প্রিয় বেগম পর্ব ৩৩

প্রিয় বেগম পর্ব ৩৩
পুষ্পিতা প্রিমা

বহুদিন পর ভাইজানকে দেখে খুশিতে আত্মহারা সকলে। সায়রা, শবনম, আয়শা ছুটে এল। সালাম দিতেই শেহজাদ সালামের উত্তর দিয়ে তাদের মাথায় হাত চাপড়ে বলল,
‘ কি অবস্থা সবার?
সায়রা বলল,
‘ ভালো। আপনি আসায় সবাই খুব খুশি হয়েছি।
সিভান কোল থেকে নেমে গিয়ে পালকি দেখে পালকির কাছে ছুটে গেল।
সাফায়াত এসে শেহজাদকে বুকে ঝাপিয়ে পড়লো। জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ তুমি ছাড়া এই মহলটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল ভাইজান। সব আনন্দ নিয়ে গেলে। দেখো তোমার আগমনে সবাই খুশিতে মেতে উঠেছে। তোমার শত্রুকেও স্বীকার করতে হবে তুমি এই মহলের প্রাণ। ‘
শেহজাদ ওর পিঠ চাপড়ে বলল, ‘ শেরহাম সুলতান কি আমাকে দেখে খুশি হয়েছেন?
সাফায়াত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হেসে বলল,
‘ হ্যা। তুমি ফিরছো না তাই তো অভিষেকের সময় ঘোষণা করেছে।
শেহজাদ বক্রহেসে বলল, ‘ এই খুশি বেশিক্ষণ থাকবে না। রূপাকে দেখলে উবে যাবে। ‘

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সাফায়াত হাসলো। শেহজাদ চিঠিতে সাফায়াতকে সবটা জানিয়েছিল। বোন জামাতা হিসেবে সে মনেপ্রাণে শেহজাদকে চাইলেও যেদিন রূপার প্রতি ভাইজানের দুর্বলতা দেখেছে ঠিক সেদিন থেকে সে চেয়েছিল রূপাই যেন ভাইজানের হয়। বড় ভাইজানের কাছে সে খেলার পুতুলের মতো। তার একমাত্র উদ্ধারকারী শেহজাদ ভাইজানই হতে পারে। বোনের অনুভূতি সম্পর্কে জানার পরও সে অপারগ। ভাইজান অবশ্যই তটিনীকে সুপাত্রে নিকাহ দেবেন তা সম্পর্কে সে অবগত। সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছেতে ঘটবে।
খোদেজা এগিয়ে এল। শেহজাদকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। শেহজাদ বলল,

‘ আমি আপনাদের ছেড়ে আর কোথাও যাব না আম্মা। ‘
খোদেজা মাথা তুলে বলে,’ সত্যি বলছো? ‘
‘ জ্বি সত্যি। ‘
খোদেজা অশ্রুজলে হাসলো। খোদেজা পালকির দিকে তাকালো। চোখমুখ মুছে বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
‘ পালকিতে করে কে এসেছে? ‘
‘ শেহজাদ পালকির দিকে তাকালো। সিভান পালকির পর্দা সরিয়ে অপরূপাকে দেখে বলল,
‘ সুন্দর বউ! কি মজা! সুন্দর বউ এসেছে। ‘
উপস্থিত সকলেই হতভম্ব চোখে তাকায়। শেরহাম এগিয়ে আসে। তার কপালে ভাঁজ। চোখে কৌতূহল। সকলেই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে। শেহজাদ পালকিতে বসা অপরূপাকে বলল,

‘ এসো। ‘
অপরূপা পালকি হতে নামলো। সায়রা,সোহিনী,শবনম এসে অপরূপার সামনে দাঁড়ালো। সায়রা ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ উফফ ভেবেছিলাম তোমায় আর কখনো দেখবো না। কত খুশি লাগছে তোমাকে দেখে। ‘
অপরূপা কোনো কথা বললো না।
সায়রা অপরূপাকে ছেড়ে ওর মুখ অনাবৃত করে দিল। শেরহাম এগিয়ে এসে বলল,
‘ তুমি তারমানে ওর সাথে ছিলে? এই তুই ওকে কোথায় পেয়েছিস? ‘
শেহজাদ উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। সায়রাকে বলল,

