প্রিয় বেগম পর্ব ২৭
পুষ্পিতা প্রিমা
শেহজাদের ঘোড়ার পিছুপিছু অনেকদূর ছুটলো অপরূপা। কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরী হয়ে গিয়েছে। শেহজাদের ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি আর শুনতে পাওয়া গেল না। সেইসাথে পথ হারিয়েছে সে। কিছুটা পিছু গেলেই বোধহয় পথ খুঁজে পাবে। তাই পেছনে তাকাতে তাকাতে ফের পৌঁছে গেল মসজিদের কাছাকাছি। ওই মেয়েগুলোকে খুঁজে না পেয়ে, শেহজাদের চলে যাওয়া দেখে, সব অপরিচিত মানুষজন দেখে সে দিশেহারা হয়ে পড়লো। কোথায় যাবে সে? কি করবে? কার কাছে আশ্রয় পাবে? তার জীবনটা কি এভাবে আশ্রয়ে আশ্রয়ে কেটে যাবে! অথৈ সমুদ্রে যুদ্ধ করে টিকে থাকা পালতৌলা নৌকোটির মতো শুধু যুক্ত করে যাচ্ছে সে।
কিন্তু কোনো কূলকিনারা নেই। যেখানে যাই সেখানেই অশান্তি, যুদ্ধ, কলহ লেগেই থাকে। ক্লান্ত হয়ে পড়ছে সে। আজকাল নিজেকে সত্যি সত্যিই অলক্ষী, অপয়া মনে হচ্ছে।
বুকের সাথে পুটলিটা চেপে ধরে নীরবে চোখের জল ফেললো। তারপর পথ খুঁজতে লাগলো। কোথাও ওই মেয়েদুটোকে দেখা গেল না। ঘোড়ার গাড়ি যেখানে থেমেছিল সেখানে গেল অপরূপা দেখলো ঘোড়ার গাড়ি নেই। আরও কিছুদূর গেল। সারি সারি যে গাড়িগুলো দাঁড়ানো ছিল তাদের সবাইকে জিজ্ঞেস করলো রূপনগর থেকে কেউ এসেছে কিনা। লোকগুলো জানালো তারা চলে গেছে কিছুক্ষণ আগে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অপরূপা হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লো। হাঁটতে হাঁটতে নির্জন জায়গায় এসে থামলো। সেখানে একটা বটগাছ আছে। বটগাছের নীচে শান বাঁধানো। সেখানে হতাশ হয়ে বসে পড়লো সে। পুটলিটা বুকে জড়িয়ে হাঁটুতে মাথা রাখতে গিয়ে কখন যে চোখে তন্দ্রা নেমে এল বিলক্ষণেও বুঝতে পারলো না সে। যখন চোখ খুললো তখন একদল সৈন্যসামন্ত দেখলো সে। মাথায় পাগড়ি বাঁধা। মুখ ঢাকা তার। মসজিদের আশেপাশে যারা ছিল তারাও কোনোমতে পালিয়ে গেল! ঘোড়াগুলি চিঁহি চিঁহি শব্দ তুলে পা তুলছে আবার শব্দ করে বসাচ্ছে।
অপরূপা জড়োসড়ো হয়ে বসলো। শঙ্কিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পুটলিটা নিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘কে আপনারা? কি চান? ‘
গাড়ি থেকে দু একজন লোক নেমে এল একসাথে। খুবই নিকটে তাদের মুখোশপরা মুখটা অপরূপা দেখতে দেখতে ঢলে পড়লো।
অতল আঁধারে নিমজ্জিত পাহাড়ের মাঝামাঝি জায়গায় একটা গুহার মতো বাসস্থান। সেখানে সারি সারি মশাল জ্বলছে। বন্য শূকরের গায়ের তীব্র গন্ধে গা গুলালো অপরূপার। বন্য শেয়ালের ভয়ংকর ডাক। হুতুম পেঁচার ডাক। পাহাড়ি নিজস্ব শব্দ। বনের ভেতরে বয়ে যাওয়া শাঁ শাঁ বাতাস। অপরূপার মনে হলো সে অন্য একটা জায়গায় আছে। নিজেকে একটা তাবুর মতো ঘরে আবিস্কার করলো সে। তাঁবু থেকে বের হতেই সেই মশালগুলো দেখতে পেল। তাঁবুর বিপরীত পার্শ্বে একজন কালো পোশাক পরিহিত এক বৃদ্ধ লোক বসে আছেন। সেখান হতে ধোঁয়ার কুন্ডলী ভেসে আসছে। বৃদ্ধকে ঘিরে সেই লোকগুলি বসে আছে যারা তাকে তুলে এনেছে । অপরূপা সাহস সঞ্চয় করে দুরুদুরু বক্ষে কাছাকাছি যেতেই সবাই একত্রে তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। অপরূপা পিছু হেঁটে বলল,
