প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১৪

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১৪
জান্নাত নুসরাত

আরশ নুসরাতের গায়ে ঢলে পড়তে পড়তে মৃদু কন্ঠে আওড়াল,”ধান্দাবাজ মহিলা,আগে আমায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যা! মরে গেলে জ্বালানোর জন্য আমার মতো কাউকে কোথাও খুঁজে পাবি না। গাধী কোথাকার,আগে রক্ত স্টোক করতে বসে গেছে।

দক্ষিণে হাওয়া বইছে পরিবেশে। দুপুরের মিয়েই যাওয়া আলোকছটা গড়িয়ে পড়ছে নাছির মঞ্জিলের ছাদে। কিছুটা আলো ইসরাতের বারান্দা হয়ে রুমে প্রবেশ করছে। মৃদুমন্দ বাতাসের তোড়ে দুলছে সাদা রঙের পর্দা। বারান্দার কাচের দরজাখানা ঠা করে রাখা। কালো রঙের খাজকাটা টাইলসে আলোক ছটা পড়ায় চিকচিক করছে। রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল ইরহাম। পায়ের গতি অস্বাভাবিক। কিছু বলতে নিবে তার আগেই নাকে এসে লাগল আঁশাটে কিছুর গন্ধ। হাত দ্বারা নাক চেপে ধরে এগিয়ে আসলো মেঝেতে শুয়ে থাকা নুসরাতের দিকে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বিছনার এ-পাশ থেকে নুসরাতের পা দেখা যাচ্ছে শুধু। ইরহাম মুখ সামনের দিকে নিয়ে উঁকি ঝুঁকি মারতেই চোখে ভাসল নুসরাতকে। আর তখনই মুখ দিয়ে বের হলো অতর্কিত চিৎকার। পেছন থেকে এসে ইসরাত হেসে ইরহামের পিঠে হাত ছোঁয়াতেই ভয়ে চোখ-মুখ খিঁচে লাফ মেরে বিছানার উপর ওঠে গেল সে। জোরে জোরে চিৎকার করে পড়তে লাগল,”কুল আউজুবি রাব্বিনাস। ইয়া রাব্বুল আলামিন আপনি এই ভুতনীদের রুহের মাগফিরাত দান করুন।
বাকি কথা শেষ হওয়ার আগেই পা জ্বলে ওঠল কারোর আকস্মিক হামলায়। পা চেপে ধরে এক চোখ খুলতেই কটমট করে খেয়ে ফেলার মতো লুক দিল ইসরাত।

ওড়না কোমরে বেঁধে হাতের ঝাড়ু উপরে তুলে তেড়ে আসলো ইরহামের দিকে। ইরহাম ভয়ে এক লাফে নিচে নেমে যেতেই নুসরাতের পায়ের সাথে পা বেজে উল্টে পড়ল নিচে। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় ইসরাত যখন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে, তখন ইরহাম পা চেপে ধরে আর্তনাদ করতে ব্যস্ত। ইরহামের কিছু বুঝে ওঠার আগেই নুসরাত নিজের চোখ থেকে শসার স্লাইজ খুলে ইরহামের হা করা মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিল।
ইরহামের চিৎকার ও এক নিমেষে বন্ধ হয়ে গেল। শসা চিবুতে চিবুতে নুসরাতের দিকে এক পলক চেয়ে জিজ্ঞেস করল,”নাকে মরার মানুষের মতো তুলো ঢুকিয়ে রেখেছিস কেন? শেওড়া গাছের শাকচুন্নি লাগছে তোকে!
ইসরাত চিহ্ চিহ্ করে ওঠল। বমেট করার ভঙ্গি করে জিজ্ঞেস করল,”তোর বমি আসছে না?
ইরহাম আরাম করে শসা চিবিয়ে চিবিয়ে খেল। তারপর ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিয়ে বিরশ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,”বমি আসবে কেন? আমি কী গর্ববতী মহিলা?

ইরহাম দু-হাত পেটের কাছে বেঁধে দু-পাশে নাড়াতে নাড়াতে দেখাল। ইসরাত বিরক্তির মধ্যেও হেসে দিল।
নুসরাত কথা বলল না। অপর চোখ থেকে শসা খুলে সেটা ও ইরহামের মুখে ঢুকিয়ে দিল। তারপর দু-হাত মাথার নিচে দিয়ে আবার মেঝেতে শুয়ে পড়তে নিবে ইরহাম হাত বাড়িয়ে নুসরাতের গালে স্পর্শ করল। মুখে ইউজ করা লাল তরল নাকের কাছে এনে নাক টেনে শুকতেই কফি পাউডারের ঝাঁঝালো ঘ্রাণ তার সাথে আশাটে গন্ধ এসে লাগল। ইরহাম সেসবে পাত্তা না দিয়ে নুসরাতকে উদ্দেশ্য করে বলল,”আমাকে ও লাগিয়ে দে!
নুসরাত চোখ বুজে রেখে, মৃদু গলায় শুধায়,
“কী লাগিয়ে দিব?
ইরহাম নিজের চোয়ালে হাতায়। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলে ওঠে,”মুখের ওসব।

