প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ২৩+২৪
পুষ্পিতা প্রিমা
সকালের নাশতা সেড়ে সদরকক্ষে বসে নানান শলাপরামর্শ, খোশগল্প করার পর ফজল সাহেব তাড়া দিলেন কাশিফ আর নাদিরকে। তিনি রওনা দিতে চান। তাঈফকে বলেছেন, সোহিনী তাঈফকে এক্ষুণি যেতে দিতে ইচ্ছুক নয় তাই সে যাচ্ছে না। আর কিছুদিন পর যাবে। নাদির তার ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়েছে। আপাতত তার মামুর সাথে ফেরা দরকার। কাশিফ বসে বসে তার ব্যাগপত্র গোছগাছ করা দেখে বলল,
” লায়লিকে কি বলবি? ”
নাদির চোখ গরম করে তাকালো। দাঁত চেপে বলল,
” মাথা খারাপ করবি না। ”
কাশিফ পা দিয়ে ব্যাগটা বিছানা থেকে লাথি দিয়ে ফেলে দিল। নাদির “চ” কারান্ত শব্দ করে বলল,
” মাথা খারাপ তোর? ”
কাশিফ বলল,
” আরেহ তুই বাড়ি যাচ্ছিস নিকাহ করতে? ”
” বাড়ি যাচ্ছি এটুকু জানি। আপাকে দেখা দিতে হবে। মামুও শান্ত হবে। ”
” তাহলে শবনম?”
নাদির থেমে তার দিকে চোখ তুলে তাকালো। ফের ব্যাগে কাপড় ভরতে ভরতে বলল,
” শবনম কি? এখনো ভাবছিনা। আপাতত বাড়ি যাই। ”
কাশিফ রেগে গিয়ে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” যেভাবে ওর জন্য পাত্র দেখছে…
নাদির সাথে সাথে বলল, ” দেখুক না। আমার চাইতে ভালো কাউকে পেলে..
কাশিফ বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল,
” তুই একটা পল্টিবাজ শালা। আমি মামাকে সত্যিটা বলে দেব। ”
নাদির ব্যাগটা রেখে বলল,
” মহল থেকে বেরিয়ে যা ইচ্ছে বলিস। এখন কাউকে কিছু বলবি না। আমি কোনো ঝামেলা চাই না। ”
কাশিফ বলল,
” একশোবার বলব। ”
নাদির তার কলার চেপে ধরে বলল,
” মাথা গরম করবি না। আমি শবনমকে কথা দিইনি। আমার ঘর বাড়ি করা নেই। হুট করে নিকাহ করব কোন আক্কেলে? আমার অনেক সময় লাগবে। শবনম যদি সময় দিতে পারে তবে..
” তাহলে ওকে অন্তত ব্যাপারটা খুলে বল। ও মনে করবে তুই আগের বারের মতো না করেছিস। ”
নাদির তার বন্দুকটা দেয়ালের পাশ থেকে তুলে নিয়ে বলল,
” ওরকম মনে করবে না। ”
কাশিফ বলল,
” নিকাহ করার পর ঘরবাড়ি করবি। সমস্যা কোথায়? ”
” সমস্যা অনেক জায়গায়। তুই আমাকে আর কোনো প্রশ্ন করবি না। ”
কাশিফ বলল,
” আমি মামাকে বলবোই। ”
নাদির তার দিকে রাগত চোখে ফিরে তাকালো। কাশিফ কক্ষ থেকে বের হওয়ার পূর্বেই ফজল সাহেব উপস্থিত। জানতে চাইলেন,
” কি বলতে চাইছো? ”
কাশিফ নাদিরের দিকে তাকালো। নাদির বলল,
” কিছু না। কখন বেরোবো সেটা জানার জন্য..
কাশিফ বলল, ” মামা আপনাকে একটা কথা বলার ছিল। ”
নাদির ডাক দিয়ে বলল, ” কাশিফ!”
