দিকে আবার তাকাল। গাড়ি স্টার্ট করে নির্দিষ্ট স্প্রিডে দিয়ে এক হাত হুইলে রেখে আরেক হাত নিয়ে রাখল ইসরাতের পায়ের উপর।
ঢোক গিলে ইসরাতের দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে জিজ্ঞেস করল,” রেই হাসছো কেন?
ইসরাত কথা বলল না, শরীরে শিরশির অনুভূতি হলো।এটা নতুন না, জায়িন স্পর্শ করলে সচারাচর এমন অনুভূতি হয়। তাই বিশেষ ভাবাবেগ হলো না ওদিকে।ইসরাত জায়িনের হাত পায়ের উপর থেকে সরাতে চাইলে জায়িন চোখ রাঙিয়ে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”হে, কি সমস্যা?

ইসরাত চোখ নামিয়ে নিল। জায়িন মুখ গম্ভীর করে বসে রইল। তবুও হাত সরাল না! ইসরাত চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে কাচের বাইরে চোখ রাখল। জায়িন লক করে রেখেছে। ইসরাত তাকিয়ে রইল কাচের ভিতর থেকে। বাইরে একের পর এক চলতে থাকা গাড়ি গুলোর দিকে তার দৃষ্টি। ধীরে ধীরে অন্ধকার ঘনীয়ে আসছে ধরণীতে। রাতের রঙে রঙিন হচ্ছে পুরো পৃথিবী। জায়িন ধীরে ধীরে গাড়ি নিয়ে ঢুকল মলের ভিতর৷ গাড়ি পার্কিং করার আগে দরজা খুলে দিল ইসরাতকে বের হওয়ার জন্য। চোখ বড় বড় করে সাবধান করে দিল,”আমি আসার আগে মলের ভিতর যদি ঢুকো তাহলে আজ রাতে তোমার খবর আছে।।
ইসরাতের মুখ থেকে ভুল ক্রমে বের হয়ে আসলো,

“কি খবর করবেন?
জায়িন ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,” তুমি কি তার ডেমো এখানে দেখতে চাও? নাকি বাসায় গিয়ে!
ইসরাত চোখ সরিয়ে নিল। দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ এক পাশে। এক হাত দিয়ে আরেক হাতে ঘর্ষণ করল। ঠোঁট কামড়ে চেয়ে রইল দূরে পাকিং করতে থাকা ব্ল্যাক কালারের বি-এম-ডব্লিউ কার এর দিকে। জায়িন গাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়ি চেক করল লক করেছে কি না? যখন দেখল সব ঠিকঠাক তখন ইসরাতের দিকে এগিয়ে আসলো। পরণে থাকা শার্টের হাতা গুটিয়ে নিল। হাতে ওভার কোট ভাঁজ করে রেখল। কপালে গভীর ভাঁজ, মুখ গম্ভীর।
ইসরাত একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে সৈয়দ বাড়ির সব পুরুষের কপালে সব সময় দু থেকে তিনটে ভাঁজ থাকে। কোনো সময় এই ভাঁজ শীতিল হয় না। এই বেটার ও সেইম অবস্থা। আরো একজনের ও এরকম থাকে। তিনি হলে দ্যা গ্রেট নুসরাত আপা!

জায়িন ইসরাতের চিন্তা ভাবনার মাঝে এসে তার হাত চেপে ধরল। ইসরাত চোখ তুলে তাকিয়ে আবার নামিয়ে নিল। জায়িন এক হাত দিয়ে ইসরাতকে টেনে নিয়ে আসলো নিজের কাছে। বুকের কাছে মাথা চেপে ধরে হাঁটা ধরল সামনের দিকে। জায়িনের শক্ত পোক্ত শরীরের কাছে তাকে চুনোপুঁটি মনে হয়। সে পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি হওয়ার পর ও জায়িনের বুকের কাছে গিয়ে পরে। উপরের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হয় জায়িনের সাথে। উপরের দিকে কথা বলতে গেলে ইসরাতের ঘাড়ে ব্যাথা হয়ে যায়। জায়িন ইসরাত কে তার দিকে তাকিয়ে তাকতে দেখে মাথা নিচু করে ইসরাতের দিকে তাকাল। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল কি? ইসরাত মাথা নাড়িয়ে কিছু না বলল। জায়িন শক্ত করে চেপে ধরে অগ্রসর হলো সামনের দিকে। ইসরাত পায়ের সাথে পা মিলিয়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে।
ডায়মন্ড স্টোরে এসে জায়িন গ্লাস ঠেলে ভিতরে ঢুকে গেল। স্লাইডিং ডোরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা জায়িনকে উদ্দেশ্য করে বলল,”হ্যালো স্যার!
জায়িন মুখ গম্ভীর রেখে বলল,

