প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১০
জান্নাত নুসরাত
পৃথিবী গোল। এই গোলাকার পৃথিবীতে দেখা হওয়া মানুষগুলো এক সময় সবাই সবার থেকে দূরে চলে যায়। গোল পৃথিবীর এক প্রান্তে একদল মানুষ বাস করে, তো অন্য প্রান্তে আরেক দল মানুষ বাস করে। নুসরাত কখনো বিশ্বাস করতো না, পৃথিবীর এক প্রান্তে একবার যার সাথে দেখা হয়েছে, ওই মানুষটার সাথে আবারো দেখা হয়। আর যদি সম্ভাবনা থেকে থাকে তাহলে ক্ষীণ। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আজ তৃতীয় বারের মতো সামনা-সামনি হলো সেই মানুষটার। প্রথমবার হয়তো তাকে বাঁচানোর জন্য লোকটা এসেছিল, দ্বিতীয় দেখাটা ও অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল, আর তৃতীয় দেখাটা, কী দ্বিতীয় দেখার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত নাকি ভাগ্য তাদের বারবার নিজের তথাকথিত তগদিরের কাছে এনে দাড় করাচ্ছে। কে জানে? হয়তোবা! তকদির বলে কিছু একটা আছে, যতই তুমি নিজের তকদিরের কাছ থেকে পালাতে চাইবে, তত সেই তকদির তোমাকে গ্রাস করে ফেলবে। মুখোমুখি করবে নিয়ে গিয়ে, নিজের তথাকথিত অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের।
নুসরাতের মুখ দেখে বোঝা গেল, এই লোকটার সাথে সে আবারো দেখা হওয়া মোটেও আশা করেনি। যার সাথে গত দু-দিন আগে নুসরাত জব্বর বেয়াদবি করে আসছে, সেই লোকটার সাথে সামনা-সামনি দেখা হতেই নুসরাতের মুখ দেখার মতো হলো। যার সাথে এ জীবনে সামনা-সামনি হবে না ভেবেছিল, সেই মানুষটার সাথে আবারো দেখা এটা কী অনাকাঙ্ক্ষিত নাকি অন্যকিছু। ভাগ্য কেন বারবার এই লোকের সাথে নুসরাতের দেখা করাচ্ছে। নুসরাত চায় না তো এই লোকটার সাথে বারংবার এভাবে দেখা হওয়া কিন্তু এই তকদির, ভাগ্য যাই হোক কেন বারংবার এই ঠাডা পড়া লোকটার সামনে এনে দাড় করাচ্ছে!
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
কোনো একটা কথা বা লিখা এরকম ছিল, তোমার তকদির যখন আগে থেকে লিখা তাহলে তুমি কেন তকদির নিয়ে এত চিন্তা করো। তকদির ছেড়ে দাও তকদিরের উপর। যা হওয়ার তা দেখা যাবে, কারণ আল্লাহ তায়ালা উত্তম পরিকল্পনাকারী। তিনি তোমার এবং তোমার ভালো হবে কীসে সেটা নির্ধারণ করেই তোমার তকদির লিখেছেন। কিন্তু যদি তুমি তকদিরের বিরুদ্ধে যেতে চাও তাহলে শুনে রাখো, তকদির তোমাকে এমনভাবে গ্রাস করে ফেলবে মনে হবে তুমি এক অন্ধকার গোহায় বা অতল এক গহব্বরে ফেসে গিয়েছ ভয়ংকর ভাবে, যা থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো রাস্তা নেই।
চারিদিকে মাগরিবের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। এখনো নাছির সাহেবদের সোসাইটির মসজিদে আজান দেননি ইমাম সাহেব। আশে-পাশে থাকা সোসাইটির মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আজানের করধ্বনি। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষিপ্র গতিতে কলিং বেলে চাপ দিচ্ছেন নাছির সাহেব কিন্তু কেউই দরজা খুলছে না। তাই রাগে, বিরক্তিতে, আর মশার কামড়ের জ্বালায় হুংকার দিয়ে ওঠলেন নাছির সাহেব।
“নাজমিন দরজা খুলো তাড়াতাড়ি, মাথা গরম আছে এমনিতে আর গরম করো না।
নাছির সাহেব হুংকার, হুশিয়ারি বা আদেশের স্বরে বলা কথা কী বাগান ভেদ করে ডুপ্লেক্স বিশিষ্ট বাড়ির ভিতর প্রবেশ করল তা নাছির সাহেব বোঝার চেষ্টা করলেন না। তিনি ওখানেই দাঁড়িয়ে নিশপিশ করা পা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। যদি পারতেন আজ এই গেইট টপকে বাড়ির ভিতর ঢোকতেন। তবে কিন্তু একটা থেকেই যায়! এভাবে বাড়িতে প্রবেশ করলে গেটের রঙে স্ক্রেচ পড়বে, আর তার জন্য খরচ করতে হবে এতগুলো টাকা। আর এই নাছির কখনো নিজের টাকা এমনি খরচ করে না। টাকা খরচ করার ভয়ে নাছির সাহেব গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন চুপচাপ। টাকার বিষয় যদি না আসতো তাহলে নাছির সাহেবকে জীবনে কেউ এই দেয়াল টপকানো থেকে আটকাতে পারত না।
নাছির সাহেব রাগ থামানোর চেষ্টা করলেন, বাড়িতে এত রাগ নিয়ে প্রবেশ করলে নাজমিন বেগমের কাছ থেকে ঝাড়ি খেতে হবে। আর তার কারণ ও সে নিজে। এর আগেও যখন সুফি খাতুন ভালো পাত্রের সন্ধান দিতে পারেননি তাহলে কেন আবার সুফি খাতুনের ওপর বিশ্বাস করে গেলেন উনি। এটা ভেবেই হাই-হুতাশ করে মরে যাচ্ছেন ভিতর ভিতর নাছির সাহেব। এবার নাছির সাহেবের নিজের ইচ্ছে হলো নিজের মাথাটা গেটে ধরে দুটো ধুমধাম করা বারি দিতে। যেই কথা সেই কাজ বারি দেওয়ার জন্য গেটের দিকে এগিয়ে যেতেই মনে হলো আরে রঙ তো ওঠে যাবে, তার জন্য খরচ হবে মোটা অংকের টাকা, আর এসব ছোটো-খাটো বিষয়ে সৈয়দ নাছির উদ্দিন টাকা খরচ করেন তাহলে সোসাইটিতে তার বদনাম হয়ে যাবে। সবার মুখের আলোচনা থাকবে, নাছির সামান্য একটা স্ক্রেচের জন্য হাতভর্তি টাকা খরচ করেছে।
নাছির সাহেবের চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে গেট খুলে গেল শব্দ করে। নাছির সাহেব শক্ত হাতে গেটে লক করতে যাবেন, ধাক্কা মেরে সুফি খাতুন এসে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলেন। ঠোঁট টেনে হাসলেন মৃদু। যা নাছির সাহেবের নিকট বিশ্রী ঠেকল। তিনি একপ্রকার মুখ ঝামটা দিয়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলেন। সুফি খাতুন নাছির সাহেবের কাছ থেকে মুখ ঝামটা খেয়ে চোখ-মুখ উল্টে নিলেন। গেট লক করে বাড়িতে প্রবেশ করলেন নাছির সাহেবের পিছু পিছু। ড্রয়িং রুমে পা দিতেই দেখলেন সোফার উপর শুয়ে আছে আহান। মুখের সামনে এক বাটি পপকন। আধুনিক ধাঁচের কিচেন কাউন্টারে বসে ইরহাম মুরগির লেগপিস খাচ্ছে, কড়মড় শব্দ করে।
সুফি খাতুন ঢোক গিললেন লেগ পিসের দিকে তাকিয়ে। লোভী চোখে তাকিয়ে রইলেন ইরহামের হাতের দিকে। ইরহাম সুফি খাতুনের এরুপ দৃষ্টি দেখে নাক কুঁচকে নিল উপরের দিকে। কিছুটা শাসিয়ে বলে ওঠে,”একদম আমার খাবারের দিকে নজর দিবে না দাদি। ওই যে, তোমার নাতি বসে পপকন খাচ্ছে ওসব খাও, এইগুলা আমার জন্য স্পেশালি মেজ মা বানিয়েছে।
সুফি খাতুনের মুখ পাংশুটে বর্ণের ধারণ করল। ঠোঁট চোখা করে শ্বাস ফেলে সোফায় বসলেন। এরমধ্যে নাজমিন বেগম মাথা থেকে পেঁচানো ওড়না খুলতে খুলতে ইরহামকে জিজ্ঞেস করলেন,”আব্বু আর কিছু খাবে তুমি?