নুসরাত ইরহামকে নিজের পাশের জায়গায় শুয়ে পড়ার জন্য দেখায় হাত দিয়ে কয়েকবার ট্যাপ ট্যাপ করে। ইরহাম শুয়ে পড়তেই তার নাকে দুখানা তুলো ঢুকিয়ে দিয়ে পুরো মুখে স্পেশাল ফেইসমাস্কটা লাগিয়ে দিল। ইসরাত হাতে ঝাড়ু নিয়ে শুধু চুপচুপ দেখল নুসরাত আর ইরহামের কান্ডকারখানা। তারপর ইরহামকে সূক্ষ্ম খোঁচা মেরে তার কথা তাকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল,”তোকে তো এখন শেওড়া গাছের শাকচুন্না লাগছে।
নুসরাত ফোড়ন কাটল ইসরাতের কথায়। মুখ দিয়ে উঁহু রকম একটা শব্দ বের করে বলল,”শাকচুন্না ম্যান ভার্সন তুই বলেছিস কিন্তু তুই জিন বললে সেটা আরো বেশি মানানসই হবে। ইরহামের বাচ্চাকে এখন তাল গাছে বসে থাকা জিন লাগছে।

ইসরাত নুসরাতের সাথে কথা বলতে বলতে পাশে বসল। কিছু একটা চিন্তা মাথায় খেলে যেতেই হাতে তুলে নিল নুসরাতের ফেইসপ্যাক। নাকের কাছে নিয়ে শুকলো, গন্ধটা কেমন যেন! মনে প্রশ্ন জাগল, কীসের গন্ধ এটা? ঠিক ধরতে পারল না। তবুও কিছুটা সন্দেহ নিয়ে এগিয়ে গেল বেডের দিকে।। হেডবোর্ডের আশেপাশে চোখ বুলাতেই ডাস্টবিনের এক পাশে লাল তরল জাতীয় কিছু পড়ে থাকতে দেখল। হাতে তুলে নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে নিবে, তার আগেই নুসরাত চোখ বন্ধ রেখে বলে ওঠল,”ওসব মুরগীর রক্ত। স্পেশালি বিদেশি মুরগীর বুকের ভেতর থেকে আমি বাংলাদেশে ইম্পোর্ট করেছি।

নুসরাতের কথায় ইসরাতের সন্দেহ কাটল না। শিশির মুখ খুলে নাকের কাছে নিতে যাবে চোখ ছোট ছোট হয়ে আসলো। নুসরাতকে কঠোর গলায় জিজ্ঞেস করল,”কী মিশিয়েছিস রক্তে?
নুসরাতের মাথায় কোনো শব্দগুচ্ছ আসলো না। তাই সালফিউরিক এসিডের সংকেত বলে ইসরাতকে কাটাতে চাইল। মুখে বর্তমানে একটা এসিডের নাম আসলো, আর তাই বলে দিল,”এইচ-টু-এস-অ-ফোর। আর ইনভেস্টিগেশন না করে পড়তে বস গিয়ে। নাহলে ডিম পাবি ডিম।
ইরহাম নুসরাতের কথা কেটে দিয়ে পরেরটুকু সে পূরণ করে দিল,”আর সেই ডিম অমলেট করে ইসরাত আপু আর জায়িন ভাই খেয়ে নিবে। তাই না আপি?
ইসরাত রাগী দৃষ্টিতে দু-জনের দিকে তাকাল। নুসরাত আর ইরহাম থোড়াই পাত্তা দিল না-কী! মেঝেতে গড়াগড়ি খেয়ে ইসরাতকে নিয়ে হাসল।

নাছির মঞ্জিলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল মমো। নুসরাত তার পাশে দাঁড়িয়ে লাফঝাপ করছিল বান্ধরের মতো৷ লাফ ঝাপ করছে বললে ভুল হবে পাশের বাসার টসটসে ফলের দিকে লোভী চোখে চেয়ে কীভাবে চুরি করা যায় সে ধান্দা করছে। মমোকে তার পাশে বডিগার্ড হিসেবে দাঁড় করিয়ে রেখেছে যাতে কেউ আসলে তাকে ইনফর্ম করতে পারে। টসটসে ফলের দিকে চোখ স্থির রেখে নুসরাত জিহ্বা বের করে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। মমোকে উদ্দেশ্য করে বলল,”মমোরে মন্টু শালারে বিয়ে করে নে, তাহলে মন্টু বেটার সব ফলগাছ আমার হয়ে যাবে।
মমো বিরক্তিতে চ সূচক শব্দ করল। সে জানতে উদগ্রীব, মন্টুকে বিয়ে করলে তার লাভ কী! তাই মনের প্রশ্ন মুখে করল,”মন্টুকে বিয়ে করলে আমার লাভ?

নুসরাত ভ্রযুগল কুঞ্চিত করল। জ্ঞানী ব্যক্তিদের ন্যায় হাত তুলে ভাষণ ঝাড়ল,”সজীবের মতো একটা বুড়ো শিশু প্রিপায়ারড পাবি। কষ্ট করে বাচ্চা জন্ম দিয়ে তোর টাকা খরচ করতে হবে না, বাচ্চা বড় করতে গিয়ে চোখের নিচে ডার্ক-সার্কেল পড়বে না, মন্টু তোর কথায় উঠবে, বসবে, তুই নাচতে বললে দু-হাত উপরে তুলে দিনতানা দিনতানা বলে নাচবে। আরো লাভ আছে, সজীব তোর মতো কচি মায়ের দেখাশোনা করবে। মন্টু তার পেট দুলিয়ে ডিংডাং করে হেলেদুলে পেটের নাচ দেখাবে, সাথে গান গাইবে, এসে হে আমার প্রাণের সখী। চারিদিকে লাভ আর লাভ, আমি কোনো লোকসান দেখছিনারে মমো।
মমো নুসরাতের আজগুবি কথায় ভেংচি কাটে। নুসরাতকে তীক্ষ্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,”আমার লাভ কী?
নুসরাত তেজি কন্ঠে বলে,

