প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩৭

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩৭
জান্নাত নুসরাত

নিজাম শিকদারের বাড়ির সামনে কখন থেকে দাঁড়িয়ে উঁকি ঝুঁকি মারছেন সুফি খাতুন। নিজাম শিকদার দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে চুপিচুপি লক্ষ করছেন তা। এই ভদ্রমহিলা এখানে এসে এরকম চোরের মতো হাবভাব করছেন কেন, তার কারণ খুঁজে পেলেন না তিনি। আকস্মিক পর্দা চেপে ধরা হাত কেঁপে উঠল। উনি আবার না সেদিনকার মতো গোলাপ ফুলগুলো চুরি করতে আসছেন। চোখ দুটো রসগোল্লার মতো বড় বড় করে হাতে বিড়াল মারার লাঠিটা নিলেন। গত কয়েকদিন যাবত ওই বাড়ির মেঝো মেয়ের বিড়ালটা একটু বেশি জ্বালাচ্ছে। উৎকৃষ্ট করে রেখেছ সবকিছু। নিজে নিয়ে আসছে বিড়াল আর ছেড়ে রেখেছে মানুষের বাড়িতে। সেদিন যখন দেখলেন তখন পেটটা সামান্য ফোলা মনে হলো। হয়তো বাচ্চা টাচ্চা হবে, ওগুলো নিয়ে যদি তার বাসায় আস্তানা ঘাড়ে তখন এসব সাফসফা করবে কে! হাতে লাঠি শক্ত করে চেপে ধরে পা বাড়ালেন ভদ্র মহিলাকে একটা উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য। সদর দরজা খুলে, চিৎকার করে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে বললেন,”কী চাই?

সুফি খাতুন কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালেন। একহাত শাড়ির আঁচলের নিচে ঢাকা। নিজেও এক ভ্রু উচিয়ে শুধালেন,”কিছু জানেন, নাকি এভাবেই?
পরবর্তী কথা আর পূরণ করলেন না, ইশারা দিয়ে বুঝিয়ে ফেললেন ফাউলের মতো হাসাহাসি করছেন। নিজাম শিকদার ঢোক গিলে এত বড় অপমান হজম করে নিলেন। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দু-হাত আড়াআড়ি বেঁধে শুধালেন,”কেন এসেছেন?
সুফি খাতুন উপহাস করে বলে ওঠলেন,
“আপনার নাতনীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।
নিজাম শিকদার হেসে উড়িয়ে দিলেন সুফি খাতুনের কথা। মুখ দিয়ে ‘’হাহ’ করে কিছু শব্দ বের করলেন। বলে ওঠলেন,”আমার নাতনী নাছিরের বাড়িতে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“এটাই ভাবতে থাকুন, গতকাল রাতেই ধরে নিয়ে গেছে।
“হেহ আপনার কথা আমি বিশ্বাস করব কেন?
সুফি খাতুন নিজের কথায় ধীরতা বজায় রাখতে বললেন,”কেন বিশ্বাস করবেন না আপনি?
এমন করে অনেকক্ষণ যাবত চলল দু-জনের ভেতর বাকবিতন্ডায়। হঠাৎ সুফি খাতুন চকচক করতে থাকা লেডিস পিস্তল বের করলেন শাড়ির আড়াল হতে। নিজাম শিকদারের দিকে তা তাক করে বলে ওঠলেন,”চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসুন, আর আমাকে নিয়ে সিলেট সদর থানায় চুপচাপ চলুন।
নিজাম শিকদার ভয়ে দু-পা পিছিয়ে গেলেন। শঙ্কিত চোখে চেয়ে দু-হাত উপরের দিকে তুলে নিজেকে স্যারেন্ডার করলেন। ভয়ার্ত কন্ঠে বললেন,”গাড়ি বের করছি, আপনি প্লিজ হাইপার হবেন না!
সুফি খাতুন ঠোঁট বাঁকালেন। ঈষৎ ব্যগ্রতা নিয়ে ঠোঁট উচিয়ে বললেন,”সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে, আঙুল বাঁকাতে হয়।

পিস্তল মাথার দিকে তাক করে অগ্রসর হলেন সুফি খাতুন। প্রথমে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলেন নিজাম শিকদার। সুফি খাতুন হুমকি দিয়ে বলে ওঠলেন,”আমাকে রেখে যাওয়ার চেষ্টা করলে, গাড়ির চাকা একদম শুট করে দিব।
কথা শেষ করে এসে ফ্রন্ট সিটে বসলেন। একহাতে দরজা টেনে লাগিয়ে পাশে তাকাতেই দেখলেন নিজাম শিকদার এখনো স্যারেন্ডার করে সোজা হয়ে বসে আছেন। সুফি খাতুন চোখ রাঙিয়ে শুধালেন,”এখানে বসে থাকবেন সারাদিন নাকি গাড়ি চালাবেন? গাড়ি চালান..!

