প্রিয় বেগম পর্ব ২৯
পুষ্পিতা প্রিমা
পুনরায় ধমকে উঠলো শেহজাদ।
‘ ওরা কে ছিল? কোথায় ছিলে তুমি? ‘
অপরূপা ঢোক গিলে এতক্ষণে মুখ খুললো।
‘ ওরা জাদুকর ছিল। আমাকে বলি দেয়ার পরিকল্পনা করছিলো। আমি পালিয়ে এসেছি। এই একমাস ওদের কাছে ছিলাম। ওরা খুব খারাপ লোক। ‘
বলতে বলতে ফুঁপিয়ে উঠলো সে। মনে হয়েছে তার সকল কষ্টগুলো কলকলিয়ে বলা যাবে এই মানুষটার কাছে। অথচ এক আকাশ রাগ, ক্ষোভ পুষে রেখেছিল সে এতদিন।
শেহজাদ হতভম্ব। অবিলম্বে তার চোখের রঙ পরিবর্তন হয়ে গেল। কটমট গলায় বলল,
‘ আমাকে আগে বলোনি কেন? আমি ওদের ছেড়ে দিলাম। ওরা তোমার কোনো ক্ষতি করেছে? ‘
অপরূপা দু’পাশে মাথা নেড়ে বলল,
‘ এই একমাস আমাকে গাঁধার মতো খাটিয়েছে। বনেবাদাড়ে পাখি শিকার করতে পাঠিয়েছে। ‘
শেহজাদ দ্বিগুণ বিস্মিত হয়ে বলল,
‘ তুমি? পাখি শিকার? ‘
‘ হ্যা শিকার না করলে খেতে দেয়নি। ‘
শেহজাদ ওর কান্নাভেজা মুখের দিকে বিমূঢ় হয়ে ভাবলো এবার সে রূপাকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করবে না। তার জন্য রূপাকে অনেক বিপদে পড়তে হয়েছে।
এতদিন পর একটা দুঃখ ঝাড়ার মানুষ পেয়েছে অপরূপা। নিজের সমস্ত রাগ, ক্ষোভ ভুলে গিয়ে এতদিনের জমানো কান্না ছেড়ে দিল। তার কান্নার চোটে তার শীর্ণদেহ দুলে উঠলো।
শেহজাদ তার গালে হাত দিয়ে পানি মুছে দিয়ে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ আমি তোমাকে আর একা ছাড়বো না। ‘
‘ ঠিকই ছেড়ে গেলেন। নিজের ভাইয়ের সব অপকর্ম জেনেও আমাকে মানিয়ে নিতে বলে মহল ছাড়লেন। ‘
‘ অনেক বড় একটা ভুল হয়ে গেছে রূপা। আমার কাছে এমন একটা চিরকুট এসেছিল যেখানে তুমি লিখেছিলে তুমি ভাইজানকে সুযোগ দিয়েছ, আমি যেন তার অধিকার ফিরিয়ে দিই। ওইসময় আমি মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম তারউপর তোমার এমন চিরকুট। ‘
‘ আমি কোনো চিরকুট পাঠাইনি। ‘
‘ আমিও না। যেটা পাঠিয়েছিলাম সেটা তোমার কাছে পৌঁছায়নি। আমি জানতে চেয়েছিলাম তুমি বিবাহে রাজী ছিলে কিনা। উত্তরে এসেছিল, হ্যা। তুমি যেমন আমাকে ভুল বুঝে পালিয়ে যাচ্ছ, আমিও তেমনটা ভেবেছি। ‘
অপরূপা চোখ চেপে জল ফেললো। এতটা অবিশ্বাসের ভেতরও কোথাও একটা বিশ্বাস ছিল যে সবটা মিথ্যে প্রমাণিত হবে। ঠিক তাই হলো। শেরহাম সুলতান এমন কোনো কাজ বাকি রাখেনি যা দিয়ে শেহজাদ সুলতানকে পরাস্ত করতে পারবে।
কাশিম দূরে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ সাহেব মাঝ নদীতে একটি জাহাজ দেখা যাচ্ছে। এদিকেই আসছে। সম্ভাবনা আছে জাহাজে শেরহাম সুলতান আর উনার লোকবল আছেন। ‘
অপরূপা আঁতকে উঠলো। শেহজাদ আশ্বাস দিয়ে বলল,
‘ কোনো ভয় নেই । আমি আছি। ‘
অপরূপা আশ্বস্ত হয়ে টিংটিংয়ের কাছে যাচ্ছিলো মাথায় কাপড় টেনে। শেহজাদের কথায় থেমে গেল।
‘ আমাকে বিশ্বাস করো তুমি? ‘
অপরূপার হাত মাথার দুপাশে ওড়নায় আটকে থাকলো। ফিরে তাকাতেই পুনরায় দুজোড়া চোখের মিলন ঘটলো।
ঢোক গিলে মোলায়েম কন্ঠে শেহজাদের অধৃষ্য চোখে চোখ রেখে অপরূপা শুধালো,
‘ করতে ইচ্ছে করেনা। তারপরও ভুল করে করে ফেলি। ‘
শেহজাদের ঠোঁটের কোণায় দুর্লভ হাসির ঝলক দেখা গেল একটুখানি। এই ভুল করে ফেলা বিশ্বাসে আর একফোঁটা আঁচও লাগতে দেবে না সে।
তারা সেই আগের মসজিদে চলে এল । সেখানে আশ্রয় নিল। টিংটিংয়ের সাথে হেঁটে এসেছে শেহজাদ। অপরূপা তার ঘোড়ার পিঠে চড়ে। সম্রাট এসেছেন শুনে সেই মসজিদের খতিবরা আপ্যায়নের ত্রুটি রাখলেন না।
অপরূপাকে নিয়ে গেল এতিমখানার রাঁধুনিগুলো। শেহজাদ তাদেরকে বলে দিয়েছে, যেন তাকে আরামের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। রাঁধুনিগুলো তাই করলো।