“হ্যালো!
ডায়মন্ড স্টোরে ঢুকার পর পর শরীর গরম হয়ে গেল ইসরাতের। চারিদিকে তাকিয়ে দেখল ইসরাত। একটা ছেলে জায়িনের দিকে এগিয়ে এসে বলল,”কীভাবে সাহায্য করতে পারি স্যার?
” কিছু ডায়মন্ডের নেকলেস দেখান!
ছেলেটা ছোট ছোট নেকলেস বের করে দেখাতে লাগলো। জায়িন ইসরাতকে ইশারা করল। মুখ দিয়ে বলল,”যেটা পছন্দ হয় নিয়ে নাও!
ইসরাত জায়িনের বাহু বন্ধনে থেকে মিনমিন করে বলল,”আপনি পছন্দ করে দিন।
জায়িন মুখে গম্ভীর ভাব ধরে রাখল। কিন্তু, মনে মনে খুশি হলো ইসরাতের কথায়। হাত বাড়িয়ে একটা নেকলেস হাতে নিল। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,

“হাউ মাচ ইজ দিজ?
ছেলেটা প্রফেশনাল ভঙ্গিতে বলল,
“স্যার দিজ ইজ ফাইভ থাউজেন ইউরো।
জায়িন জিজ্ঞেস করল,
“ইজ দেয়ার আ দিসকাউন্ট অফার গোয়িং অন?
ছেলেটা বিনয়ী হেসে বলল
“ইয়েস স্যার! টেন পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট.
জায়িন জিজ্ঞেস করল,
“সো আফটার দ্যা ডিসকাউন্ট হাউ মাচ ডোএস ইট কাম টু?”
ছেলেটা কোমল কন্ঠে বলল,
“স্যার উইথ টেন পার্সেন্ট অফ দ্যা নেকলেস উইল বি ফোর থাউজেন ফাইভ হান্ড্রেশ ইউরোস।
জায়িন পকেটে হাত ঢুকিয়ে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে শুধাল,” কার্ড অর ক্যাস?
ছেলেটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“কার্ড স্যার !
জায়িন নিজের ব্ল্যাক কার্ড এগিয়ে দিল ছেলেটার দিকে। ছেলেটে কার্ড মেশিনে লাগিয়ে সেটা এগিয়ে দিয়ে জায়িনকে বলল,” স্যার পিন!
ইসরাত জায়িনকে পিন লিখতে দেখে হাতের নিচ থেকে উঁকি ঝুঁকি মারতে লাগলো। জায়িন ইসরাতকে এরকম করতে দেখে ধীরে ধীরে পিন লিখতে লাগলো ইসরাত কে দেখিয়ে।
ইউরো পে করতেই ছেলেটা বক্সে পুরে ডায়মন্ড নেকলেস জায়িনের দিকে এগিয়ে দিল। হাসি মুখে বলল,”আবার আসবেন স্যার ম্যামকে নিয়ে! ক্রিসমাসের সময় আমাদের এখানে দারুণ দারুণ অফার দেওয়া হয়। কখন কখন ২৫ থেকে ৩০ পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট দেওয়া হয়।
জায়িন ঠোঁট টেনে হেসে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। গ্লাস টেনে খুলে দিয়ে গ্লাসের সামনে দাঁড়ানো ছেলেটা বলল,”আবার আসবেন স্যার!
জায়িন শুধু মাথা নাড়িয়ে বের হয়ে গেল। মলের ভিতরে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল,”কিছু নিবে?
ইসরাত বোকার মতো বলল,

