প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৬৭ (২)

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৬৭ (২)
জান্নাত নুসরাত

সমূদ্রের পাশ ঘেঁষে একটা খালি জায়গা লাল গোলাপের সাহায্যে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। গোলাপের মাঝখানে ছোটো খাটো একটা টেবিল রাখা হয়েছে যার উপর রাখা হয়েছে দুটো কাচের পিরিচ নাইফ, কাটা চামচ, কিছু মোমবাতি, আর কোমল পানীয়। টেবিলের উপর রাখা মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। মোমবাতি জ্বালানোর জন্য মিটিমিটি আলো জ্বলছে চারিদিকে। বাতাসের ঝাপটায় মোমবাতির শিখা বার বার এদিক সেদিক দোলে আবার নিজ জায়গায় স্থির হচ্ছে।

ইসরাত মুগ্ধ চোখে দেখল সবকিছু। সমূদ্রের পাশ ঘেঁষে আয়োজন টা করায় পানির কলকলানির তীব্র শব্দ এসে কানে লাগলো। জায়িন ইসরাতের কাঁধ চেপে ধরে অগ্রসর হলো টেবিলের দিকে। চেয়ার টেনে ইসরাত কে বসিয়ে দিল। নিজে গিয়ে বসল সামনের চেয়ারে। ইসরাত মুগ্ধ গলায় বলল,”সব কিছু কত সুন্দর?
জায়িন গম্ভীর গলায় বলল,
“হু!
ইসরাত জায়িনের দিকে তাকাল যে তার দিকে একদৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। জায়িন ফিসফিস স্বরে বলল,”রেই তুমি এতো সুন্দর কেন ?
ইসরাত হালকা শব্দ করে হাসল। ঠোঁটে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে বলল,”কারণ আপনি আমার দিকে সুন্দর চোখে তাকান তাই।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সময় নিজস্ব গতিতে বয়ে চলছে। প্রকৃতি ও সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নিজের রুপ পরিবর্তন করছে। গ্রীষ্ম, শরৎ, এক এক করে দুটাে ঋতু চলে গিয়েছে। বাংলাদেশে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হওয়ায় ছয় ঋতু মাত্রিক দেশ। ইউরোপ সকল দেশে তিনটে কি চারটে ঋতু থাকে? এর তোলনায় বেশি নয়! দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটা দেশ শুধু ছয় মাত্রিক ঋতু।
ফ্রান্সে চারটে ঋতু হওয়ায় দুটো সময়ের সাথে এসে চলে গেছে। এখন শীত চলছে এখানে। ক্যালেন্ডারে কাটা পরেছে সাত সাতটি মাস! নুসরাতের কাছে ফ্রান্সে কাটানো এই মাস গুলো জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়। নিজের মতো নিজের সময় কাটাচ্ছে। নেই কোনো সাংসারিক ঝামেলা! নেই কোনো চিন্তা! এই জীবন তার কাছে উপভোগ্য মনে হচ্ছে।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নুসরাত নিজেকে দেখল একচোখ দিয়ে পরখ করল। কী ছিল আর এখন কী হয়েছে? পেট আগের তুলনায় ফোলে গেছে। সামনের দিকে বের হয়ে আছে পেট। নুসরাত পেটে হাত বুলিয়ে নিজে নিজে হাসল। হাসির সাথে সাথে গালের কন্টোর লাইনে দাগ পড়ল।
নুসরাত আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। সে এতো নাদুস-নুদুস হলো কীভাবে? তারপর আবার হাসে! নুসরাতের কাছে মনে হয় সেদিন দেশ থেকে এসেছিল একা একটা লাগেজ নিয়ে আর এখন দু-জন হয়ে গেল। নিজেকে প্রশ্ন করে নিজে আবার হাসে নুসরাত।

