প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১
জান্নাত নুসরাত
গ্রীষ্মের দাপদাহে শহুরে জীবন বিবর্ণ। হঠাৎ কাল বৈশাখী ঝড় আসার আগে যেমন আকাশ কালো মেঘে গুমোট হয়ে যায় তেমনি গুমোট হয়ে গেল। সাদা পাঞ্জাবি, আর কালোর মধ্যে সাদা চেক বিশিষ্ট লুঙ্গি পরিহিত পৌঢ় লোকটি চোখ তুলে একবার আকাশ পাণে তাকালেন। হঠাৎ করে পরিবেশ গুমোট হওয়ার কারণ সে ধরতে পারলেন না।
শহুরে অঞ্চল হওয়ায় এখানে বিদুৎ চলে আসছে অনেক আগে। রাস্তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ইলিট্রিক খুঁটিগুলো সদর্পে। পৌঢ় লোকটি বিদ্যুতের খুঁটির দিকে তাকিয়ে শব্দ করে শ্বাস ফেললেন। তার বাড়িতে কিংবা তার গ্রামে এখনো বিদুতের খুঁটি পর্যন্ত যায়নি, তাই এই গরমের দিনে তাকে আর তার পরিবারকে অনেক দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পৌঢ় লোকটির চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটল কোথাও মট করে গাছের মগডাল ভাঙার আওয়াজে।
ঝড় আসার আগে আকাশে মেঘ গুরুম গুরুম শব্দে ডেকে উঠল। পরপর বাতাস শুরু হলো। বাতাসের বেগে গাছের মগডাল ভেঙে পড়ছে দূর ওই মাঠে। আর তার সাথে পৌঢ় লুকটির লুঙ্গি বাতাসে উড়তে লাগল। লুঙ্গি উড়তে উড়তে সেটা উঠে গেল হাঁটুর কিছুটা উপরে। লুঙ্গি চেপে ধরে পৌঢ় লোকটি আশ-পাশ একবার ভীত চোখ বুলিয়ে নিলেন। যখন দেখলেন কেউ নেই, ঢোক গিলে ভয় হজম করে, লুঙ্গি সামলে হাঁটা ধরলেন সামনের দিকে। কপালে তার বিরক্তির ভাঁজ। গরমের কারণে বাড়ি থেকে বের হতে চাচ্ছিলেন না, গ্রামের তুলনায় শহরে গরম বেশি তাই তিনি এই জায়গায় আসতে একটু দেনামোনা করছিলেন। যখন সৈয়দ বাড়ির সবার বড় কর্তা এবং সোসাইটির মধ্যে সবচেয়ে শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি সৈয়দ আজমাল আলী নিজের ছোট ছেলে সৈয়দ সোহেদ আহমদকে দুপুরে পাঠালেন একটি চিঠি দিয়ে তখন তাকে না চাইতে রাজী হতে হলো। চিঠি বললে ভুল হবে একপ্রকার হুমকি! সেই হুমকির ভয়ে পৌঢ় লোকটি আর চেয়ে না করতে পারেননি, মিনমিন করে সোহেদকে জানিয়ে দিলেন সময় মতো পৌঁছে যাবেন সৈয়দ বাড়িতে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে গালি দিলেন সৈয়দ বাড়ির সবাইকে। গালি দেওয়ার পরপর আবার চোখ বুলিয়ে নিলেন, ভালো করে দেখলেন কোনো মানুষ আশে-পাশে আছে কিনা! যখন নিশ্চিত হলেন নেই আরো দুটো গালি দিয়ে দিলেন আজমল আলীকে।
পৌঢ় লোকটি ধীর পায়ে হাঁটায় সৈয়দ বাড়ির মেইন ফটকের সামনে পৌঁছাতেই শুরু হলো ধুলো ঝড় সাথে উত্তাল-পাত্তাল বাতাস। একহাত দিয়ে নিজের লুঙ্গি হাঁটুর কাছে চেপে ধরে, অন্যহাত দিয়ে মাথা ঢেকে দৌড়ে গিয়ে প্রবেশ করলেন দু-তলা বিশিষ্ট সৈয়দ বাড়িতে।
ভিতরে প্রবেশ করতেই সৈয়দ বাড়ির সকলের দৃষ্টি পৌঢ় লোকটির দিকে স্থির হলো। লোকটি মৃদু হাসার চেষ্টা করে সোফায় বসা আজমল আলীর উদ্দেশ্যে সালাম দিলেন,”স্লাম-আলাইকুম!