“কি?
জায়িন গম্ভীর চোখে তাকাল ইসরাতের দিকে। ক্লথ এরিয়ার দিকে এগিয়ে গেল। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল,” স্যানেটারি ন্যাপকিন নিবে?
লজ্জায় ইসরাতের গাল লাল হয়ে গেল। ঠোঁট কামড়ে বলল,”জি না!
জায়িন কথা বাড়াল না। ইসরাত কে এক প্রকার নিজের সাথে টেনে নিয়ে গেল। জায়িন নিজের পছন্দ মতো কিছু ড্রেস ইসরাতের জন্য ক্র‍য় করল। ইসরাত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

রাতের খাবার বাইরে খেল দু-জন। জায়িন যত্ন সহকারে স্টেক ছোট ছোট পিস করে দিল। খাবার খাওয়া শেষে জায়িন গাড়ি নিয়ে উল্টো পথ ধরল।
ইসরাত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“এটা তো এপার্টমেন্ট যাওয়ার রাস্তা না?
” তোমাকে কে বলেছে আমরা এপার্টমেন্ট যাচ্ছি! আমরা এপার্টমেন্ট যাচ্ছি না!
“তাহলে কোথায় যাচ্ছি?
“লং ড্রাইভে যাচ্ছি!
ইসরাত ঠোঁট কামড়ে কিছু চিন্তা করল। জায়িনের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় বলল,” এপার্টমেন্টে নুসরাত একা….
ইসরাতের কথা থামিয়ে দিল মাঝপথে জায়িন। গম্ভীর গলায় বলল,”রেই তোমাকে কে বলেছে এপার্টমেন্টে ও একা?
ইসরাত অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তাহলে অন্য কেউ আছে কি?
জায়িন ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বলল,

“অবশ্যই আছে।
” কে? আমি কেন দেখতে পাইনি?
“তোমার বোনের ঘাড়ে যে দুটো জিন আছে ওই গুলা ওর সাথে আছে।
ইসরাত জায়িনের পায়ে থাপ্পড় মারল। জায়িন হা হা করে হাসল ইসরাতের রিয়েকশন দেখে।
” দূর আপনি না,
” আমি কি?
“আমি সিরিয়াস নিয়ে নিয়েছিলাম আপনার কথা।
” আমি তো সিরিয়াস হয়ে কথাটা বলেছি। ওর ঘাড়ে তো কমপক্ষে হলে ও হাজারটা জিন আছে। এই জন্য এতো ঘাড় ত্যাড়া তোমার বোন! তুমি কত সুইট আর তোমার বোনকে দেখো পুরো একটা গুন্ডা রেই! হাঁটার স্টাইল তো ছেলেদের মতো! কাপড় পড়ে ও ছেলেদের মতো। শুধু চুলের জন্য মেয়ে লাগে নইলে চুল গুলো কেটে দিলে পুরো ছেলে হয়ে যাবে তোমার বোন।
ইসরাত নাক ফুলিয়ে তাকাল। দাঁত কামড়ে বসে রইল।
জায়িন ঠাট্টা করে বলল,”রাগ করেছ রেই?
ইসরাত কথা বলল না। জায়িন এক হাত হুইলে রেখে অন্য হাত দিয়ে ইসরাতের হাত চেপে ধরল।
“মজা করছিলাম! তুমি দেখি সিরিয়াস নিয়ে নিলে।
ইসরাত চুপ হয়ে রইল। বাকি রাস্তা কাটল এমন নিস্তব্ধ! জায়িন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভুল করে বলে ফেলে এখন আফসোস হচ্ছে! জীবনে চলার পথে জীবনে স্ত্রীকে সত্যি কথা বলতে নেই, জায়িন আজ বুঝল।

নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছে গিয়ে জায়িন ইসরাতকে মানাতে চাইল ইসরাত চুপ করে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জায়িন কান ধরে উঠ বস করল। জায়িনকে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইসরাতের মায়া লাগলো। হাত বাড়িয়ে জায়িনের কপালের উপর পরে থাকা চুল গুলো অগোছালো করে দিল। জায়িন ইসরাতের কোমর চেপে ধরে টেনে কাছে নিয়ে গেল। শির শির বাতাসে নাকি জায়িনের সংস্পর্শে ইসরাত কেঁপে উঠল ঠিক বুঝা গেল না। ধীরে ধীরে দুটো অধরে অধর মিলল।
আকাশ কাঁপিয়ে মেঘের গর্জন আসলো। মেঘে ঢেকে গেল পূর্ণিমার চাঁদ। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো। ধরণী ভিজে যেতে লাগলো বৃষ্টির স্নিগ্ধ পানিতে। সজীব হতে লাগলো গাছ পালা। বৃষ্টির ছন্দে নিজেরা ও ছন্দ মিলিয়ে দোলে উঠল। ভিজে গেল বৃষ্টির পানিতে গাছপালা সাথে বৃষ্টির বরফ শীতল পানিতে ভিজতে লাগলো দুই মানব মানবী। বৃষ্টির পানির ঠান্ডা স্পর্শে প্রতিটা অঙ্গ প্রতঙ্গ কেঁপে উঠল দু-জনের।

জুন মাসের এক দুপুরে খবর আসলো আরশের ছোট খাটো একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। নুসরাত তখন গিয়েছে হসপিটালে। কিছু দিন ধরে শরীর ভালো যাচ্ছে না তাই। হসপিটাল থেকে ফিরে আসলো খুশি খুশি মুখে। ঠোঁটে লেগে আছে হাসির ঝলক। বাসা আসার পর ইসরাত খবর দিল আরশের এক্সিডেন্ট হয়েছে। নুসরাতের ভাব গতি বুঝা বড় দায়! হাতের মধ্যে ফলের ব্যাগ ছিল। হসপিটাল থেকে ফিরার পথে বিভিন্ন প্রকার ফ্রুটস নিয়ে এসেছিল।
নির্লিপ্ত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রুমে চলে গেল। রুমে গিয়ে ফল রাখল। হাতে করে দুটো আপেল নিয়ে আসলো। নাইফ আনতে গেল কিচেনে। নাইফ নিয়ে এসে আরাম করে বসল সোফায়। আপেল টুকরো টুকরো করে কাটতে কাটতে ইসরাতের দিকে তাকাল। ইসরাত অদ্ভুত চোখে নুসরাতের দিকে তাকিয়ে আছে।
“কি? আপেল খাবি তুই!
ইসরাত দু-পাশে মাথা নাড়াল।

” তাহলে হা করে তাকিয়ে আছিস কেন? মুখে মশা ঢুকে যাবে তো! মুখ বন্ধ কর।
ইসরাত অবাক গলায় বলল,
“তুই শোনতে পাসনি ছোট ভাইয়া এক্সিডেন্ট করেছে।
নুসরাত আপেলের টুকরো মুখে ঢুকিয়ে নিল। আপেল চাবাতে চাবাতে বলল,” জীবনে চলার পথে দু-একটা ইঞ্জুরি হবে এসব স্বাভাবিক। সিরিয়াস নেওয়ার কিছু নেই!
“নুসরাত তুই কি ঠিক আছিস?
” ইয়াহ আ’ম অলরাইট! আমার কি হবে?
ইসরাত মাথায় হাত দিয়ে নিজের রুমে গেল। ফোন বের করে কল করল জায়িনকে। ওপাশ থেকে কল ধরতেই ইসরাত বলল,”শুনছেন!

“হু!
” নুসরাতের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। ছোট ভাইয়া এক্সিডেন্ট করেছে বলার পর ও আরাম করে বসে আপেল নাইফ দিয়ে কেটে কেটে খাচ্ছে। আর মুচকি হাসি দিয়ে বলছে জীবনে চলার পথে দুই একটা ইঞ্জুরি হওয়া স্বাভাবিক।
জায়িন চুপ করে রইল।
“কিছু বলছেন না কেন?
” কি বলব? তোমার পাগল বোনের বিষয় আমি জানি না! হুজুর পাঠাচ্ছি রেই। ঝাড় ফুক দিয়ে দিবেন। জীন ভর করলে মেরে তাড়িয়ে দিবেন। কেমন?
“দূর কি সব বলেন? ফোন রাখুন তো! ফালতু কথা বলে আমার টাইম ওয়েস্ট করবেন না। অনেক কাজ পড়ে আছে।
ইসরাত ফোন কেটে দিল। জায়িন হতবম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল ফোনের দিকে। সে টাইম ওয়েস্ট করছে! আজ বাসায় গিয়ে বুঝাবে কত চালে কত ধান?