ছোটো খাটো একটা ব্যাগ আর স্লিপার পরে এপার্টমেন্ট থেকে চুপিচুপি বের হয়ে গেল নুসরাত। ইসরাতের জন্য একা কোথায় যেতে পারে না? কোথায় যেতে চাইলে ইসরাত ও সাথে চলে আসে। নিজে একটু ইনজয় করতে পারে না সে একা একা। তাই আজ প্ল্যানিং করেছিল ইসরাত ওয়াশরুমে ঢুকলেই লুকিয়ে এপার্টমেন্ট থেকে বের হবে।
ইসরাতরা একটু শহরের বাহিরের দিকে হওয়ায় এদিকে গাড়ির চলাচল একেবারে কম। হঠাৎ হঠাৎ বাচ্চাদের সাইক্লিং করতে দেখা যায়। রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ নুসরাতের পাশ ঘেঁষে একটা সাইকেল চলে গেল। নুসরাত হা করে তাকিয়ে রইল। এক্ষুণি হার্ট এ্যাটাক করে সে মরে যেত যদি আরেকটু ক্ষণ ছেলেটা এখানে দাঁড়িয়ে থাকত। নুসরাত কিছুক্ষণ রাগী চোখে সাইকেলিং করা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হাঁটা ধরল। পেটে হাত বুলিয়ে নিয়ে বলল,” যদি হাতের কাছে পেতাম বর্তা বানাতাম। আমার উপর দিয়ে সাইকেল চালানোর শখ রফাদফা করে দিতাম। জীবনে সাইকেল চালানোর শখ আর জাগতো না। আমার বাচ্চাটার কিছু হয়ে গেল আমি কী করতাম?

প্লাজু আর ওভার সাইজড টি শার্ট নুসরাতের পরণে। মাথায় ক্যাপ, গলায় স্কার্ফ, শরীর গরম থাকার জন্য ওভার কোট পরেছে বড়সড়। হেঁটে হেঁটে সামনের দিকে যেতে লাগলো। কয়েক মিনিট হাঁটার পর একটা বাঙ্গালী এলাকা এসে পৌঁছাল নুসরাত। সেখানে ভারতীয় কিছু মানুষ আছে তাদের কথার টোনে বুঝা গেল।
মহিলা একসাথে গল্প করছেন বাসার বাহিরের লনে বসে। বাচ্চারা আশে-পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে খেলাধুলা করছে। নুসরাত কিছুক্ষণ আশে আশে পাশে হেঁটে ফিরতি পথ ধরল। ফিরার পথে দেখল বাঙ্গালী কিছু রেস্টুরেন্ট দেওয়া আছে। নুসরাত ফুচকা, চটপটি, কাবাব, পিয়াজু, যা যা এভায়ভেল ছিল সব অর্ডার করে করে পার্সেল নিল। এপার্টমেন্টে গিয়ে ইসরাতের সাথে মিলে খাবে।

এপার্টমেন্টে ফিরতেই ইসরাতের ঝাড়ি খেল নুসরাত। নুসরাত কিছু মনে করল না। টেবিলের উপর পার্সেল রেখে চলে গেল ফ্রেশ হতে। ইসরাত পার্সেল খোলে দেশি খাবার পেয়ে আর কথা বাড়ালো না। ভেবেছিল নুসরাতের পিঠে দু-এক ঘা দিবে। মাফ করে দিল বাঙ্গালী খাবারের জন্য। তার আর জায়িনের বাসায় খাবার খাওয়া কম হয়! জায়িন সময় পেলেই রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায় নাহলে বেড়াতে নিয়ে যায় ফলে রাত হয়ে যায়। আর এপার্টমেন্টে ফিরার আগে বাহিরে খেয়ে ফিরে।

ক্যালেন্ডারে আরেকটা মাস কাটা পরল। ডিসেম্বর শেষ হয়ে জানুয়ারির পর্দাপন শুরু হতে চলেছে। নুসরাতের প্রেগন্যান্সির আট মাস চলছে। নুসরাত নিজের পেট দেখে আর হা হা করে হাসে।
রাত আটটার দিকে নুসরাত আর ইসরাত এপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে রাস্তায় বের হতেই স্নো-ফল শুরু হলো। এই প্রথম বছরের স্নো-ফল হয়েছে। স্নো ধীরে ধীরে পিচঢালা রাস্তায় পড়ে সাদা হতে লাগলো। আজ ২৪ ডিসেম্বর হওয়ায় পুরো শহর ক্রিসমাসের আয়োজনে মেতেছে। খ্রিস্টানেরা রাস্তার পাশ ঘেঁষে প্লাস্টিকের ওক গাছ বসিয়েছে। ওক গাছের আশে পাশে দাঁড়িয়ে বাচ্চারা বিভিন্ন প্রকার লাইট বেঁধে দিচ্ছে। লাল নীল রঙে রঙিন হয়েছে পুরো শহর। উৎসব উৎসব আমেজ।!