“শোন মমো, সম্পর্কের ক্ষেত্রে লাভ লোকসান দেখতে হয় না। আমি বড় বোন যা বলব,তোর তাই করতে হবে। নাহলে সম্পর্কে এখানেই শেষ।
হঠাৎ সৈয়দ বাড়ির ভেতর থেকে বাহিরে আগমন ঘটল হেলাল সাহেবের। মমোকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাত তুলে ইশারা করলেন এদিকে আসার জন্য। মমো হেলাল সাহেবের ইশারা দু-পাশে না ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে প্রত্যাখ্যান করে। হাত উপরে তুলে দেখায় পরে আসবে। হেলাল সাহেব মমোর কথা শুনতে চাইলেন না, হাত দিয়ে আবারো ইশারা করলেন আসার জন্য। মমো দ্বিমত পোষণ করল। অনিহা নিয়ে না করতে যাবে হেলাল সাহেব দৌড়ে এসে হাত চেপে ধরলেন মমোর। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,”চল!

মমো একটু ইতস্তত করল। না যাবার জন্য ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। হেলাল সাহেব নাছোড়বান্দা, মমোকে ছাড়া তিনি যাবেন না। তাই টানাটানি শুরু করেন। আকস্মিক এমন কাজে মমো অবাক হওয়ার সময় পেল না, তার আগেই হোঁচট খেল। পিচঢালা রাস্তায় পড়ে যেতে নিবে নিজেকে কোনোরকম সামলে নিল।
নুসরাত হেলাল সাহেবকে দেখতেই ফোঁস করে উঠল। মমোকে সৈয়দ বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য টানাটানি করতে দেখে হেলাল সাহেবের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ল নুসরাত। রীতিমতো তাবা মেরে শিকারী বাঘের ন্যায় আঁকড়ে ধরল মমোকে। দু-জনের টানাটানিতে মমো বাকশূন্য হয়ে গেল। হা করে হতবাক নয়নে দু-জনের দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিল।

আর তখনই সৈয়দ বাড়ির দরজার সামনে আগমন ঘটল মাহাদির। সে মাত্র হসপিটাল থেকে ফিরেছে। বুকের কাছের কাপড়ে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ। মমোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সৈয়দ বাড়ির গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে দু-পাশে মাথা নাড়ায়। মৃদু কন্ঠে নিজে নিজেকে বলে ওঠে,”স্ট্রেঞ্জ! এই মেয়ে সারাদিন কী কান্না করে?
চোখ দুটো উপরে তুলে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে করতে শঙ্কায় দু-পাশে মাথা নাড়ায়। নিজে নিজেকে প্রশ্ন করে,”এই বাড়িতে কী সব অদ্ভুত পিসদের বসবাস? হয়তো? কে জানে?

তিনজনের একজন খেয়াল করেনি মাহাদি এসেছে। নুসরাত আর হেলাল সাহেব পুরোদমে দু-জন দু-জনকে চোখ দিয়ে শাসাচ্ছেন। কেউই পেছনে নেই চোখ দিয়ে শাসানোর বেলায়। মমোর ভ্যাঁ করে কান্না হেলাল সাহেবের কানে যেতেই হাত কিছুটা শীতিল হয়ে আসে উনার,কিন্তু নুসরাতের খাঁমচে ধরা হাত শীতিল হয় না। সে কোনোদিকে না তাকিয়ে মমোর হাত ধরে টান দিতেই হেলাল সাহেবের হাতের তালু থেকে মমোর হাত বের হয়ে আসলো ঢিলে হয়ে। এমন জোরালো টানে দু-জন উল্টো গিয়ে পড়ল নাজমিন বেগমের অতি প্রিয় ছোট বাগান বিলাসে গাছের উপর।

নতুন চারাটা এনে কিছুদিন আগে রোপন করেছিলেন নাজমিন বেগম, এটার এমন ধ্বংসাত্মক অবস্থা হতেই নুসরাত ভয়ার্ত চোখে পেছনে তাকাল। শরীরের নিচে চাপা পড়া টব উপরে মমো দুটোর পিষ্টনে জান বেরিয়ে এসে গলার কাছে আটকালো। টবের তীক্ষ্ণ খোঁচায় হাহাকার করে উঠতেই মমো লাফ মেরে ওঠে দাঁড়াল। মমো তেমন একটা ব্যথা পায়নি, কিন্তু নুসরাতের মুখের অভিব্যক্তি দেখে বোঝা গেল হয়তো কোমরের একটা হাড্ডি ভেঙেছে, নয়তো মচকেছে। মুখ খিঁচে সোজা হয়ে বসতে নিবে হেলাল সাহেব হাত বাড়িয়ে দিলেন ওঠার জন্য। নুসরাত হেলাল সাহেবের বাড়িয়ে দেওয়া হাত পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করল। তেজি কন্ঠে বলল,”প্রয়োজন নেই।
কথার ঝাঁজের সাথে ব্যথার প্রকাশ ঘটল। হেলাল সাহেব ভাব নিলেন সামান্য। নুসরাতকে ঠাট্টা করে বললেন,”আইচ্ছা।