কাশিফ হড়বড়িয়ে বলল, ” ও তোমাদের ঠিক মেয়েকে নিকাহ করতে পারবে না। ”
ফজল সাহেব কপাল কুঞ্চন করলেন। বললেন,
” তো কাকে করবে? ”
নাদির কাশিফকে থামানোর উপয়ান্তর না দেখে অন্যদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল।
” সেই মেয়েকে নিকাহ করবে যার সাথে কিছুবছর পূর্বে নিকাহ হওয়ার কথা ছিল। ”
ফজল সাহেব ভুরু কুঁচকালেন হিসেব মিলাতে। নাদিরের দিকে সরু চোখে চেয়ে থাকতে থাকতে আমচকা কুঞ্চিত কপালটা মসৃণ হয়ে এল কাঙ্খিত বার্তাটি পেয়ে যাওয়ায়। উনার মুখাবয়বের রঙবদল স্পষ্ট জানান দিচ্ছে, সেই মেয়েটি কে হতে পারে তা উনি বুঝে গিয়েছেন। খুশি নাকি বিরক্ত হলো তা বুঝা গেল না। গম্ভীর স্বরে বললেন,
” ও কি সত্যি বলছে? ”
নাদির চোখা দৃষ্টিতে তাকালো। কাশিফ বলল,
” ও আর কি বলবে মামা? ও তো পালাতে পারলেই বাঁচে। আমি যতটুকু দেখেছি দুজনেই তখন রাজী ছিল না, কিন্তু এখন দুজনের মত আছে। শবনমেরও। ”
ফজল সাহেব বললেন,
” তুই এটা আমাকে আগে বললি না কেন? নাকি ওই মেয়েটার কাছ থেকেও পালাতে পারলেই বেঁচে যাস। ”
কাশিফ বলল, ” দেখো মামা। ও যতটুকু শবনমের মুখ চেয়ে হ্যা বলেছে, বাইরে গেলে দেখবে না বলতে দুমিনিট লাগবে না। ”
ফজল সাহেব নাদিরের দিকে চেয়ে রইলেন। তার নিরুত্তর ভাবভঙ্গিতে উনি উনার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন। কিছু বুঝে উঠার আগেই মেয়েলী কন্ঠস্বর ডেকে উঠলো দরজার বাইরে থেকে।
” আসতে পারি? ”
সকলেই ঘাড় ফিরাতেই শবনমকে দেখতে পেল। ফজল সাহেবকে দেখে সে মৃদু হাসলো। বলল,
” জনাব মেহমাদের জিনিসগুলি ফেরত দিতে এসেছি। ”
সে দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলো। ফজল সাহেব হেসে বললেন,
” ভেতরে এসো না। যার জিনিস তাকে দিয়ে দাও।”
শবনম আবারও অনুমতি নিল। ” আসব? ”
কাশিফ বলল, ” হ্যা এসো। ”
শবনম গুটিগুটি পায়ে কক্ষে প্রবেশ করলো। নাদির তার দিকে তাকালো না আর। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। শবনম বলল,
” আপনার পোশাক। ”
নাদির অন্যদিকে মুখ করে রাখা অবস্থায় পোশাকগুলো নিল। শবনম তার চিরুনি বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
” আপনার চিরুনি। ”
নাদির চিরুনি নিয়ে ব্যাগে ভরতে লাগলো। শবনম বলল,
” আপনার গামছাটা। দুঃখীত অক্ষত দিতে পারিনি, কোণায় ছিঁড়ে গেছে খানিকটা। ”
নাদির তার দিকে এবারও না ফিরে গামছাটা নিয়ে ছোট করে বলল,
” সমস্যা নেই। ”
শবনম কারো দিকে না তাকিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। ভেবেছিল নাদির তার দিকে একবার অন্তত তাকাবে, সে কি চাইছে তা তার চোখ দেখে সে বুঝে নেবে। কিন্তু সব শেষ। কি সুন্দর সব গোছগাছ করে চলে যাচ্ছেন উনি। এমন নির্দয় মানুষের প্রতি কেন তাকে আকৃষ্ট হতে হলো? কক্ষে প্রবেশ করামাত্রই দরজা বন্ধ করে মুখ চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। তার তক্ষুণি তটিনীর গলা শুনতে পেল। সে শবনমকে ডাকছে। বড়আপু কেন ডাকছে এখন? তৎক্ষনাৎ বুকভর্তি কান্না গিলে সে চোখ মুছে কন্ঠ পরিষ্কার করে কক্ষ থেকে বের হয়ে জবাব দিল।