‘ রূপাকে অন্দরমহলে নিয়ে যাও। ‘
‘ নাহ ও অন্দরমহলে যাবে না। আমার কথার উত্তর দে। ‘
সায়রা সোহিনীরা ওর গর্জনে সরে দাঁড়ালো। খোদেজা এগিয়ে এসে অপরূপার সামনে দাঁড়ালো। সকলে যা লক্ষ করেনি খোদেজা তা লক্ষ করলেন। গায়ের ভারী পোশাক, নাকের টানানথ, মাথার টায়রা পরখ করে অত্যধিক কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ এতদিন কোথায় ছিলে তুমি? এই সাজে কেন? তোমার নিকাহ হয়েছে? ‘
অপরূপা উপর-নীচ মাথা দুলালো।
খোদেজার বক্ষঃ কেঁপে উঠলো। চট করে শেহজাদের দিকে তাকালেন উনি। শেহজাদ শান্ত। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে
শেরহামের দৃষ্টিজোড়া হতে বিস্ময় গলে পড়ছে। বাকি সবাইও আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে অপরূপার দিকে। শাহানা আর হামিদা ফিসফিস করতেই তটিনী বলল,

‘ আম্মা রূপা এসব কি বলছে?’
শেরহাম এগিয়ে এসে খপ করে অপরূপার হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বলল,
‘ মিথ্যে বলছো? কিসের নিকাহ? কার সাথে? এসব নিকাহ আমি মানিনা। ‘
শেহজাদ এসে তার হাত থেকে রূপাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘ আমার সাথে। ও আজকের পর থেকে তোমার ছোট ভাইয়ের বেগম। দৃষ্টি আর মুখ সংযত করো। নইলে আমাকে শেখাতে হবে। ‘
সকলেই বিস্ময়ে কিম্ভূতকিমাকার। শেরহামের মাথার উপর যেন বাঁজ পড়ার শব্দ হলো। হাতের মুঠো, চোয়াল, চিবুক শক্ত করে ভয়ংকর হয়ে উঠলো সে। অপরূপা শেহজাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
খোদেজা এসে বলল,

‘ পুত্র কি বলছো এসব? ‘
‘ ঠিক বলছি আম্মা। আমি রূপার দায়িত্ব নিয়েছি কালেমা স্বাক্ষী রেখে । এই সম্পর্ক সত্যি। ‘
শেরতাজ সাহেব এগিয়ে এসে বললেন,
‘ শেহজাদ! এতবড় ভুল করতে পারো না তুমি। এই মেয়ে নিষ্পাপ হতে পারে। কিন্তু ও তোমাকে আর তোমার রাজ্যের ধ্বংসকারী অস্ত্র হয়ে এসেছিল।’
তটিনী মুখে ওড়নার আঁচল গুঁজলো। শাহানা বলল,
‘ শান্ত হও কন্যা। খোদাবান তোমার কষ্টের উত্তম প্রতিদান দেবেন মা। ‘
তটিনী চলে গেল দৌড়ে। শাহানা তার পিছুপিছু চলে গেল।
শেরতাজ সাহেবের কথার প্রত্যুত্তরে শেহজাদ বলল,
‘ আমি ঠান্ডা মাথায় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি বড়চাচা। সায়রা রূপাকে অন্দরমহলে নিয়ে যাও। আম্মা আপনিও যান।’
শেরহাম অপরূপার পথ আটকে বলল,
‘ সত্যি কথা বলো। ও তোমাকে জোরাজোরি করে নিকাহ করেছে?’
অপরূপা দৃঢ় কন্ঠে বলল,

‘ নাহ। ‘
শেরহাম বাজখাঁই গলায় বলল,
‘ আবারও প্রশ্ন করছি। সত্যিটা বলো। তুমি আমাকে ভালোবাসতে আর ওকে নিকাহ করতে রাজী হয়ে গেলে? আমার হয়ে আমার পিঠে ছুরি মেরেছ? আমার শত্রুর সাথে হাত মিলিয়েছ? ‘
অপরূপা বলল,
‘ আপনি ছলনা বন্ধ করুন। ‘
শেহজাদ গর্জন করে বলল,
‘ রূপা ভেতরে যেতে বলেছি। সায়রা নিয়ে যাও। ‘
সায়রা একপ্রকার টেনে নিয়ে গেল অপরূপাকে। শেহজাদ শেরহামের পথ রুদ্ধ করে বলল,

