প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৮
জান্নাত নুসরাত
সকাল সকাল বাড়িতে রান্নার ধুম পড়েছে। আরশের নিউ বিজনেস পার্টনার দাওয়াত রক্ষাতে আজ আসছেন সৈয়দ বাড়িতে। লিপি বেগম সকাল থেকে খিটখিটে মেজাজ নিয়ে ঘুরছেন। কিছুক্ষণ চিৎকার চেচামেচি করার পর যখন দেখলেন কেউ তার কথা শুনছে না, নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত তখন তিনি নিজের রুমের দিকে গেলেন। রুমের দরজা ঠাস করে খুলে রুমে প্রবেশ করলেন। বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলেন হেলাল সাহেব চোখে চশমা এটে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে পড়ছেন নিশ্চিন্ত মনে। এটা দেখার পর লিপি বেগমের মাথা আরো বেশি গরম হয়ে গেল। তিনি মরছেন চিন্তায় আর এদিকে সবাইকে দেখ নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছে। রাগী মুখ নিয়ে বিছানার কাছে দাঁড়ালেন। হেলাল সাহেব একবার লিপি বেগমের দিকে তাকিয়ে আবার খবরের কাগজ পড়তে ব্যস্ত হলেন। লিপি বেগমের রাগ মাথায় চড়ে বসল। কেউ তার কথা শুনছে না। তাকে খেয়াল করছে না।বিছানার পাশের বক্সের উপর থেকে পানি ভর্তি গ্লাস নিয়ে পানি ফেলে দিলেন হেলাল সাহেবের উপর। বিছানা থেকে ধড়ফড় করে উঠে বসলেন হেলাল সাহেব।
“কি হয়েছে লিপি?
লিপি বেগম উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে তাকলেন হেলাল সাহেবের দিকে।হে লাল সাহেব ঘাবড়ে গেলেন। নিজ মনে ভাবলেন উনি আবার কি ভুল করলেন? কিছু মনে করতে পারলেন না। লিপি বেগমের দিকে তাকাতেই দেখলেন তার দিকে শান্ত হয়ে তাকিয়ে আছেন।
” এরকম ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছো কেন?
“……
” কি হয়েছে বলো?
লিপি বেগম অভিমানী গলায় বললেন,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
” কিছু না!
হেলাল সাহেব এক হাত দ্বারা লিপি বেগমকে জড়িয়ে ধরে পাশে বসালেন।
“কি হয়েছে বলো?
” কিছু না।
“আরে বলো কি হয়েছে? জায়ান কিছু করেছে?
“নাহ!
“তাহলে, জায়িন কিছু করেছে তাই না?
” না আপনার ছেলে আরশ করেছে। আজ মেহমান আসবে আপনার ছেলে গতকাল রাতে তো আমাকে জানাতে পারত। কিন্তু আপনার ছেলে আমাকে আজ জানাচ্ছে তার বিজনেস পার্টনার আসছে। এই ছেলের কোন কান্ডব জ্ঞান নেই। আপনার মতো হয়েছে একদম!
“তো এখন জানালে কি হয়েছে?
” আরে, আপনি বুঝতে পারছেন না কেন? রান্না হবে কখন? নাস্তা হবে কখন? আর খেতে দিব কখন?।দুপুরের খাবারের সময় হওয়ার আগে তো সবার খিদে পেয়ে যায়। আজ যদি দুপুরের খাবারের টাইমের আগে বলে খিদে পেয়েছে তখন দেখবে মজা। আর আপনাকে বলছি, কিছুক্ষণ পর এটা খাব ওটা খাব বলবেন না। তাহলে আজ আপনার একদিন নইলে আমার একদিন।
লিপি বেগম স্বামীর সাথে আরো কিছুক্ষণ চিৎকার চেচেমেচি করে রুমের বাহিরে আসলেন।
“এবার কিছুটা শান্তি শান্তি লাগছে। নিজ মনে বিড়বিড় করলেন লিপি। হেলাল সাহেব বিমূর নেত্রে তাকিয়ে থাকলেন তার সহধর্মিণী যাওয়ার পথে। এসেছিল আরশের কথা বিচার দিতে চলে গেল তাকে অপমান করে। মুখ দিয়ে বের হয়ে আসলো, ” আজব মেয়ে মানুষ।!