নুসরাত হেলাল সাহেবকে তাকে নিয়ে করা ঠাট্টা স্পষ্ট ঠের পেল। চোখ মুখ উল্টে ভেংচি কাটল। মমো দু-জনের মাঝখানে নীরব দর্শক হয়ে দু-জনের একজন আরেকজনকে নিয়ে ঠাট্টা করা দেখল। হেলাল সাহেব মমোকে বললেন,”চল মমো, তোর বড় মামনি আজ চিকেন ফ্রাই করেছে।
মমো কিছু বলতে নিবে নুসরাত ধাক্কা মেরে গেটের ভেতর ঢুকিয়ে দিল তাকে। মমো কী বলতে চায় তা শোনার প্রয়োজন বোধ করল না। এটা দেখাও জরুরি মনে করল না বেচারি মেয়েটা বাঁচল কী মরল! আখিঁ যুগল প্রশস্থ করে চেঁচায়,”কোথাও যাবে না মমো।
হেলাল সাহেব,”এ্যাহ বলে নুসরাতকে ভেংচি কাটলেন। চোয়াল শক্ত করে, কন্ঠে রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে নুসরাতকে ঝাড়ি মেরে বললেন,”তুই বললেই হলো?

নুসরাত মুখ বাঁকায়। হেলাল সাহেবের কথা কপি করে। তারপর একমুহূর্ত বিলম্ব না করে বলে ওঠে,”হ্যাঁ আমি বললেই হলো। এখন আপনি আসতে পারেন মিস্টার হেলাল রজনী।
হেলাল সাহেব নিজের নামের এত বড় অপমান সইতে পারলেন না। তার কত সুন্দর নামকে রজনীগন্ধা বানিয়ে দিল।। হাত তুলে নুসরাতের মুখের সামনে রাখলেন। কাঠখোট্টা গলায় শাসালেন,”চপ্! আমার নাম হেলাল আহমদ কোনো রজনীগন্ধা টজনীগন্ধা না।
নুসরাত মুখের কাছে হাত রেখে বড় একটা হাই তুলে। তর্জনী আঙুল দিয়ে কান খোঁচায়। অতঃপর আবারো হাই তুলতে তুলতে অলসতা নিয়ে হেলাল সাহেবের কথার উত্তর দেয়,”ওই তো একই হলো!
“একই না।

হেলাল সাহেব চিৎকার করে ওঠলেন। আকস্মিক চিৎকারে নুসরাত হুড়মুড় করে পেছনে সরে যায়। ঢোক গিলে নিজের ভয়ার্ত চেহারা লুকাতে চায়, তার আগে হেলাল সাহেব তর্জনী আঙুল তুলে বলে ওঠেন,”একদম বেয়াদবি করবি না। এরকম বেয়াদবি করলে তোকে বিয়ে করবেটা কে?
নুসরাত হেলাল সাহেবের আঙুল আলগোছে নামিয়ে দিল। ইশারা দেখাল মুখের উপর আঙুল তোলা সে একদম পছন্দ করে না, ঘৃণা করে। পরক্ষণে ঠোঁটে দুষ্টু হাসির বাহার খেলা করল। গা দুলিয়ে সামান্য হেসে মাথায় ওড়না টেনে নেয়। লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গি করে নিজের দু-হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে, দু-পাশে দুলতে দুলতে নিজের কথা দ্বারা বোমা ফেলল হেলাল সাহেবের মাথায়। ব্যঙ্গাত্মক গলায়, ঠোঁটে হেলাল সাহেবের গা জ্বালানোর মতো হাসি ঝুলিয়ে রেখে মিনমিন করে আওড়াল,”কেন, আপনার গাধা ছেলেটা করবে!
হেলাল সাহেব ছ্যাত করে ওঠলেন। নিজের ছেলের নামের পাশে গাধা ট্যাগ বসে যেতে দেখে। নুসরাতকে সতর্ক করলেন,”একদম আমার ছেলেকে গাধা বলবি না।

নুসরাত হে হে করে হাসল। যা হেলাল সাহেবের রাগের মাত্রা বাড়িয়ে দিল দ্বিগুণ। একটু আগে হেলাল সাহেব যেভাবে বলেছিলেন আইচ্ছা নুসরাত ও সেরকম টেনে টেনে ব্যঙ্গ করে আওড়াল,”আইচ্ছা।
নুসরাত আর হেলাল সাহেবের ঝগড়া মধ্যে এসে ইসরাত উপস্থিত হলো। গেট ঠেলে বের হয়ে শক্ত কন্ঠে নুসরাতকে বলল,”এ কেমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ তোর?
নুসরাত অপার্থিব আদলে দু-কাঁধ উচায়। ঠোঁট উল্টে নিয়ে নিষ্পাপ মুখ ভঙ্গি করে। ফিসফিসে কন্ঠে বলে ওঠে,”আমি কিছু করিনি।