‘ কারা আপনারা? ‘
বৃদ্ধ লোকটি ইশারায় তাকে ডাকলো। অপরূপা কম্পমান বক্ষে এগিয়ে গেল। ভীত জড়োসড়ো হয়ে নির্দিষ্ট আসনে বসতেই লম্বা দাঁড়ি গোঁফওয়ালা বৃদ্ধ বলল,
‘ আমরা সন্ন্যাসী। যোদ্ধা। ‘
অপরূপা সকলের পাথরের মূর্তির ন্যায় পলকহীন মুখের দিকের চেয়ে ভয়ে ভয়ে বলল,
‘ আমার কাছ থেকে কি চান? কেন তুলে এনেছেন? আমাকে মুক্তি দিন। ‘
‘ তুমি এই গভীর রাতে গহীন বনে কোথায় যাবে? তোমার বাড়িঘর কোথায়?
‘আমার কিচ্ছু নেই। আমাকে ছেড়ে দিন। ‘
জ্বলন্ত আগুনের উপর একমুঠো ধুপ ফেলে দিতেই অপরূপা খুকখুক করে কেশে উঠতেই বৃদ্ধ বলল,
‘ তুমি দুটো দিন সময় কাটাও এখানে। ওই মনুষ্যসমাজকে তোমার তুচ্ছ মনে হবে। জীবন এভাবেই সুন্দর। নেই কোনো ঝঞ্ঝাট, নেই পিছুটান, নেই কারো মায়া। ‘
অপরূপা কাশতে কাশতে স্বাভাবিক হলো। বলল,
‘ আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। খিদেও পেয়েছে। ‘
কমলা রঙের শাড়ির মতো পোশাক প্যাঁচানো দুটো মহিলা এসে তাকে তুলে নিয়ে গেল। তাঁবুর ভেতর বসিয়ে চুপচাপ চলে গেল। ফের দু’মিনিটের মধ্যে ফিরে এসে বিরাটাকার একটি পাতায় করে খাবার নিয়ে এল। অপরূপা পিছিয়ে গিয়ে বলল,
‘ছিঃ এসব আমি খাইনা। পোড়া মাংস। আমি খাব না। নিয়ে যান। কিসের মাংস এসব? ‘
‘ পাখির মাংস। ‘
বলেই চলে গেল মহিলা দুটো। অপরূপা সেসব না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। মাঝরাতে খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করে উঠলো তার। ক্ষিধে এমনভাবে কলিজা আঁচড়াচ্ছে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে চোখের পলকেই মাংসগুলো শেষ করে ঢকঢক করে মাটির কলস থেকে পানি খেল সে।
তারপর কান মাথা ভোঁ ভোঁ করে উঠলো। তাঁবুর বাইরে বিশালাকৃতির একটা ছায়া চোখে পড়লো তার। ভয়ে তরতরিয়ে ঘাম ছুটলো । গলা শুকিয়ে এল। মাথা ঘুরে উঠলো।
তাঁবুর মধ্যে থাকা হারিকেনের পাশে ধনুক, বল্লম, ছোট ছোট চাকু, কুড়াল, পেরেক, মাতুলি দেখতে পেল সে। নিজের প্রাণসংশয়ের ভয় সে চট করে
ধনুক হাতে তুলে নিল। তাবুর ফটক দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে ছায়াটি বরাবর আন্দাজে তীর ছুঁড়তেই নিজেই সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠে ছিটকে পড়ে গেল। সাথেসাথে গোৎগোৎ শব্দ তুলে ভূমিকম্পের মতো মাটি কাঁপিয়ে জন্তুটি পালিয়ে গেল।
অপরূপা জড়বস্তুর ন্যায় পড়ে রইলো অবশ শরীরে। তার শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরা মৃত্যুভয়ে কাঁপছে। ভেতরের কান্না ভেতরেই চেপে গেল তার। এখানে কান্না মানেই তার বিপদ।
তাঁবুর বাইরে মনুষ্য পদধ্বনির শব্দ পেল সে। বেরিয়ে এল সাথে সাথেই । চেঁচিয়ে উঠে ধপ করে বসে পড়ে বলল,
‘ আমাকে মুক্তি দিন। আমি এখানে থাকতে পারব না। ‘
বৃদ্ধ লোকটি নিরুত্তাপ। রুক্ষস্বরে বলল,
‘কাল সেটি আবারও আসবে। প্রস্তুত থাকবে। ‘
কথাটি শুনে অপরূপার দমবন্ধ প্রায়। পালাতে পারবে না সে জানে। যতক্ষণ না এরা চায় ততক্ষণ সে পালাতে পারবে না। কিন্তু কাল কি করে লড়বে ওই জন্তুর সাথে। আজ কোনোমতে বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু কাল?