সামনে বসা আজমল আলীর রুঢ় গলার আওয়াজ ভেসে আসলো। বয়সের ভারে শরীর নরম হয়ে আসলে ও সৈয়দ বাড়ির বড় কর্তা হিসেবে গলার স্বর যতেষ্ট রুঢ় ও স্পষ্ট। পৌঢ় লোকটিকে তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করে বললেন,”স্লাম-আলাইকুম কি? সুন্দর করে সালাম করো—বলো আস-সালামু আলাইকুম।
পৌঢ় লোকটি কথা বাড়ালেন না। চোখ নিচের দিকে মার্বেল টাইলসে স্থির রেখে দ্বিতীয়-বারের মতো সালাম দিলেন। এবার আজমল আলীর উত্তর ভেসে আসলো ওয়ালাইকুমুস-সালাম বলে। অতঃপর রাশভারী কন্ঠে বললেন,”বসো।
বিনীত স্বরে বললেন নাকি আদেশ দিয়ে বললেন পৌঢ় লোকটি ঠিক বুঝলেন না। চুপচাপ গিয়ে সামনের একটি সোফায় বসলেন। চোখ তুলে সামনে তাকাতেই চোখের মণির মধ্যে আবদ্ধ হলেন সৈয়দ বাড়ির বড় পুত্র সৈয়দ হেলাল আহমদ। তার পাশে চুপচাপ মাথায় ওড়না টেনে বসে আছেন তার স্ত্রী লিপি খান। উনার পাশেই চুপচাপ বসে আছে তাদের দু-পুত্র। বড় ছেলে সৈয়দ জায়িন হেলাল ও ছোট ছেলে সৈয়দ আরশ হেলাল। দুজনের মুখ থমথমে। বড়জনের বয়স চৌদ্দ এবং ছোট জনের বয়স বারো।
হেলাল সাহেবের ঠিক সামনে বরাবর বসে আছেন এ বাড়ির দ্বিতীয় পুত্র যাকে হাড় কিপটে বলে চেনা যায়, তার নাম সৈয়দ নাছির উদ্দিন। উনার পাশ ঘেঁষে বসে গম্ভীর মুখ বানিয়ে আছেন উনার স্ত্রী নাজমিন চৌধুরী। এই দম্পতির দু-কন্যা। বড় কন্যা সৈয়দা ইসরাত নাছির এবং ছোটো কন্যা সৈয়দা নুসরাত নাছির। বড় মেয়ের বয়স সাড়ে আট বছর আর ছোট মেয়ের বয়স সাত বছর। আল্লাহর রহমতে উনার একার দু-মেয়ে, আর কারোর মেয়ে নেই। ছেলে না থাকার কোনো দুঃখ নেই, কারণ উনি উনার দু-মেয়েকে এই ছোট জীবনে ছেলেদের মতো ট্রিট করে বড় করছেন। সৈয়দ বাড়িতে আর মেয়ে না থাকার কারণে, আজমল আলীর কাছে একটু বেশি আদরের এই দু-বোন।
মাঝ বরাবর সোফায় বসে আছেন সৈয়দ বাড়ির তৃতীয় পুত্র সৈয়দ শোহেব আহমদ। যার পাশ ঘেঁষেই বসে আছেন উনার স্ত্রী ঝর্ণা বেগম, ও এক সন্তান। সেই সন্তানের নাম সৈয়দ ইরহাম শোহেব। যার বয়স সাত!
ঝর্ণা পাশ ঘেঁষে বসে আছেন রুহিনী। সৈয়দ বাড়ির ছোট সদস্য সৈয়দ সোহেদ আহমদ এর সহধর্মিণী তিনি। যার এক সন্তান সৈয়দ আহান নাওফিল। বয়স মাত্র দুই।
ড্রয়িং রুম জুড়ে বসা সবার মুখ একবার করে দেখে নিলেন পৌঢ়। সৈয়দ হেলাল আহমদ ছাড়া সবার ভাবগতি ভালো কিন্তু উনার মুখে ভেসে উঠছে স্পষ্ট বিতৃষ্ণা। এই বিতৃষ্ণা কীসের জন্য তার কারণ আঁচ করতে ব্যর্থ হলেন পৌঢ় লোকটি!
কাশির শব্দে চোখ ফিরিয়ে তাকালেন সামনে বসা আজমল আলীর পাশে বসা মেহেরুন নেছা মায়ার দিকে। আজমল আলীর স্ত্রী, যার কথা ছাড়া সৈয়দ বাড়ির রান্না ঘরের একটা মশলার কৌটা এদিক-ওদিক হয় না।
আজমল আলী স্ত্রীকে কাঁশতে দেখে হাত বাড়িয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। স্ত্রীকে মোলায়েম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,”মায়া কি হয়েছে?
বড় শখের নারী মেহেরুন নেছা উনার। যৌবন কালে অত্যাধিক সুন্দরী হওয়ার ধরুণ অনেক পুরুষের রাতের ঘুম হারাম হওয়ার কারণ ছিলেন মেহেরুন নেছা নামক এই রমণী। আর এই অত্যাধিক সৌন্দর্যের কারণে আজমল আলী সেই যে ঊনিশ দশকে আটকে ছিলেন মায়াতে আর এখনো আটকে। বয়স বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে হাতের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে কিন্তু সৌন্দর্য আগের তুলনায় একরত্তি ও কমেনি। তার এই সৌন্দর্যে ভাগ নিয়েছে সৈয়দ বাড়ির বড় কন্যা ইসরাত। মেয়েটা যেমন সুন্দরী তেমনি স্বাস্থ্য ভালো। কিছুটা গুলুমুলু টাইপ। মুখের ধরণটা ও মেহেরুন নেছার মতো হওয়ার ধরুণ সবথেকে বেশি আদর পায় সে মেহেরুন নেছার কাছ থেকে।
আজমল আলীর দিকে তাকিয়ে মেহেরুন নেছা ঠোঁট এলিয়ে হেসে দু-পাশে মাথা নাড়ালেন কোনো সমস্যা নেই বলে। আজমালী এবার নিজের দৃষ্টি স্থির করলেন পৌঢ় লোকটির দিকে। রাশভারী গলায় জিজ্ঞেস করলেন,”জানো তুমি, তোমাকে এখানে কেন ডাকা হয়েছে?