ইরহাম দু-পাশে মাথা নাড়াল না ভঙ্গিতে। এর মধ্যে নাজমিন বেগমের চোখ গেল সুফি খাতুনের দিকে। না চাইতে ও এতক্ষণের ভালো থাকা মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তিনি বুঝে পান না, ছোট এত ভালো আর ছোট এর মা এত খারাপ কীভাবে?
নাজমিন বেগম নিজের মেজাজ খারাপ করতে চাইলেন না, তাই কিচেনে সিঙ্কে থাকা বাটিগুলো ধুয়ে রাখতে গেলেন। দু-হাতের হাতা গুটিয়ে নিতেই, ইরহাম বলে ওঠল,”একদম তুমি এখানে আসবে না, আমি ধুয়ে রাখব।
নাজমিন বেগম কথা শুনলেন না, হাতা গুটিয়ে এগিয়ে যেতেই ইরহাম লাফ মেরে কিচেন কাউন্টার থেকে নেমে নাজমিন বেগমকে ঠেলে বের করে দিল সেখান থেকে। কিচেনের দরজা লাগাতে লাগাতে শক্ত কন্ঠে বলল,”তুমি কী চাও, তোমার মেয়ে আমাকে এসে পিটাক? উঁহু মেজ মা তোমার মতিগতি আমার কাছে ভালো ঠেকছে না।
নাজমিন বেগম ভেজানো দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন,”কেন? ও তোমাকে কেন পিটাবে?
“আরে….
কথাটা বলতে বলতে ইরহাম ভেজানো দরজা আবার খুলে নাজমিন বেগমের গলা পেঁচিয়ে ধরল। দু-হাতে গলা পেঁচিয়ে নিয়ে বলল,” উফ সুইটহার্ট বোঝার চেষ্টা করো, তোমার মেয়ে আমাকে বলে গিয়েছে যে যে বাটিতে খাবো সেই বাটি যেন নিজ দায়িত্বে ধুয়ে রাখি, নাহলে ওই জল্লাদ মেয়ে বিনা পাউডারে আমাকে ওয়াশিং মেশিনে ফেলে ধুয়ে দিবে।
নাজমিন বেগম মুখে হাত দিয়ে অবাক কন্ঠে জানতে চাইলেন,”সত্যি? ওই পাগল এসব বলেছে?
ইরহাম নির্দোষ ভঙ্গিতে মাথা দোলায়। দু-জনের একজন খেয়াল করল না দূরে বসা সুফি খাতুন সূক্ষ্ম নজরে দু-জনের দিকে তাকিয়ে আছেন। আর গালে হাত দিয়ে কোনো একটা বিষয় মিলাচ্ছেন।
এর মধ্যে গড়গড় করতে করতে নাছির সাহেব এসে হাজির হলেন ড্রয়িং রুমে। মুখ-চোখে স্পষ্ট রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। নাছির সাহেবের পিছু পিছু ইসরাত নেমে আসছিল, চোখ মুখে কী হয়েছে জানার উদ্বেগ? প্রশ্নাত্মক চাহনি মায়ের দিকে ছুঁড়ে দিতেই নাজমিন বেগম মাথা নাড়িয়ে পরে বলবেন বললেন।
নাছির সাহেবের রাগ দেখে আঁচ করতে পেরেছিলেন নাজমিন বেগম কী হয়েছে? আর এখন তো পুরো পরিস্কার তার কাছে, যে সুফি খাতুন আবারো কোনো আধ বুড়ো নাহয় বয়স্ক লোক ধরে নিয়ে এসেছেন ইসরাতের জন্য। আর এজন্য মহামান্য স্বামীর এত রাগ। তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন নাছির সাহেবের কথা বলার অপেক্ষায়।
চুপচাপ দাঁড়াতে কোথায় পারলেন! ইরহাম পেছন থেকে উঁকি মারল প্রথমে ড্রয়িং রুমে, পরপরই নাজমিন বেগমকে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা জিজ্ঞেস করল,”মেজ মা কী হয়েছে? মেজ আব্বু এরকম ক্ষেপা ষাঁড়ের মতো হয়ে আছেন কেন?
নাজমিন বেগম মাথা কাত করে চোখ পাকালেন ইরহামকে। হাসি আটকানোর চেষ্টা করে মুখে মেকি রাগ এনে বললেন,”ইরহাম..!
ইরহাম নিজের মাথা রাখল নাজমিন বেগমের কাঁধে। ঠোঁট উল্টে জিজ্ঞেস করল,”ইরহাম কী সুইটহার্ট?
“ফ্লার্ট করা বন্ধ করবে তুমি?
নাজমিন বেগমের প্রশ্নে ইরহাম দু-পাশে মাথা নাড়াল। তাদের কথপোকথন সুফি খাতুন দূরে বসে ত্যাড়া চোখে দেখলেন। এর মধ্যে নাছির সাহেব কেটকেটে গলায় বললেন,”এই বুড়ো নিজাম শিকদারকে তুমি আমার মেয়ের জন্য পছন্দ করতে পারলে? তোমার উপর সামান্য বিশ্বাস করায়, বিশ্বাসের এই মূল্য দিলে তুমি ফুপি?
আহান পপকন খেতে খেতে ওঠে বসল। ইসরাতকে নিজের পাশে বসার জায়গা করে দিল। ইসরাত বসল আহানের পাশ-ঘেঁষে শান্ত ভঙ্গিতে। তারপর দু-জন একসাথে বসে মুখে পপকন পুরতে শুরু করল।
পপকন খেতে খেতে যখন পাত্র হিসেবে শুনল নিজাম শিকদারের কথা ছিটকে পপকন বের হয়ে আসলো মুখের বাহিরে। কেশে উঠল শব্দ করে। আহান হালকা হাতে ইসরাতের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল, ইসরাতের মুখ দিয়ে বের হয়ে আসলো অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে,”নিজাম দাদুকে, এই মহিলা আমার জন্য পছন্দ করেছে?
