প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৬
জান্নাত নুসরাত
টুং টাং নোটিফিকেশন আসার শব্দে গভীর ঘুমে তলিয়ে থাকা নুসরাতের ঘুম কিছুটা হালকা হলো। আসলে ঘুমটা নোটিফিকেশন আসার শব্দে ভাঙেনি ইসরাতের লাথি খেয়ে ভেঙেছে। ঘুম ঘুম চোখ খুলে একবার তাকিয়ে আবার চোখ বুজে নিয়ে নুসরাত নতুন উদ্যমে ঘুমানোর প্রয়াশ শুরু করল। চোখ লেগে আসতেই কর্কশ গলায় কেউ গেয়ে উঠল,”খা খা খা আমায় চুইষা চুইষা খা…
ইসরাত নুসরাতের পায়ের কাছে মুখ রেখে শুয়ে ইংরেজি ডার্ক রোমান্স নোবেল টিয়ার্স অফ টেস পড়ছিল। প্রথম চ্যাপ্টারের শেষের দিকে ছিল তখন তার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটিয়ে অসভ্য গানটা বেজে উঠল। কি গানটা যেন? খা খা আমায় চুইষা চুইষা খা.. কি অদ্ভুত!? শুনলেই তো গায়ে কিরকম করে ওঠে।
পরবর্তী টুকু বাজার আগেই ইসরাত হাত বাড়িয়ে ফোনের সাউন্ড অফ করে ফেলল। বড় বড় চোখে নুসরাতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,”এটা চেঞ্জ করিসনি কেন?
নুসরাত এক চোখ খুলে গাল বাঁকিয়ে হাসে। ইসরাতের কথার উত্তর না দিয়ে ঠোঁট টিপে ভিন্ন রকম প্রশ্ন করে,”নোবেলটা পড়ছিস? কি রকম?
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
ইসরাত কপাল কুঁচকায় সামান্য। সবসময় শান্ত থাকা ইসরাতের কথায় এবার একটু বিরক্তি প্রকাশ পায়।
“তোকে কি জিজ্ঞেস করেছি আর তুই আমাকে কি জিজ্ঞেস করছিস!
নুসরাত এক গাল ফুলিয়ে হাসে। আরাম করে শুয়ে চোখ বন্ধ করে বলে ওঠে,”গানটা ক্রিঞ্জ না?
ইসরাত নুসরাতকে একটি প্রশ্নের বিপরীতে অন্য আরো একটি প্রশ্ন করতে দেখে শব্দ করে শ্বাস ফেলে। আর কথা না বাড়িয়ে উল্টো ফিরে বসে পড়ে, নোবেলের বাকি অংশ পড়ার জন্য। নুসরাত পিছন থেকে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করে,” ওই, নোবেলের মেইন ক্যারেক্টর গুলোর নাম কি?
ইসরাত বইয়ের দিকে মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে থেকে হু বলে ওঠে, কোনো কথা বলে না। নুসরাত তর্জনী আঙুল দিয়ে ইসরাতের পিঠে আবার ধাক্কা দিয়ে বলে,”বল না, মেইল ক্যারেক্টর নেইম কি? আর ফিমেল ক্যারেক্টর?
ইসরাত বইয়ের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে নিচু গলায় প্রশ্নের উত্তর করে,”ফিমেল ক্যারেক্টর নেইম টেস।
নুসরাত টু শব্দ করতে যাবে ইসরাত নিষেধ বাণী দিয়ে বলে,”আর একটা শব্দ নয়, আমাকে পড়তে দে। মেইল ক্যারেক্টর এর এখনো কোনো হদিস খুঁজে পাইনি।
নুসরাত চোখ উল্টো নেয়। পিছন ফিরে মোবাইলের সাউন্ড অন করতেই আবার সেই গান বেজে ওঠে। খা খা খা… ইসরাত চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই নুসরাত দু-হাত উপরে তুলে স্যারেন্ডার করার ভঙ্গি করে, কিন্তু ফোন পিক করে না, বাজতে বাজতে সেটা কেটে যায়। ইসরাত দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। এই মেয়ে আর তার অদ্ভুত নিয়ম। কেউ কল দিলে প্রথম বারে পিক করবে না, এতে নাকি কল করা ব্যক্তির ভাব বেড়ে যাবে। কুল সাজার জন্য দ্বিতীয় বার কল পিক করবে। হাহ্….!
দ্বিতীয় বার কল আসার পর প্রথমবার রিং হতেই কল পিক করে কানে ধরে নুসরাত। ফোন কানে লাগিয়ে বলে,”হু!
ওপাশের ব্যক্তিটি ছটফটে গলায় জানায়,
“আরে বোন, তুই হু মারাচ্ছিস, ওদিকে তোর আশিক, মজনু বিয়ে করে নিচ্ছে।
নুসরাত তর্জনী আঙুলের সাহায্যে ভ্রু চুলকায়। সাদিয়ার কথায় কোনো মনোযোগ না দিয়ে, নিজের নেইলসের দিকে মনোযোগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আবার বলে ওঠে,” হু!