হেলাল সাহেব গম্ভীরমুখে নিজের জায়গায় ফিরে গেলেন। তখনো তিনি ভদ্র বাচ্চার ন্যায় বসে থাকা মৃন্ময়ের সুদর্শন মুখখানা ঠিকঠাক লক্ষ করেননি। দূর থেকে চেনা চেনা ঠেকল, তবুও কিছু একটা খটকা থেকেই গেল, হয়তো চোখের ভুল। বয়স বাড়ছে এজন্য চোখের কাছে সবাইকেই চেনা পরিচিত মনে হয়। চেয়ার টেনে বসতেই কানে আসলো মৃন্ময়ের স্বর। যতেষ্ট শীতল রাখা চেষ্টা করছে নিজেকে তবুও কথা বলতে বলতে গলা চড়ে যাচ্ছে। দেখেই মনে হচ্ছে সৈয়দ বাড়ির মানুষ জনের উপর খুবই বিরক্ত। খড়খড়ে কন্ঠে বলে ওঠে,”খুবই বেয়াদব একেকটা ছেলে মেয়ে, কোনো কথা বললে বা আদেশ দিলে কানে তোলার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন বোধ করে না।
হেলাল সাহেব এটা শুনতেই খেঁকিয়ে উঠলেন। ভ্রু-যুগল কুঁচকে, ক্ষিপ্ত সুরে বললেন,”ওরা কেন তোমার কথা শুনতে যাবে? তুমি কে আদেশ দেওয়ার?

মৃন্ময় হেলাল সাহেবের এসব কথা কান দিল না। নাছির সাহেব নামক ভদ্রলোকের পানে এক নজর চেয়ে আবারো বলে ওঠল,”এদের আপনাদের বাড়িতে না রেখে পাগলা গারদে রাখা উচিত ছিল, সবগুলার মাথা নষ্ট, পাগল।
নাছির সাহেব এক পলক ভাইয়ের দিকে চাইলেন, রেগে ফেটে পড়ছেন তিনি। যথাসম্ভব পরিবেশ সামাল দিতে বলে ওঠলেন,”আমি বুঝতে পারছি।
হেলাল সাহেব বিরাট চটে গেলেন। খ্যাঁক করে ওঠে শুধালেন,”তুই কী বুঝতে পারছিস, আমাদের বাড়ির ছেলে মেয়ে পাগল?
নাছির সাহেব হ্যাঁ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালেন। পরপর আবারো তিন জোড়া চোখের তোপে পড়ে না ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালেন। হেলাল সাহেব খিঁচানো মেজাজের কর্কশ আওয়াজ ভেসে আসলো,”আমার মনে হয়, এই পুলিশ অফিসার নিজেই পাগল, ভদ্রলোককে পাগলা গারদে পাঠানো অতিব জরুরী! বাচ্চা, বাচ্চা ছেলে মেয়েদের পেছনে এমন হাত ধুয়ে পড়েছ কেন?

মৃন্ময় বিস্ময় বিমূঢ় নেত্রে দেখল হেলাল সাহেবকে। ঠোঁট ঠেলে না চাইতেও মিনমিনিয়ে বেরিয়ে আসলো,”এই পাগলদের গুরু মনে হচ্ছে আপনিই।
পরপর অবাক চোখে তাকিয়ে, কঠিন অপগারতা ঠোঁটের নিকট নিয়ে শুধাল,“এরা বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়ে? কোনদিক দিয়ে? সবগুলোই বদমায়েশ, বাঁদর!
হেলাল সাহেব বললেন,
“তুমি হবে বদমায়েশ, বাঁদর। সামান্য দুটো দুষ্টুমি করায় কে বাচ্চাদের হাজতে নিয়ে আসে?
নুসরাত যখনই নিজেদের অপমান শোনল পেছন থেকে হাবিলদারকে ডেকে উঠল,”এইইইইই হাবিলদার…!
হাবিলদার মহৎপ্রাণ হৃদয় নিয়ে এসে হাজির হলেন নুসরাতের সামনে। মুখে হাসি নিয়ে বলে ওঠলেন,”জ্বি ম্যাডাম!
নুসরাত ভাবসাব নিয়ে লোহার শিকল চেপে ধরে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে ওঠল,”এই হাবিলদারের বাচ্চা, একটা কাজ করেন, এম্বুলেন্স এনে থানার বাহিরে রাখুন।
হাবিলদার অবাক কন্ঠে বলে ওঠলেন,