পৌঢ় লোকটি উপর নিচ মাথা নাড়ালেন। আজমল আলী কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললেন,”আরেকবার প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে মুখ দিয়ে কথা বলবে,তুমি বোবা নও যে মাথা উপর নিচ দোলাচ্ছ।
পৌঢ় লোকটি ধমক খেয়ে মিনমিন করে আওড়ালেন,
“ঠিক আছে।
আজমল আলী শব্দ করে শ্বাস ফেললেন। বড় ছেলের দিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিলেন মুখের ভাবগতি। তিনি মুখ দেখে খুব ভালো করে পড়ে নিতে পারেন মানুষের মনের কথা। ছেলের মনে এখন কি চলছে তা ও খুব সহজে ধরে নিতে পারলেন। ঠোঁটের কোণ বেয়ে বয়ে গেলে মৃদু হাসির ফোয়ারা। যা কেউ দেখার আগেই বিলীন হয়ে গেল।
নাছির সাহেবের দিকে চোখ ফিরিয়ে তাকাতেই দেখলেন তিনি নিচের দিকে তাকিয়ে খুশিতে গদগদ করছেন। নিজের মেয়েগুলোকে নিজের কাছে রাখার সুযোগ তিনি কোনো ভাবে মিস করবেন না, তাই বড় ভাইয়ের সাথে মনমালিন্য হলে ও তিনি এতে খুশি। অনেক সময় ভালো কিছু পেতে হলে বড়-ছোট জিনিস কোরবানি দিতে হয়। আর এই কোরবানি দিতে তিনি এক পায়ে রাজী।
আজমল আলী নাছির সাহেবের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। পৌঢ় লোকটির দিকে দৃষ্টি জ্ঞাপন করলেন। এবং শান্ত গলায় বললেন,” ইমাম বিয়ে পড়ানো শুরু করুন। বড় মেয়ে সৈয়দা ইসরাত নাছিরের সাথে বড় ছেলে সৈয়দ জায়িন হেলালের বিয়ে হবে। এবং ছোট মেয়ে নুসরাত নাছিরের সাথে আরশ হেলালের বিয়ে হবে।
ইমাম সাহেব জি আচ্ছা বললেন। মোটা ফ্রেমের জানালার ওপাশ থেকে বৃষ্টির ফোটা এসে ঘরের ভিতর পড়ছে। ঝনঝন করে বৃষ্টি পড়ার শব্দের সাথে ইমাম সাহেব শব্দ তুলে বিয়ে পড়াতে শুরু করলেন।
“সৈয়দ নাছির উদ্দিনের বড় কন্যা সৈয়দা ইসরাত নাছিরের সাথে নগদ দশ লক্ষ টাকা দেনমোহর, এক বিঘা জমি ও বিশ তুলো সোনা ধার্য করিয়া তুমি কি ইসরাত নাছিরকে বিয়ে করতে রাজী আছো। রাজী তাকিলে বলো বাবা কবুল।
জায়িন মুখ বন্ধ করে বসে রইল চুপচাপ। ইমাম সাহেব আবার জিজ্ঞেস করলেন, এবার ও চুপ। আজমল আলী গলা খাঁকারি দিয়ে জায়িনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। মোলায়েম কন্ঠে বললেন,” দাদা বলছ না কেন? তোমার কি কোনো সমস্যা আছে বা কিছু বলতে চাও?
জায়িন মনে হয় এই প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিল এতক্ষণ। কাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন আজমল আলী জিজ্ঞেস করতেই পুরুষালি ভারী গলায় বলল,”কাবিন নামায় আরো একটা জিনিস এড করাব দাদা।
আজমল আলীকে উদ্বিগ্ন হতে দেখা গেল না। তিনি নরম চোখে নাতির দিকে চেয়ে থেকে বললেন,”কি দাদা?