” জ্বি আমি এখানে। ”
তটিনী বলল,
” তাড়াতাড়ি কক্ষে এসো। কথা আছে। ”
শবনম নিজেকে স্বাভাবিক করে তটিনীর কক্ষের দিকে পা বাড়ালো। উঁকি দিয়ে দেখলো, ভাইজান আছে কিনা। যখন দেখলো তটিনী একা তখন কক্ষে প্রবেশ করামাত্রই বলল,
” কেন ডেকেছেন? ”
তটিনী বিছানায় চাদর বিছিয়ে দিতে দিতে বলল,
” তোমার ভাইজান জিজ্ঞেস করছিলো, নাদির মেহমাদকে নিকাহ করতে তোমার আপত্তি আছে এখনো? ”
শবনমের চোখজোড়া ফের ছলছল করে উঠলো। তটিনী দেখার আগেই চোখের জল আড়াল করে শক্ত কন্ঠে বলল,
” হ্যা। ”
” কিসের আপত্তি? ”
তৎক্ষনাৎ ওর দিকে ফিরে তাকালো তটিনী। অবাক চোখে চেয়ে বলল,
” তোমার বিপদের দিন যে তোমার পাশে থেকে তোমাকে রক্ষা করেছে তাকে নিকাহ করতে কিসের আপত্তি? এর চাইতে ভালো ছেলে কোথায় পাবে তুমি? একি, তোমার চোখমুখ অমন কেন? কেঁদেছ? ”
শবনম দ্রুত মাথা নাড়তে নাড়তে বলল,
” কই নাতো। দরকার পড়লে ইমরানকে নিকাহ করব কিন্তু উনাকে নয়। ”
তটিনী হা করে চেয়ে থাকলো। শবনম বেরিয়ে গেল বলামাত্র। এটা শুধুমাত্র রাগের কথা হতে পারে না।
তখনি শেরহাম শবনমকে চোখ মুছতে মুছতে কক্ষ থেকে বের হতে দেখলো। সে কক্ষে আসামাত্রই জানতে চাইলো,
” কি বলেছে? ”
তটিনী এগিয়ে এসে বলল, ” জানো কি বললো? বললো, ইমরানকে নিকাহ করবে তাও নাদির মেহমাদকে নিকাহ করবে না। ”
শেরহাম চোখ সরু করে তটিনীর দিকে চেয়ে রইলো। তটিনী বলল,
” কি ভাবছো? ”
শেরহাম তার মাথায় চাটি মেরে বলল,
” ধুরর মাথামোটা। ওটা কেন বলেছে বুঝলি না? তুই তো এমনিতে সব জান্তা। সেটা কেন বললো বুঝতে পারিসনি? মাথামোটা, গর্দভ। সর। ”
বলেই চাদরটা কেদারায় রেখে বের হতে যাচ্ছিলো। কি মনে করে পেছনে ফিরতেই দেখলো তটিনী টলমলে চোখে চেয়ে আছে। শেরহাম হেসে বলল,
” এটাতেও ব্যাথা পেয়ে গেছিস? কাল যে আমাকে কামড়ালি? ”
তটিনী মাথার পাশে হাত চেপে ধরে ফুঁপিয়ে বলল,
” কাল থেকে আমার এমনিতেই মাথাটা ব্যাথা করছে। তারউপর চড় মেরেছ। ”
শেরহাম এগিয়ে আসতেই তটিনী ঝাড়ি দিয়ে বলল
” একদম ছুঁবিনা আমাকে। ”
শেরহাম হো হো করে হেসে উঠে বেশি করে ছুঁলো। কোমর জড়িয়ে ধরে কাছে টানতেই তটিনী ধস্তাধস্তি করতে করতে বলল,
” মেরে আবার ঢং করছে। ছাড়। ”
শেরহাম চোয়াল শক্ত করে কর্কশ গলায় ধমকে উঠে বলল,
” লাত্থি দিয়ে বের করব এখন মহল থেকে। ”
তটিনী থেমে গেল। ধস্তাধস্তি থামিয়ে দিয়ে অবাক চোখে চেয়ে রইলো শেরহামের দিকে।
” মহল থেকে বের করে দেবে? ”
শেরহাম উত্তর দিল।
” হ্যা। ”