“কেন?
নুসরাত নাকের পাটা ফুলিয়ে, উচ্চ শব্দে চিৎকার করে বলল,”এখান থেকে বের হয়ে আমি আপনার স্যারকে কুত্তার মতো পেটাব।
হাবিলদারের দু-ঠোঁট বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। হেলাল সাহেব এপ্রিশিয়েট করলেন নুসরাতকে। গর্বে ফুলে উঠা বুক দাপিয়ে বললেন,’”একদম ঠিক আছে, আমাদের বাড়ির সিংহ!
মৃন্ময় বিমূর্ত চোখে এক পলক ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্য করে হাসল। নুসরাতের কথা কানে না তোলে হেলাল সাহেবের আগের কথার সুর ধরে উপহাস করে বলল,”দুটো দুষ্টুমি করেছে? ওরা গাড়ি ধাক্কা দিয়ে গ্লাস ভেঙে, সেটায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।

“তো, তোমার গাড়িতে লাগিয়েছে? আগুন লাগালে আমাদের গাড়িতে লাগিয়েছে, তোমার সমস্যা কী? প্রয়োজন হলে আরো দুটো গাড়িতে আগুন লাগাবে।
হেলাল সাহেবকে থামানোর চেষ্টা করলেন চার ভাই। তিনি সবাইকে চোখে রাঙিয়ে দেখলেন। মৃন্ময় আবারো বলল,’”তাহলে মুরগী চুরির বিষয়ে, কী বলবেন আপনি?
হেলাল সাহেব প্রথমে আমতা আমতা করলেন। পরপর আবারো স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর দিলেন,
“ওগুলো কী ওরা চুরি করেছে, এনে পেলে পুষে বড় করবে বলেই তো নিয়ে আসছিল।
মৃন্ময়ের ইচ্ছে হলো নিজের মাথা দেয়ালে ঠুকে মরে যেতে। নিস্পৃহ ভঙ্গিতে চেয়ে রইল হেলাল সাহেবের দিকে। তার কাছে মনে হলো কথা বলার শক্তি নেই, কেউ সব শুষে নিয়েছে। চোখ দুটো ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে আসা কন্ঠে বলে ওঠল,”জরিমানাগুলো দিয়ে উনাদের নিয়ে যান। নাহলে আগামীকাল কোর্টে চালান করা হবে।
হেলাল সাহবে কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলে ওঠলেন,”আমাদের কী টাকার অভাব যে জরিমানা দিতে পারব না? শুধু বলুন কতটাকা জরিমানা?

মৃন্ময় কিছু মিনিট নীরবে থেকে বলে ওঠল,
“সত্তর হাজার টাকা। আগেই বলে দেই, ল্যাম্পপোস্ট ভেঙে ফেলার জন্য সরকারিভাবে পঞ্চাশ হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে।
হেলাল সাহেব এক মুহুর্ত দ্বিরুক্তি না করে বললেন,
“ক্যাস না কার্ড?
মৃন্ময় বলে ওঠল,
“ আপনি যা ভালো বুঝেন।

হেলাল সাহেব নিজের পকেট হাতড়ে মানিব্যাগ বের করলেন খুচরা পয়সা। সব মিলিয়ে বিশ হাজারের মতো হলো। নাছির সাহেব নিজের পকেট থেকে দুঃখি মুখে এক হাজার টাকার বান্ডিল রাখলেন। গতকালই তিনি ক্যাস করেছেন এগুলো আর আজই এদের জন্য সব জলে চলে যাচ্ছে। খুবই কষ্টে সেটা রাখলেন টেবিলের উপর। মৃন্ময় অদ্ভুত চোখে চেয়ে রইল এই পরিবারের মানুষের দিকে। শোহেব আর সোহেদ মিলিয়ে বাকি টাকা দিয়ে দিলেন। টাকা দেওয়া শেষ হতেই জেলের তালা খুলে দিলেন হাবিলদার। পিঁপড়ের মতো একের পর এক লাইন ধরে সবাই বেরিয়ে আসলো। হেলাল সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। কোনো কথা ছাড়া হাঁটা ধরলেন সামনে। তার সাথে পা মিলিয়ে হাঁটা ধরল ইরহাম,আহান। পেছন পেছন সবাই ও অগ্রসর হলো। নুসরাত তাদের সাথে না গিয়ে দৌড়ে আসলো মৃন্ময়ের কাছে। মৃন্ময় ভ্রু উচিয়ে চাইতেই প্যান্টের পকেট থেকে এক প্যাকেট নাপা এক্সাট্রা টেবলেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল,”নাপা এক্সাট্রা খান আর নিজের মাথাকে ঠান্ডা করেন। সারাক্ষণ ক্যাটক্যাট করতে থাকেন।