আরশের এক্সিডেন্টের এক মাস পেরিয়ে গেছে। নাছির সাহেব ব্যবসার কাজ থেকে বিরতি নিয়েছেন। এসব কাজে এখন আর শরীর মানে না। ইরহাম আর আরশ মিলে সব সামলাচ্ছে। হেলাল সাহেব আর নাছির সাহেব মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যার যার কাজ সবাইকে ভাগ করে দিবেন। সম্পত্তি ও সব ভাই বোনের মধ্যে ভাগ করে দিবেন যাতে ভবিষ্যতে কোনো প্রকার সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়া বিবাদ না হয়। অনিকা ও টুকটাক অফিস যায় এখন। ব্যবসার কাজে সে ও হাত লাগাচ্ছে বাপ, চাচা, ভাইদের সাথে।

জুলাই মাসের এক মধ্য দুপুরে নাছির সাহেবের কল আসলো নুসরাতের মোবাইলে। কোন প্রকার হ্যালো না বলেই আসল কথায় আসলেন তিনি। আদেশ দিয়ে বললেন,” নুসরাত, আগামীকাল তোমাদের ওখানের ছয়টার সময় একটা গ্রুপ কল আসবে সেটায় জয়েন হবে কোনো কথা ছাড়া। আমার কোনো ছেলে নেই, তাই আমার ছেলের জায়গায় তুমি আমার হয়ে বসবে। এবং বুঝে শুনে কথা বলবে। কোনো প্রকার ত্যাড়ামি করবে না।
নুসরাত হা না করার আগেই নাছির সাহেব কল রেখে দিলেন। নুসরাত কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল।
পরের দিন,

ছয়টার সময় কল আসলো। নুসরাত জয়েন হলো গ্রুপ কলে। ল্যাপটপ নিয়ে বসল সোফার উপর। নিচে প্লাজু আর উপরে সাদা শার্ট ইন করে পরা। চুল গুলো পনিটেল করে রাখা। পিছনের সাদা প্রজেক্টেরে নুসরাতের মুখে ভেসে উঠতেই শান্ত হয়ে গেল পুরো রুম। নুসরাত কপালে ভাঁজ ফেলে গলার স্বর যতেষ্ট কঠিন করল। ল্যাপটপে ভেসে উঠছে আরশ, ইরহাম, হেলাল, নাছির, সোহেদ, শোহেব আর অনিকার মুখ।
আরশ আড়চোখে তাকাল সামনের দিকে। গাল গুলো ফোলে গিয়ে ঢোল হয়ে গিয়েছে নুসরাতের। আগের তোলনায় সুন্দর হয়ে গিয়েছে। মুখের সামনে দু গাছি চুল এনে রাখা। আরশ বিড়বিড় করে বলল,”আমাকে ছাড়া খুব ভালো আছিস!
নুসরাত আরশের দিকে তাকাল আড় চোখে। কপালে ব্যান্ডেজ করা, আগের তোলনায় রোগা হয়ে গিয়েছে, চোখের নিচে কালো হয়ে গর্ত হয়ে গিয়েছ। ঠোঁটের অবস্থা যাতা! মনে হচ্ছে নিয়মিত স্মোকিং করে। নুসরাত দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।

জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
“শুরু করুন! কি প্রয়োজনে এতো জরুরি ভাবে আমাকে আপনার হয়ে বসতে বললেন আব্বা।
নাছির সাহেব সাদা পর্দায় একবার তাকালেন। তারপর ল্যাপটপে তাকিয়ে বললেন,” একটু অপেক্ষা করো!
হেলাল সাহেব সূক্ষ্ম কাশি দিলেন। গলার আওয়াজ বাড়িয়ে বললেন,”সবার নিজ নিজ সম্পত্তি নিজ নিজ নামে উইল করা হবে। কিন্তু, সেটা ততদিন পর্যন্ত কার্যকর হবে না যতদিন পর্যন্ত আমরা ভাইরা বেঁচে আছি। আমরা সবাই মরে যাওয়ার পর সম্পত্তি যার যার নিয়ে আলাদা হলে হবে না হলে নেই।
নুসরাত ফোড়ন কাটল হেলাল সাহেবের কথা। কথার মধ্যে কাঠিন্য ফোটে উঠল।
“আপনাকে সম্পত্তি আলাদা করার কথা কে বলেছে?
নাছির সাহেব বললেন,