সুন্দরপুরের সমস্ত অলিতে-গলিতে পাঁচ পাঁচটা ঘোরাঘুরি করলো শেহজাদ। এক জমিদার বাড়িতে আতিথেয়তার গ্রহণ করলো। জমিদার বাড়ির একজন ভৃত্যকে সাথে নিয়ে সারা সুন্দরপুরের অলিগলিতে ঘুরে বুঝলো দারিদ্র্যতা এখানকার বড় সংকট। সচ্ছল অবস্থা মাত্র গুটিকয়েক বাড়ির।
নিজের জাগতিক সমস্ত দুঃখ, বেদনা, পাওয়া-না পাওয়ার হিসেব, আর হার-জিতের কথা ভুলতেই তার এই পদক্ষেপ। দাদাজান বলতেন, তোমার দায়িত্বকে কভু অবহেলা করবে না, যাই হয়ে যাক। যা তোমার তা তোমার কাছে ফিরে আসবেই। যা কিছুর প্রতি তুমি আকৃষ্ট হও সেইসব যদি তুমি না পাও তবে আফসোস করবে না। মনে করবে তা তোমার জন্য অকল্যাণকর ছিল। দাদাজানের কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে সে।
কিন্তু দিনশেষে যখন ক্লান্তি এসে ভর করে চোখের পাতায় তখনি ঝাপসা ঝাপসা ওই চোখদুটি ভেসে উঠে মানসপটে। অন্যায়, এবং সমীচীন নয় জেনেও তাকে ভাবতে বড়ই ভালো লাগে। মনে হয় রূপা তার জন্য কিছুতেই অকল্যাণকর হতে পারে না। কিছুতেই ওই সরল মনের মেয়েটি তার জন্য অশুভ হতে পারে না। হঠাৎ করে মনে হয় না ওই রাতটি মিথ্যে। তাদের নিকাহ হয়নি। সে মহলে ফিরে দেখতে পাবে রূপা নিকাহ করেনি। যার কাছে ধ্বংস তাকে রূপা ভালোবাসতে পারে না। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয় কি যায় আসে এতে? সামান্য স্বপ্নের মৃত্যুই তো ঘটলো। দিব্যি আছে সে। ভালোমন্দে বেঁচে আছে। বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে। খেতে পারছে। বেশ আছে। জীবনে এত এত পূর্ণতার মাঝে এটুকু অপূর্ণতা থাকুক।
কিন্তু মহলে সে কি করে ফিরবে? এক ছাদের নীচে থেকে রূপাকে অন্য খাঁচায় দেখে নিজেকে সামলাবে কি করে? ভাবতেই বুকের বাম পাশ হতে ব্যাথা উদগম হয় তারপর একটু একটু করে তা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। মনটা তাকে শান্তি দেয় না। বারবার বলে, তোর মনটা ভালো নেই। মনটাই যে রূপা। তারমানে রূপা ভালো নেই।
মনের এই দোলাচালে সে চিঠি লিখলো সাফায়াতকে। জমিদার বাড়ির ঠিকানা দিল।
বত্রিশ ঘন্টার ভেতরেই কাশিম এসে হাজির এল
সেখানে। জানালো খোদেজা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। শেরহামের লোকজন দিনদুপুরে নগরে লুটতরাজ করছে। দুটি মালবাহী জাহাজ সমুদ্রপথে আটকে রেখেছে শেরহাম। আর রূপা সেইরাতেই পালিয়েছে। আর সে সুন্দরপুরেই আছে।
সব শুনে শেহজাদের পায়ের নীচের মাটি সরে গেল। স্তব্ধ হয়ে গেল সে। ধমকের সুরে গর্জন করে বলল, তাকে পালাতে দিলে কি করে? কিছু চেনে ও?