ইসরাত আচ্ছা বুঝেছি বলল। হেলাল সাহেবের দিকে এক পলক চেয়ে, চোখ নিচে নামিয়ে নিল। নুসরাত ইসরাতের এরকম মাটির দিকে চোখ নামিয়ে নেওয়ার মানে বুঝল না। ইসরাতের এমন আচরণ সে মোটেও বরদাস্ত করতে পারল না। এটা সাংঘাতিক খারাপ আচরণ হিসেবে নুসরাতের নিকট গণ্য হলো। মানুষের সাথে কথা বললে বলবে চোখে চোখ রেখে, সোজা দাঁড়িয়ে, স্পষ্ট, এভাবে চোখ নামিয়ে ভদ্র হওয়ার মানে কী! নুসরাত বুঝে না। তাই ইসরাতের ভদ্রতায় পানি ঢেলে, থুতনি চেপে ধরে হেলাল সাহেবের মুখোমুখি করে দিল। নিজেও বাপ-চাচাদের ন্যায় কপালে গাঢ় ভাঁজ ফেলে বড় বড় অক্ষিপটে হেলাল সাহেবকে অবলোকন করল। তার দৃষ্টি অবিচল, হেলাল সাহেবের দিক থেকে একবিন্দু নড়চড় করল না। শিকারী যেমন শিকারের থেকে চোখ সরায় না, নুসরাত তেমন করে চোখ সরালো না। নিজেকে শিকারী মনে করল আর হেলাল সাহেবকে নিজের শিকার মনে করল। হেলাল সাহেব নুসরাতের দৃষ্টি অবজ্ঞা করলেন। অসহ্যকর কন্ঠে ক্ষীণ আওয়াজে বিড়বিড় করলেন,”হাইডোক্লোরিক এসিডে ডুবিয়ে ছাড়ব তোকে।

নুসরাত কান খাড়া করতেই কানে আসে ঝাপসা কিছু শব্দ। নুসরাত কথাটা মাটিতে ফেলতে দিল না। আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে চিৎকার করে হেলাল সাহেবের কথার প্রতিত্তোর করল,”আমি কী ছেড়ে দেব না-কী,আমি ও একজনকে ফেরাস নাইট্রাসে ডোবাব।
ইসরাত হতবাক নয়নে দু-জনের দিকে চোখ বুলায়। বাকশূন্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,”আপনি কী বাচ্চা বড় আব্বু, ওর সাথে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করছেন কেন?
হেলাল সাহেব উপর নিচ মাথা নাড়ালেন। মুখ দিয়ে ক্ষীণ শব্দে উচ্চারণ করলেন,”হ্যাঁ আমি বাচ্চা!।
নুসরাত চোখ মুখ উল্টে নেয় ব্যঙের মতো। তেরছা কন্ঠে, হেলাল সাহেবকে স্পষ্ট তিরস্কার করে বলল,”এ্যাহ, নাতি নাতনীদের নিয়ে খেলার বয়সে, নিজেকে বাচ্চা মনে করছেন! ময়ূরের পেখম কাক নিজের পেছনে লাগালেই কী কাক ময়ূর হতে পারে? উঁহু একদম না!

নুসরাতের স্পষ্ট তিরস্কারে জ্বলে ওঠলেন হেলাল সাহেব। ক্ষিপ্র পায়ে এগিয়ে এসে নুসরাতকে ধরতে যাবেন নুসরাত উচ্চ শব্দে হেসে ওঠল সাথে ইসরাত ও। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে কান খাঁড়া করে হেলাল সাহেব আর নুসরাতের কথোপকথন শোনছিলেন নাছির সাহেব। নুসরাত আর ইসরাতের হাসির শব্দ শুনতেই এতক্ষণের চেপে রাখা হাসি ফুস করে বেরিয়ে আসলো তার। মেয়েদের সাথে তাল মিলিয়ে হু হা করে নাছির সাহেব ও হেসে দিলেন। ইসরাত ঠোঁট টিপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করল কিন্তু নুসরাতের বাজখাঁই হাসির আওয়াজ আর সাথে তার মুখ ভঙ্গি দেখে ইসরাত নিজের হাসি ধরে রাখতে পারল না। এক হাত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে উল্টো পথে দৌড়ে নাছির মঞ্জিলের ভেতর প্রবেশ করল। নাছির সাহেব নিজেও অস্বাভাবিক পরিবেশ ঠান্ডা করার জন্য আলগোছে কেটে পড়লেন।
হেলাল সাহেব বাপ-মেয়ে সবাইকে হাসতে দেখে মেকি রাগ মুখে ফুটিয়ে তোলার বৃথা চেষ্টা করলেন। ধুপধাপ পায়ে সৈয়দ বাড়ির দিকে যেতে যেতে শুভ্র মুখে ক্ষীণ হাসির ছটা ভেসে ওঠল। যা খুবই সূক্ষ্ম, গভীরভাবে অনুধাবন না করলে বোঝা বড়ই মুশকিল।

নিজাম শিকদার থমথমে মুখ বানিয়ে বসে আছেন। কিছুক্ষণ আগে যা দেখেছেন তা এখনো তার নিকট ঘোলাটে। ওই বেয়াদব মেয়ে নিজার ভাইকে কীভাবে গুলি করল,একবার ও কি হাত কাঁপল না এই মেয়ের! নিজাম শিকদার ওঠে দাঁড়ালেন সৈয়দ বাড়িতে খবর পৌঁছানোর জন্য। এভাবে আর বসে থাকা সম্ভব না। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাচ্চা ছেলেটা কী বেঁচে আছি না-কী মরে পড়ে আছে তা এক আল্লাহ ভালো জানে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পথে ড্রয়িং রুমে দেখা হলো আরমানের সাথে। আর তৎক্ষণাৎ মেজাজ চটে গেল নিজাম শিকদারের। নিজের দিক পরিবর্তন করে ঝাড়ি মারতে বসে গেলেন আরমানকে। ঠোঁট কুঁচকে নিয়ে, তিরস্কারের সহিত শুধালেন,”কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?