নুসরাত মৃন্ময়কে চুপচাপ চেয়ে থাকতে দেখে জোর করে তার হাতের মুঠোয় প্যাকেটটা ধরিয়ে দিল। তারপর দ্রুত গতিতে দৌড় দিয়ে চলে গেল সামনে। পেছন থেকে হাবিলদারের কথা আসলো কানে। হাবিলদার বলছেন,”স্যার আপনি হাসছেন?
পরপর মৃন্ময়ের সেই গম্ভীর কন্ঠ আসলো,
“কোথায় হাসছি? উল্টাপাল্টা কথা না বলে নিজের কাজে যান।
সামনে থেকে নুসরাতের হাত টেনে ধরল মমো। নুসরাতকে তাড়া দিয়ে বলল,”তাড়াতাড়ি আয়..!
সিলেট সদর থানা থেকে বের হতেই চোখে পড়ল দ্রতগামী এক গাড়ি এসে থেমেছে সেখানে। সবার তীক্ষ্ণ চোখ যখন সেখানে স্থির গাড়ির দরজা খুলে পাগলাটে ভঙ্গিতে বের হয়ে আসলো জায়িন। মাথার আমন্ড কালার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে বাতাসে। চোখদুটোতে অসহায়ত্ব ভালোই ভর করেছে।

সূর্যের তীক্ষ্ণ আলোক রশ্মি চোখে পড়তেই জ্বল জ্বল করে উঠল অক্ষিগোলক। কপালে ভাঁজ ফেলে সামনে তাকাতেই চোখে পড়ল গরমের তাপে লাল হওয়া নিজের প্রিয় মুখখানি। স্নিগ্ধতায় পরিপূর্ণ মুখটা চোখের সামনে উপলব্ধি করতেই হৃদয়ে শান্তি নেমে আসলো। এতক্ষণের ধড়াস ধড়াস করে কাঁপা বুকটা চলাচল নিস্তব্ধে ধীর হলো। নৈঃশব্দে কাটল সময়। ঘড়িতে তখন কাটায় কাটায় বারোটা। নিজের হয়রানি ছাপিয়ে, ঝড়ের গতিতে এসে পুরুষালি শক্তপোক্ত হাত পেঁচিয়ে ধরল ইসরাতকে। কয়েক পল কাটল। পিঠ পেঁচিয়ে ধরতেই পুরো মেয়েলি দেহ শূণ্যে ভাসল। ইসরাত প্রথমে কী হয়েছে বুঝে উঠতে পারল না। যখন বুঝল ততক্ষণে সে জায়িনের বাহুতে। পা জমিন হতে দু ইঞ্চি উপরে। অনুভব হলো হৃৎপিন্ডে চলাচলকৃত আন্দোলন। নিজেকে সামলে নিয়ে আশেপাশে চোখ বোলাতেই বাপ চাচার গোল গোল দৃষ্টি নিজেদের দিকে পেল ইসরাত। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে মোচড়া মুচড়ি করল, তবুও ছাড়া পেল না। কটমটিয়ে উঠে বলল,”জায়িনের বাচ্চা ছাড়ুন আমাকে..!