ইসরাতের নাক-মুখ কুঁচকে গেল। ইচ্ছে করল বুড়িকে ধরে কয়েকটা ধুপধাপ পেটাতে। ইসরাত শুধু মনে মনে ভাবতে পারল, কিন্তু করতে পারল না নিজের ব্যক্তিত্ব বোধের বাহিরে বের হয়ে। এরপর কানে আসলো
সুফি খাতুনের অত্যন্ত কোমল স্বরে, যতটুকু স্বর নরম করলে একটা মানুষকে নিজের আয়ত্তে আনা যায় ততটুকু এনে বললেন,” নাছির তুই রাগ করছিস কেন? আমি তো তোর মেয়ের ভালোর জন্য বলছি, আর লোকটার বয়স ও তো কম! একদম নাদান শিশু! তোর কাছে বুড়ো মনে হলে তো আরো ভালো। দু-দিন পর মরে গেলে সব সম্পত্তি তোর মেয়ের হয়ে যাবে। আরাম আয়েশে দিন কাটাবে তোর মেয়ে। রাজ করবে রাজ… ওই ছেলেটার বাড়িতে।
নাছির সাহেব হতবিহ্বল। চেহারার অবস্থা বেহাল। শুভ্র বর্ণের চেহারা ধীরে ধীরে লাল টুকটুকে হতে শুরু করল। ইসরাতের ও সমান অবস্থা। রাগে নাকের পাটা বারবার ফুলছে বাপ মেয়ের দুজনের।
পাশে বসা আহান স্পষ্ট দেখল বড় আপির বারংবার পা দিয়ে মেঝেতে নখ খুঁটানো,দাঁতের সাথে দাঁত চেপে কটমট কটমট শব্দ করা, আর অতিষ্ঠ হওয়া চোখে তাকিয়ে থাকা। আহান গলা নিচে নামিয়ে বলল,”আরে আপি ভলকেনোর মতো ফোলা তোমার সাথে যায় না, ওইটা নুসরাত আপির সাথে যায়। এরকম দাঁতের উপর অত্যাচার করলে কম বয়সে বুড়ি হতে হবে, পরে মাত্র একুশ বছর বয়সে তুমি দাঁত বিহীন হয়ে যাবে। সবাই তোমাকে ফোকলা বলে ডাকবে! আর এই ডাক কী আমি মেনে নিতে পারি, উঁহু না! আমার এত সুন্দর, কিউট, গুলু, লাল্টু, আপি এত তাড়াতাড়ি ফোকলা হতে পারে, সেটা আমি কীভাবে মেনে নিতে পারি? আর সেটা আমি কেন মানব? উঁহু কখনো মানব না।
আহান নাটকীয় ভঙ্গিতে কথাটা শেষ করল। চোখ মুখ বন্ধ করে বাপ্পারাজের মতো বলে ওঠল, ফিসফিস করে,”না এ হতে পারে না, আমার আপি এত তাড়াতাড়ি ফোকলা হতে পারে না, আমি বিশ্বাস করিনা। আ আ আ!
নাছির সাহেব চোখের পলক না ফেলে হা করে চেয়ে রইলেন সুফি খাতুনের দিকে কিৎকাল। এক আঙুল তুলে শাসাতে শাসাতে সুফি খাতুনকে বললেন,”ফুপি খবরদার এরুপ কথা আরেকবার যদি শুনি, তাহলে আমি নাছির নিজের ভদ্রতা তোমার প্রতি বজায় রাখব না। আমার মেয়ে কী নদীর জলে ভেসে এসেছে যে, আমি নিজাম চাচার সাথে ওর বিয়ে দিব। তোমার জঘন্য চিন্তা দেখে আমি স্পিচলেস। একটা মানুষ কীরুপ চিন্তা করতে পারে তোমাকে না দেখলে আমি জানতামই না। আর সম্পত্তির কথা আসলে, আমার সম্পত্তি কী কম আছে? আর এসকল সব সম্পত্তি আমার অবর্তমানে আমার মেয়েরা পাবে।
আহান হিহি করে হেসে উঠল। তখনই সবার চোখ আহানের দিকে ফিরে গেল। নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ প্রহরে ঘোরে গেল পুরো নাছির মঞ্জিল। আহান ঢোক গিলে নিয়ে বলে,”স্যরি হাসার জন্য। আরেকটা স্যরি একটা কথা বলতে চাচ্ছি আপনাদের বড়দের মধ্যে। আই হেভ আ আইডিয়া মেজ আব্বু।
আহান কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঝটপট কন্ঠে বলে উঠল,”আমরা এক কাজ করতে পারি নানির ভাষায় যিনি নাদান শিশু, আই মিন নিজাম দাদুর সাথে নানির একটা সেট-আপ করে দিলে কেমন হয়? একদম মেইড-ফর-ইচ-আদার লাগবে দু-জনকে।
আহান কোনো রকম কথা শেষ করে হা হা করে হাসতে লাগল। সাথে ইসরাত ও হাসতে শুরু করল। হাসতে হাসতে ঢলে পড়ল আহানের গায়ে। ইরহাম হাসতে হাসতে মেঝেতে বসে পড়ল, পারে না সে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খায়। একমাত্র নাজমিন বেগম কোনোরকম হাসি আটকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, বাচ্চাদের সাথে নিজে তাল মিলিয়ে হাসলে বিষয়টা খারাপ দেখাবে। নাছির সাহেবের দিকে চোখ পড়তেই দেখলেন নাছির সাহেব মুখে হাত চেপে ধরে হাসছেন। দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন নাজমিন বেগম, স্বামীর হাসাহাসিতে। এই লোকটা ধমক দিবে, তা না করে এদের সাথে বসে দাঁত বের করে হাহা হিহি করে হাসছে।
আরশ কখন থেকে হাসছে নুসরাতের দিকে তাকিয়ে থেকে। নুসরাতের কাছে আরশের হাসিটা বিষের মতো লাগল। একটা মানুষের হাসি এত জঘন্য হয় কীভাবে তা একে না দেখলে কখনো নুসরাতের বিশ্বাস হতো না। নুসরাতের নিষ্প্রাণ চোখে আরশের দিকে তাকিয়ে রইল। তখনই কানে আসলো গমগমে পুরুষালি স্বরে বলা কথা, যা তার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিয়েছে মানুষটা।
“সরে বসো মেয়ে! আর এভাবে তাকানোর কিছু নেই, আমার দিকে আপনার।
আরশের তীব্র গতিতে বলা কথায় নুসরাত এক মুহুর্তের জন্য কথা বলতে ভুলে গেল। নিজের জায়গায় অসাড় হয়ে বসে রইল নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। তার এই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা আরশ লক্ষ করল, ধৈর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে। চুপচাপ স্থির ভঙ্গিতে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল নুসরাতের সরে বসার অপেক্ষায়। নুসরাত সৌরভির দিকে চোখ ঘোরাতেই সোরভি বলল,”বেচারার গাড়ি নষ্ট হয়ে গিয়েছে, একটু হেল্প চাইছিল তাই আর কী হেল্প করতে এগিয়ে গেলাম। উনি আমাদের সাথেই সিলেট যাবেন।
নুসরাতের মুখটা নিমেষেই পাংশুটে বর্ণের ধারণ করল। তার মুখ দেখেই বোঝা গেল সে আশা করেনি এই লোককে এখানে। আরশ ভ্রু বাঁকিয়ে আদেশ দিয়ে বলল,”সরে বসুন।
নুসরাত সরে গেল। জায়গা করে দিল আরশকে বসার। আরশ নিজের লাগেজ পিছনে রেখে এসে বসল নুসরাতের পাশের সিটে। সামনের সিটে বসেছে সৌরভি ড্রাইভারের সাথে। ধীরে ধীরে গাড়ি চলতে শুরু করল। আধ-ঘন্টা পার হলো নুসরাত, সৌরভি এমনকি আরশ টু শব্দ করল না। পিনড্রপ সাইলেন্ট পুরো কার জুড়ে। সৌরভি এবার নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করল আরশকে,”ভাইয়া কী নিয়ে পড়াশোনা করছেন? আই মিন পড়াশোনা শেষ আপনার?
আরশ মোবাইল অফ বাটনে চাপ দিয়ে বন্ধ করে নিল। বন্ধ করার আগে দেড় কী দুই বছরের একটি মেয়ের মুখের ঝাপসা কিছু অংশ দেখা গেল। তারপর ঠুপ করে মোবাইল বন্ধ হয়ে গেল। আরশ মোবাইল নিজের গলায় ঝুলানো ব্যাগে ঢোকাল। কিছুটা অন্যমনস্ক থাকায় সৌরভিকে আবার জিজ্ঞেস করল,”হ্যাঁ, কী বলছিলেন আপনি?
সৌরভি আবারো একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল,
“আপনারা স্টাডি কম্পিলিট?
আরশ পুরুষালি ধারালো কন্ঠে প্রশ্নের উত্তর দিল,
“জ্বি!