সাদিয়া ওপাশ থেকে দু-কাঁধ উচায়। সে কাকে কল দিয়েছে জানানোর জন্য তার বি-এফ বিয়ে করে নিচ্ছে। সাদিয়া দাঁত কড়মড় করে বলে ওঠে,”এই মাগী! তোর বি-এফ এর বিয়ে আজ,আর তুই আমার সাথে হু মারাচ্ছিস।
নুসরাত অবাক হওয়ার ভান করল। “আজ, বলে মৃদু চিৎকার করে নিজের বিস্ময় প্রকাশ করল। কিছুটা দুঃখি কন্ঠে বলল “দেখছিস শালা আমায় দাওয়াতই দেয়নি। দাওয়াত দিলে কি আমি যেতাম?
সাদিয়া মুখের বিকৃতি ঘটিয়ে তাকিয়ে রইল ফোনের দিকে। নুসরাত আবার বলে,”এখন যখন দাওয়াত দেয়নি তাহলে মাঙ্গের নাতির বিয়েতে তো যেতেই হবে। কি বলিস তুই? গিয়ে একটা সারপ্রাইজ দিব নাকি?
সাদিয়াকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মুখের উপর ফোন রেখে দিল। মোবাইল ঢিল মেরে বিছানা রাখতে রাখতে ইসরাতের দিকে তাকায়। ইসরাতকে চিন্তিত মুখে বসে থাকতে দেখে বিদ্রপূর্ণ গলায় জিজ্ঞেস করে,”তোর আবার কি হয়েছে?
“তুই কি বিয়েতে যাবি ওই ছেলেটার? আর তোদের ব্রেক-আপ হয়েছে আমাকে জানালি না কেন?
নুসরাত অবজ্ঞার দৃষ্টিতে ইসরাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। হেয়ালি করে বলে,” তো, এটা কোনো এমন বিষয় নয় যে তোকে আমার জানাতে হবে। আর বেশি কথা বলেছিস তাই আবিরের বিয়েতে তুই ও আমার সাথে যাচ্ছিস। রেডি থাকিস.
গ্রান্ড মোস্তফা হোটেল আবাবিলের সপ্তম তলার এলিভেটরের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইরহাম আর ইসরাত। কিছুক্ষণ আগে ইরহামের বলা কথায় ইসরাত এখনো শকড। শক থেকে বের হতে পারছে না বেচারি। হতবিহ্বল চেহারা সামনের দিকে স্থির রেখে আবার জিজ্ঞেস করে,”কি বললি আবার বল?
ইসরাতের প্রশ্নে ইরহাম উত্তেজিত হয়। পা দিয়ে মেঝেতে আঘাত করে বলে,”আরে আপু, বুঝো না কেন? আমাদের সৈয়দ চয়েস এর ম্যানেজার ওই বেটা।
ইসরাত মাছের মতো হা করে নেয়। আর কত ধাক্কা নিতে হবে এই ছোট্ট জীবনে। নিজেদের সামলে দু-জন হেঁটে ভেন্যুতে প্রবেশ করে। বিনা দাওয়াতে আসায় মুখ লুকিয়ে হাঁটতে গিয়ে দুজনের ধাক্কা লাগে আবিরের সাথে। সেদিকে না তাকিয়ে তারা স্যরি বলে পালাতে চায়, তার আগে আবির বলে ওঠে,”ওয়াট আ সারপ্রাইজ ছোট স্যার। আপনি এখানে?
আবিরের গলার আওয়াজ শুনতেই ইরহামের মুখে অন্ধকার নেমে আসে। ক্ষীণ হাসার চেষ্টা করে কথাটা না শোনার ভান করে। আবির বলে,”ছোট স্যার, বড় স্যার তো বললেন, আপনারা আসছেন না।
ইরহাম অতর্কিত হা হা করে হাসে৷ ভিতরে ভিতরে বিরক্তিতে ফেটে পড়ে। নিজের সাথে লড়াই করে হাত টেনে এনে আবিরের পিঠে চাপড় মেরে উত্তর করে,”সারপ্রাইজ কেমন লাগল মিস্টার আবির?
আবির সৌজন্যতা রক্ষাতে হালকা হাসে। ইরহাম ইসরাতের দিকে আঙুল তুলে তাক করে বলে,”মিট মাই সিস্টার। মেজ বাবার বড় মেয়ে।
আবির মাথা ঝুকিয়ে সালাম করে। ইসরাত সালামের উত্তর দিয়ে ঈষৎ হাসে। আবির সৌজন্যমূলক কথা বলে চলে যেতেই ইরহাম হু হা করে হেসে ওঠে। ইসরাত ইরহামের আচরণে অবাক হয়। মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করে,”হয়েছি কি?
ইরহাম হাসির তোড়ে ঢলে পড়ে ইসরাতের গায়ে। ইসরাত ইরহামের গায়ে হালকা হাতে থাপ্পড় মেরে চোখ রাঙিয়ে কিড়মিড় করা স্বরে বলে,”এরকম আচরণের মানে কি ইরহাম?