তটিনী নিজেকে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
” আমি এই ঢংয়ের মহলকে লাত্থি দিয়ে চলে যাব। তুই বের করার কে? আমার কতবড় বাড়ি আছে জয়পুরে। আজই চলে যাব। ”
বকবক করে গটমট পায়ে হেঁটে বেরিয়ে যাওয়ার সময় শেরহাম তাকে টেনে এনে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে দুগালে এলোপাতাড়ি চুমু দিয়ে বলল,
” লাথালাথি পরে হবে। আগে চা নিয়ে আয়। মাথা ধরে আছে, যাহ। ”
তটিনী তার দিকে চেয়ে রইলো। কি প্রতিক্রিয়া দেবে সে ভুলে বসেছে। রাগে চোখের কোণায় এসে জমে থাকা জল শেরহাম মুছে দিয়ে গালে আঙুল বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
” কামড়াবি? ”
তটিনী দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ” হ্যা। ”
শেরহাম তার কোমর টেনে গাল এগিয়ে দিয়ে বলল,
” দে। ”
তটিনী মনে মনে হেসে উঠলো। শেরহাম ভুরু কুঁচকে চেয়ে ইশারা করলো কামড় দিতে। তটিনী গাল ছেড়ে তার পুরু ওষ্ঠাধরে লক্ষ্য স্থির করতেই শেরহাম তার ভিন্ন উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বলল,
” শয়তানি। ”
তটিনী মৃদু হেসে তার গলা জড়িয়ে ধরতেই, শেরহাম কোমর টেনে তাকে আরও নিকটে এনে গাঢ় ওষ্ঠপুট চুম্বনে লিপ্ত হলো।
পিঠে ব্যাগ চাপিয়ে হাতে শিকারি বন্দুকটা নিয়ে সদরকক্ষে চলে এল নাদির আর কাশিফ। শেহজাদ তাদের বেরোনোর খবর পেয়ে তড়িঘড়ি করে ছুটে এসে নাদিরের হাতে হাত মিলিয়ে বলল,
” আর কয়েকটা দিন থেকে গেলে ভালো হতো না? ডাক্তার বাবু আপনি কিন্তু এটা উনাদের সাথে অন্যায় করছেন। ”
ফজল সাহেব কাষ্ঠ হাসলেন। সাফায়াত এসে হাতে হাত মিলালো। বলল,
” শবনমের নিকাহ কিন্তু সামনে। দাওয়াত পৌঁছে যাওয়ামাত্র আপনাদের উপস্থিতি চাই। ”
নাদির কিঞ্চিৎ হেসে বলল, ” হ্যা চেষ্টা করব। ”
সাফায়াত কথাটা নেহাতই মেহমানদারির খাতিরে বললেও নাদিরের অভিব্যক্তিটুকুও তার চাওয়ার ছিল। তখন শুধুমাত্র তার চরিত্র এবং তার পেশা সম্পর্কে জেনে তাদের বোনকে তার হাতে তুলে দেয়ার কথা ভাবলেও আজ পরিস্থিতি সেই জায়গায় নেই। অন্তত আব্বা এই প্রস্তাব কিছুতেই মানবেন না। বালুচরি দ্বীপে শবনমের হারিয়ে যাওয়া, সেখানে কাকতালীয়ভাবে সেই মানুষের আশ্রয়ে সুরক্ষিত থাকা, যার সাথে তার ভাগ্য জুড়ে দেয়ার কথা ছিল, এ নিশ্চয়ই খোদাতায়ালার কোনো ইশারা! কিন্তু এই ছেলেটা কি এখনো আগের মতোই সংসার বিদ্বেষী হয়ে আছে? নাকি শবনমের জন্য তার মনে এতটুকু হলেও কিছু আছে, যা সাফায়াত জানতে চায়। আর যদি সে উত্তর হ্যা পায়, তাহলে শবনমের মতামত নেয়ারও প্রয়োজন মনে করবে না। আর আব্বাকে সে তার সর্বোচ্চ দিয়ে বোঝাবে যে একা একটা মেয়েকে বালুচরি দ্বীপে যে সুরক্ষিত রেখেছে সে নিশ্চয়ই কালেমা পড়ে নিকাহ করা বেগমকে আরও বেশি যত্নে রাখবে!