জায়িন অন্তরভেদী চাউনি ইসরাতের দিকে স্থির করল। বুদ্ধিদীপ্ত মাঝারি আকারের লম্বা লম্বা পাপড়ি বিশিষ্ট চোখগুলো এতক্ষণ স্থির ছিল মার্বেল টাইলসে। ইসরাত এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করল না। নখ মুখে ঢুকিয়ে দাঁত দিয়ে কামড়াতে লাগল। সকলের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রাশভারী গলায় জায়িন বলল,”কাবিন নামায় লিখুন সোনা, জমি, দেনমোহর ছাড়া ও আমাকে। কখনো যদি ইসরাত আমাকে ডিভোর্স দিতে চায়, বা পারিবারিক যাতাকলে পড়ে কোনো কারণে বিয়েটা অস্বীকার করতে চায় তাহলে যেন আমাকে ওর পিছ ছাড়াতে না পারে। দেনমোহরের জায়গায় আমার নাম লিখুন। আজ থেকে এই আমাকে ইসরাতের নামে আমি লিখে দিলাম এই কাবিন নামায়। যাতে ভবিষ্যতে ডিভোর্স দেওয়ার হলে দেনমোহর হিসেবে আমি আবার নিজেকে ওকে দিতে পারি।
আজমল আলী প্রসন্ন হাসলেন। কাছে ডেকে জায়িনের কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো হাত বুলিয়ে দিলেন। মৃদু কন্ঠে বললেন,”বাপের মতো গাধা হোসনি এটাই অনেক। তুই এই বয়সে এতো বুঝদার আর তোর বাপ বুড়ো হয়ে গেল তারপর ও মাথায় গোবর ঠাসা।
জায়িন কথা আর বাড়াল না। ইমাম সাহেব আবার প্রথম থেকে বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন।
“সৈয়দ নাছির উদ্দিনের বড় কন্যা সৈয়দা ইসরাত নাছিরকে নগদ দশ লক্ষ টাকা দেনমোহর, এক বিঘা জমি , বিশ তুলো সোনা, ও স্বয়ং নিজেকে দিয়ে আপনি কি এই বিয়ে করতে রাজী আছেন? রাজী থাকিলে বলো আলহামদুলিল্লাহ কবুল!
জায়িন এক কাল বিলম্ব করল না। রাশভারী গলায় বলে উঠল,”আলহামদুলিল্লাহ কবুল।
এবার ইমাম সাহেব ইসরাতের দিকে এগিয়ে গেলেন। যে এতক্ষণ বসে নখ খুঁটছিল আর এখন আঙ্গুর খাচ্ছে। নাছির সাহেব মেয়েকে মাথায় ওড়না টেনে বসতে বলতেই সে ওড়না টেনে বসল। মার্বেল আকৃতির গুলগুল চোখ করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সামনে বসা পৌঢ় লোকটির দিকে। নাছির সাহেব বললেন,”চোখ নিচের দিকে নামাও ইসরাত!
বাবার আদেশ পেতেই ইসরাত চোখ নামিয়ে নিল নিচের দিকে। ইমাম সাহেব বিয়ে পড়াতে যাবেন, নাছির সাহেব থামিয়ে দিলেন। ভাঙা গলায় বললেন,”আমি বিয়ে পড়াব আমার মেয়ের।
সবাই রাজী হয়ে গেল। ইমাম সাহেব সরে গেলেন, জায়গা করে দিলেন নাছির সাহেবকে বসার। নাছির সাহেব এবার গমগমে স্বর তুলে বললেন,” সৈয়দ হেলাল আহমদ এর বড় পুত্র সৈয়দ জায়িন হেলাল নগদ দশ লক্ষ টাকা, এক বিঘা জমি, বিশ তুলো সোনা ও স্বয়ং জায়িনকে দেনমোহর হিসেবে ধার্য করিয়া তোমাকে আমি তার কাছে সপিয়া দিলাম। তুমি এই বিয়েতে রাজী থাকিলে স্ব-ইচ্ছে বলো আলহামদুলিল্লাহ কবুল।
ইসরাত মায়ের দিকে তাকাতেই মাথা নাড়ালেন উপর নিচ কবুল বলে দেওয়ার জন্য। চোখ ফিরিয়ে নাছির সাহেবের দিকে তাকাতেই দেখল বাবার চোখ খুশিতে টলমল করছে। মৃদু গলায় নাছির সাহেব আবার বললেন,”রাজী থাকিলে বলো কবুল।
ইসরাত আঙ্গুর মুখের ভিতর ঢুকিয়ে আরাম করে চাবাতে লাগল। জায়িনের দিকে তাকাতেই দেখল সে কড়মড় দৃষ্টিতে তাকেই উপর থেকে নিচে পরিদর্শন করছে। আরাম করে বসে ইসরাত বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ কবুল।
সৈয়দ বাড়ির সবাই হাপ ছেড়ে বাঁচলেন। এবার আরশের দিকে এগিয়ে গেলেন ইমাম সাহেব। বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। শেষে বললেন রাজী থাকিলে বলো বাবা কবুল। আরশ মাথার নিচে হাত ঢুকিয়ে আরাম করে বসল। ত্যাড়া গলায় বলল,”কবুল না বললে কোনো সমস্যা?
আজমল আলী রাগী চোখে তাকালেন আরশের দিকে। হেলাল সাহেবের দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখলেন তার চোখে বিয়ে হবে না ভেবে আশার আলো জ্বলে উঠেছে। একজনের বিয়ে হলে কি হবে, যাক আরেকজন বেঁচে গেছে! আজমল আলী ছেলে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রুঢ় গলায় আরশকে বললেন,”না বললে বিয়ে হবে না দাদা।
আরশ হাসল। চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করে ঠোঁট টিপল। তারপর আজমল আলীর দিকে তাকিয়ে ব্যাঙ্গাতক গলায় আবার বলল, “কবুল না বললে কেন বিয়ে হবে না?
আজমল আলী যথাসম্ভব নিজের ক্রোধ সামলে বললেন,”হয়না বলেই হয়না!
“কবুল আমাকে বলতেই হবে?