“আপনার সাবজেক্ট কী ছিল ভাইয়া?
সৌরভি আগ্রহ নিয়ে জানতে চায়। চোখ-মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠছে উদ্দীপনা। আরশ দেখল মেয়েটার জ্বলজ্বল করা চোখের চাহনি। প্রশ্নের উত্তর জানার আকাঙ্ক্ষা। এই বয়সে সকলেরই অজানা জিনিসের প্রতি কৌতূহল থাকে, তা দেখে হালকা হাসল আরশ। যা আলগোছে বিলীন হয়ে গেল দন্তপাটির নিচে। পুরুষালি নির্বিকার চিত্তে উত্তর দিল সৌরভি করা প্রশ্নের,” ইকোনমিক্স।
সৌরভি এবার কোনো প্রশ্ন করার আগে আরশ জিজ্ঞেস করল,”নাম কী আপনার?
সৌরভি হাসি হাসি মুখ করে মাথা কাত করে তাকায়। আরশের দিকে তাকানোর আগে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকা নুসরাতের সাথে চোখাচোখি। নুসরাতের দৃষ্টি শীতল, বাজ পাখির ন্যায় শিকারি। সৌরভি সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে উত্তর দিল,”জ্বি সৌরভি শিকদার।
আরশ মাথা নাড়াল বোঝার ভঙ্গিতে। এবার সৌরভি জিজ্ঞেস করল আরশকে,” আপনার নাম কী ভাইয়া?
নুসরাত দু-জনের কথার ভিতর নির্লিপ্ত৷ সারাদিন পটর পটর করা নুসরাতের ভিতর কথা বলার কোনোপ্রকার উদ্দীপনা দেখা দিল না। আরশ রাশভারী কন্ঠে বলল,” আরশ, সৈয়দ আরশ হেলাল।
নুসরাত মোবাইলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। ঠিক বোঝা গেল না, আরশের কথা তার কানে গিয়েছে কী না। সৌরভি অবাক চোখে তাকায় আরশের দিকে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,”ভাইয়া, ও
সৌরভি সবকিছু গুলিয়ে ফেলল কথা বলতে গিয়ে। আরশ ভ্রু কুঞ্চিত করে। মাথা একটু আগায় সামনে, জিজ্ঞেস করে,”ও কী?
নুসরাত এতক্ষণের নির্লিপ্ততা ঝেড়ে ফেলে বলে ওঠে,
“ও কিছু না।
সৌরভি মুখ খুলতে নিবে নুসরাত দু-পাশে মাথা নাড়ায়। ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ দেখায়। যা আড় চোখে লক্ষ করে আরশ। ঠোঁট টিপে এবার জিজ্ঞেস করে,” কী বলছিলেন বলুন আপনি?
সৌরভি হাসে। নিজের কথা এক নিমেষে গুছিয়ে নিয়ে বলে ওঠে,”ভাইয়া পৃথিবী কিন্তু গোল আবারো প্রমাণ হয়ে গেল৷ দেখুন আপনাদের বাড়ির একটু বিপরীতে যে বাড়ি ওইটা আমাদের বাড়ি।
আরশ কিছু বলে না, এবার সরাসরি নিজের দৃষ্টি ঘোরায় নুসরাতের দিকে। জানতে চেয়ে জিজ্ঞেস করে সৌরভিকে,”উনার নাম?
সৌরভি ঝটপট উত্তর দিতে গিয়ে থেমে যায়, নুসরাত সৌরভির কথায় ফোড়ন কেটে বলল,”ময়না মির্জা।।
আরশ তড়াক করে নুসরাতের দিকে তাকায়, কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে,”আপনার সাথে আমার আরো একবার দেখা হয়েছিল কী?
নুসরাত নির্লিপ্ত গলায়, কাঠকাঠ কন্ঠে বলে,
“জি না।
আরশ জিজ্ঞেস করে সৌরভিকে,
“ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবনা আপনার সৌরভি?
সৌরভি নম্র কন্ঠে উত্তর করে,
“জি গৃহিনী হবো।
আরশ হাসে একটু। আবারো জিজ্ঞেস করে,
” পড়াশোনা কতদূর?
সৌরভি ঝটপট গলায় উত্তর দেয়,
“অনার্স ফাস্টইয়ার।
“ময়না মির্জা আপনার ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবনা?
আরশের ঠাট্টার স্বরে করা প্রশ্নে নুসরাত ঠোঁট বাঁকায়, মৃদু কন্ঠে বলে,” বিয়ে শাদি করব, বাচ্চা পয়দা করব, পাশের বাড়ির ভাবি,আন্টিদের সাথে বসে আরেক বাসার ভাবি-আন্টিদের নামে চুগলি করব। এই ভাবনা আমার।
আরশ নিজের চোখের উচ্চ পাওয়ারের চশমা খুলে হাতে নেয়,গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”আমি এটা জিজ্ঞেস করিনি।
নুসরাত আরশের কথা কেটে দিয়ে ব্যগ্রতা নিয়ে জিজ্ঞেস করে,”তাহলে কী জিজ্ঞেস করেছেন আপনি?
আরশ নিষ্প্রাণ দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির করে, উদাসীন কন্ঠে জানতে চায় আবার,”ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার জানতে চেয়েছি। আই মিন, ভবিষ্যৎ প্ল্যান কী?
নুসরাতের ঠোঁটের আগায় প্রশ্নের উত্তর ছিল মনে হয়ে। ঝটপট উত্তর দিতে গিয়ে একটু সময় থামল। তারপর এক মুহুর্ত বিলম্ব না করে আগের মতো অবিচল কন্ঠে বলল,”আমি রাস্তায় প্রতিবন্ধী সেজে বসে থাকব, আর আমার জামাই ভিক্ষা করবে। সাথে সাথে বলবে, আল্লাহ্ নবীজির নামে চারটা দিয়ে যান।
সৌরভি নিরর্থক অভিমত পোষণ করল। এই মেয়ে দ্বারা সব সম্ভব। হয়তোবা দেখা যাবে বেশি ঘাটাতে গেলে এর বেচারা ভবিষ্যৎ জামাইকে নিয়ে সত্যি সত্যি রাস্তায় নেমে গিয়েছে ভিক্ষা করতে। তাই সৌরভি নিজে ও ঠোঁটে জিপার এঁটে বসে রইল সামনের সিটে। আরশ ও আর কথা বলল না। অনেক কথা বলেছে আজকের জন্য, মুখে ব্যথা হয়ে গিয়েছ তার। তাই মোবাইল আবার পকেট থেকে বের করে স্ক্রল করতে লাগল চুপচাপ।
মাগরিবের আজান দিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। আরশ সৌরভিদের গাড়ি একপাশে দাড় করিয়ে গিয়েছে দশ মিনিটের জন্য মসজিদে। গাড়ি থেকে নামার আগে পরণের ডেনিম জ্যাকেটটা রেখে গিয়েছে নিজের সিটের ওপর৷ সেখান থেকে ব্ল্যাক বেরির মিষ্টি গ্রাণ সুরসুর করে প্রবেশ করছে গাড়িতে বসে থাকা দুই রমণীর নাসারন্ধ্রের ভিতর।
দীর্ঘ দশ মিনিট পর যখন আরশ ফিরে আসলো তখন দেখল নুসরাত ভুসভুস শব্দ করে ঘুমাচ্ছে সিটের মধ্যে। মাথা একদিকে কাত হয়ে আছে। আরশ গাড়িতে বসে গাড়ির দরজা টেনে লাগিয়ে দিল। তারপর হাত বাড়িয়ে নুসরাতের মাথা টেনে আনল সিটে, আলগোছে সিটের উপর রেখে দিল মেয়েলি মাথাটা। নিজের পিঠের পেছনের কুশন বের করে নিয়ে নুসরাতের মাথার নিচে দেয়, যত্নসহকারে।
আরশ নিজের চোখ নুসরাতের থেকে ফিরাতেই সৌরভির সাথে চোখাচোখি হয়। থতমত খেয়ে, ঠোঁট টিপল আরশ। তারপর একটু সন্দেহি গলায় জিজ্ঞেস করল,”ও বিবাহিত?