জায়িনের নাজুক কন্ঠ স্বর ভেসে আসলো,
“গিভ মিন জাস্ট ফাইভ সেকেন্ড ইসরাত, আমাকে আগে আপনাকে অনুভব করতে দিন।
ঠিক পাঁচ সেকেন্ড অতিবাহিত হলো। তারপরই ইসরাতকে নিজের বাহু থেকে ছাড়ল জায়িন। নির্মিশেষ দৃষ্টিতে উপর নিচ অবলোকন করে জানতে চাইল,”আপনি ঠিক আছেন ইসরাত?
ইসরাত নিজেকে জায়িন থেকে দূরে সরিয়ে নিল। চোখদুটো বিস্ফোরক রকম গরম করে বলে ওঠল,”বেয়াদব..!
হেলাল সাহেব নিজেও দূর থেকে নিজের নির্লজ্জ ছেলের দিকে চেয়ে কড়মড় করে, উচ্চস্বরে বললেন,”অসভ্য…!
জায়িন জড়িয়ে ধরতেই সুফি খাতুন আর নিজাম শিকদার এর আগমন ঘটেছে থানার বাহিরে। সুফি খাতুন গাড়ির গ্লাসের বাহিরে চোখ মেলে চাইতেই জায়িনের এমন বেহায়াপানায় দেখে চোখ হাত দিয়ে ঢেকে ফেললেন। ভৎসনা করে বললেন,”কেয়ামতের আলামত, নাউজুবিল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ!

জায়িনের কানে স্পষ্ট গেল হেলাল সাহেবের কথা, সে পরোয়াই করল না। দু-পা বাড়িয়ে ইসরাতের হাত চেপে ধরতে যাবে, ইসরাত দু-পা পিছিয়ে গেল। তার পেছন থেকে পরপর উঁকি দিল চারটা মাথা। সবার শেষে একটু একটু চেনা মাথাটা উঁকি দিল। ইসরাতের ডান দিকে নুসরাত ইরহাম আহান, বাঁ-দিকে মমো আর সৌরভি। সবগুলো একসাথে মিলে ব্যঙ্গাত্মক কন্ঠে হেসে হেসে বলে ওঠল,”আপনি কী ঠিক আছেন জায়িন ভাইইই?

আরশের যখন জ্ঞান ফিরল তখন দুপুর দুটো বাজে। ততক্ষণে বিয়ের ডেট একদিন পিছিয়েছে। অনেক মেহমানকে ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে আগামীকাল বিয়ে। মাহাদি ফোনে কথা শেষ করে আরশের কেবিনে ঢুকল। হসপিটালের ফিনফিনে কাপড় তার পরণে। চোখগুলো নির্মিশেষ দৃষ্টিতে জানালার বাহিরে নিবিষ্ট। মিয়িইয়ে পড়া আলোকে দেখছে, নির্জীব চোখে। আগের মতো পাগলামি করল না, জানতে চাইল না নুসরাত কোথায়! চুপচাপ চেয়ে রইল। মাহাদি গলা খাঁকারি দিল আরশের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। আরশ ঘাড় বাঁকিয়ে দেখল তাকে। হাতের স্যালাইনের দিকে ইশারা করে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জানতে চাইল,”কখন যেতে দিবে?
মাহাদি আরশের হাতের স্যালাইনের দিকে একবার চেয়ে অন্য কথা উচ্চারণ করল ,”একটা কথা বলার ছিল।
আরশ নিরুদ্বেগ কন্ঠে, নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“কোন বিষয়ে?
মাহাদির ঠোঁট থেকে ক্ষীণ শব্দ বের হলো,
“ নুসরাতের….
আরশ হাত তুলে থামিয়ে দিল। নিষেধাজ্ঞা জারী করল,”শুনতে চাচ্ছি না।
মাহাদি মনে করল হয়তো আরশ মনে করছে ওদের কিছু হয়ে গিয়েছে তাই শুনতে চাচ্ছে না, তাই নিজের কথায় জোর দিল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে আরশের কোনো কথা না শুনে বলে ওঠল,”নুসরাত, ইরহাম, আহান…
আরশ খেঁকিয়ে উঠল। হাইপার হয়ে উঠে বসতে যাবে মাহাদি বলল,”ওরা বেঁচে আছে।
কঅথা শেষ হতেই সবকিছু ঠান্ডা হয়ে গেল। বেসামল ভঙ্গিতে নিজের জায়গা ছেড়ে ওঠা আরশের চোখমুখে নেমে আসলো রাজ্যের গম্ভীরতা। তা আবার নিমেষেই উবে গিয়ে উদয় হলো কিছু একটা। বাজপাখির ন্যায় দৃষ্টি স্থির করল মাহাদির দিকে। ইশারা করে বলল,”এদিকে আয়..!