‘ যুদ্ধ আমার সাথে। আর যুদ্ধ নারীঘটিত কোনো ব্যাপার নয় । সুপুরুষ হয়ে থাকলে আমার সাথে জিতে দেখাও। রূপার দিকে হাত বাড়ালে আমি এবার হাত কাটতে দু’বার ভাববো না।’
‘ শেরহাম ধাক্কা দিয়ে ওর কলার চেপে ধরে বলে,
‘ আমার সবকিছুর উপর তোর নজর। ভিখিরিনীর ছেলের নীচু নজর তো হবেই।
দেহরক্ষীরা এসে শেরহামের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। টেনে ধরে সরিয়ে নেয়।
শেহজাদ কলার ঝেড়ে বলে,

‘ তোমার এসব ফালতু কথায় আমার কিছু যায় আসে না। তোমার সবকিছুতে নয় বরং আমার সবকিছুতেই তোমার নজর ছিল। তোমার মতো মানুষকে রূপা ঘেন্না করে। তুমি দিনদিন নিকৃষ্ট জীবে পরিণত হয়েছ। প্রতিহিংসা তোমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। তুমি আমার কিচ্ছু করতে পারবে না। কিচ্ছু না। ‘
শেরহাম সারা মহল কাঁপিয়ে বিকটশব্দে গর্জে বলল,
‘ এবার করব। তোর ধ্বংস না দেখা অব্দি আমি শান্ত হবো না। তুই আর তোর রূপা দুটোকেই মারব আমি। ‘
শেহজাদ গটগট পায়ে হেঁটে ভেতরে চলে গেল। যেতেই অন্দরমহলে মহিলা আসরের কক্ষে কেদারায় বসা খোদেজা তাকে বলল,

‘ তুমি স্বেচ্ছায় ধ্বংস ডেকে এনেছ নিজের। তুমি একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ। আর ও জাদুকর। মায়ের মতো হিংস্র, ভয়ংকর, নিষ্ঠুর ও । তুমি জানতে এই মেয়েকে নিকাহ করলে সে আগুন হয়ে যাবে তারপরও তুমি তাকে দেখানোর জন্য নিকাহ করে নিয়ে এলে। এটা খুব দরকার ছিল পুত্র? ছেলে মানুষী হয়ে গেল না? ‘
শেহজাদ নিজ অবস্থানে অটল থেকে বলল,
‘ আমি কাউকে দেখানোর জন্য নিকাহ করিনি আম্মা। আর কাউকে ভয়ও পাইনা। আপনি এসব বলে তাকে সুযোগ করে দেবেন না। মনে রাখবেন রূপা এখন আশ্রিতা নয় আপনার পুত্রবধূ। যদি আমাকে পুত্র মনে করেন। ‘
খোদেজা আহতকন্ঠে ডাকলেন,

‘ শেহজাদ! ‘
‘ সত্যিটা বলেছি আম্মা। পুত্রবধূ কন্যাসম। আমি আশা করছি আপনি রূপার প্রতি নিজের ক্ষোভ রাখবেন না। তাকে চেনার চেষ্টা করুন। ‘
‘ যেন তুমি তাকে অনেক চিনে ফেলেছ? ‘
‘ মানুষ চিনতে অনেক বছর সময় লাগেনা আম্মা। ‘
‘ তার ক্ষমতা আছে তোমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করার? ‘

‘ আল্লাহ ছাড়া কেউ কাউকে রক্ষা করতে পারেনা। আমরা উছিলা মাত্র। রূপা আমার উছিলা-য়। আমি তা অস্বীকার করতে পারব না। আপনি জানেন গত একমাস সে কোথায় ছিল? আপনার কোনো ধারণা আছে ও মহল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর কাদের হাতে পড়েছিল? সন্ন্যাসী রূপী জাদুকরের কাছে একটামাস কাটিয়ে আসা আপনার কাছে ছেলেখেলা মনে হয়? আপনি ভাবতে পারছেন কি দূর্বিষহ কষ্টের মধ্যে তার দিন কেটেছে? একজন মা হয়ে কন্যাসম একটা মেয়ের কষ্ট কি আপনি অনুভব করতে পারেন আম্মা? আপনি আমার জন্মদাত্রী না হয়েও মা হয়ে উঠেছেন। তেমনি ভাবে রুপারও মা হয়ে উঠুন। আমি নিজেই আপনাকে নিশ্চিত করছি ও আপনার বিরুদ্ধে কখনো কথা বলবে না। আমি ক্লান্ত। বিশ্রাম নিতে যাচ্ছি। ‘