বাচ্চারা ওক গাছ সাজানো রেখে এসে স্নো ধরতে ব্যস্ত হলো। চারিদিকে বাচ্চাদের হাসি রমরমা হয়ে উঠছে। নুসরাত বাচ্চাদের সাথে মিলে স্নো-ফল দিয়ে গুল গুল করে চাকা বানিয়ে একে অন্যের দিকে ছুঁড়ে মারছে।
ইসরাত সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল আনমনে। জায়িন এসে ইসরাতকে পিছন থেকে স্পর্শ করল। ইসরাত নড়ল না। ইসরাতের কাঁধ চেপে ধরতেই সে নিজের হুশে ফিরল। অবাক দৃষ্টিতে তাকিতে তাকল জায়িনের দিকে। কখন আসলো এখানে?
জায়িন হাঁটু গেড়ে বসল পিচঢালা রাস্তায়। বাতাসের সাথে বাচ্চাদের খিল খিল হাসির শব্দ আসছে। ইসরাত এখনো বিস্ময় পূর্ণ দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে জায়িনের দিকে। জায়িন আজ হাসল না। পকেট থেকে ছোটো খাটো একটি রিং এর বক্স বের করে খুলে সেটি বাড়িয়ে দিল ইসরাতের দিকে। বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে জায়িনের সিল্কি চুলগুলো হালকা হালকা উড়ছে। ইসরাতের চুল ও উড়ছে। জায়িন ইসরাতের চোখের দিকে তাকিয়ে সম্মোহনী গলায় বলল,” রেই!
ইসরাত আনমনা গলায় বলল,

“জি!
“তুমি কি আমার হবে?
ইসরাত চোখের পাতা ফেলল,চোখ মুখের সামনে আসা বেবি হেয়ার গুলো কানের পিছনে গুজে বলল,”আমি তো আপনার জায়িন!
জায়িন ইসরাতের দিক থেকে চোখ সরাল না। ঠোঁট কামড়ে হাসল।
জায়িনের আবেগি গলা,
“তুমি কি আমার মানুসিক শান্তি হবে?
ইসরাত রিনরিনে গলায় বলল,

” আমি পুরোটাই তো আপনার।
“তাহলে আমার দেওয়া এই ছোট্ট উপহার তুমি গ্রহণ করছ না কেন রেই?
” কখন আপনার দেওয়া আমি কোনো উপহার ছোটো মনে করি না! এটা আমার কাছে অনেক বড় কিছু। আপনার দেওয়া এই উপহার আমি সাদরে গ্রহণ করলাম আমার প্রিয় স্বামী।
জায়িন ইসরাতের হাতে রিং পরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ইসরাতের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,”আমার উপহার কোথায়?

“কি উপহার চান আপনি ?
” যা বলব তাই দেবে!
ইসরাত মাথা নাড়াল। জায়িন আদেশ দিয়ে বলল,
“মুখ দিয়ে বলো রেই!
” আপনি যা চাইবেন তা দিব!
“আই ওয়ান্ট টু বি দ্যা ফাদার অফ ইউ্যের চাইল্ড।
ইসরাত লজ্জায় লাল হয়ে গেল। জায়িন ইসরাতের হাত চেপে ধরে বলল,” লেটস গো এপার্টমেন্ট!
ইসরাত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কেন?
জায়িন মাথা কিছুটা ঝুঁকিয়ে ইসরাতের কানের কাছে নিজের মুখ নিয়ে বলল,”লেট’স স্ট্রার্ট দ্যা প্রসেসিং ফ্রম টুডেই।
ইসরাত হাত দিয়ে মুখ ঢাকল। জায়িন ইসরাতের এতো লজ্জা দেখে আর অপেক্ষা করল না। পাজো কোলে তুলে রওনা হলো এপার্টমেন্টের দিকে। সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে জায়িন ইসরাতের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় শব্দ করে হেসে উঠল। সাথে করে ইসরাত ও হাসল।