“জি না ভাইয়া।
আরশ এবার একটু ধীরতা নিয়ে,সন্দেহি কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,”আর ইউ সিউর সৌরভি?
এবার সৌরভি থমকায়। সত্যি তো সে নুসরাতকে কোনোদিন জিজ্ঞেস করেনি তাদের বাড়ি বিষয়ক প্রশ্ন।কখনো জিজ্ঞেস করেনি সে কী বিবাহিত নাকি অবিবাহিত!
সৈয়দ বাড়ির অভ্যন্তরে ঘটে চলা কোনো কিছু তার কাছে পরিস্কার নয়, আর নুসরাত ও কোনোদিন ইচ্ছা প্রকাশ করেনি বলার জন্য নিজের বাড়ির ভিতরে চলা সমস্যার। সৌরভি দ্বিধাদ্বন্ধে ভোগে। দ্বিধা নিয়ে নিজের নুয়য়েই যাওয়া চোখ তোলে। আমতা-আমতা করে বলে ওঠে,”আই ডোন্ট নো ভাইয়া। আমি কোনোদিন জানতে চাইনি এই বিষয়ে ওর কাছে।
আরশ হাসল। আর কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল না সৌরভিকে।
রাত গভীর হলো। রাস্তায় গাড়ি চলাচল ধীরে ধীরে কমতে শুরু করল। গ্লাস ভেদ করে বাতাসে শো শো করে এসে প্রবেশ করল পুরো গাড়িতে।
গাড়ি যখন সোসাইটির ভিতর ঢোকল, নুসরাত ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাল। মাথা একদিকে করতেই ম্যানলি পারফিউমের তীব্র ঘ্রাণ প্রবেশ করল নাসারন্ধ্রের ভিতর দিয়ে। চোখ ঝাপটাতেই বাহিরের ল্যাম্পপোস্টের তীক্ষ্ণ রশ্মি এসে লাগল চোখে। এক হাত দিয়ে চোখ চেপে ধরল। তারপর আলো সয়ে আসতেই, ঘুম ঘুম কন্ঠে সৌরভিকে জিজ্ঞেস করল,”চলে এসেছি?
তখনো নুসরাতের নাকে যাচ্ছে ব্ল্যাকবেরির মিষ্টিঘ্রাণ। ঘুম পুরোপুরি না কাটায় বুঝতে পারল না, পাশের ব্যক্তির কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে আছে সে। সৌরভি উত্তর দিল ধীরে সুস্থে নুসরাতের প্রশ্নের,”ম্যাডামের ঘুম শেষ?
নুসরাত উঠে বসতে বসতে নাকে হাত ডলল। নাকে নিশপিশ করছে কোনোকিছু। প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে নাক-মুখ খিঁচে হাচ্চি দিয়ে ওঠল। মুখ থেকে হাত সরাতেই পাশ থেকে কেউ টিস্যু এগিয়ে দিল নাকের সামনে। নুসরাত তা নাকে চেপে ধরে পাশে তাকাতেই কালো মণিবিশিষ্ট পুরুষালি চোখের সাথে চোখের মিলন ঘটল। অতঃপর সেদিকে তাকিয়ে থেকে নুসরাত সৌরভিকে বলল,”আমাকে এখানে নামিয়ে দেয়। আমি একা একা যেতে পারব।
সৌরভি অনিহা নিয়ে বলল,
“আর একটু রয়েছে, সামনে গিয়ে নামবি।
নুসরাত শুনল না, সে এখানে নামবে বলছে মানে এখানেই নামবে। কারোর কোনো কথা শুনবে না, অজ্ঞতা ড্রাইভারকে সৌরভি গাড়ি থামানোর কথা বলল। ড্রাইভার গাড়ি থামাতেই নুসরাত নিজের এয়ারপড, ল্যাপটপের ব্যাগ, আর মোবাইল তাবা মেরে চেপে ধরে নেমে যেতে নিবে, আরশ জিজ্ঞেস করল,” বিবাহিত?
নুসরাত গাড়ির দরজার লক খুলে,গাড়ি থেকে নামতে নামতে উত্তর দিল,”না।
আরশ আবারো রাশভারী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“বিবাহিত?
নুসরাত আবারো নির্লিপ্ত কন্ঠে উত্তর দিল,
” না।
আরশ নিজের জায়গায় অটল থেকে, কঠোর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,”বিবাহিত?
নুসরাত শীতল কন্ঠে উত্তর দিল,
” না।
সৌরভি একবার আরশের দিকে একবার নুসরাতের দিকে শুধু তাকাল। দু-জনের বিবাহিত প্রশ্নে আর না উত্তরে সে আটকে। আবারো সৌরভির কানে আসল কড়মড় করে আরশ জিজ্ঞেস করছে,”বিবাহিত?
নুসরাত গাড়ির দরজা আটকাতে আটকাতে বলল,
“জি না।
আরশ পুরুষালি উদ্বীগ্ন কন্ঠে আবারো জানতে চায়, “বিবাহিত?
নুসরাত তেরছা গলায় বলে,
” না।
আরশ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। নুসরাতের দিকে একবার তীক্ষ্ণ চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে,” আপনি কী বিবাহিত ময়না মির্জা?
আরশ শেষের কথাটা একটু টেনে টেনে বলল। যেন নুসরাতের নামের ঠাট্টা উড়াল।
নুসরাত ও কাঠকাঠ গলায় বলে,
“আমি পিউর সিঙ্গেল ভাইয়া। আপনার আমাকে দেখেই বোঝা উচিত।
আরশের ঠোঁটে হাসি ফোটে উঠে। যা গাড়ি অন্ধকার থাকার ধরুন বোঝা মুশকিল হয়। আরশ তীক্ষ্ণ গলায় জানতে চায়,”শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করছি মিস ওর মিসেস বিবাহিত কিনা? পরেরবার উত্তর দেওয়ার জন্য সময় থাকবে, কিন্তু উত্তর দিতে পারবেন না ময়না মির্জা।
আরশের কন্ঠে অদৃশ্য কোনো কিছু অনুভব করল নুসরাত। তবুও নিজের ধীরতায় অটল থেকে রগরগে গলায় উত্তর দিল,”আমি অবিবাহিত, অবিবাহিত, অবিবাহিত। হয়েছে? এবার আমি যাই।
আরশ ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলোয়, নির্বিকার চোখে, ধৈর্য ধরে বসে নুসরাতের মুখের পরিবর্তন দেখল কীরকম হয়েছে তার করা প্রশ্নে। উত্তর দেওয়ার সময় ঠোঁট নাড়ানো, কপাল কুঞ্চিত হওয়া, নাকের পাটাতন থেকে ঘাম মুছে নেওয়া, অতীষ্ঠ হওয়া, এমন কী তার ওপর বিরক্ত হয়ে শক্ত হাতে দরজা লাগানো।
আরশ বন্ধ গাড়ির দরজার দিকে চেয়ে, চুলে হাত বোলাতে বোলাতে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। চোখ বন্ধ করে পিছনের দিকে মাথা এলিয়ে দিয়ে বলে উঠল, “I liked your blunt answer in a dengerous way. আপনার প্রতি জানার কৌতূহল আরো একটু বেড়ে গেল ময়না মির্জা। শুধু সত্যটা জানতে দিন, একটু কনফিউশান রয়েছে আপনার প্রতি সেটা দূর হোক, তারপর বুঝিয়ে ছাড়ব আমি আরশ হেলাল কী! দোয়া করুন, আমি যাকে ভাবছি আপনি যেন সে না হোন, আপনি যদি সে হোন, you are totally doomed Mrs syed arosh.