” ঠিক আছে। আমি কিন্তু মাথায় রাখব একথা। যাচ্ছেন তো নিকাহ করতে, বেগমকেও সাথে করে নিয়ে আসবেন। সুলতান মহলে উনার ভালো লাগবে। ”
নাদির অপ্রসন্ন হেসে ফজল সাহেবকে বললেন,
” মামু আমি গাড়িতে রাখছি ব্যাগগুলো। তুমি এসো। ”
সোলেমান মাহমুদ এলেন তখন। শেরতাজ সাহেব আর শাহজাহান সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিল নাদির। সোলেমান মাহমুদের মুখোমুখি হতেই তিনি বললেন,
” তোমাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আমার মেয়েকে সুরক্ষিত রাখার জন্য তোমাকে কি বলে ধন্যবাদ দেব জানিনা। তবে তোমাকে আর তোমার বন্ধুকে আমি কিছু দিতে চাই। ”
শেহজাদ আর সাফায়াত কৌতূহলী চোখে তাকালো। কি দিতে চাচ্ছেন উনি? নাদির চুপ করে রইলো। সোলেমান সাহেব কক্ষে গেলেন আর দ্রুত ফিরে এলেন। পেছন পেছন শেরহামও এল। সে চেয়ে রইলো সোলেমান সাহেবের দিকে। সোলেমান সাহেব দুটো কাগজের ভাঁজ বের করলেন। একটা নাদিরের হাতে আর অন্যটা কাশিফের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন,
” জানিনা কৃতজ্ঞতা সরূপ আর কি দেয়া যায়। তবে এটুকু গ্রহণ করো।”
শেহজাদ সাফায়াতের দিকে তাকিয়ে ইশারায় কিছু বলতেই সাফায়াত বলে উঠলো,
” আব্বা আপনি…
নাদির ততক্ষণে কাশিফের হাত থেকে টাকার বান্ডিলটা নিয়ে তারটাসহ সোলেমান সাহেবের হাতে তুলে দিল। বলল,
” মাফ করবেন। আপনার মেয়ের জায়গায় অন্য মেয়ে হলেও একই কাজটা করতাম। এই কাজ করে আমার পেট চলে না। আমি রোজগার করি আর তা দিয়ে খাই দায় ফূর্তি করি। আপনার কৃতজ্ঞতার প্রতি সম্মান জানাচ্ছি। আসি। ”
সাফায়াত তার পথ রুদ্ধ করে বলল,
” নাদির আপনি আব্বার কাজে রাগ করবেন না। ”
নাদির যেতে যেতে বলল,
” না রাগ করার কিছু নেই। ”
সোলেমান মাহমুদ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। শেহজাদ কপালে হাত চেপে শেরহামের দিকে চোখ রাখতেই শেরহাম সোলেমান সাহেবের কাজে বিরক্তিসরূপ কপাল কুঞ্চিত করে বেজার মুখে তটিনীর দিকে ফিরে বিড়বিড় করলো, ” টাকার গরম!”
তটিনী দ্বিতল চত্বরে দাঁড়িয়েছিল। তার পাশে অপরূপা, সায়রা, শাহানা, হামিদা। সবার পেছনে শবনম। আব্বার কাজে সে নিজেও লজ্জিত হলো। আব্বা এটা কি করলো? সবাইকে টাকা দিয়ে সন্তুষ্ট করা যায়না। নিদারুণ মনোবেদনায় সে কপাল চাপড়ালো। সব শেষ!