বাড়ির সামনে লাক্সারিয়াস একটি মার্সিডিজ এসে দাঁড়ালো। হর্ণের শব্দে দু তলা থেকে নেমে আসলো আরশ। দরজার সামনে গিয়ে দেখলো বাড়ির কর্তীরা ইতিমধ্যে সবাই এসে দাঁড়িয়ে আছে মেহমান কে নিয়ে আসার জন্য। ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে বাহিরে পা রাখলো এক রমণী। রমণীটি মার্সিডিজ থেকে নেমে কোর্টের বোতাম লাগালো। সাদা রং এর কোট, চোখে ডিওরের চশমা, ব্রাউন কালার সিল্কি চুল বাতাসে এলোমেলো উড়ছে রমণীর চুলগুলো । হাঁটার সাথে স্টিলেটো শব্দ করছে । নীরবতা ভেঙে আরশ বলল,”ওয়েলকাম মাই হুম মিস ডেলা! থ্যাংকস ফর কামিং।
” মেনশন নট মিস্টার।
বাড়ির কর্তীদের দিকে তাকিয়ে সালাম দিল ডেলা,”আসসালামু আলাইকুম।
“ওয়ালাইকুম আস্’সালাম। কেমন আছো?
” জি ভালো আছি। আপনারা কেমন আছেন?
“আলহামদুলিল্লাহ আমরা ভালো আছি।
রুহিনি বললেন,
” এখানে দাঁড়িয়ে সব কথা বলা শেষ করে ফেলবে। ভিতরে যাবে না!
নাজমিন বেগম বললেন,
“হ্যাঁ হ্যাঁ ভিতরে চলো। পরে গল্প করব! চলো মেয়ে চলো..
নাস্তা পরিবেশনের পর লিপি বেগম বললেন,
” নাও, মেয়ে খাওয়া শুরু করো! পরে গল্প হবে আগে খাওয়া শুরু করো।
“জি!
নাজমিন কাবাব এগিয়ে দিতে দিতে বললেন ,
” এটা খেয়ে দেখো। দারুণ খেতে…।
ডেলা বলল,
“না না আর খেটে পারব না আন্টি। আমার পেট পুরো ফুল হয়ে গিয়েছে।
নিচ তলায় শোরগোলের শব্দ শুনে রুম থেকে বের হলো জায়িন। কে এসেছে সেটা দেখার জন্য? সেই সময় দরজা খুলে ইসরাত বের হলো রুম থেকে পিছন থেকে নুসরাত বের হলো। জায়িন কে খেয়াল করেনি নুসরাত! হঠাৎ দরজার খোলার জন্য দরজার পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছিল জায়িন।
” সর বাল, মুখের সামনে থেকে।
ধাক্কা দিয়ে ইসরাতকে পাশে সড়িয়ে সিঁড়ি দিকে চলে গেল। পিছন ফিরে তাকালে দেখতে পেত ইসরাত কে ধাক্কা দেওয়ার জন্য সে জায়িনের উপর ধপাস করে গিয়ে পড়েছে।
নিচ তলার সদর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকছিল জায়ান।ঝড়ের গতিতে কেউ এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে,নিজের ব্যালেন্স ঠিক রাখতে না পেরে জায়ান মেঝেতে ধপাস করে পড়ল। তার উপর পড়ল জড়িয়ে ধরা ব্যাক্তিটি। মেঝেতে পড়ে একবার ব্যথা পেল জায়ান। আবার তার উপর কেউ পড়ার জন্য আরো একবার ব্যথা পেল কোমরে। মুখ দিয়ে বেড় হয়ে আসলো জায়ানের,”কোন বালরে? পড়ার আর জায়গা পাসনি? আমার উপর পড়তে হলো।
“নুসরাতের এই খামখেয়ালির জন্য আজ পরে গিয়ে মেয়েটা ব্যথা পেত।