আরমান নিজাম শিকদারের কঠোর গলা শুনে থমকে দাঁড়ায়। ঘাড় কাত করে প্রশ্নের উত্তর দেয়,”বাহিরে।
নিজাম শিকদারের চটে যাওয়া মেজাজ আরো বেশি চটে গেল। প্রশস্ত গলায় চেঁচিয়ে বললেন ,”বাহিরে তো যাচ্ছো জানি। কেন যাচ্ছো? সেটা জানতে চাচ্ছি?
আরমান গম্ভীর গলায় সরল মনে প্রশ্নের উত্তর দিল,
” বন্ধুর বউকে দেখতে।
নিজাম শিকদার খিঁচে যাওয়া মেজাজে চিরচির করে ওঠলেন। ঠাট্টা করে বললেন,” সারা জীবন কী দেখে যাবে মানষের বউ। আমি বুড়ো যে মরে যাচ্ছি একটা নাত বউয়ের জন্য তাতে তোমার কোনো খেয়াল আছে! আমার কথার কোনো মূল্য আছে তোমার কাছে?সেদিন বললাম যে, নাছিরের বড় মেয়ের দিকে একটু চোখ,কান,মন খোলা রাখতে সেদিকে মন দিয়েছ?
আরমান গম্ভীর গলায় বলল,

“জি রেখেছি। আর কিছু?
নিজাম শিকদার হিংস্র পশুর ন্যায় তাবা মেরে কলার চেপে ধরলেন আরমানের। কানের কাছে নিজের মুখ নিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলে ওঠেন,”মেয়েটাকে নিজের হবু স্ত্রী-র চোখে দেখো।
আরমান মাথা নাড়াল। সে দেখবে মেয়েটাকে হবু স্ত্রীর চোখে। কথা বলতে ইচ্ছে হয় না তার, তারপর ও এখান থেকে কাটতে হলে কথা বলা অত্যাবশক। তাই মুখ দিয়ে কষ্ট করে দুটো শব্দ বের করে,”আর কিছু নাহলে আমি এবার যাই।
নিজাম শিকদার মাথা নাড়ালেন চলে যাওয়ার জন্য। উনি যে পা বাড়িয়েছিলেন সৈয়দ বাড়ির উদ্দেশ্যে একটা খবর দেওয়ার জন্য তা বেমালুম ভুলে গেলেন।

সৌরভিকে সোফায় চুপচাপ বসে থাকতে দেখে জ্বালানোর জন্য একটু এগিয়ে গেলেন। গায়ে গা লাগিয়ে গিয়ে বসলেন। সৌরভির হঠাৎ তার দাদার গায়ে গা লাগিয়ে বসার কারণ খুঁজে পেল না। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে কিছু বলতে নিবে নাকে এসে লাগল বিচ্ছিরি গন্ধ। আর সেই গন্ধে তার পেটের ভেতরের শিরা-উপশিরা গুলিয়ে ওঠল। নাক চেপে ধরে নিজাম শিকদারের দিকে এক পলক চাইতেই বুড়ো হা হা করে হেসে ওঠলেন। হাসির সাথে বয়সের সাথে পড়ে যাওয়া দাঁতের জামি ভেসে উঠল। সৌরভি নাক চেপে ধরে বিরক্তি নিয়ে বলে ওঠে,”ছি্হ দাদা! বায়ূ দূষণ করছো, দূরে গিয়ে করো আমার মুখের কাছে এসে করছো কেন?
নিজাম শিকদার হাসি আটকে কোনোরকম হাস্যরস কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,”ঘ্রাণ কেমন? ঘ্রাণে তো ঘ্রাণেন্দ্রিয় জুড়িয়ে গিয়েছে তাই না?

সৌরভি উঠে দাঁড়িয়ে পুরো ড্রয়িং রুমে এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করতে করতে আওড়ায়,”ঘ্রাণ ইন্ধ্রিয় জুড়ায়নি, কিন্তু অনেক বেশি বমির উদ্রেক হচ্ছে।
সৌরভির রাগী কন্ঠে হেসে ওঠলেন আশি ঊর্ধ্বে থাকা বুড়ো। সৌরভির মধ্যে নিজের স্ত্রী পেয়ারা বেগমের প্রতিচ্ছবি দেখলেন। সেদিকে নিষ্পলক দৃষ্টি স্থির রেখে ডুবে গেলেন পুরোনো কিছু স্মৃতিতে। সেই স্মৃতিচারণ করার মধ্যে সৌরভি এসে চুটকি বাজাল নিজাম শিকদারের চোখের সামনে, তখনই কেঁপে ওঠে তড়িৎ গতিতে চোখ ফিরালেন সৌরভির দিকে। উদাসীন চেহারা নিয়ে ক্ষীণ হেসে সৌরভি কাঁধ জড়িয়ে নিস্প্রভ কন্ঠে বলেন,”তোর জন্মের পর আমি তোর নাম পেয়ারা বেগম রাখতে চাইছিলাম, কিন্তু তোর বাপ আমাকে তোর নাম পেয়ারা বেগম রাখতে দেয়নি।

নিজাম শিকদারের কথায় ছেলের প্রতি কিছুটা রাগ প্রকাশ পেল। সৌরভি হাসতে হাসতে ঢলে পড়ল নিজাম শিকদারের পেটের ওপর। কম্পিত অধর জোড়া চেপে হাসি থামানোর চেষ্টা করতে লাগল। অতঃপর নিরর্থক অভিমত পোষণ করে বলে ওঠল,”আল্লাহ বাঁচাইছেন, আব্বু যদি সেদিন দ্বিমত পোষণ না করতো তাহলে আজ আমার নাম পেয়ারা বেগম হতো। ভাবতেই কেমন গা গুলাচ্ছে দাদা! মানুষ আমার নাম নিয়ে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে।