“দাঁড়াও আপু বলছি।
কথা শেষ করে ঠোঁট টিপে হাসি থামানোর চেষ্টা করে। পরপর বলে,” বি সিরিয়াস আপু! ধরো নুসরাতের সাথে এই বেটার সব ঠিক থাকত, আর এই বেটার সাথে নুসরাতের বিয়ে হতো তাহলে তুমি আজ ওর বড় আপু হতে, ম্যাম হতে না। হা হা হা…!
ইসরাত ইরহামের এতো হাসির অর্থ খুঁজে পায় না। চোখ উল্টে বলে,”হা হা করতেই আছিস, একদম মুখ বন্ধ। কি এমন হাসির কথা বললি যে, হে হে করে মরে যাচ্ছিস। আমার তো কোনো হাসি পাচ্ছে না!
ইসরাতের কথায় ইরহামের মুখ কালো বর্ণ ধারণ করল। মুখ ফুলিয়ে আড় চোখে ইসরাতের দিকে তাকাল। ইসরাত পাত্তা না দিয়ে চুপচাপ গিয়ে সোফায় বসে পড়ে।
“অ্যাটেনশান গাইজ..!
মাইক হাতে নুসরাতকে স্টেজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবিরের শ্বাস আটকে যায়। জিরো পয়েন্ট জিরো ওয়ান হার্স গতিতে অন্তরত্মা কেঁপে ওঠে। এ এখানে আসলো কিভাবে এই প্রশ্ন তার ভিতর নাড়া দিয়ে ওঠে। ভয় আর দ্বিধা মিশ্রিত চাহনি নিক্ষেপ করে সামনে। পর মুহুর্তে আবিরের মনে হয় এই কদিন নুসরাতকে নিয়ে সে এত ভেবেছে যে, এখনো নিজের চোখের সামনে নুসরাতের প্রতিবিম্ব ভাসছে। নিজের চোখের ভুল মনে করে চোখ টাইটলি বন্ধ করে নেয় আবির। কিৎকাল পর আবার চোখ খুলে, না এটা তার মনের ভুল নয়, আর না এটা তার চোখের ভুল, নুসরাত ঠিকই হাতে মাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার জায়গায়। আর একের পর এক কথা বলে চলেছে।
নুসরাত ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। যা আবিরের কাছে দূর্বেধ্য ঠেকে। নুসরাত আবার রহস্যমিশ্রিত একটা হাসি দিয়ে বলে,”এমনি মাইকটা হাতে নিয়ে চেক করছিলাম। আসলে, কি জানেন আপনারা, আমার লুকানো জিনিসের প্রতি কৌতূহল অনেক বেশি। তো যা বলছিলাম… আমার একমাত্র বয়…..ফ্রেন্ড বিয়ে করে নিচ্ছে আর সে আমাকে দাওয়াতই দিল না…।
নুসরাত মুখ দিয়ে চুকচুক আকারে শব্দ করে। যেন সে প্রচুর ব্যথিত আবিরের এমন কাজে।
” দাওয়াত দিল না তো কি হয়েছে? দাওয়াত বিহীন আমি নিজে চলে এসেছি, সাথে আমার বোন আর ভাইকে ও নিয়ে এসেছি বিনভুলাই মেহমান হিসেবে।
নুসরাতের কথা শেষ হতেই একটা গুঞ্জন শুরু হলো পুরো হলে। সবাই একে অন্যের সাথে কানাঘুষা করতে শুরু করল এখানকার যুগের ছেলে মেয়েরা এরকমই নির্লজ্জ আর বেহায়া হয়। কিরকম গলা ফাটিয়ে এসে বলছে তার বয়ফ্রেন্ডের বিয়েতে এসেছে।
” আরে কাম ডাউন, কাম ডাউন আন্ট’স! আমি বয় ফ্রেন্ড বলে বোঝাতে চাইছি ছেলে বন্ধু। তো যা বলছিলাম…একে তো বিয়তে দাওয়াত দেয়নি আমাকে আবির, বিন বুলাই মেহমান হয়ে এসেছি তার উপর এখানে আসার পর থেকে অপমান আর অপমান হচ্ছি। গত আধঘন্টা যাবত আপনাদের ক্যামেরাম্যানকে ফটো তুলে দেওয়ার কথা বলছি সে আমার একটা ও ফটো তুলে দিচ্ছে না। প্লিজ আপনাদের ক্যামেরা ম্যানকে বলুন আমার একটা পিক তুলে দেওয়ার জন্য। এটা বলার জন্যই আমি এই মাইকটা হাতে নিয়েছি, আসলে আমার মাইকের কোনো প্রয়োজন ছিল না, আমার গলার আওয়াজ মাইকের তুলনায় আরো বেশি স্পষ্ট আর উচালো, তবুও মান-সম্মান রক্ষাতে এটা হাতে নিয়েছি। এই আর কি…!
ইসরাত আর ইরহাম চোরের মতো চেহারা বানিয়ে বসে রয়েছে। পারলে দু-জন মাটি খুঁড়ে ভিতরে ঢুকে যেত। এ কার সাথে এসেছে তারা বিয়েতে!