আজমল আলী এবার বেশ শব্দ করে চোখ থেকে ছোটো লেন্সের চশমা খুলে সেন্টার টেবিলে রাখলেন। রাগী স্বরে নাছিরকে বললেন,”বলেছে ছেলেটা তিনবার কবুল এবার তুই দাদুনকে বিয়ে পড়া।
আরশ মনে মনে শয়তানি হাসি হাসল। বাবার মুখের দিকে তাকাতেই দেখল এতক্ষণ পরিতৃপ্তি নিয়ে হাসা মুখটা পাংশুটে বর্ণ ধারণ করেছে। আরশের দিকে দৃষ্টি স্থির হতেই পিঠে হাত বুলিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। আরশ ও সম-পরিমাণ ব্যথিত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিন্তু নিজ মনে ঠিকই বিড়বিড় করএ আওড়াল, “আলহামদুলিল্লাহ কবুল।
নুসরাতের পালা এলো যখন নাছির সাহেব কিছু বলার আগেই নুসরাত চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, “আলহামদুলিল্লাহ কবুল, কবুল, কবুল কবুল।
ড্রয়িং রুমে মুখ গম্ভীর করে বসা আজমল আলী শব্দ করে হেসে উঠলেন এই পর্যায়ে। নুসরাত আর ইসরাতকে নিজের দু-পাশে বসিয়ে আদর করে দিলেন। জায়িন আর আরশকে ও করে দিলেন। সবার শেষে ইরহামের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,”তুই রাগ করিস না, আরেকটা মেয়ে থাকলে তোর সাথে বিয়ে দিয়ে দিতাম।
কথাটা শেষ করে উচ্চ শব্দে হাসলেন। বাবার সাথে তাল মিলিয়ে হাসলেন ছোট তিন পুত্র। কিন্তু বড় পুত্রের মুখে অমাবস্যার মতো অন্ধকার নেমে আছে। ঠোঁটে নেই এক চিলত হাসি। আজমল আলী আর ফিরে তাকালেন না হেলাল সাহেবের দিকে। রাগ করলে করুক গে, তিনি ও তার জেদ নিয়ে অটুট। বাবা ভাইয়ের এই নীরব স্নায়ু যুদ্ধ পরিবারের সবাই চুপচাপ দেখল। কেউ টু শব্দ করল না। আজমল আলী যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আজ পর্যন্ত তার কোনো খারাপ দিক বের হয়নি তাই এবার ও চোখ বন্ধ করে সবাই আজমল আলীর উপর বিশ্বাস রাখছেন। সবার মধ্যে বেঁকে বসেছেন হেলাল সাহেব। বাবার এই সিদ্ধান্ত তিনি মেনে নিতে পারছেন না। পরিবারের ভিতরে বিয়ে তিনি কোনো কালে চাননি আর তার বাবাই ভাইয়ের মেয়ের সাথে তার ছেলে দুটোর বিয়ে দিয়ে দিলেন।
নিজের অভিমান চেপে উঠে দাঁড়ালেন। এতক্ষণ অনেক কষ্ট করে এখানে বসে ছিলেন আর পারবেন না তিনি, অসাড় পা বাড়ালেন নিজ রুমের দিকে। পিছনে রেখে গেলেন বিষন্ন হয়ে বসে থাকা আজমল আলীকে। জোর করে বিয়ে দিয়ে এবার আজমল আলী নিজেই একটু দ্বিধায় ভুগছেন। পিঠে মেয়েলি হাতের স্পর্শ পেতেই আজমল আলী পিছু ফিরলেন। নাজমিন বেগম ও লিপি বেগম হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। দুইজন পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে নিচু গলায় বললেন,”আব্বা সব ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করবেন না।
মাগরিবের আজান দিতেই সবাই যে-যার রুমে ফিরে গেল। ড্রয়িং রুমে একা বসে রইলেন নাছির সাহেব, নুসরাত ও ইসরাত। বাহিরে তখনো ঝুমঝুম শব্দ তুলে বৃষ্টি পড়ছে। মোমবাতি দুটো সেন্টার টেবিলে রাখা। বিদুৎ সংযোগহীন হয়েছে অনেকক্ষণ। হেলাল সাহেবের রুম থেকে আসছে একাধিক আল্লাহু-আকবার বলার ধ্বনি।
মনোযোগ ফিরিয়ে এনে নাছির সাহেব সামনের সোফায় তাকাতেই দেখলেন নুসরাত এক পা সোফার হাতলে রেখেছে আরেক পা তুলে রেখেছে সোফার উপরের ফমের উপর। আরাম করে শুয়ে কান খুঁচাচ্ছে।
ইসরাত উনার পাশে বসে মৃদু স্বরে অজিফা পড়ছে। নাছির সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। খুশি মনে হাক ছুঁড়লেন নাজমিন বেগমের উদ্দেশ্যে,”ও নাজমিন, এই বৃষ্টির দিনে গরম গরম কোনো কিছু তৈরি করো।
রান্না ঘর থেকে নাজমিন বেগম প্রতিউত্তর করলেন হালকা গলায়,”অপেক্ষা করুন!