নিজে নিজে বিড়বিড় করে এসে দু তলার সিড়ির রেলিং ধরে দাঁড়ালো জায়িন। নিচে একটা মেয়েকে কেন্দ্র করে বসে ছিল সবাই। মেয়েটা সিঁড়ির দিকে পিঠ করে বসেছিল তাই তার মুখ দেখা যাচ্ছিল না। সদর দরজা দিয়ে জায়ানকে ভিতর ঢুকতে দেখে মেয়েটা দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। জায়িনের মুখ থেকে “পড়ে যাবে বলার আগে জায়ানকে নিয়ে ধপাস করে পড়ল মেয়েটা। মেয়েটা যখন মেঝে থেকে উঠে কোর্ট ঝেড়ে পিছন ফিরে তাকালো তখন দু-তলা থেকে জায়িন মেয়েটার মুখ দেখে নিচে নামলো। পিছন থেকে এসে হালকা স্পর্শ করলো।
” ওয়াট আ সারপ্রাইজ ডেলা?
ডেলা নিজের পিছন থেকে চিনা পরিচিত মানুষের গলার আওয়াজ শুনে পেছন ফিরে তাকালো। যখন দেখলো মানবটি তার প্রিয় একজন ব্যক্তি। দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো জায়িনকে।
” জায়িন টুই এখানে টো এটা কে?
“এটা আমার জমজ ভাই জায়ান।
” এই জন্য বলি তুই আমাকে চিনটে পারছিস না কেন? এই জন্যই বলি ক্লিন সেভ করলি কখন? আর কি যেন বলল ছেলেটা? বব্বব্বব বা…
ডেলাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে জায়ান বলল,
“বলেছিলাম ভালো আছো তুমি?
“না না এটা টুমি বলনি আরো কি যেন বলেছিলে?
” না না এইটা বলেছিলাম। নুসরাত, আমি ভালো আছো এইটা বলেছিলাম না।
নুসরাত তব্ধুল খেয়ে তাকিয়ে তাকলো। ও কি জানে? ও তো এই মাত্র এখানে এসেছে। তবুও জায়ানের কথায় সায় দিয়ে হ্যাঁ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো।
“তুই এখানে? এখানে আসবি আমাকে আগে বললি না।
আরশের দিকে আঙুল তুলে ইশারা করে বলল,
” মিস্টার আরশের সাথে আমি নিউ ডিল সাইন করেছি।মিস্টার আরশ ইনভাইট করেছিলেন আমাকে আসার জন্য, এন্ড নাও আমি এখানে দাওয়াট রক্ষাটে।
“ওহ! আমার সাথে চল। তোর সাথে আমার অনেক কথা আছে।
জায়িন ডেলাকে নিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেল। লিপি বেগম চোখ মুখ কুঁচকে বসে রইলেন। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে এই বিষয় মোটে ও তিনি পছন্দ করেননি। একটা মেয়েকে নিয়ে তার ছেলে পার্সোনাল রুমে চলে যাচ্ছে। আর কেউ কিছু বলছে না! ছেলের ও তো দেখছেন কোনো কান্ডজ্ঞান নেই।
যেসকল নাস্তা পরিবেশন করা হয়েছিল ড্রয়িং রুমে সেগুলো নিয়ে কিচেনে রাখছিলেন নাজমিন। পিরিচে থেকে যাওয়া খাবার গুলো পাত্রে রাখছেন রুহিনি। আর ঝর্ণা সেগুলো পরিস্কার করে নিজ নিজ জায়গায় রাখছেন। ড্রয়িং রুম থেকে খাবার কিচেনে নেওয়া শেষ করে নাজমিন চলে গেলেন। কিচেনে রয়ে গেলেন রুহিনি ও ঝর্ণা।
ঝর্ণা বললেন,
“দেখেছ রুহিনি উনার ছেলে একটা মেয়ে নিয়ে রুমে চলে গেল এই বিষয়ে কিছুই বললেন না। আর আমাদের ছেলে মেয়েরা একটু জোরে কথা বললে এসে দোষ ধরতে শুরু করেন। নিজেদের সন্তান ঠিক নেই আর অন্যের সন্তানের পিছনে পড়ে থাকেন।
রুহিনি বলল,
“আচ্ছ বাদ দাও এসব আপা। এসব বলে তো আর কিছু হবে না। যার যা ইচ্ছা করুক। আমাদের কি?