মাহাদি আরশের দিকে এগিয়ে যেতেই আরশ উঠে বসার চেষ্টা করল। মাহাদি বন্ধুকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেল। পেছনে বালিশ দিয়ে সুন্দর করে বসাতেই আরশ বলল,”আমার সামনে আয়…!
মাহাদি মাথা নাড়িয়ে আরশের সামনে দাঁড়াতেই, ঠাস করে কান ঝাঁঝানো একটা থাপ্পড় পড়ল বেচারার গালে। কান তালা লেগে গেল মাহাদির সেই শব্দে। মাহাদি একহাত গালে চেপে অবাক চোখে দেখল আরশকে। সাপের মতো হিসহিসিয়ে বলা আরশের কথা কানে আসলো,”ইউ ইডিয়ট, আগে বলবি না..!
মাহাদি হা করে চেয়ে থাকল। কর্কশ সুরে জানতে চাইল,“তুই আমায় বলতে দিয়েছলি?
এক হাত গালে আরেকটু চেপে ধরে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে, নিষ্পাপ মুখে বলে ওঠল,“আমি তোর থেকে দুই-দিনের বড়, সম্মান দে আমায়..!

আরশ কোনো কথা না শুনে চিৎকার করল,
“শাট-আপ মাহাদি।
মাহাদি নাক ফোলাল। হিসহিসিয়ে আরশকে অভিশাপ দিল,”তোর থেকে বড় গাদ্দার তোর ভবিষ্যৎ বাচ্চা হবে, আমি মাহাদি খান আজ তোকে অভিশাপ দিলাম।

সৈয়দ বাড়ির ড্রয়িং রুমের সোফায় পায়ের উপর পা তুলে শুয়ে আছে থানা থেকে ফিরত সবাই। হাতে পাইনাপেল এর জুস। নিজাম শিকদার টিপেটিপে সৌরভির কাছ ঘেঁষছেন আর বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এতদিন তিনি কী কী বলেছিলেন! আজ তা একদম খাপে খাপ মিলেছে কিনা! সৌরভি বিরক্তি কন্ঠে যখন বলল,”দাদু তুমি থামবে?
তখন থেকে শুরু হয়েছে আবারো ভাষণ। বলেই চলেছেন তো বলেই চলেছেন। একটাই কথা তার,’’যেদিন বড়সড় বিপদে পড়বি সেদিন আমাকে বলতে আসিস না।
সৌরভি মুখ ঝামটা মেরে বলে ওঠল,
“আচ্ছা।

বাড়ির কর্তীরা ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছেন ছেলে মেয়ের দিকে। যে নাজমিন বেগম খালি পায়ে ঘরে হাঁটলে তার ভালোবাসার সোফায় বসতে দেননা, সেই নাজমিন বেগম আজ কাদা গায়ে মাখামাখি সবাইকে বসতে দিয়েছেন, এমনকি সোফার একদিকে পা তুলে শোয়া নুসরাতকে পর্যন্ত ধমকাচ্ছেন না। নুসরাত মুখ দিয়ে আনন্দ পূর্ণ শব্দ নিশ্রিত করে বলে ওঠল,”আম্মা এরকম করে যদি রোজ শোয়া যেত তাহলে মজাই চলে আসত!
নুসরাতের কথায় আজ আর ধপ করে জ্বলে উঠলেন না নাজমিন বেগম। চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন মমতাভরা দৃষ্টিতে। ইসরাত বিরক্ত হয়ে মা চাচিদের বলে ওঠল,”চোখ সরাও আমাদের থেকে..!

চারজনের আট জোড়া চোখ সরল না। আরো আষ্টেপৃষ্ঠে ফিরে আসলো! কিচেনের দায়বার পড়েছে নুসরাতের দু-মামির উপর। নুসরাতের নানি জোহরের নামাজ পড়ছেন৷ অনান্য আত্মীয়রা এতক্ষণ বসে থাকলেও এবার উঠে উঠে চলে গেল নিজেদের রুমের দিকে। গোসল সারার জন্য। নুসরাত ফিক করে হেসে উঠল আকস্মিক কিছু একটা মনে করে। এলিয়ে এলিয়ে ব্যঙ্গাত্মক গলায় বলে ওঠল,”আপনাকে অনুভব করতে দিন..! আপনি ঠিক আছেন ইসরাত!
নুসরাত নিজের কথা শেষ করতেই সবগুলো হেসে উঠল খিকখিক করে। নিজাম শিকদার উঠে দাঁড়ালেন। সৌরভির হাত চেপে ধরে বিদায় নিলেন সবার কাছ থেকে। সৌরভি আরো একটু নাছির মঞ্জিলে সময় কাটাতে চাইল দাদা নামক লোকটার জন্য সম্ভব হলো না। জবরদস্তি টেনে টুনে নিয়ে গেলেন নিজ গৃহে। নাজমিন বেগম তাড়া দিলেন,”যাও যাও গোসল করতে যাও সবাই..! আজ আমাদের বাড়িতে দুপুরে খাবে সবাই।