জানুয়ারি মাসের দশ তারিখ। প্রজেক্টের কাজ শেষ করে জায়িন নিজের অফিস ব্লিডিং থেকে বের হয়ে আসলো। ঠোঁট কামড়ে কল দিল আরশকে। তখন বাংলাদেশে রাত দুটো আর ফ্রান্সে সাড়ে আটটার মতো।
জায়িন কানে ফোন লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যতক্ষণ পর্যন্ত আরশ কল ধরল না একের পর এক লাগাতর কল দিতে থাকল জায়িন।
নুসরাতের ডেলিভারি ডেইট দিয়েছে এই সপ্তাহের ভিতর। জায়িনের বিবেকে বাঁধছে একে নুসরাতের প্রেগন্যান্সির কথা সে জানাতে দেয়নি দুই এখন বাচ্চা জন্ম হওয়ার টাইম চলে আসছে এখনো বলেনি। আরশের ও সমান অধিকার আছে তার বাচ্চার বিষয়ে জানার। নিজের সাথে গত এক সপ্তাহ ধরে বোঝা পাড়া করে আজ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে বাচ্চার কথা সে জানাবে।
জায়িন দীর্ঘ শ্বাস ফেলল! আরশ কল ধরছে না। গাড়ি পার্কিং এড়িয়া থেকে বের করতেই আরশের কল ব্যাক আসলো। জায়িন গাড়ি এক পাশে থামিয়ে কল পিক করে কানে লাগালো।
ওপাশ থেকে ভেসে আসলো আরশের গম্ভীর গলার স্বর।

“হ্যালো!
জায়িন গলা পরিস্কার করে নিল। হায় হ্যালো রেখে সোজা কথায় আসলো।
” আগামী দু-দিনের ভিতর ফ্রান্স আসতে পারবি!
আরশ ঠোঁট কামড়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে জায়িন নিষেধাজ্ঞা জারি করল।
“কোনো প্রকার প্রশ্ন নয় আরশ।
আরশ থেমে গেল। ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল,
” কোনো বিশেষ কিছু?
জায়িন ঠোঁট কামড়ে হাসল।
“আসলে দেখতে পারবি! ইমেডিয়েট আসার চেষ্টা কর!
আরশ গম্ভীর গলায় বলল,
” বললেই তো আসা যায় না! টাইম লাগবে!
“লেইট করলে কিন্তু মিস করে যাবে আরশ! বড়সড় সারপ্রাইজ!
আরশ কিছু একটা ভাবল। চিন্তিত গলায় বলল,
” কিন্তু, কন্ডিশনের কি হবে?
“কন্ডিশনকে গুল্লি মার! নুসরাত জানলে না, কিছু হবে! বাড়িতে কাউকে জানানোর দরকার নেই আলগোছে চলে আয়!

” আচ্ছা দেখছি!
“দেখছি মানে কি? তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা কর! নাহলে সারপ্রাইজ মিস করবি আরশ! সারাজীবন আফসোস থেকে যাবে কেন আমার কথা শোনে আসলি না তাড়াতাড়ি?
আরশ গম্ভীর গলায় বলল,
” আমি দেখছি কি করা যায়? চেষ্টা করব আসার!
আরশ ফোন রেখে দিল। জায়িন ফোনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। সে নিজেকে আটকে নিয়েছে একসাথে এতো কিছু বললে বেচারা এতো শক নিতে পারত না তাই আর বলেনি।

পরের দিন,
এগারো জানুয়ারি দুই হাজার ছাব্বিশ।

সন্ধ্যার দিকে লেভার পেইন উঠল নুসরাতের। জায়িন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এই সপ্তাহের শেষের দিকে টাইম দেওয়ায় তো সে আরশকে দু-দিনের ভিতর আসার কথা বলেছিল। আজ উঠবে জানলে আরো আগে জানাত জায়িন।
নিজের চিন্তাভাবনা এক পাশে ফেলে রওনা হলো সিটি হসপিটেলের দিকে। নুসরাত তখন দাঁত কামড়ে ব্যাথা সহ্য করছে। কপালে চারিপাশে জমা হয়েছে চিকন ঘামের রেশ। ধীরে ধীরে তা বাড়তে লাগলো। পনেরো মিনিটের মাথায় জায়িন হসপিটালের সামনে পৌঁছে গেল। গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভিং সিট থেকে বের হলো। ঘুরে এসে ব্যাক সিট থেকে নুসরাতকে নামাতে সাহায্য করল। নুসরাত দাঁত খিচে দাঁড়িয়ে আছে। জায়িন দেখল কপালে বেয়ে ধড় ধড় করে নেমে যাওয়া ঘাম। লাল হয়ে যাওয়া নুসরাতের ঘামাক্তক মুখ।