ব্রাইড গ্রুম কথা বলছিল চুপিচুপি। তাদের দু-জনের কথার মধ্যেই নুসরাত ব্রাইড আর গ্রুমকে ঠেলে দূরে সরিয়ে মাঝখানে বসে পড়ল৷
“তুলুন তুলুন, ফটো তুলুন।
ক্যামেরাম্যান ফটো তোলার আগে চিজ বলতেই নুসরাত মিডিল ফিঙ্গার বের করে দাঁত কেলিয়ে হাসল। তারপর মাঝখানে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আবিরকে ধাক্কা মেরে তার বউয়ের উপর এক প্রকার ফেলে দিয়ে নির্বিকার চিত্তে বলে উঠল,”তাড়াতাড়ি তুলুন ফটো ভাইয়া।
আবিরের বউ তাকে দু-বাহু ধরে তুলতেই নুসরাত সেদিকে তাকিয়ে বমি করার মতো করল। আর ক্যামেরা ম্যান সেই সময় ফটো তুলে ফেলল।
“ভাইয়া আর একটা পিক তুলে দিন, এই যে আমার হাতে যে ব্রেসলেট আছে সেটা যেন ফটোতে স্পষ্ট আসে।
কনে জানতে চাওয়া চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ফটোতে স্পষ্ট আসা লাগবে কেন ব্রেসলেট?
নুসরাত ঠোঁটে হাত রেখে মেকি হাসে। দুই ঠোঁট টিপে চোখ ঝাপটে বলে,” আসলে এটা আমাকে সৈয়দ চয়েস দিয়েছে প্রমোশন করার জন্য, তাই স্পষ্ট ছবি আসা চাই, তোমাদের বিয়ে এলবাম দেখার সময় মানুষ যখন আমার ছবি দেখবে তখন তো ব্রেসলেট টা ও দেখবে। আর এটা দেখে তারা পছন্দ করলে, সেটা বায় করার জন্য সৈয়দ চয়েস যাবে।
আবিরের মনে সংশয় জন্ম নেয়। সৈয়দ চয়েস ওকে কেন প্রমোশনের জন্য ব্রেসলেট দিবে। তাই কিছুটা অবাক গলায় জানতে চেয়ে প্রশ্ন করে,”সৈয়দ চয়েস তোমাকে এটা দিতে যাবে কেন প্রমোশনের জন্য?
নুসরাত কথার প্রতিউত্তর করে না। আলগোছে এড়িয়ে যায় সে কথা। আবির আবারো দৃঢ় কন্ঠে জানতে চায়,”কেন দিয়েছে তোমাকে ওরা এটা? দেখি, ব্রেসলেট টা দেখি?
আবির দেখার জন্য নুসরাত দিকে এগিয়ে আসতেই নুসরাত হাত সরিয়ে ফেলে। ক্যামেরা ম্যানের দিকে তাকিয়ে বলে,”আরে ভাই মুখ দেখছেন কেন তাড়াতাড়ি ছবি তুলুন?
নুসরাতের ঝাঁঝ মেশানো কথার আঘাতে হন্যে হয়ে ব্রেসলেট দেখার জন্য এগিয়ে যাওয়া আবির আর ব্রেসলেট দেখার সাহস করে না। চোখ তুলে নুসরাতের মুখের দিকে তাকাতেই চোখ তার সেখানে আটকে যায়। চোখ মুখে আটকে গেছে বললে ভুল হবে , নাকের স্টোনের নোজ রিং এর দিকে চোখ আটকেছে তার। সাদা রঙের পাথর টা জ্বলজ্বল করছে নাকের মধ্যিখানে। কপালে ঘাম জমে আছে কিছুটা। গালে ব্লাশ দেওয়ার জন্য গাল দুটো টকটকে গোলাপি হয়ে আছে। ঠোঁটে নুড কালার লিপিস্টিক। আর কাপড় আজ সচারাচরের মতো নেই কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। কালো রঙের ফরমাল শার্ট আর সাদা অফ হোয়াইট কালার ফরমাল প্যান্ট পরেছে। গলায় প্যান্ডেন্ট ঝুলছে। হাতে কাপড়ের সাথে মিলিয়ে ছোট হ্যান্ড ব্যাগ।পায়ে লুইস বাটনের রেড কালারের হিল এই সাজে নুসরাতকে যতেষ্ট গোছালো দেখাচ্ছে। কিন্তু ও এত দামি জুতা কোথায় পেলে আবির মনে মনে ভাবতে লাগলো। কিছুক্ষন পর নিজেই নিজেকে উওর দিল হয়তো কোনো ফুতপাতের দোকান থেকে নিয়েছে হয়তো বা। আর তার সাথে দেখা করতে যখন আসত তখন কি পরিধান করে আসত? অভার সাইজড টিশার্ট আর ব্যগি প্যান্ট! চুলগুলোতে করে রাখত পাখির বাসার মতো। আর আজ চুল আঁচড়ে ঠিকঠাক সেজে তার বিয়েতে এসেছে তাকে চমকে দিতে। আগে এরকম করে থাকলে সে কি কখনো এই মেয়েটাকে ছেড়ে দিত? অব্যশই না!
আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তখনই অনুভব হয় কেউ তার হাত তাবা মেরে চেপে ধরেছে। মেয়েলি হাতের লম্বা নখের দংশনে ধীরে ধীরে নিজের অতর্কিত চিন্তা থেকে বের হয়ে চেতনায় ফিরে আসে সে। হতবিহ্বল মুখ নিয়ে নুসরাতের দিকে তাকাতেই নুসরাত ঠোঁটে ঝুলানো মেকি হাসি দীর্ঘ করে বলে,”তুমি তো জানো আবির, আমি কারোর ঋণ রাখতে পছন্দ করিনা। তোমার একটা ঋণ আমার কাছে থেকে গিয়ে ছিল, তাই আজ তা শোধ করে দিতে আসলাম।
নুসরাতের সুচারু গলার আওয়াজে আবির নিজের চোখ নিচে নামিয়ে নেয়। ঢোক গিলে সূক্ষ্ম গলা ভিজাতে চায়, হয় না! হাতের মধ্যে গোলাকার কিছুর অস্তিত্ব পেতেই হাতের মুঠ খুলে দেখতে পায়, নুসরাতকে তার পক্ষ থেকে দেওয়া আংটি। আংটিটার দিকে তাকিয়ে আবার দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সে।
নুসরাত শব্দহীন হাসল। আবিরের বউয়ের হাতে ছোট একটা বক্স তুলে দিতে দিতে বলল,”দোয়া করি ভালো থাকো। আশা করব, তোমার জীবন সুন্দর ও সুখী হবে।
তারপরই আবিরের শোনার মতো করে গলা নামিয়ে নিয়ে বলে,”জানি ভালো থাকবে না, তবুও দোয়া করে দিলাম। যেই মাথা মোটার ভাগ্যে পড়েছে……আহ্ আমি আর বলতে চাই না।
নুসরাত কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ায়, সামনের দিকে যেতে নিবে আবির পিছন থেকে জিজ্ঞেস করে,”চলে যাচ্ছো?
নুসরাত মাথা ঘুরায় পিছনে। অনর্থক হেসে, তাচ্ছিল্য করা কন্ঠে বলে,”এতো তাড়া দিচ্ছো কেন আবির? এসেছি যখন খেয়েই না হয় যাই। আমি আবার বস্তি থেকে আসার সময় ভাবলাম তোমার না আবার আমার দেওয়া গিফট পছন্দ না হয়। হাহ্….!
আর কোনো কথা বলে না নুসরাত, আবিরকে ও বলার সুযোগ না দিয়ে লুইস বাটনের রেড কালার হিল দিয়ে গটগট শব্দ তুলে চলে যায় চোখের নিমেষে কোথাও। যেমনি হঠাৎ করে এসেছিল, তেমনি হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেল।
সন্ধ্যা থেকেই সৈয়দ বাড়ির ভিতর থেকে একের পর এক নাকি কান্নার শব্দ আসছে। সোহেদ সাহেব বিজনেস এর কাজে দিল্লি গিয়েছেন, তাই তার দেখা সৈয়দ বাড়িতে নেই। শোহেব বাড়ির ফটকে মাথায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ করে মা অসুস্থ হয়ে পড়বেন সেটা তিনি ভাবতেই পারেননি। বাড়িতে সোহেদ না থাকার কারণে কোনো দিক দিশা ও খুঁজে পাচ্ছেন না।
নাছির সাহেব নাছির মঞ্জিলের ভিতর থেকে মহিলাদের চিৎকার চেচামেচির শব্দ শুনে বাড়ির বাহিরে বের হয়ে আসতেই দেখা হলো শোহেবের সাথে। ভাইয়ের চিন্তিত মুখ দেখে নাছির সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,”কি হয়েছে তোর? মুখ এমন হয়ে আছে কেন? আর বাড়ির ভিতর থেকে এত চিৎকার চেচামেচির আওয়াজ আসছেই বা কেন?