নিজের স্টাডি রুমে মাথায় হাত ঠেকিয়ে বসা এক চওড়া শরীর বিশিষ্ট পুরুষ। বয়স তার ত্রিশের কোঠায় কিন্তু এখনো অবিবাহিত। পছন্দসই কোনো রমনী না পাওয়ায় ত্রিশ বছরের এই জীবনে এখনো সিঙ্গেল সে। গম্ভীর মুখো ভঙ্গি করা তার, চোখে-মুখে তীক্ষ্ণতা। চোখ স্থির সামনের ল্যাপটপের দিকে। ঠোঁটে ক্ষূর হাসি লেগে আছে সামান্য। ল্যাপটপের কিবোর্ডে আঙুল চালাতে চালাতে এক সময় তার হাত থামে। বিরক্ত হয় নিজের প্রতি। বাঁ-হাতের তালুতে কপাল ঠেকিয়ে নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বসে। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে ওঠে ওভাল আকৃতির একটা মুখ। গাল গুলো হালকা ফুলো ফুলো, মেয়েলি উঁচু সরু নাকের বাঁ-পাশে ছোট্ট একটি নোজ রিং।
চোখের পাপড়ি গুলো ঘন কালো, কিন্তু অতোটা লম্বা নয়। নাহিয়ান আবরার পূর্বের জানা মতে মেয়েদের চোখের পাপড়ি লম্বা হয়, তাহলে এই মেয়ের ক্ষেত্রে ভিন্নতা কেন! বদ্ধরুমে বসে থেকে থেকে নাহিয়ান হেসে উঠল হু হা করে। পাঁচ সেকেন্ডের ভিতর নিজের হাসি থামিয়ে আগের মতো গম্ভীর হয়ে গেল। রুমে প্রতিধ্বনি হওয়া হাসির তীক্ষ্ণ শব্দ গায়েব হয়ে গেল এর কিছু মিনিট পর। নাহিয়ান উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াতেই ভেসে উঠল পুরুষালি শক্তপোক্ত শরীর। ড্রপ সোল্ডার টি-শার্ট পরণে থাকায় হাতের বড় বড় মাসাল গুলো ভাসছে স্পষ্ট। সাদা রঙের গ্যাবাটিনের প্যান্টটা নিচের দিকে গুটিয়ে ঠাখনুর উপর রাখা। শুভ্র বর্ণের শরীরটা নজরকাড়া সুন্দর। টু-ব্লক-হেয়ার-কাটটা নাহিয়ানের মুখের সাথে মানানসই। ছয় ফুট লম্বা পুরুষটাকে এই হেয়ারকাটে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে। থুতনিতে হাত বোলায় নাহিয়ান। হাতে খোঁচা লাগে ছোটো ছোটো দাড়ির। হাত বোলাতে বোলাতে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে আবারো নিজের রিডিং টেবিলে বসে গেল সে। হাতগুলো মুখের সামনে তোলে ধরতেই বাহির থেকে ঠুকঠুক করে শব্দ আসলো। নাহিয়ান গম্ভীর পুরুষালি ধারালো কন্ঠে বাহিরর মানুষের উদ্দেশ্যে বলল,”কামিং, মিস্টার শেখর রায়।
নাহিয়ানের ধীরতা নিয়ে লোকটাকে ডাকা দেখে বোঝা গেল এতক্ষণ উনার অপেক্ষায় এই স্টাডি রুমে বসে সে।
শেখর রায় অনুমতি পেতেই ভিতরে প্রবেশ করলেন। হাতে উনার একদলা কাগজের স্তুপ। রিডিং টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই নাহিয়ান হাত দিয়ে দেখাল সামনের চেয়ারে বসার জন্য। শেখর রায় চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। কাগজ বললে ভুল, মোটা মোটা দুটো ফাইল রাখেন কাচের টেবিলের উপর মিস্টার শেখর। নাহিয়ান ফাইলগুলো দেখেই নিজের রিডিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে ছোট্ট লেন্সের এক জোড়া কালো ফ্রেমের চশমা বের করে। চোখে এঁটে নিয়ে নাহিয়ান তার পুরুষালি গম্ভীর চিত্তে বজায় রেখে বলে,”What’s the girl’s name, Mr. Shekhar Roy?
শেখর রায় চোখ নিচের দিকে নামিয়ে নিয়ে বলে উঠেন,”সৈয়দা নুসরাত নাছির।
কাগজের স্তুপের দিকে নাহিয়ান চোখ বোলাতে বোলাতে বলল,”এইয ?
শেখর উত্তর দিলেন,
“নাইন্টিন।
নাহিয়ানের মুখ দিয়ে বের হয়ে আসলো পারফেক্ট। ফাইলগুলোতে চোখ বোলাতে বোলাতে আবারো একই ধীরতা নিয়ে পুরুষালি পুরু কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,”ওয়েট?
শেখর আবারো নিরুদ্বেগ কন্ঠে বললেন,
“জি স্যার, ফোর্টি এইট।
নাহিয়ান এবার চোখ তুলে তাকায় শেখর রায়ের দিকে। ঠান্ডা কন্ঠে জানতে চায়,”বিবাহিত নাকি অবিবাহিত?
“স্যার এই বিষয়ে কোনো উত্তর খুঁজে পাইনি এখনো৷ কারণ অনেকেই বলছে বিবাহিত আবার অনেকে বলছে ম্যাম অবিবাহিত।
নাহিয়ান মাথা দোলাল। তীক্ষ্ণ কন্ঠে মিস্টার শেখরকে উদ্দেশ্য করে শক্ত গলায় বলে,” এখন আপনি আসতে পারেন মিস্টার শেখর। আবার প্রয়োজন হলে ডেকে পাঠাব। এন্ড আপনাদের ম্যাডামের দিকে নজর রাখবেন। প্রতিটি সেকেন্ডে কী কী করছেন তার এক একটা সূক্ষ্ম ইনফরমেশন আমি চাই।
মিস্টার শেখর ওকে স্যার বলে উঠতে যাবেন এর মধ্যে, নাহিয়ান আবার ডেকে উঠল। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে,”মিস এর ইনফরমেশন বের করতে তিনদিন কেন সময় লাগল আপনাদের?
মিস্টার শেখর কিছুটা ভরকে গেলেন। মৃদু কন্ঠে ডেকে উঠলেন,”স্যার..
নাহিয়ান ঠোঁট টিপল। কপালে ভাঁজ ফেলে গমগমে পুরুষালি হাস্কি গলায়, শাসনো কন্ঠে বলল,”স্যার.. আমি শুনতে চাইনি মিস্টার শেখর। আমি আমার প্রশ্নের উত্তর চাইছি আপনার কাছে।
মিস্টার শেখর ঢোক গিললেন। ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন,”স্যার আপনি বলেছিলেন ম্যামের বাসা বাহ্মণবাড়িয়া। গত দু-দিন যাবত আমরা সবাই উনার খোঁজ করেছিলাম সেখানে, কিন্তু কোনো সন্ধান পাইনি। এরপর জানা গেল যে, ম্যাম ওখানে বেড়াতে গিয়েছেন, উনি ফ্লাইটে বা ট্রেনে করে যাননি, বায় রোড গিয়েছিলেন, এজন্য একটু সময় লেগেছিল ম্যামের খোঁজ পেতে।
নাহিয়ান ক্ষূর চোখে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে মিস্টার শেখরকে,”ম্যাডামের বাসা কোথায়?