জায়িন কোনো প্রশ্ন না জিজ্ঞেস করে একবার ইসরাতের দিকে তাকিয়ে পাজোকোলে তুলে নিল নুসরাতকে। ইসরাতের মুখে চিন্তার ছাপ। নুসরাতকে শান্ত থাকার জন্য বলছে। নুসরাত বিরক্তি আর ব্যাথায় ইচ্ছে করল ইসরাতের চুল ছিঁড়ে ফেলতে। এই মেয়েকে সাথে কে আনতে বলেছিল। এ তো তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার বদলে টেনশন দিয়ে মেরে ফেলছে।
কোলে নিতেই জায়িনের কাছে মনে হলো কমপক্ষে দুই শত কেজি ওজনের কোনো ভারী বস্তু কোলে নিয়ে নিয়েছে। তাড়াতাড়ি পা ফেলে হসপিটালে ভিতর প্রবেশ করল। ইসরাত জায়িনের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে না পেরে দৌড়াতে শুরু করল।

“স্ট্রেস রেলিফ থাক বোন কিছু হবে না।
নুসরাত রাগে চাইল ইসরাতের চুল ছিঁড়তে। হাত পা ব্যথায় অবস হওয়ার জন্য হাত চালাতে পারল না। নাহলে ইসরাতের মাথার চুল আজ সে একটা মাথায় রাখতো না।
নুসরাতের গাইনি ডাক্তার নুচাস ক্রিস্টেবেলা। যিনি প্রেগন্যান্সি টাইমে নুসরাতের চেকআপ করেছিলেন। ডা: ক্রিস্টেবেলা নুসরাতের অবস্থা দেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডেলিভারি রুমে নিয়ে গেলেন। ইসরাত পিছু পিছু গেল ডেলিভারি রুমে।

জায়িনের মোবাইলের ভাইব্রেশনের শব্দে মোবাইল কেঁপে উঠল। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখল আরশ কল দিচ্ছে।
” হ্যালো!
“তোমরা কোথায়? আমি তোমার এপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
জায়িন অবাক হয়ে বলল,
” তুই এপার্টমেন্টের সামনে মানে!
আরশ হাসি মুখে বলল,
“আরে ভাই কি সারপ্রাইজের কথা বললি তাই তো অপেক্ষা করতে না পেরে নিজে সারপ্রাইজ হয়ে আজকে চলে আসছি। এখন নিজে এসে সারপ্রাইজ! তোরা কোথায়?
জায়িন ঢোক গিলে বলল,

” একটু সিটি হসপিটালে আয়!
“কেন? কি হয়েছে? ইসরাতের কোনো কিছু কি হয়েছে?
জায়িন বিরক্ত গলায় বলল,
” আয় এলি দেখবি! সারপ্রাইজ চাস না তাহলে আর কোনো প্রশ্ন নয়।
আরশ আসছি বলে ফোন রাখল। অতিরিক্ত উত্তেজনার জন্য আরশ পনেরো মিনিটের রাস্তা দশ মিনিটে চলে আসলো। হাসি হাসি মুখ করে এসে হসপিটালে ঢুকল। ভিতরে প্রবেশ করতেই জায়িনকে বসে থাকতে দেখল ওয়েটিং রুমে। সামনেই ডেলিভারি রুম! আরশ হাসি হাসি মুখ করে গিয়ে জায়িনকে স্পর্শ করতেই জায়িন চিন্তিত মুখ তুলে আরশের দিকে তাকাল।

আরশ জায়িনের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে নিজের পাশে বসার জন্য বলল। আরশ বসল না! জিজ্ঞেস করল,”ইসরাত কোথায়? আর নুসরাত কোথায়?
নুসরাতের কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে কিছুটা জড়তা আসলো আরশের গলায়।
আরশ উচ্ছাসিত গলায় বলল,
“আর আমার সারপ্রাইজ কোথায়?
জায়িন আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করল ডেলিভারি রুমের দিকে। আরশ ভ্রু কুঁচকে একবার তাকাল ডেলিভারি রুমের দিকে। আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আসলো জায়িনের দিকে। চিন্তিত গলায় বলল,” ডেলিভারি রুমে আবার কিসের সারপ্রাইজ?