সবাই হৈ হুল্লোড় করে উঠল। নেচে-কুঁদে চলে গেল নিজ নিজ রুমদখলে। সিঁড়ি বেয়ে উঠার সময় দেখা হলো হেলাল সাহেবের সাথে। দু-জনে দু-জনের পানে চেয়ে মুখ ঝামটা মারল। অতঃপর ধুপধাপ পায়ে একজন উপরে অন্যজন উপরে চলে গেল। নিচে দাঁড়ানো ইরহাম আর আহান পরস্পরের পানে চেয়ে মিনমিনিয়ে আওড়াল,”সারাজীবন শুনে আসলাম বউ শাশুড়ীর যুদ্ধ, আর এখানে দেখছি শ্বশুর বউয়ের যুদ্ধ।
আহান সুর মিলিয়ে একটাই কথা আওড়াল,
“দুই দিনের দুনিয়ায় চারদিন এসব দেখতে হয়।

আজ সকালে বাড়ির বড়রা মিলে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করবে ভেবেছিল, তা সম্ভব হয়নি ওই দূর্ঘটনার কারণে। তাই বিকেল বেলা সিদ্ধান্ত নিলো অনুষ্ঠান করার। ইসরাতকে শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে পিঁড়িতে বসালেন বাড়ির বয়স্ক মহিলারা। ইসরাতের নানি নামাজি হলেও ব্যাপক কুসংস্কারে বিশ্বাসী তিনি। সাত পুকুরের পানি এনে বাড়ির বউকে না গোসল করালে নাকি জ্বীনের আছড় হয়, তাই এটাও পালন করবেন। নুসরাত তো মুখ ফসকে বলেই ফেলেছিল,’তোমার মায়ের উপর কী জ্বীন ভর করেছিল, যে এমন আজগুবি কথা বলছ? আজ সে শান্ত, ভদ্র, নির্মল হয়ে গিয়েছে, তাই কিছু বলেনি, কোনোভাবে কাউকে চটানো যাবে না, নাহলে তার দেওয়ার থেকে নেওয়ার বেশি পড়ে যাবে। সেটা আর কী, তার মায়ের রোবটিক্স জুতোর বারি নাহয় ঝাটার বারি। আজ যা করেছে তাতে নাছির সাহেব সম-পরিমাণ রেগে, তার কতটাকার গাড়ি সে উড়িয়ে দিয়ে এসেছে। এরা আবার কীভাবে জেনে গেছে আরশের গাড়িও সে জ্বালিয়ে দিয়েছে। এরপর থেকে বম হয়ে ঘুরছেন, যেকোনো সময়, যেকোনো মুহুর্তে বমব্লাস্ট হয়ে যাবে।

ছালিমা বেগম জায়িনকে কোথা থেকে ধরে এনে বসালেন ইসরাতের পাশে। গায়ে সেন্ডু গেঞ্জি আর লুঙ্গি। লুঙ্গির অবস্থা খুবই নাজুক। বোঝাই যাচ্ছে জোরজবরদস্তি করে পরানো হয়েছে। একহাতে লুঙ্গি পেটের উপর চেপে ধরে আছে জায়িন। যখন তখন খুলে যাবে যাবে মনে হচ্ছে। পেটের উপর লুঙ্গি বাঁধা থাকলেও তা লুজ হয়ে ঠাখনুর নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পেছনের দিকে অনেকটা মাটির সাথে গড়াগড়ি খাচ্ছে। দু-একবার উষ্ঠা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে বেচারা নিজেকে সামলেছে এর ভেতর। নুসরাত, ইরহাম, আহান, সুর ধরে শব্দ করে হেসে ফেলল জায়িনের লুঙ্গি পরে নাজেহাল অবস্থা দেখে। তাদের হাসি দেখে বাকি সবাই হাসল।।লিপি বেগম ছেলের পানে চেয়ে মিটিমিটি হাসলেন। জায়িন মায়ের দিকে চেয়ে, অসহ্য কন্ঠে বলল,”আম্মু তুমি ও হাসবে!
লিপি বেগম এক হাত ঠোঁটের উপর রেখে বললেন,