মিস্টার শেখর অত্যন্ত কোমল কন্ঠে জানান,
“সিলেটে।
সকাল ছয়টা। সৈয়দ বাড়ির বাগানে বসে আছে ইসরাত চোখ বন্ধ করে। একবার নাক বন্ধ করে সকালের শীতল বাতাস আরোহণ করছে নিজের মধ্যে। আবার শ্বাস ফেলে নিজের ভিতরের কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের করে দিচ্ছে। এক-সময় এরকম করতে করতে নাক বন্ধ হয়ে গেল মেয়েটার। অক্সিজেনের সূক্ষ্মতা অনুভব করতেই চোখ খুলে তাকাল। চোখের উপর কালো কিছুর আবরণ দেখে ভরকে গেল। ভরকে গিয়ে চিৎকার করতে যাবে এর মধ্যে নুসরাতের গলার স্বর ভেসে আসলো।
” ভাই এখানে বসে কী করছিস? বাইরে গিয়ে কুংফু কর তাহলে একদিন রোগা-পাতলা হয়ে যাবি পাতলুর মতো।
নুসরাত কথা শেষ করে এক হাতে সামনে এনে হু হা করতে শুরু করল। ইসরাত নিজের মুখের উপর থেকে জিনিসটা সরাতেই চোখে ভাসল আন্ডারওয়্যার। ওয়াক ওয়াক করে বমি করতে যাবে নুসরাত বলল,”বোন আমার থাম, এভাবে বমি-টমি করে আমার এত সুন্দর বাগান নষ্ট করিস না। এটা আমি গত সপ্তাহে লোকাল বাজার থেকে ফকফকা পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়ে তোর জন্য স্পেশালি কিনেছি, যাতে তুই এতে সর্দি মুছতে পারিস। বল একদম ভালো কাজ করেছি না? তুই তো আবার লোকাল জিনিস ইউজ করিস না, ব্রারান্ডের মাল ইউজ করিস।
নুসরাত কিছুটা টেনে টেনে বলল শেষের কথা। ইসরাত চোখ তুলে নুসরাতের দিকে তাকায়, যে হাসি হাসি মুখ করে ইসরাতকে অবলোকন করছে। দ্বিধা ভরা কন্ঠে সত্যতা যাচাই করতে জানতে চায়,”সত্যি?
নুসরাত বিরক্তি নিয়ে এগিয়ে আসে ইসরাতের দিকে। টেনে মাদুর থেকে তুলতে তুলতে বলে,”আমার মা, আমি মিথ্যা কথা বলিনা তুই জানিস না? আমি কী তোর মতো একটা বোকা মেয়েকে মিথ্যা কথা বলতে পারি?
নুসরাতের কথা শেষ হতেই ইসরাতের হাতের গাট্টা লাগে তার মাথায়। ইসরাত কাঠকাঠ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,”মিথ্যা কথা বলার জায়গা পাস না? তুই আর মিথ্যা দু-জন একে অপরের খালাতো ভাই-বোন।
নুসরাত ইসরাতের মাথা হাতে দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে বলে উঠে,”এত সত্যি কথা বলতে নেই, চল পার্কে একটু হাঁটা-হাঁটি করে আসি।
ইসরাত যেতে চাইল না, নুসরাত এক প্রকার টেনে নিয়ে গেল বাড়ির বাহিরে। অজ্ঞতা না চাইতে ও যেতে হলো নুসরাতের টানাটানি কাছে হার মেনে নাছির মঞ্জিলের বাহিরে। সৈয়দ বাড়ির পার হওয়ার সময় দেখা হলো হেলাল সাহেবের সাথে। ইসরাত মৃদু কন্ঠে সালাম দিল। হেলাল সাহেব সালাম নিয়ে তা আবার ফিরিয়ে দিলেন।
নুসরাতের এতটুক সময় নেই, সে কোনোরকম সালাম করে ভাগল সেখান থেকে বড় বড় পা ফেলে। নিজাম শিকদার নিজের বারান্দা থেকে জিনিসটা লক্ষ করে বিড়বিড় করে আওড়ালেন,”বেয়াদব মেয়ে।
পার্কের ভিতর প্রবেশ করতেই দেখা হলো ইরহামের সাথে নুসরাতের। ইসরাত ততক্ষণে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে নুসরাতের থেকে। ইরহাম নুসরাতকে দেখতেই দৌড় দিয়ে আসলো দু-হাত মেলে। নুসরাত ও দৌড় মেরে গিয়ে ঝাপটে জড়িয়ে ধরল। ইরহামের পিঠে নুসরাত হাত বোলায়। দু-জন এক সাথে হেসে ওঠে অনেকদিন পর দেখা হওয়ার জন্য। ইরহাম মিনমিন করে জিজ্ঞেস করে,”ভাই কবে আসছত বাড়িতে?
নুসরাত ইরহামের কাঁধ চেপে ধরে পার্কের ভিতরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলে,”গতকাল রাতে।
ইরহাম অবাক কন্ঠে বলে ওঠে,
“তোকে একটা কথা জানাতেই ভুলে গিয়েছি।
নুসরাত অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
” কী?
“ছোট ভাইয়া ও বাহ্মণবাড়িয়া ছিল এতদিন, আর গতকালই এসেছে।
নুসরাত ইরহামের কথা সম্পূর্ণ এড়িয়ে যায়। শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,”বল তোর দিন কাল কেমন কাটছে?
দু-জন কথা বলে বলে পার্কের অন্য রাস্তা দিয়ে চলে যায়। কিন্তু ইরহামের সাথে হাঁটতে আসা সুফি খাতুন তীক্ষ্ণতা নিয়ে তাকিয়ে থাকেন দু-জনের গলা পেঁচিয়ে হাঁটার দিকে। দু-জন দু-জনের সাথে এত মাখামাখি ভাব তিনি মোটেও মেনে নিতে পারলেন না।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফন্দি আঁটলেন কীভাবে কথাটা ঝর্ণার কানে তোলা যায়। এবং সেই বুদ্ধি আসতেই উল্টো পথে ফিরে হাঁটা ধরলেন। শুভ কাজে দেরি কীসের! এক্ষুণি ঝর্ণার কাছে গিয়ে আলাপ বসাবেন এবং এটা ভালোভাবে জেনে আসবেন, প্রাপ্তবয়স্ক বাচ্চাদের এভাবে ঢলাঢলি করতে দেন কেন উনারা? কোনো কী দায়িত্ব-জ্ঞান নেই উনাদের ভিতর! চ্যাহ চ্যাহ তার তো চোখই নাপাক হয়ে গেল। কী জঘন্য জিনিস দেখে ফেলেছেন আজ। সুফি খাতুন নাছিরের কানে কথা তুলবেন ভেবে ও বাদ দিলেন। নাছির গতকাল যা অপমান করেছিল তা কী কম! আর এই বেটার কথা ছাড়া নাছির এক পা হাঁটে না, তা সুফি খাতুন ভালো করে জানেন। তাই নিজেকে অপমান করার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সুফি খাতুন নাছির মঞ্জিলে না যাওয়াই ভালো মনে করলেন। আর আরো একটা জিনিস তিনি কোনোদিন ভুলবেন না। মরার আগ পর্যন্ত মনে রাখবেন নাছিরের সেই অপমান।
পার্কের ভিতর নুসরাতকে খুঁজে না পেয়ে ইসরাত ফিরে গেল বাড়ির দিকে। রাস্তার পাশ ঘেঁষে বেড়ে ওঠা সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে থাকা একটি ছোট্ট বিড়ালের সাথে দেখা হলো ইসরাতের। ইসরাত বিড়ালটা কোলে তুলে নেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় যত্ন সহকারে। হাত বোলাতে বোলাতে নিজের হাতের সাথে মাফ-ঝুক নেয়। তার হাত থেকে ও ছোটো বিড়ালটা। তখনই নিজের পেছন থেকে ভেসে আসে স্পষ্ট জায়িনের গলার আওয়াজ,”ইসরাত বিড়াল পরিস্কার নয়, আপনি কেন বিড়ালটিকে পরিস্কার না করে স্পর্শ করছেন?