“যাহ গিয়ে দেখে আয়! দেখিস সারপ্রাইজ পেয়ে আবার হার্ট অ্যাটাক না করে বসিস। মন প্রাণ শক্ত করে যাস আমার ভাই! গুড লাক…
আরশের বুকের ভিতর চাপ লাগলো। জায়িনের দিকে প্রশ্নাতক দৃষ্টিতে তাকাতেই জায়িন বলল,” আমি বলতে পারব না! তুই নিজে গিয়ে দেখে আয়!
আরশ সামনের দিকে পা বাড়াল। যত পা আগাচ্ছে তত হৃৎপিন্ডের গতি বেড়ে যাচ্ছে তার। আরশ ধীরে শ্বাস নিল। শ্বাস আটকে আসছে তার! নুসরাতের সাথে দেখা হওয়ার সূক্ষ্ম আশা মনে জাগল। হৃৎপিন্ডের গতির সাথে শরীরের অস্থিরতা বৃদ্ধি পেতে লাগলো। কপাল ঘেমে গেল। ডেলিভারি রুমের ভিতর থেকে সূক্ষ্ম চিৎকারের আওয়াজ আসছে।
আরশের গলার আওয়াজ চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল হলো না। এটা নুসরাতের গলার আওয়াজ! দীর্ঘ সাতমাস পর নুসরাতকে দেখার উত্তেজনায় নাকি সারপ্রাইজ পাওয়ার উত্তেজনায় আরশের হাত পা থরথর করে কাঁপতে লাগলো আরশ বুঝতে পারল না। পিছন ফিরে একবার জায়িনের দিকে তাকাল। সে মাথা নিচু করে বসে আছে। আরশের তাকানো অনুভব করতেই চোখ তোলে তাকাল। আরশ কপালের ঘাম মুছে জায়িনের দিকে তাকাতেই জায়িন চোখ দিয়ে আশ্বাস দিল ভিতরে যাওয়ার জন্য।

আরশ কাঁপা কাঁপা হাত দরজার উপর রাখতেই সারা শরীর মৃগী রোগীর মতো করে কেঁপে উঠল। নিজের ভিতর দিয়ে একপ্রকার শিহরণ বয়ে গেল। এবার একটু ভয় লাগলো! মনে মনে ভাবল কি এমন সারপ্রাইজ আছে ডেলিভারি রুমের ভিতর?
ডেলিভারি রুমের সামনে থেকে শুনল ভিতর থেকে নুসরাতের চিৎকার। আরশ দরজা ধাক্কা দিতেই চাপানো দরজা খুলে গেল। ইসরাত আর নুসরাত এক সাথে তাকাল দরজার দিকে। ডা: ক্রিস্টেবেলা হাতে গ্লাভস পরতে পরতে সামনে তাকালেন। ইসরাতকে জিজ্ঞেস করলেন,”হু ইজ হি?

ইসরাত অবাক চোখে আরশের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,” আপনার রোগীর হাজবেন্ড!
নুসরাত আর আরশের ধ্যান নেই। নুসরাত পেট চেপে ধরে দাঁত কামড়ে সামনে তাকিয়ে আছে। ব্যথার জন্য চোখ দিয়ে এক ফোটা পানি পড়ে গেল। আরশ নুসরাতের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হাত তোলে পেটের দিকে ইশারা করল। আরশের কাঁদো কাঁদো গলা! অতিরিক্ত শক নিতে না পেরে আরশের মাথা ঘুরে উঠল। চোখের পানি চোখ দিয়ে বের না হয়ে হেচকি ওঠে গেল। দরজার সামনে থেকে পা টলে গেল এক মুহূর্তে। নুসরাত মৃদু গুঙ্গিয়ে উঠল ব্যথায়। আরশ নুসরাতের পেটের দিকে ইশারা করে বলল,”আমার বাচ্চা! আমার সন্তান! আমার আমার… আমার বেবি…