কাজের মেয়ে রহিমা এসে তখন কিচেনে ঢুকল।
“সেজ আম্মা বড় ভাই কইছে কাউরে দিয়া যাইতে তার রুমে কাফি ফাটানোর জইন্যে।
ঝর্ণা বলল,
” আচ্ছা তুই এখন যা আম্মার কাছে! আমি পাঠিয়ে দিব কাউকে দিয়ে।
রুহিনি বলল,
“আপা আমি বসিয়ে দেই কফি। তুমি বাটিগুলো পরিস্কার করে নাও।
ঝর্ণা বলল,
“আমাদের কাজের বেডি পাইছে তারা। একজন পরে একজন শুধু ওডার দিতেই আছে।
রুহিনি বলল,
“আচ্ছা বাদ দাও!
কিচেনের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল নুসরাত ও ইসরাত। হঠাৎ ভিতর থেকে ফুসুর ফুসুর শুনে কিচেনের দরজার পিছনে দাঁড়িয়ে গেল নুসরাত। ইসরাত কিছু জায়গা হেঁটে যাওয়ার পর যখন দেখলো নুসরাত তার সাথে নেই সে ফিরে আসলো আবার পিছনের দিকে। ইসরাত দেখলো নুসরাত কিচেনের দরজার পিছনে লুকিয়ে কি যেন করছে? হালকা করে পিছন থেকে স্পর্শ করতেই মেয়েটা কেঁপে উঠলো। মনে হচ্ছে চুরি করতে এসে ধরা পড়ে গিয়েছে এরকম মুখ বানিয়েছে।
” কি করছিস এখানে?
নুসরাত হাত দিয়ে আস্তে আস্তে কথা বলার জন্য ইশারা করলো। ইসরাত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে তাকলো নুসরাতের দিকে। ইশারা করলো কেন আস্তে কথা বলবে?
নুসরাত ফিসফিস করে বলল,
“ওই দেখ, এই মহিলারা আবার চুগলি করছে। এদের কি আর কোনো কাজ নেই? সারাদিন চুগলি করা ছাড়া।
“তাই তুই লুকিয়ে লুকিয়ে মানুষের কথা শুনবি? ইটস আ বেড হেভিট। মানুষের কথা লুকিয়ে শুনতে নেই।
” চুপ কর বেডি! আমি তো শুনব।হুহ…
প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৭
বলে চুল উড়িয়ে চলে গেল নুসরাত। ইসরাত ওখানে দাঁড়িয়ে রইলো। মেয়েটা তার কথা শুনলো না। হঠাৎ করে মনে হলো তারা কি যেন একটা কাজ করতে যাচ্ছিল? ব্রেইন কেচ করল নুসরাত তো চলে যাচ্ছে। এই মেয়ে যদি একবার বিছানায় শুয়ে পড়ে তাহলে সেখান থেকে তোলা মুশকিল হয়ে পড়বে। পিছন থেকে চিৎকার করে ডাকলো ইসরাত,”এই মেয়ে এইইইইইই…..