” পরে বলছি! আগে কথা শেষ করতে দেও।
নুসরাত মুখ বন্ধ করে বসে রইল। আরশ ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল নুসরাতের দিকে। এতো নাদুস-নুদুস হলো কীভাবে রহস্য উদ্ধার করতে ব্যর্থ হলো।
নাছির সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন,
“তোমার আর ইসরাতের সম্পত্তি যাবে আরশ আর জায়িনের নামে। তোমাদের স্বামী হিসেবে এগুলো ওদের পাওনা। আর কখন মরে যাই তার ঠিক নেই তাই তোমাদের একটা ব্যবস্থা করে যাই ভাবলাম।
নুসরাত ঠাস করে টেবিলে থাপ্পড় মারল। নাছির সাহেবের মুখে মরার কথা শোনে মাথা গরম হয়ে গেল। ক্ষোভ নিয়ে বলল,” আমার সম্পত্তির ০.০০০০০১ পার্সেন্ট আমি কাউকে দিবো না। আর আপনি বলছেন আমার আর ইসরাতের টুয়েন্টি ফাইভ পার্সেন্ট সম্পত্তি আপনার মেয়ের জামাইদের নামে দিয়ে দিতে। ওয়াট আ লেইম জোক। আমি আমার সম্পত্তি কাউকে দিব না। ওগুলো পড়ে পড়ে নষ্ট হবে তবুও অপাত্রে আমি ঢালব না।
নুসরাতের গলার স্বর কঠোর।
“যে আমার বাপের সম্পত্তির দিকে চোখ তোলে চাইবে কাটা চামচ দিয়ে চোখ তুলে আমি লুডু খেলব। আমার সম্পত্তির দিকে চোখ তুলে তাকানোর চেষ্টা করবেন না কেউ। আর এসব ফালতু আইডিয়া আপনাদের মাথায় কে ঢুকিয়েছে?

নুসরাত নাছির সাহেব আর হেলাল সাহেব কে মিমিক্রি করে বলল,” সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে যাব যাতে ভবিষ্যৎে কোনো সমস্যা না হয়। যত্তসব আজে বাজে কথা! আব্বা আপনাকে সাবধান করে দিলাম আরেকদিন মরার কথা বলবেন না। আমার ছেলে নেই আমার হয়ে ওখানে তুমি বসবে। আমি কেন বসব? আপনার বড় মেয়েকে বললেন না কেন বসার জন্য?

উকিল চোখ মুখ অন্ধকার করে বসে রইলেন। কিছু টাকা পাবেন আশা করে এসেছিলেন এখন বন্ড হয়ে গেল।
নুসরাত উকিলের দিকে তাকিয়ে ল্যাপটপের মধ্যে আঙ্গুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলল,”টাকা খাওয়ার কথা মাথায় থাকলে এখানে ঝেড়ে ফেলুন। আগামী বিশ বছরের আগে এই সম্পত্তি আলাদা হচ্ছে না। তাই চুপচাপ এখান থেকে নিজের গাট্টি আটান। নইলে এখান থেকে বসে আপনার ব্যবস্থা আমি নুসরাত করতে পারি। গেট আউট!

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৬৫

নুসরাত ধমকে-ধামকে সবাইকে ফোন রেখে দিল। হেলাল সাহেব আর নাছির সাহেব হা করে রইলেন। শোহেব আর সোহেদ মুচকি মুচকি হাসলেন। একজন আরেক জনের দিকে তাকিয়ে থামজাপ দেখালেন। বিড়বিড় করে বললেন,”প্ল্যান সাকসেসফুল। একদম ঠিক জায়গায় ঢিল ছুঁড়ে মেরেছি।
বড় ভাইদের অন্ধকার মুখের দিকে তাকিয়ে সোহেদ আর শোহেব ও মুখ কালো করে ফেললেন। দুঃখি দঃখি মুখ বানিয়ে নিলেন। ভাব করলেন নুসরাতের এভাবে ফোন কেটে দেওয়ায় উনারা অনেক ব্যথিত। মনে মনে খুশিতে ফেটে পরলেন।

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৬৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here