কথা সম্পূর্ণ করার আগেই পা ভেঙে মেঝেতে পড়ে গেল। নুসরাত ইসরাতকে কিছু বলার পূর্বেই ধপাস করে শব্দ হলো। আরশ অতিরিক্ত শকে অজ্ঞান হওয়ার আগে উচ্চ শব্দে গুঙ্গিয়ে উঠল। বিড়বিড় করে বলল,”কাউকে ছাড়ব না! একটাকে ও না! আমার, আমার বাচ্চা…
নুসরাত পেট চেপে ধরে চিৎকার করে উঠল। ক্রিস্টেবেলা রাগী গলায় বলল,”এখানে এসব কি হচ্ছে? এটা ডেলিভারি রুম না অন্য কিছু! নার্স, নার্স মিসেস নুসরাতের হাজবেন্ডকে তাড়াতাড়ি এখান থেকে নিয়ে যান। উনি এই অবস্থায় সামনে থাকলে উনার টেনশন বেড়ে যেতে পারে।
ইসরাত হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল। নুসরাত পেট চেপে ধরে চিৎকার করে উঠল। ইসরাত কে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে বলল,”এটাকে এখান থেকে বের করুন! এই দুটো বাচ্চা জন্ম হওয়ার আগে যেন ডেলিভারি রুমে না আসে। যদি আসে তাহলে আমি এদের মাথা ফাটিয়ে ফেলব। শালা আমার বাচ্চা হচ্ছে না ওদের বাচ্চা হচ্ছে! আমি অজ্ঞান হওয়ার জায়গা শালা এসে অজ্ঞান হয়ে গেল। একটাকে ছাড়ব না আমি!
নুসরাত প্রসব ব্যথা আর চিৎকার করার জন্য হাপিয়ে উঠল। টেনে টেনে শ্বাস নিতে লাগলো।
একজন ছেলে নার্স এসে আরশকে তোলে নিয়ে গেল। ক্রিস্টেবেলা ইসরাত কে ডেলিভারি রুমের বাহিরে চলে যাওয়ার জন্য বললেন।

“কিন্তু ও একা….
” উনি যতেষ্ট স্ট্রং নিজেকে সামলাতে পারবেন। আপনি বাহিরে অপেক্ষা করুন। আপনার উপর রাগ করে উনার প্রেশার বেড়ে যেতে পারে।
ইসরাতের দুঃখি মুখ দেখে ক্রিস্টবেলা আশ্বাস দিয়ে বলল,
” কিছু হবে না! ঈশ্বরকে ডাকুন! ঈশ্বর সহায় হবেন অবশ্যই।
ইসরাতকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ক্রিস্টবেলা বাহিরে পাঠাতে চাইল কিন্তু ইসরাত জেদ ধরে দাঁড়িয়ে রইল এক জায়গায়। ক্রিস্টবেলা ডেলিভারি রুমে উপস্থিত নার্স দিয়ে একপ্রকার ঠেলে ডেলিভারি রুমের বাহিরে বের করে দিল ইসরাতকে।
ইসরাতের পেট চেপে ধরে যখন বাহিরে নিতে লাগলো নার্স তখন ইসরাত দুই হাত দু-দিকে মেলে চিৎকার করে উঠল,”নাআয়া, আমি যাবো না! আমি এখানেই থাকব।
নার্স কথা শুনল না। ইসরাতকে টেনে নিয়ে গিয়ে বাহিরে রেখে আসলো। ডেলিভারি রুমের ভিতর ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল ইসরাতের মুখের উপর।

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৬৭

ইসরাত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল চিন্তিত মুখ নিয়ে। জায়িন মাথা নিচু করে বসে রইল চেয়ারের মাঝে। একবার চোখ তুলে তাকাল ডেলিভারি রুমের দিকে আরেকবার তাকাল আরশকে যেই কেবিনে সিফট করা হয়েছে সেই কেবিনের দিকে। তারপর ইসরাতের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। তার ও ইচ্ছে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার জন্য। এতো টেনশন কি নেওয়া যায়?

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৬৭ (৩)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here