অপরূপা রাতে খেল না। না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লো। অনেকদিন যাবত সে ভালো করে ঘুমায় না। ভোররাতে স্বপ্নে সাদা পাঞ্জাবিতে মোড়া এক শুভ্র পুরুষকে দেখলো সে। মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। চারপাশে তীব্র আতরের সুগন্ধি। তাদের ঘিরে অসংখ্য প্রজাপতি উড়োউড়ি করছে। সেই শুভ্র পুরুষ খুবই নিকটে তার কপালের ঝালর সরিয়ে শুভ্র স্পর্শে তাকে রাঙিয়ে দিল। অপরূপা অনুভব করলো এত ভালোবাসা মিশিয়ে কেউ কখনো তাকে ছুঁইনি। এমন অনুভূতি আগে কখনো পায়নি। অপরূপা তুলতুলে পাখির ছানার মতো গুঁজে গেল একটি চাদরের নীচে। মনে হলো তাকে আর কেউ দেখবে না।
না শেরহাম সুলতান না কোনো অশুভ কিছু। এমন একটা আশ্রয় তো সে চেয়েছিল! কেন পায়নি? শরীরের প্রত্যেকটি শিরা উপশিরা ঝণাৎ করে কেঁপে উঠে ঘুম ছুটে গেল তার। কানে এল আজানের প্রতিধ্বনি। পুরোনো জং ধরা ইটের চার দেয়ালের ঘরে সে একা। খাট থেকে নেমে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। রাঁধুনিগুলোও উঠে গিয়েছে। তাদের অনেক রান্না করতে হবে আজ। সম্রাট আছেন। অনেক কাজ তাদের।
ফজরের নামাজের জন্য মসজিদের দিকে চলে গেল অপরূপা। মহিলাদের কক্ষের দিকে পা বাড়াতেই দেখতে পেল কক্ষটি খালি। কেউ নেই। সে ফজরের নামাজ আদায় করে নিল। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলো, শুকরিয়া আদায় করলো। মোনাজাত শেষ করতে করতে কানে এল সেই দরাজ গলার স্বর আর আতরের সুগন্ধি। অপরূপা সম্মোহিত হয়ে পড়ে এই গন্ধ নাকে এলে।
কয়েক পা এগিয়ে কক্ষের জানালার কাছে দাঁড়াতেই ঝটকা খেল পুনর্বার। সাদা ধবধবে সেই শুভ্র পুরুষটি শেহজাদ সুলতানের রূপে দাঁড়িয়ে মসজিদের সবচাইতে বয়োজ্যেষ্ঠ মৌলবির সাথে কথা বলছেন। তরতর করে কাঁপতে থাকা হাতটা তুলে মৌলবি সাহেব শেহজাদের মাথায় রাখতে চাইলেই শেহজাদ মাথা নামিয়ে দিল। উনি মাথায় চাপড় দিতে দিতে বললেন,
‘ খোদা তোমায় নেক হায়াত দিক। বিবাহিত জীবন সুখের হোক। ‘
শেহজাদ কিঞ্চিৎ হেসে মাথা তুলে তাকাতেই অপরূপার দিকে চোখ পড়লো হঠাৎ। অপরূপা দ্রুত সরে গিয়ে নামাজের জায়গায় গিয়ে বসে পড়লো। কান্নায় ভেঙে পড়লো। উনি কি মহলে ফিরে গিয়ে তটিনীকে নিকাহ করবেন? তটিনীর সাথেই তো বিবাহের কথা ছিল। উনি মহলে ফিরে গেলে তার কি হবে? সে তো মহলে ফিরতে পারবে না। কখনো ফিরবে না। কোন ব্যাথায় সে কাঁদছে তা সে নিজেই বুঝতে পারছেনা, নিজের সুরক্ষার কথা ভেবে, নাকি অন্যকিছু? শেরহাম সুলতানের পাপে পাপিষ্ঠ সে অমন পুতঃপবিত্র মানুষকে কেন স্বপ্নে দেখলো?
তিনিও তো পাপিষ্ঠ রূপাকে ভালোবাসেননি। তাহলে পাপমোচন করতে কেন যাবেন?
অপরূপা কান্নার মাঝে খেয়াল করেনি শেহজাদ এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে। পাশে এসে বসেছেও। অপরূপা কান্নামুখর চোখে তার দিকে তাকালো। শেহজাদ তার কান্নার কারণ জানতে চাইলো না। বলল,
‘ কোথায় যাবে ভেবেছ? ‘
অপরূপা কান্না রোধ করে ভাঙা গলায় বলল,
‘ গ্রামে। ‘
শেহজাদ চাপাস্বরে জানতে চাইলো
‘ গ্রামে কি? ‘
অপরূপা চোখ নত করে দু’পাশে মাথা নেড়ে বলল,
‘ কিছু না। ‘
‘ আমার দিকে তাকাও। ‘
অপরূপা তাকালো না। বলল,
‘ পারব না। ‘
প্রিয় বেগম পর্ব ২৮
শেহজাদ তার থুঁতনি ধরে মুখ তুলতেই অপরূপা কান্নাভেজা চোখে দেখলো সেই মোহনীয় দৃষ্টি! সেই আতরের ঘ্রাণ। সেই শুভ্র স্পর্শ। হৃৎস্পন্দন থেমে গেল তার। কানদুটো গরম হয়ে এল। শ্বাসপ্রশ্বাস রুদ্ধ এল। শেহজাদ বলে ফেললো,
‘ চলো নিকাহ করে ফেলি। ভালো পরে বেসো। ‘