ইসরাত কেঁপে উঠল গমগমে পুরুষালি পুরু কন্ঠে। নিজের পিছন থেকে ভেসে আসছে পুরুষালি গলাটা। কপাল কুঞ্চিত করে ভাবে, আগে বলে দিলেন না কেন? তাহলে তো পরিস্কার করে স্পর্শ করতাম। মনের কথা মনে রেখে জায়িনের মুখ দেখার জন্য ঘাড় বাঁকায় সামান্য, অক্ষিকোটরে ভাসে পুরুষালি শুভ্র বর্ণের মুখ। জায়িন ঠোঁট জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে, বিড়ালটাকে ইসরাতের হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয়। আবারো ঘাসের উপর বিড়ালটকে রেখে দেয়। তারপর পকেটে হাত ঢোকায়। কিছু একটার খোঁজ করে পকেটে হাতায়। হাতে কাঙ্ক্ষিত বস্তুর স্পর্শ পেতেই মুঠোয় পুরে নেয়।
ইসরাত কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে ছিল জায়িনের দিকে, জায়িন জিনিসটার মুখ খুলে ইসরাতের হাতে স্প্রে করতে করতে বলে ওঠে,”ও এখনো ছোট তাই ওকে এখানে রাখুন, বড় হলে নিয়ে যাবেন নিজের বাসায়।
ইসরাত মেনে নেয়, শান্ত ভঙ্গিতে জায়িনের কথা। চুপচাপ চলে যেতে নিবে জায়িন হাত টেনে ধরে। ইসরাত প্রশ্নাত্মক চাহনি ছুঁড়ে দিতেই জায়িন বলে,” বাসায় গিয়ে হাত ভালো করে পরিস্কার করে নিবেন।
ইসরাত নিজের হাত ছাড়ায় না জায়িনের হাত থেকে। পুরোপুরি শরীর ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে। দু-হাত আড়াআড়ি বুকে বেঁধে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,”আপনি যে একজন কার্ডিলজিস্ট সেটা বারংবার আমাদের বুঝাতে হবে না! আমি জানি কীভাবে নিট এন্ড ক্লিন থাকতে হয়!
জায়িন জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। ইসরাতের হাত আরেকটু বল প্রয়োগ করে চেপে ধরে বলে ওঠে,”আমি সেটা বলেনি ইসরাত আপনাকে।
“আপনি যাই বলুন, আপনার কথার শুরু হয় ডিসিপ্লিন দিয়ে, আর শেষ হয় ও ডিসিপ্লিন নিয়ে।
ইসরাত শীতল কন্ঠে বলল। কথা শেষ করে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই জায়িন ইসরাতের কব্জি চেপে ধরল। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,” লাফ-ঝাপ করছেন কেন ইসরাত? আপনি না শান্ত, ভদ্র মেয়ে? তাহলে শান্ত, ভদ্র, সুশীল মেয়ে হয়ে দাঁড়িয়ে থাকুন আমার সাথে।
ইসরাত ব্যগ্রতা নিয়ে জায়িনের প্রশ্নের উত্তর দেয়,
“সেটা আমি জানি মিস্টার। এবার আমার হাত ছাড়ুন, নয়তো আমি চিৎকার করব।
জায়িন দু-কাঁধ উচায়। নির্লিপ্ত চোখে ইসরাতকে উপর থেকে নিচে অবলোকন করে নির্বিকার কন্ঠে বলে ওঠে,”তো চেঁচান না! আমি কী ভয় পাই নাকি আপনার চেঁচানো!
ইসরাত আঙুল তুলে শাসানোর জন্য, জায়িন নিজের আঙুল দ্বারা আলগোছে তা নামিয়ে দেয় নিচের দিকে। ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে,” ইসরাত মুখের সামনে তর্জনী আঙুল তোলা আমি মোটেও পছন্দ করিনা। নেক্সট টাইম করবেন না এটা।
ইসরাত সরু চোখে দেখে জায়িনকে। ক্ষূরতা নিয়ে বলে,
“তা আমার দেখার বিষয় নয়,আপনাকে কী বিরক্ত করে আর কী না করে!
জায়িন ইসরাতের কব্জি একটু শক্ত করে চেপে ধরে অন্য রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে,”অবশ্যই। কারণ আমার ভবিষ্যতের দায়িত্ব আপনার উপর নির্ভর করে।
ইসরাত চেঁচাতে যাবে, জায়িন ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল,”চুপ, একটা শব্দ নয় ইসরাত।
ইসরাত মুচড়ে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে ওঠে,”আমি কিন্তু চেঁচাবো বলছি, ছাড়ুন আমার হাত।
“তো চেঁচান! আমি না করেছি নাকি! এতে কিন্তু আপনারাই লস।
ইসরাত প্রশ্নাত্মক চাহনি নিয়ে জায়িনকে জিজ্ঞেস করে,
“কীভাবে?
“দেখুন ইসরাত আপনি চিৎকার করবেন, মানুষ আসবে আপনাকে বাঁচাতে, তখন আমাকে জিজ্ঞেস করবে আমি কেন আপনাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি? আমি সোজা উত্তর দিব আপনি আমার বউ বারো বছর আগে বিবাহ করে রেখে গিয়েছিলাম এখন বউ বিবাহ মানছে না, তাই বউকে আমার ভাষায় বুঝাতে একটু ওই দিকে নিয়ে যাচ্ছি।
ইসরাত উপর নিচ মাথা নাড়াল জায়িনের কথায়। আবার তড়াক করে জিজ্ঞেস করল,” কিন্তু প্রমাণ কোথায় আপনি আমার স্বামী?
জায়িন হাসল। ইসরাতের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,”আমাকে এত বোকা ভাববেন না ইসরাত, আমি মাঠে খালি হাতে নামিনি। বেট-বল, স্টাম্প, প্লেয়ার, আম্পায়ার সব নিয়েই নেমেছি।
“আমার প্রশ্নের উত্তর আমি পাইনি?
ইসরাত রিনরিনে গলায় বলে ওঠে।
জায়িন ইসরাতের মাথায় হাত দিয়ে টোকা দিয়ে বলে,”বোকা ইসরাত! আমার কথার মধ্যেই উত্তর আছে, আপনি কষ্ট করে জ্ঞান কাজে লাগিয়ে খুঁজে নিন।
ইসরাত জায়িনের চওড়া পুরুষালি পৃষ্ঠদেশের দিকে তাকিয়ে থাকে। নাকে ম্যানলি পারফিউমের কড়া ঘ্রাণের সাথে পুদিনাপাতার আর কোলনের ঘ্রাণ আসছে। ইসরাত চোখ বন্ধ করে মিষ্টি সেই ঘ্রাণটা টেনে নেয় নিজের ভিতর।
জায়িন পিছনে ইসরাতকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে, মনে করে পালানো চেষ্টা করছে মেয়েটা। তাই ঘাড় ঘুরিয়ে তড়াক করে তাকায় পিছনে। ইসরাত তখনো নিজ জায়গায় স্থির দাঁড়িয় থেকে মিষ্টি সেই ঘ্রাণটা টেনে নিচ্ছে নিজের ভিতর। জায়িন স্থির দাঁড়ানো ইসরাতের দিকে এক পা এগিয়ে যায়, তারপর দু-পা, তারপর তিন পা, এরকম করে একদম ইসরাতের সন্নিকটে চলে আসে। টানটান হয়ে দাঁড়ানো জায়িন সামান্য গ্রীবা বাঁকিয়ে নিজের মুখ ইসরাতের মুখের কাছে নিয়ে আসে। রেড চেরির মতো লাল বর্ণের পুরুষালি ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে নাড়িয়ে শীতল কন্ঠে ইসরাতে শোনার মতো করে বিড়বিড় করে আওড়ায়,
প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৯
❝হাজারো বছর আপনার দিকে
তাকিয়ে থাকলেও, আমার চোখের
তৃষ্ণা কখনোই মিটবে না…! ❞