এরপর আর কোনো হাক আসলো না নাছির সাহেবের কাছ থেকে। নাজমিন বেগম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ডাল পিষতে শুরু করলেন পাটার মধ্যে।
ঝর্ণা মাংস ছোট ছোট করে কেটে রাখলেন একটা বাটিতে। রান্না ঘরে চার জন রমণী থাকা সত্ত্বেও আজ কোনো টু শব্দ নেই। এতো নিস্তব্ধতা রুহিনী মেনে নিতে পারলেন না। নিজেই আগ বাড়িয়ে জা-দের সাথে কথা তুললেন বিয়ে বিষয়ক। জিজ্ঞাসু গলায় লিপি বেগমকে বললেন,”বড় আপা!
লিপি বেগম মশলা তৈরি করছিলেন। রুহিনীর ডাকে কেঁপে উঠলেন। হকচকিয়ে গিয়ে বললেন,”হু!
এবার রুহিনী গলায় খাঁদে নামিয়ে নিলেন। নম্রতা বজায় রেখে জিজ্ঞেস করলেন,”বড় আপা বড় ভাইয়া বিয়েতে মত দিলেন না কেন?
লিপি বেগমের হাত থেমে গেল। উদাস দৃষ্টি জা-য়ের দিকে দিয়ে বললেন,”পরিবারে নাকি ভাঙন ধরবে এতে! ভাঙন ধরার হলে তো এমনি ধরত,এতদিনে তাই নারে মেজ।
নাজমিনের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে লিপি বেগম তাকিয়ে রইলেন চুপচাপ। লিপি বেগমের প্রশ্নের উত্তর ঝটপট দিলেন নাজমিন বেগম।
“জি আপা।
রুহিনী কিছু বুঝলেন না, সব তার মাথার দু-হাত উপর দিয়ে গেল। ঝর্ণা বেগম মাংস কাটা হাত নিয়ে কপালে রাখলেন। রুহিনী বেগমকে বকা দিয়ে বললেন, “বোকাটা এখনো বুঝেনি, বড় আপা বুঝিয়ে বলো।
লিপি বেগম মাটির উনুনে পাতিল বসিয়ে হাসলেন। ঝর্ণা বেগমকে হালকা ধমক দিয়ে বললেন,”তুই ওকে ধমকাচ্ছিস কেন রে সেজ? দাড়া আমি তোকে খুলে বলছি সবকিছু।
রুহিনী বেগম ঝর্ণা বেগমের ধমক খেয়ে মুখ চুপসে গিয়েছিল, যখন লিপি বেগম ঝর্ণা বেগমকে ধমকে তাকে বুঝিয়ে বলার কথা বললেন, তখন আবার ঠোঁটে এসে ভীর করল হাসি। ঝর্ণা বেগম আর নাজমিন বেগম সেটা খেয়াল করে হালকা হাসলেন।
লিপি বেগম এবার বলতে শুরু করলেন,
“গতকাল রাতে পাঠাগারে গোপন বৈঠক বসেছিল না, বাড়ির পুরুষদের নিয়ে। সেখানে আব্বা জায়িন ইসরাতের বিয়ের কথা তোলেন।
রুহিনী কথা থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” শুধু কি জায়িন ইসরাতের?
এবার নাজমিন বেগম মৃদু স্বরে বললেন
“হু!
রুহিনী অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
“তাহলে নুসরাত আর আরশ কোথা থেকে এড হলো এখানে!
রুহিনীর গলা থেকে বিস্ময় ঝড়ে পড়ছে। গুলগুল চোখে চেয়ে আছেন বড় জা-দের দিকে। তার এরকম বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন আর গোল গোল চাউনি দেখে বড় জা-য়েরা উচ্চ শব্দে হেসে উঠলেন। ঝর্ণা বেগম পারেন তো এখানে গড়াগড়ি খেয়ে হাসতেন। রুহিনী গাল ফোলালেন। দু-বছরের বাচ্চার মা হয়ে ও এখনো আঠারো এর সেই কিশোরীদের মতো গাল ফোলান তিনি। আরেক দফা জা-য়েরা তাকে নিয়ে হেসে গড়াগড়ি খেল। এবার বেজায় চটে গেলেন রুহিনী তিন জা-য়ের উপর। রাগী গলায় বললেন,” আপা তোমরা জুট বেঁধে আমাকে নিয়ে হাসছ! একদিন আমার ও দিন আসবে, সেদিন তোমাদের নিয়ে আমি ও হাসব।
লিপি বেগম মিছি মিছি চোখ বড় বড় করে দু-জায়ের দিকে তাকালেন। রুহিনীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,”এই নাজমিন, ঝর্ণা হাসছিস কেন ওকে নিয়ে। দুটোকে ধরে লাগাব না..
ঝর্ণা বেগম আর নাজমিন বেগম এতক্ষণ পেটে চেপে রাখা হাসি ফুস করে ছেড়ে দিলেন। দু-জনের হাসি দেখে লিপি বেগম ও হেসে দিলেন। পরপর রুহিনী উচ্চ শব্দে হেসে দিলেন। চারজন রমণী কোনো কারণ ছাড়া নিজেদের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পরপর হাসলেন।
চোখের কোণে পানি জমা হওয়ায় লিপি বেগম চোখ মুছে নিলের হাতের তালু দিয়ে। হাসি কোনো রকম চেপে বললেন,”আর হাসাবি না আমায়, খবরদার!