কাশিম মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো। বলল, মা বেগম সাহায্য করেছেন।
শেহজাদের আর কিছু বলার রইলো না।
শেহজাদ কাশিমকে বলে সৈন্যদল ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিল সুন্দরপুরে। শেহজাদ সেই মসজিদে নামাজ আদায়ের জন্য গেলে এক খতিবের মাধ্যমে জানতে পারলেন, সাদা পোশাক পড়া একটা মেয়ে ডাকাত সৈন্যদের হাতে পড়েছিল সেইরাতে।যেইরাতে মাহফিল ছিল। মেয়েটি অতিশয় রূপবতী ছিল।
সবটা শোনার পর শেহজাদ নিজেকে ধিক্কার দিল। রূপা তার এত কাছাকাছি ছিল আর সে দেখলো না, বুঝলো না? এখন কোথায় খুঁজবে সে রূপাকে? তারমানে ওইদিন চিরকুটটা সে লিখেনি? কত ভুল বুঝলো সে রূপাকে! এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত কি করে করবে সে? ডাকাত সৈন্যরা রূপাকে অক্ষত রেখেছে কি আদৌ? খোদার দরবারে সে আর্জি জানায় রূপা যেখানে থাকুক ভালো থাকুক।
এদিকে, সন্ন্যাসীদের আঁখড়ায় বন্দি রূপার দিন কাটতে লাগলো রোজ রাতে বন্য শূকরের আক্রমণ ঠেকাতে, দিনের বেলায় ক্ষিধের জ্বালা মেটাতে মাছ শিকারে, আর পাখি শিকারে। পরপর কয়েকবার ঘোড়ার লাগাম হাত থেকে ছুটে গিয়ে বন্য মাটির ঝোপঝাড়ে, কাটাবনে পড়ে ক্ষতবিক্ষত হলো সে। আর তখন মনে হলো তার পালানোর দরকার। এ জীবন তার কাম্য নয়। সেও একটু ভালো থাকার অধিকার রাখে।
বড়ই অযত্নে সেই ক্ষত শুকানোর পর সেই লাগাম পুনরায় ধরে ঘোড়াটিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল সে জ্যোৎস্নারাতে। পেছনে তাকে তাড়া করে চলেছে সন্ন্যাসীদের দল। ছুটতে ছুটতে বিশাল জায়গাজুড়ে বসা একটি মেলার সামনে এসে দাঁড়ালো সে। ঘোড়ার পিঠ থেকে নামতেই ঘোড়াটি তার কাঁধে মুখ ঘষলো। অপরূপা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
প্রিয় বেগম পর্ব ২৬
‘ভালোই প্রশিক্ষণ দিয়েছি বল বন্ধু?’
বাতাসের সাথে সেই পরিচিত আতরের সুগন্ধি পুনরায় নাসিকাগ্রে প্রবেশ করতেই অপরূপা মাথা ঢেকে মুখ কাপড় বাঁধলো। পেছনে অনেকগুলো ঘোড়ার পায়ের শব্দ এসে থামলো। অশ্বারোহীর একজন দরাজ গলায় বলে উঠল,
‘পথ ছেড়ে দাঁড়ান।’
সামনেও একদল অশ্বারোহী এসে দাঁড়ালো। যাদের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছে সে। পেছনে শেহজাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অপরূপা আর অপরূপার সামনের লোকদের চেয়ে রইলো। অপরূপা দ্বিধাগ্রস্তের মতো চেয়ে রইলো। কি করবে এখন সে?