শোহেব সাহেব ভাইয়ের দিকে ফিকে হয়ে যাওয়া দৃষ্টিতে তাকান। কাঁদো কাঁদো হয়ে যাওয়া নিভু কন্ঠে বলেন,”আম্মার অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছে ভাই। আমি এম্বুলেন্স কল দিয়েছি আসছে বলছে, কিন্তু এখনো আসেনি।
নাছির সাহেব মাথায় হাত দিলেন। ভাইয়ের দিকে রাগী দৃষ্টি ছুঁড়ে বাড়ির ভিতরে পা দিতে যাবেন কানে বেজে উঠল গম্ভীর গলার সেই বাজখাই আওয়াজ,বের হয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। আর এক পা এগোলো না সামনে, সেখানেই নাছির সাহেবের পা স্থির হলো, দ্বিতীয় পা ভিতরে বাড়ানোর ও সাহস আর হলো না।
ইসরাত আর নুসরাত বের হয়েছিল বাড়ির বাহিরে কান্নার শব্দ শুনে। দু-জন বাড়ির বাহিরে আসতেই দেখল নাছির সাহেব একপ্রকার হন্তদন্ত হয়ে সৈয়দ বাড়ির ভিতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছেন, কিন্তু ভিতরে আর পা রাখলেন না। বাড়ানো পা পিছনে নিয়ে আসলেন কিৎকাল গেটের সামনে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থেকে।
দূরে দাঁড়িয়ে বাবার কর্মকান্ড খুব সূক্ষ্ম চোখে দু-বোন লক্ষ করল। ইসরাত নিষ্পলক চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। বুঝতে চাইল নাছির সাহেব কেন এভাবে থেমে গেলেন? কেন বাড়ানো পা পিছিয়ে নিলেন? আর কেনই বা মুখটা অস্বাভাবিক থমথমে ধারণ করেছে? নিজের মাথায় চাপ দিল। মস্তিষ্ক থেকে এই কেন বিশিষ্ট এত প্রশ্নের একটা উত্তর আসলো আর সেটা আসতেই চোখ কুঁচকে ঠোঁট উল্টে দাঁড়িয়ে রইল। মুখের ভিতর নখ ঢুকিয়ে হাফসাফ করতে লাগল। অতর্কিত চিন্তাগুলো জোরা লাগানোর চেষ্টা করতেই, এম্বুলেন্সের উচ্চ শব্দ ভেসে আসলো নিজের থেকে দু-হাত দূর থেকে। ইসরাত নিজের অতর্কিত চিন্তা থেকে বের হয়ে সামনে তাকায় তখনই নাছির সাহেব ধমকে ওঠেন। গর্জে ওঠা কন্ঠে বলেন,”তুমি এখানে এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? তোমার মাকে ডেকে নিয়ে আসো? যাও!
নুসরাতের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকাতেই সে ও চোখ ছোট ছোট করে তাকায় নাছির সাহেবের দিকে। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে কি। নাছির সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে কড়মড় কন্ঠে বিড়বিড় করে বলেন,”একে কিছু বলাই বৃথা।
মেহেরুন নেছাকে সৈয়দ বাড়ির ভিতর থেকে ইরহাম আর শোহেব বাহিরে নিয়ে আসলেন। পেছন পেছন কান্না করতে করতে বেরিয়ে আসলেন বাড়ির মহিলারা। নুসরাত আর ইসরাত দু-জন দু-জনের দিকে তাকিয়ে বিতৃষ্ণা নিয়ে শ্বাস ফেলল। নাক ফুলিয়ে দু-বোন চোখ দুটো উল্টে নিল। নুসরাত বোনকে চোখ দিয়ে ইশারা করল মা-চাচিদের সাথে যাওয়ার জন্য।
তখনই কান্না করতে করতে আসলেন আহানের নানি সুফি খাতুন। হাউমাউ করে মরা কান্না জুরে দিলেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে। নাছির সাহেব সবাইকে ইশারা দিতেই সবাই গাড়িতে উঠে গেলেন। সুফি খাতুন এম্বুলেন্সে কান্না করতে করতে উঠতে যাবেন নুসরাত উনার হাত চেপে ধরল। মিচকে হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করল,”দাদি কোথায় যাচ্ছো?
সুফি খাতুন শব্দ করে শ্বাস ফেললেন। নুসরাতের কথার উত্তর না দিয়ে চলে যেতে চাইলে সে ঝাপটে ধরে উনাকে। ভ্রু তুলে জিজ্ঞেস করল,”কোথায় যাচ্ছো দাদি? বললে না যে?
সুফি খাতুন নাক কুঁচকে নিজের বিরক্তি সামলান। এই মেয়েটাকে দেখলেই তার রাগ রাগ লাগে। বেয়াদব একটা। এ নাকি স্পষ্ট কথা বলে, স্পষ্ট কথা বলার নামে যে বেয়াদবি করে তা কে বলবে। বেটাছেলেদের মতো ঘুরে বেড়ায় আবার বলে স্পষ্টবাদী। সুফি খাতুন নিজের বিরক্তি চেপে কিছু বলতে যাবেন, এম্বুলেন্স সাইরেন বাজিয়ে ভু শব্দ করে পাশ কাটিয়ে চলে যায় তার। সুফি খাতুন কিছুক্ষণ এম্বুলেন্সের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে ঠোঁট কুঁচকে বললেন,”কোথাও যাচ্ছি না।
নুসরাত হে হে করে হাসল। মৃদু কন্ঠে বলে ওঠে,
“আগে বলে দিলেই হতো দাদি ,সামান্য একটা কথা বলা জন্য এতো অপেক্ষা করালে।
নুসরাত বোকা হেসে সুফি খাতুনের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। রাস্তায় পায়চারি করতে করতে হঠাৎ তার মনে হলো কেউ একজন তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে সিউর কে এদিকে এরকম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাথা নিচু করে মিচকে হাসি দিয়ে নিজাম শিকদারের কিছু বোঝে ওঠার আগেই ঠোঁট চেপে বিশ্রী হাসি দিয়ে চোখ বড় বড় করে নিজাম শিকদারের দিকে নিক্ষেপ করে বলে ওঠে,”কেমন আছো বুড়ো হ্যান্ডসাম?