লিপি বেগমের চোখ রাঙানি দেখে নাজমিন বেগম হু হা করে হেসে উঠলেন। চোখ হাঁটুতে চেপে ধরে বললেন,”আপা কিছুক্ষণ আমরা কেউ কারোর দিকে তাকাব না, তাহলে হাসি একটু হলে ও কমবে।
হাসির চোটে নাজমিন বেগমের কথা গুলো এবড়ো-থেবড়ো হয়ে আসলো। সবাই মেনে নিলেন, তারপর যে-যার কাজ গুছাতে লাগলেন। চারজনের এক জা ও কারোর দিকে ফিরে তাকালেন না কিছুক্ষণ। লিপি বেগম পাতিলে তৈল দিয়ে ডালের ভরা ভাজতে ভাজতে রুহিনীর উদ্দেশ্যে বললেন, “শোন ছোটো! তো আব্বা শুধু দু-জনের বিয়ের কথা তুললেন, কিন্তু উনি বেঁকে বসলেন। মেজ ভাই আব্বা কথা শেষ করার আগেই খুশিতে হইহই করে উঠলেন। মেজ ভাইয়ের খুশির কারণ তো তুই বুঝতে পারছিস। তার মেয়ে তার কাছে থাকবে এটাই বড় ব্যাপার।
ইসরাতের জন্মের পরেই মেজ ভাই বলেছিলেন মেয়ের বিয়ে দিবেন না তিনি। আর এই প্রস্তাব পাওয়ার পর হাতে জিলাপি পাওয়ার মতো খুশি হয়েছিলেন। আমার উনাকে বেঁকে বসতে দেখে আব্বা কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন। জিজ্ঞেস করলেন কেন বেঁকে বসেছেন। যুতসই কোনো কারণ দেখাতে পারলেন না। তোরা তো জানিস আব্বা কী-রকম লোক! উনার কাছ থেকে যুক্তিসঙ্গত উত্তর না পেয়ে ত্যাড়া গলায় বললেন তুমি কোনো যুতসই উত্তর দিতে পারলেন না হেলাল, তাই তোমার এই বেঁকে বসার জন্য শাস্তি হিসেবে ছোট ছেলের সাথে নাছিরের ছোট মেয়ের বিয়ে নির্ধারণ করা হলো।
রুহিনী মুখে এক হাত চাপলেন। বিস্ময়ে তার অক্ষিকোটর থেকে অক্ষিগোলক বের হয়ে আসছে। মৃদু চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,”আপা বড় ভাইয়া তো এসব তোমাকে জানায়নি, তাহলে তুমি এটা জানলে কীভাবে?
এবার চোর ধরার মতো তিন জা মুখ লুকিয়ে ফেললেন ওড়নার আড়ালে। রুহিনী সন্দেহি নজরে তাকাতেই তিনজন একসাথে বোকা হেসে নাজমিন বেগম বললেন,”গোপন বৈঠকের কথা শুনে আমি, আপা, আর ঝর্ণা তিনজন মিলে কান পেতেছি দরজার ও-পাশে। তাদের গলাতো বাজখাঁই ধীরে কথা বললে ও জোরে বের হয় তাই শুনতে কোনো অসুবিধে হয়নি।
রুহিনী ব্যঙের মতো হা করে ফেললেন। দুঃখি চোখে জা-দের দিকে তাকাতেই দেখলেন তারা কাচুমাচু করছে। কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,”তোমরা একা একা কান পাততে চলে গেলে আমাকে সাথে নিলে না।
ঝর্ণা বেগম সতর্ক চোখে বাহিরের দিকে একবার তাকালেন। রুহিনীকে শাসিয়ে বললেন,”ধীরে কথা বল ছোট,শুনতে পাবে ভাইয়ারা। আর তোকে আমরা নিয়ে যেতাম, কান পাততে, ওখানে গিয়ে যদি আহান কান্না করে সেটা—ভেবে আপারা আমি নিয়ে যায়নি।
বাড়ির কর্তীরা ফিসফিস শব্দ করে আরো অনেক কথা বলল বাড়ির কর্তাদের নিয়ে, যা বাড়ির কর্তাদের অগোচরে রয়ে গেল।
লাঠি ভর দিয়ে রুমের ভিতর পায়চারি করছেন মেহেরুন নেছা এদিক থেকে ওদিক। আজমল আলী বাথরুমে গিয়েছেন। হাঁটতে হাঁটতে বার বার চোখ ফিরিয়ে তাকালেন বাথরুমের দরজার দিকে। কাঙ্কিত ব্যক্তি তখন ও বাথরুমে। এবার বিরক্ত হয়ে মেহেরুন নেছা দূর্বল পা ফেলে এগিয়ে গেলেন দরজার সামনে। হালকা হাতে থাপ্পড় দিতে যাবেন দরজায় তখনি দড়াম করে ওয়াশরুমের দরজা খুলে গেল।
আজমল আলী দরজা খুলে ভ্রু কুঁচকে স্ত্রীর পানে তাকিয়ে রইলেন। মেহেরুন নেছা ও একই ভঙ্গিতে ভ্রু বাঁকিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। রাগী স্বরে আজমল আলীকে জিজ্ঞেস করলেন,”আপনি ওগো বিয়ে দিছেন ক্যা? হেলাল যখন রাজী হই নাই, তখন জোর করবার কি দরকার আছিল। আমারে কি সব খুইলা কইবান আপনি!