“হাসছি না বাবা, হাসছি না..!
ইসরাতকে সাদার মধ্যে লাল সুতোর কাজ করা শাড়ি পরিয়েছেন। ব্লাউজ লাল কালারের। চুলগুলো পিঠে ছেড়ে রেখেছেন। ছালিমা বেগন বাটা হলুদ এনে প্রথমে জায়িনের গায়ে ছোঁয়ালেন, পরে ইসরাতের। একে একে সকলে ছুঁইয়ে দিল। সুগন্ধি মিশ্রিত কলসিতে রাখা পানিগুলো প্রথমে নিয়ে ইসরাতের মাথায় ঢেলে দিলেন। গায়ের হলুদ যাতে শুয়ে যায় তার জন্য। এরপরের কলসির পানি জায়িনের শরীরে ঢেলে দিলেন। সবাই সুর টেনে গীত ধরল,”আইজ ময়নার গায়ের হলুদ কাইল ময়নার বিয়া, হলুদ বাটো মেন্দি বাটো লোহার পাটা দিয়া। ময়নার মা কাঁন্দইন করইন উন্দালে বসিয়া। ও বনোরসি কই গেলায় গো তোমার ফুরি তইয়া,তাই আইজকে কান্দন করের জামাই লগে যাইবার লাগিয়া।

নুসরাত ভদ্রমহিলাদের এসব গীত শুনে গলায় ফাস দিতে ইচ্ছে হলো। আবারো কানে আসলো জায়িনকে উদ্দেশ্য করে গাইছে সবাই,”আইজ ময়নার বিয়া রে, বাজে ঢোলের তান, কান্দে রে মায় গোপনে, শুনে গানের গান। হলুদের রঙ লাগলো গায়, রূপে উঠলো ফুটি, চোখে কাজল, মুখে লাজে, বউ রে যেন মতি।
নুসরাত এবার বাঁধ সেধে বলল,
“কিন্তু ইসরাতের মুখে তো কোনো লাজ নেই..!
জায়িন উঠে দাঁড়াল এর মধ্যে। ভদ্রমহিলারা নুসরাতের কথা না শুনে গাইছে গীত। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে তালি দিচ্ছেন সামনে গিয়ে। আবার পেছনে এসে হাঁটছেন। এরকম গোল গোল করে ঘুরতে ঘুরতে গান ধরলেন আবারো। জায়িন ভেজা শরীর নিয়ে সামনে হাঁটা ধরতেই লুঙ্গিখানা তার কোমর থেকে খসে পড়ল। ইসরাত পেছন থেকে চিৎকার করে ওঠে বলল,”আরে আপনার লুঙ্গি..!

নুসরাত, ইরহাম, আহান দাঁড়িয়ে নাচ দেখছিল বয়স্ক মহিলাদের, ইসরাতের চিৎকারে তড়িৎ মাথা ঘুরাল। হতবিহ্বল চেহারা নিয়ে পেছন ফিরল কী হয়েছে দেখার জন্য। জায়িনের অস্বাভাবিক শীতিল মুখের দিকে চোখদুটো গোল গোল করে চেয়ে রইল নুসরাত। চোখ নিচের দিকে নামাল না। শঙ্কায় ঠান্ডা হওয়া শরীর নিয়ে নড়চড় বিহীন দাঁড়িয়ে রইল। বড় থেকে শুরু করে ছোটদের পর্যন্ত জায়িনের দিকে উৎসুক দৃষ্টি। চোখদুটো হয়তো কোনোরকম আটকে আছে ভেতরে, সবার তাকানো দেখে মনে হলো এই অক্ষিগোলক থেকে বের হয়ে যাবে মণিগুলো। নুসরাত কোনোরকম ঢোক গিলল, চোখ দুটো তখনো সামনে স্থির। ভুল করে নড়চড় করল না। হাপিত্যেশ করে মিনমিনিয়ে আওড়াল,”গেল রে ইরহাম গেল, জায়িন ভাইয়ের সব মান-ইজ্জত গেল। সবাই সব দেইখা নিল রে..!

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩৬

আহান ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে আওড়াল,
“জয় বাংলা, লুঙ্গি সামলা..!
ইরহাম সেই সুর ধরে বলে ওঠল,
“মান-সম্মান আল্লাহর হাওলা..!

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩৭ (২)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here