নিজাম শিকদারের মুখ পানসে হয়ে গেল। তাকে কেউ বুড়ো বলুক সেটা তিনি পছন্দ করেন না। তিনি এখনো ইয়াংম্যান। বাজারে পাত্রী খোঁজার জন্য বের হলে পাত্রীর লাইন লেগে যাবে, আর এই মেয়ে তাকে বুড়ো বলে সবসময় অপমান করে।
নুসরাত কে তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজাম শিকদারকথার উত্তর দিলেন অনিহার সহিত,”হ্যাঁ ভালো ভালো! তুমি যাওনি? তোমার দাদির অবস্থা দেখছ?
নুসরাত নাক উপরের দিকে তুলে ফেলে। হালকা হাতে নিজের এবড়ো থেবড়ো ভ্রু চুলকে নিয়ে, চোখ উল্টে উত্তর করে,”দাদার সাথে যদি যেতাম, তাহলে তোমার সাথে কি করে কথা বলতাম! মাথার স্ক্রু ঢিলে হয়ে গিয়েছে তোমার, ডাক্তার দেখাও গিয়ে। বুড়ো হয়ে যাচ্ছো এর প্রমাণ কি বারবার তোমায় দিতে হয় বুড়ো?
নিজাম শিকদার মুখ কালো করে ফেললেন। সেই মুহুর্তে সেখানে এসে উপস্থিত হলো ইরহাম। হাতের আঙুলে চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে একবার নিজাম শিকদারের দিকে আর একবার নুসরাতের দিকে তাকাল। নিজাম শিকদার ইরহামকে দেখে যতটুকু মুখের বিকৃতি ঘটানো যায় ঘটিয়ে ফেললেন। এমন লুক দিলেন যেন জঘন্য একটা মানুষের মুখ দেখে ফেলেছেন। দো-তলা থেকে থু করে থুথু ফেলে দিলেন মাটিতে। বিড়বিড় করে ইরহামকে দুটো গালি দিয়ে চলে গেলেন বারান্দা থেকে। নুসরাত আর ইরহামের কানে মৃদু শব্দে সামান্য কথা আসলো,”মেয়েবাজ ছেলে! সৈয়দ বাড়ির নাম ডুবিয়ে ছাড়বে। বদমাস, হতচ্ছাড়া ছেলে মেয়ে।
নুসরাতের মুখের আদলের রঙ এক নিমেষে পরিবর্তন হয়ে গেল। শান্ত থাকা মেজাজটা চট করে চড়ে গেল। হাতের কাছে থাকা মোবাইল ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে ফেলল না। মাথায় আসলো এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকার তার মোবাইল। মোবাইলের কভার দুমড়ে-মুচড়ে ফেলতে চাইল মনে হলো তেরোশত টাকার কভার। নিজের হাতের চশমা ঢিল মারতে গিয়ে থেমে গেল। এটা ছাড়া তার চলবে না, কারণ এটা তার মতো একটু আদটু কানা ব্যক্তির জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস। তাহলে কি ঢিল মেরে নিজের রাগ সামলাবে। চোখ পাশ ফিরাতেই চোখে ভাসল ইরহাম। এক যোগে ইরহামের দিকে শিকারী নজরে চেয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে হেসে উঠল নুসরাত। ইরহাম নুসরাতের হাসির কারণ ধরতে পারল না। ইরহামের কিছু বোঝে ওঠার আগেই নুসরাত দাঁত খিঁচে পুরুষালি গালে ঠাস ঠাস করে দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দেয়।
দূরে দাঁড়ানো সুফি খাতুন হায় হায় করে উঠলেন। নুসরাত কে ভৎসনা করে বলেন, “কি মেয়েরে বাবা? বড় ভাইকে থাপ্পড় মারে।
নুসরাত সুফি খাতুনের জোর গলার ভৎসনা গায়ে মাখলো না। দু-হাত আরাম করে ঝেড়ে ফেলে ইরহামকে ফিসফিস করে বলে ওঠে,” এখন কিছুটা রাগ কমেছে।
রাগ করিসনি তো?
ইরহাম গালে হাত দিয়ে নিশ্চল চোখে চেয়ে রইল সামনের দিকে। নুসরাতের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তাকানো দেখে দু-পাশে মাথা নাড়িয়ে বলে উঠল,”না কিছু মনে করিনি।
ইরহামের হাত থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে হেলেদুলে গাড়িতে গিয়ে বসল নুসরাত। আহানকে ডাক দিতেই সে এসে ব্যাক সিটে বসল। ইরহাম নিজের গালের মধ্যে এক হাত চেপে মুখ হা করে গাড়িতে গিয়ে বসল। এখনো বেচার শক থেকে বের হতে পারেনি। নিজের সূক্ষ্ম গলবিল ঢোক গিলে ভিজিয়ে নিয়ে, নিভে যাওয়া কন্ঠে বলে,”তোর হাতটা দেখি। এতো শক্ত কেন তোর এই হাত। হাত নয় যেন লোহা। দেখ, আমার গালে এখনো চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। তুই আমাকে চড় থাপ্পড় মারার আগে একবার বলে দেস না কেন! তাহলে তো আমি রেডি হয়ে বসে থাকব তোর হাতের মার খাওয়ার জন্য। এরকম অতর্কিত হামলা করবি না, আমার মতো নিরীহ প্রাণী, নিষ্পাপ, বাচ্চা একটা ছেলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আলো, এরকম আক্রমণে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক করে মরে গেলে কি হবে?