নিজাম শিকদার সৌরভির এমন কথায় অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। তার স্ত্রীর নামে কোথায় খারাপ আছে? পেয়ারা কত সুস্বাদু একটা ফল। উনার স্ত্রী যেমন নামে মিষ্টি ছিলেন দেখতে ও ছিলেন মিষ্টি। নিজাম শিকদার সৌরভির হাসাহাসি মুখ দেখে বেজায় চটে গেলেন। এ-কথা সে-কথা বলে দু-জনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়ে বড়সড় একটা গ্যাঞ্জাম লেগে গেল। যার কুফল হিসেবে একদম ভুলে গেলেন সেই বেলা নুসরাত যে আরশকে শুট করেছিল তা। পরে যখন মনে হলো কিছু একটা ভুলে গেছেন তখন অনেকক্ষণ ভাবার পরও মনে হলো না, আসলে কী ভুলে গেছেন! তাই নিয়েও আরেকবার সৌরভির সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হলেন আশি ঊর্ধ্ব লোকটা।

রেস্টুরেন্টে এক কোণে বসে আছেন হেলাল সাহেব। চোখ সরু করে তীক্ষ্ণ চোখ বুলাচ্ছেন দু-জন সামনে বসা লোকের দিকে। তার বিজ্ঞ চোখগুলোর সরু দৃষ্টির তোপে পড়ে সামনে বসা দু-জন একটু বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল। কিছুটা ভয় পেল লোকটাকে চোখের মণি এমন সরু সরু করে তাকানো দেখে। দু-জন নড়েচড়ে বসল। কালো বাকেট হ্যাটটা টেনে ঠিক করে নিল। দুজনই নিজেদের ভালো ইম্প্রেশন দেওয়ার চেষ্টা করল। একটা কথা আছে না, ফাস্ট ইম্প্রেশন ইজ লাস্ট ইম্প্রেশন। তাই প্রথম দেখায় নিজেদের যথাসাধ্য ভালো দেখানোর চেষ্টা দু-জন ব্যস্ত হলো। টাকার বান্ডিলের একটা খাম দু-জনের দিকে এগিয়ে দিয়ে ইশারা করলেন বিপরীত সিটের দিকে। দু-জন হেলাল সাহেবের দৃষ্টি অনুসরণ করে একবার চোখ বুলিয়ে নিল বিপরীত দিকের সিটে। যেখানে একটা মেয়ে কুর্তি পরে বসে আছে।
গলা খাঁকারি দিয়ে হেলাল সাহেব দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন সামনে বসা দু-জনের। ফিসফিস কন্ঠে সামনে বসা দু-জনের উদ্দেশ্য আদেশ দিলেন,”ওই মেয়ের সব তথ্য আমার চাই। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কী কী করে ওই মেয়ে এ-টু-জেড সব খবর চাই। বুঝেছ?

কার্টুনের মতো মুখাবিশিষ্ট দু-জন উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। হেলাল সাহেব ফিসফিস করে আবার দু-জনকে বললেন,”ভালো করে কাজ শেষ করলে বোনাস পাবে। আর বাকি টাকা কাজ শেষে পাবে।
এর মধ্যে কুর্তি পরা মেয়েটা উঠে দাঁড়াল। সেটা আড় চোখে দেখতেই নিজের মুখ কার্ড দিয়ে ঢেকে ফেলেন। এক এক করে দুটো মেয়ে পাশ কাটাল তাদের। সামনে বসা লোক দুটো উঁকি দিল মেয়েটাকে ভালো করে দেখার আশায়। হেলাল সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল,”স্যার কোন মেয়ে? আসলে এখানে তো দেখছি দুটো মেয়ে।
হেলাল সাহেব হাতের ইশারায় দেখালেন,

“ওই যে ওই মেয়ে,দেখতে পাচ্ছো?
দু-জনের একজন ও কিছুই বুঝল না, আসলে হেলাল সাহেব কোন মেয়েকে দেখাচ্ছেন। তবুও চোখাচোখি করে মিথ্যা বলল,”জি জি, দেখেছি।
হেলাল সাহেব বিরক্তি নিয়ে শুধালেন,
“তাহলে বসে আছো কেন? যাও মেয়েটাকে ফলো করো!
দু-জন ওঠে দাঁড়িয়ে চোখ সানগ্লাস লাগিয়ে নেয়। একসাথে বলে ওঠে,”যা আদেশ করবেন স্যার।

নাহিয়ান আবরার পূর্বের সাথে নুসরাতের আবারো দেখা হলো হসপিটালের করিডোরে। নুসরাত না দেখার মতো করে উপরের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ পাশ কাটাতে চাইল তার আগেই বেটা এসে রাস্তা আটকে দাঁড়াল। নুসরাত বিরক্ত হলো এই বেটার ওপর প্রচুর। চোখ তুলে তাকিয়ে, বাজ পাখির ন্যায় চেয়ে রইল। হাত নিশপিশ করে ওঠল কয়েকটা লাগানোর জন্য। একহাত দিয়ে চেপে ধরল আরেক হাত। নাহিয়ান আবরারকে পাশ দিয়ে কেটে পড়তে চাইল তার আগেই নাহিয়ান জিজ্ঞেস করল,”কোনো সমস্যা মিস?
নুসরাত নাহিয়ানের কথার উত্তর দিল না। না চেনার ভান করে ভীর ঠেলে যাওয়ার মতো করে পাশ কাটাতে কাটাতে বলে,”ওয়াট দ্যা ফাক! একটু দেখি তো!