শেহজাদ তার কক্ষে চলে গেল।
কক্ষে গিয়ে অপরূপাকে দেখলো না। রূপাকে কি এই কক্ষে নিয়ে আসা হয়নি? সে পুনরায় আসরে ফিরে গিয়ে সায়রাকে বলল,
‘ রূপা কোথায়? ‘
সায়রা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে খোদেজার দিকে তাকালো। খোদেজা বলল,
‘ সে আমার পুত্রবধূ। তাই তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে যোগ্য করে নেয়া অব্দি আমি তাকে তোমার কক্ষে যাওয়ার অনুমতি দেব না। তুমি আমাদের মাঝে এসো না। আমি সবকিছু বরদাস্ত করব না। ‘
শেহজাদ রুক্ষস্বরে বলল,

‘ আপনার যা ইচ্ছে তাই করুন। কিন্তু অবিচার করবেন না। আপনি যদি অবিচার করেন তার প্রতি তাহলে শেরহাম সুলতান আরও বেশি প্রশয় পাবেন। আশা করছি আপনি আমাকে হতাশ করবেন না। আমি নগর পরিদর্শনে বের হবো। সায়রা রূপার প্রতি যত্নশীল হবে। সোহিনী, শবনম আর আয়শাকে বলছি তোমরা রূপাকে সঙ্গ দেবে। তটিনী তুমি ওর প্রতি কোনো প্রকার দ্বেষ পুষে রাখবে না। ফুপু আপনিও না। ছোটমা আপনি ওকে শিখিয়ে পড়িয়ে দেবেন। আসি। ‘
তটিনী, শাহানা সকলেই মুখ গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে রইলো। খোদেজা হেঁটে গেল মতিবানুদের কক্ষে। শেহজাদ এসেছে ভেবে অপরূপা দরজার কাছে ছুটে এসে দরজা খুলে দিতেই খোদেজাকে দেখে চোখ নত করলো। খোদেজা তার মুখের উপর একটা শাড়ি ছুঁড়ে কুপিতস্বরে বলল,

‘ এসব রাণীর পোশাক ছাড়ো। পোশাক পড়লেই রাণী সাজা যায় না। নিজেকে প্রমাণ করো। তার আগে শেহজাদের সাক্ষাৎ পাবেনা তুমি। প্রমাণ করো তুমি তার কতটা ভালো চাও। কতটা আপন ভাবো তাকে। তার সরলতা, কোমলতা আর অন্ধ ভালোবাসাকে পুঁজি করে তুমি ওর ক্ষতি করবেনা তার নিশ্চয়তা কি? এত সহজ নয় বেগমে শেহজাদী হওয়া। সহজে তার ভালোবাসা পেয়ে গিয়েছ বলে এমনটা ভেবোনা তার পাশে দাঁড়ানোর যোগ্যতাও তোমার হয়ে গেছে। যদি কোনোদিন যোগ্য হয়ে ওঠো সেদিনই আমি তোমাকে মুকুট পড়িয়ে দেব। তার আগে ভাবা বন্ধ করো তুমি এই সম্রাটের বেগম। ‘

প্রিয় বেগম পর্ব ৩২

অপরূপা শাড়িটা নিয়ে কান্না গিলে দাঁড়িয়ে রইলো শূন্য চোখে। তার চোখে কান্না না দেখে খোদেজা বিভ্রান্ত হলো। অদ্ভুত! স্বামীর কাছ থেকে দূরে রাখার পরও তার চোখে জল নেই? এই মেয়ের জন্য সম্রাট এতটা উতলা?

প্রিয় বেগম পর্ব ৩৪