আহান পিছন থেকে বলে ওঠে,
“কিছুই হবে না। দেশের জনসংখ্যা থেকে একজন কমে যাবে। আর আমাদের ঘর থেকে ও।
ইরহাম তীক্ষ্ণ চোখে আহানের দিকে তাকাতেই আহান মুখ জিপার টানার মতো করে। নুসরাতের দিকে তাকাতেই নুসরাত মাথা দোলায় উপর-নিচ। ইরহামকে ভরসা দিয়ে বলে ওঠে,”আচ্ছা। এরকম আর হবে না।
আহান হি হি করে হাসে গাড়ির পিছনে বসা অবস্থায়। ইরহাম কপালের হালকা ভাঁজ শীতিল করে পিছনে ফিরে জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে? দাঁত কেলানো হচ্ছে কেন?
আহান নিজের হাসি দমন করতে চেয়ে মুখ হাতের কব্জিতে চেপে ধরে। কোনোরকম হাসি থামিয়ে বলে ওঠে,”আপু বলছে না, আর মারবে না। তুমি সিউর থেকো রাগ ওঠলেই এরকম আরো দু-চারটা তোমার উপরই পড়বে। আপুকে আমি বিন্দু পরিমাণ বিশ্বাস করিনা।
নুসরাত আহানকে জিহ্বা বের করে ভেঙ্গায়। চোখ ছোট ছোট করে বলে ওঠে,”চুপ কর বেডা। কানের নিচে এমন একটা থাপ্পড় লাগাব দাঁত নড়ে যাবে। দুধের দাঁত এখনো পড়েনি আর আসছে আপু…..ভাগ এখান থেকে শালা।
আহান নুসরাতের কথা শুনে হি হি করে হেসে ওঠে। ইরহাম ও গালে হাত রেখে হাসতে যাবে মটমট করে শব্দ করে ওঠে দাঁতের মারি। দাঁত চেপে কাঁদো কাঁদো মুখ বানিয়ে হু হু করে হাসে ও সে।
“হ্যালো হেলাল তোমার মায়ের অবস্থা তো খারাপ, হার্ট অ্যাটাক করে হসপিটালে ভর্তি, শেষবারের মতো তোমাকে দেখার আর্জি জানাচ্ছেন উনি।
হেলাল সাহেব ফোনের দিকে হা করে তাকিয়ে রইলেন। ফোন লাউড স্পিকারে থাকার জন্য স্পষ্ট সব কথা কানে গেল লিপি বেগমের। লিপি বেগম আর্তনাদ করে ওঠেন। মাথায় হাত দিয়ে সামনে এগিয়ে এসে ফিকে হয়ে যাওয়া অসাড় কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,”আম্মার কি হয়েছে?
নিজাম শিকদারের গলা এবার নরম হয়ে আসে৷ ঢোক গিলে নিয়ে ব্যথিত কন্ঠে বলেন,”যা শুনেছ বড় বৌ-মা তাই।
আরশ নিজের রুম থেকে বের হয়ে মা বাবকে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে দেখে হাতে পানির জগ নিয়ে এগিয়ে আসে৷ বাবার দিকে চেয়ে এক ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে? এরকম আপনারা দু-জন বসে আছেন কেন?
লিপি বেগম নিজের অসাড় চোখ তুলে তাকান উপরে। পুরোদস্তুর নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে এলোমেলো কন্ঠে বলে ওঠেন,”আম্মার শরীর খারাপ করেছ, হসপিটালে নাকি ভর্তি। বাপ আমার কিছু একটা কর, দেশে যাব আমি। আব্বার শেষ সময়ে আমি ছিলাম না, এবারো কি থাকতে পারব না? না না.. আম্মা কখনো আমাকে মাফ করবে না। তুই বাপ আমার টিকেট বুক কর! কেউ গেলে যাক না গেলে নাই, দেশে আমি একাই যাব।
প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৫
আরশ কপালে ভাঁজ ফেলে তাকায় হেলাল সাহেবের দিকে। হেলাল সাহেব নিজের এলোমেলো, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া চাউনি উপরে তুলে কিয়ৎকাল চুপ থাকেন। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে নিজের করা প্রতিজ্ঞার বিরুদ্ধে গিয়ে ধীর স্বরে আওড়ান,”চারটা টিকেট কাটো আরশ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমরা দেশে যাচ্ছি।
আরশ অবাক চোখে চেয়ে থাকে বাবার দিকে। রক্ত শূন্য হয়ে যাওয়া ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে
নম্র গলায় জানতে চায়,”কিন্তু চারটা টিকেট কেন?
হেলাল সাহেব নিজের দৃষ্টি মার্বেল টাইলসে স্থির করেন। অধর প্রসারিত করে বৃথা হাসার চেষ্টা করে বলে ওঠেন,”তুমি আর জায়িন ও যাচ্ছো।