নাহিয়ানকে ওখানে দাঁড় করিয়ে রেখে নুসরাত কেটে পড়ল তড়িৎ গতিতে। নুসরাত পালিয়ে যেতেই নাহিয়ানের ঠোঁটে ফুটে উঠল অদৃশ্য হাসির রেখা। নিজের ক্লিনসেভ থুতনিতে হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করে আওড়াল,”ইন্টারেস্টিং।
তৌফ পেছন থেকে চিমটি কাটল লেভিনকে। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,”ভাই এরকম ইন্টারেস্টিং বলে বিড়বিড় করে কেন? উনি কী আর কোনো মহিলা পায়নি? এই বেটাদের মতো চলাফেরা করা মহিলাকে দেখে তার কীভাবে ইন্টারেস্টিং লাগে!
লেভিন ঠোঁটে হাত রেখে চুপ দেখায়। তৌফ চোখে মুখে কৌতূহল এনে আবারো ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে,”মাঙ্গের নাতি, তুই আমারে শুধু চুপ থাকতেই কছ? একটা কথা বলবার দেছনা! দিব না-কী খাস বাংলায় একখান গালি?

লেভিন ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে নাহিয়ানের পেছন পেছন চলে গেল। তৌফ লেভিনের পেছনে যেতে যেতে মৃদু কন্ঠে নিজের সাথে কথা বলে,”ওই মহিলার কাছে ভাত পায় না, আবার দেখলেই বলে ইন্টারেস্টিং। আমাগো সাথে ভাব লন ভাই আবার ভদ্র মহিলার সামনে গেলে একদম ভালো, নাদান শিশু হয়ে যান। তবুও ভদ্র মহিলার কাছ থেকে এক রত্তি পাত্তা পান না। আমাগো সাথে এরকম ভাব না নিয়া ভদ্র মহিলার সাথে নিলেই তো পারেন ভাই। ভাবওয়ালা বেডামানুষ! বেডা মানুষের এত ভাব থাকা ভালা লক্ষণ না।
তৌফ পেছনে থেকে কতগুলো গালি খরচ করে সবার উদ্দেশ্যে। নাহিয়ান তৌফ বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতেই এক দৌড়ে তার পাশে ঘেঁষে এসে দাঁড়ায় সে। মিনমিনে কন্ঠে বলে ওঠে,”জি ভাই।
তৌফকে কিছুটা ইশারা করতেই তৌফ অন্যদিকে চলে যায়। লেভিনের সাথে কিছু রাজনৈতিক পরামর্শ করতে করতে সামনের দিকে পা বাড়ায়।

নাহিয়ান সবাইকে নিয়ে করিডোর পার করে হসপিটালের বাহিরে চলে যেতেই, দেয়ালের পেছন থেকে চুপিচুপি বেরিয়ে আসলো নুসরাত। বিরক্তি ঝড়ে ঝড়ে পড়ছে তার মুখ দিয়ে। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করল,সব মাথা-মোটারা কী তোর পেছনেই পড়ে? সেই চিন্তা বাড়িতে বসে আরাম করে করবে বলে তুলে রাখল নুসরাত, এখন ইরহামের জন্য অপেক্ষা করাটা জরুরি।
করিডোরে ইরহামের অপেক্ষায় যখন এপাশ-অপাশ করছিল তখন দু-জন লোককে তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখল। সে ওদের দিকে তাকাতেই দু-জন উল্টে ফিরে কথা বলতে লাগল। নুসরাত নিজ মনে বিড়বিড় করল,”গাধারদল।

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১৩

হঠাৎ কোনো পূর্ব বার্তা ছাড়া ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। নিকষ কালো ধরণীকে আলোকিত করে বিদুৎ ঝলকে ওঠল। নুসরাত নিজের অভিব্যক্তি নির্লিপ্ত রেখে মেয়েলি তীক্ষ্ণ চোখ জোড়া নিক্ষেপ করে অদূরপানে। পেছন থেকে কারোর হেঁটে আসার শব্দ শুনে কান খাড়া করে। পেছন ফিরে কে এসেছে দেখার আগেই ব্ল্যাকবেরির মিষ্টি ঘ্রাণ নাক চিড়ে ভেতরে প্রবেশ করে। সামনের দেয়ালে নিজের পেছনে বৃহৎকার প্রতিবিম্ব দেখতে পায়। স্থির দাঁড়িয়ে সরু চোখে দেখতে থাকে সেই প্রতিবিম্বকে। দেয়ালে থাকা পুরুষালি প্রতিবিম্ব ধীরে ধীরে নিচু হয়ে আসে তার দিকে। যতক্ষণে টনক নড়ে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। নির্দিষ্ট দূরত্বে সরে যাওয়ার আগে পুরুষালি শক্ত বুকের কাছে পিঠ ঠেকে তার। বলিষ্ঠ একহাত গলা পেঁচিয়ে ধরে, কানের কাছে হিসহিসিয়ে আওড়ায়,”এগেইন আ’ম ব্যাক, মিসেস আরশ!

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here