আজমল আলী স্ত্রীর জিজ্ঞাসা দৃষ্টি অবজ্ঞা করে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। আরাম করে গিয়ে বিছানায় বসলেন। হাতের লাঠি আর মোমবাতি এক-পাশে রেখে স্ত্রীকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। মেহেরুন নেছা কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেলে এগিয়ে গেলেন স্বামীর দিকে। রাগী চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে পাশ ঘেঁষে বসলেন। আজমল আলী মোটা গম্ভীর গলায় এবার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করলেন,”শুনো, তোমার বড় ছেলের প্রবাসের ফিরার আর দিন কত?
মেহেরুন নেছা ভ্রু বাঁকিয়্র নিলেন। জিজ্ঞেস করতে যাবেন বিয়ের সাথে প্রবাস যাওয়ার কি সম্পর্ক—তার আগেই বুঝে গেলেন আজমল আলী স্ত্রীর মনের কথা। আদেশ সহকারে বললেন,”আগে বলো দিন কত, তারপর তোমার সব প্রশ্নের উত্তর পাবে মায়া।
মেহেরুন নেছা এবার খানিকটা দমে গেলেন। হাতের আঙুল চেপে দিন গুণতে লাগলেন। গণনা শেষে মৃদু গলায় আওড়ালেন,”এই তো সাইমনের সোমবারের পরের সোমবার,মাইনে নয় দিন পর। কিন্তু এইডার সাথে বিয়ার কি সম্পইর্ক? আমি বুঝলাম না!
আজমল আলী স্ত্রীর কাঁধ চেপে ধরলেন। স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন,”আমাকে বিশ্বাস করো তুমি?
মেহেরুন নেছা মাথা উপর নিচ নাড়ালেন। আজমল আলী মোলায়েম কন্ঠে বললেন,”তোমার ছেলে এবার প্রবাসে গেলে আর ফিরে আসত না।
মেহেরুন নেছা ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেললেন। দ্বিধা নিয়ে স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন,”আপনে জাইনলা কীভাইবে?
“শক্রবার রাতে আমি যখন পাঠাগারে ছিলাম তখন জানতে পেরেছি।
মেহেরুন নেছা আরো কিছু প্রশ্ন করতে যাবেন আজমল আলী থামিয়ে দিলেন। তর্জনী আঙুল তুলে ঠোঁটের উপর রেখে দেখালেন চুপ। মেহেরুন নেছা স্বামীর কাছ থেকে আদেশ পেয়ে আর কথা বাড়ালেন না। চুপ মেরে বসে রইলেন।
“তোমার ছেলে এবার প্রবাসে গেলে আর ফিরে আসত না। তার দুইটা সন্তান তার কাছে কীসের টানে দেশে আসবে সে। হয়তো আমি আর তুমি মারা গেলে আসত হেলাল,আসাতে কী আমি-তুমি ওকে দেখতে পেতাম। না তো, তাই আমি হেলালের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে তার ছেলেদের নাছিরের মেয়েদের সাথে বিবাহ নামক বন্ধনে বেঁধে দিয়েছি। এতে করে হেলাল দেশে আসতে না চাইলে, তার ছেলেরা বউয়ের টানে দেশে আসলে তাকে ও আসতে হবে। আর এতে করে পারিবারিক সম্পর্কে ও চির ধরবে না। ভাইয়েরা ভাইয়েরা মিলমিশ করে বেঁচে থাকবে।
মেহেরুন নেছা এবার পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন। কিছুটা চিন্তিত গলায় বললেন,” কিন্তু জায়িন, আরশ বড় হইবার সাথে যদি ওগো নতুন কাউরে পছন্দ হই তাইলে তখন কী হইব?
মেহেরুন নেছার প্রশ্নে মৃদু শব্দে হেসে উঠলেন আজমল আলী। স্ত্রীর পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“জায়িন এরকম কিছু করবে না,ছেলেটা এই বয়সে যতেষ্ট ম্যাচিউর,ছোটটা করলে ও করতে পারে, আচ্ছা এসব নিয়ে এখন ভেবে কী হবে! যখন হবে তখন ভেবে দেখা যাবে। সারাদিনে অনেক ধকল গিয়েছে এবার একটু শুয়ে আরাম করো।
মেহেরুন নেছা মাথা নাড়ালেন। স্বামীর পাশ ঘেঁষে গিয়ে শুয়ে পড়লেন, বিছানার এক পাশে চিন্তামুক্ত হয়ে। কিন্তু আজমল আলী সত্যি কী চিন্তামুক্ত হতে পারলেন! মোমবাতি জ্বালানো কক্ষে নিশাচর প্রাণীর মতো উপরের সিলিং ফ্যানের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
সম্পর্ক স্থায়ী থাকার জন্য যে বিয়ে দিয়েছিলেন, সেই বিয়ের জন্য পারিবারিক ধীর সম্পর্কটা ধীরে ধীরে কী ভেঙে যাবে নাকি সময়ের সাথে সেটি আরো মজবুত হবে। তা সময় এবং তকদির বলে দিবে। ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, তকদিরের উপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে চোখ বুজলেন আজমল আলী।