ফজল সাহেব সোলেমান মাহমুদের হাত ধরে বললেন, ” ওর কথায় মনে কষ্ট নেবেন না। ”
সোলেমান মাহমুদ চুপ করে রইলেন। ছেলেটা খুব ত্যাড়া। অথচ দেখলে মনে হয় ভদ্র। ফজল সাহেব উপায়ান্তর না পেয়ে বেরিয়ে গেলেন। পেছন পেছন শেরহাম আর শেহজাদ বেরিয়ে এল। কথাবার্তা বলতে বলতে শেরহাম উনাদের সাথে গাড়িতে উঠলো। শেহজাদকে বলল,
” তুইও চল। উনাদের ঘাটে দিয়ে আসি। ”
” জ্বি। ”
নাদির গাড়িতে উঠে বসলো। তার মেজাজ বিগড়ে আছে এখনো। শেহজাদ বলল,
” সাফায়াত, চলো উনাদের দিয়ে আসি ঘাট অব্ধি।”
” জ্বি আসছি। ”
সবাই মিলে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে বসলো। শবনম গাড়ি ছেড়ে দেয়ার আগমুহূর্তে দোতলার বারান্দায় ছুটে এসে দাঁড়িয়েছিল। কাতর চোখে তাকিয়েছিল। নাদির গাড়িতে উঠে বসামাত্র সেদিকে চোখ রাখতেই শবনমকে দেখলো। তার বিগড়ানো মেজাজ ধীরেধীরে শান্ত হয়ে এল শবনমকে দেখে। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, তার জন্য সে শবনমকে কিছুতেই কষ্ট পেতে দেবে না। গাড়িতে করে ঘাটের কাছে যেতে হেসেমেতে অনেক গল্পগুজব হলো সবার মধ্যে। শবনমের নিকাহ’র প্রসঙ্গ উঠায় কথার একফাঁকে শেরহাম নাদিরের উদ্দেশ্য বলল,
” আচ্ছা, কিছুবছর পূর্বের প্রস্তাবটা যদি আবার পাও, তাহলে কি ফিরিয়ে দেবে? মানে শবনমের সাথে নিকাহের প্রস্তাবটা? ”
নাদির তার প্রশ্নটা শুনে থতমত খেল। অপ্রস্তুত হয়ে গেল। শেহজাদ আর সাফায়াত প্রশ্নটা বুঝতে সময় নিলেও যখন বুঝে গেল তখন নাদিরের দিকে চেয়ে রইলো উত্তরের অপেক্ষায়। তাদের চোখজোড়া অত্যধিক কৌতূহলী। ফজল সাহেব হেসে উঠে বললেন,
” প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে পারে, কিন্তু শবনমকে নয়।”
বলেই উনি হেসে উঠলেন। নাদির বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেল। শেরহাম বলল,
” শবনম এবার রাজী, যদি তোমার কোনো অমত না থাকে তাহলে আমরা কথাবার্তা এগোতে পারি। তোমার অমতই বা থাকবে কেন? ওকে যা চেনার বাকি ছিল তাও তো চিনে নিয়েছ। তাহলে আর কোনো দ্বিধা? ”
বলেই শেহজাদ আর সাফায়াতের দিকে চাইলো। শেহজাদ ডাকলো, ” নাদির সাহেব? ”
কাশিফ হো হো করে হেসে উঠে তার পিঠে চড় বসিয়ে বলল, ” ও রাজী রাজী। আমাকে বলেছে। ”
নাদির দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ” কখন বললাম?”
সাফায়াত বলল, ” শবনম কি কোনোদিকে দিয়ে অযোগ্য? ”
নাদির বলল, ” না না, শবনম নয়, অযোগ্য যদি কেউ হয় সেটা আমি। ”
শেহজাদ বলল, ” ইমরানের চাইতেও অযোগ্য? ”
নাদির উত্তর দিতে পারলো না। শেরহাম বলল,
” আর কোনো কথা নয়। তোমার বোনকে নিয়ে চলে এসো। পাকা কথা বলবো। ”
সাফায়াত বলল, ” আপনি যদি কাজে বাইরে বাইরে থাকেন, তাহলে শবনম মহলে থাকবে সবার সাথে। আপনি যখন ছুটি পাবেন তখন আপনার আপার কাছে নিয়ে গিয়ে রাখবেন ওকে। আপাততঃ আমাদের কাছে আপনার চাইতে বিশ্বস্ত, ভরসাযোগ্য কোনো হাত নেই যার হাতে আমরা আমাদের বোনকে তুলে দিতে পারি। আমি আর ভাইজান গত পরশুও একথাটা বলছিলাম।
ঘাটের কাছাকাছি গাড়ি এসে পৌঁছুতেই শেরহাম নাদিরকে বলে উঠলো, ” আচ্ছা বেশ একথায় রইলো। আর কোনো কথা নয়। সাফায়াত মহলের সবাইকে বলে দেবে। এত সমস্যার কিছু দেখছিনা আমি। ”
ফজল সাহেব খুশি হয়ে বললেন, ” আমার বুকের উপর হতে পাথর সরে গেল। আপনাদের না বলে শান্তি পাচ্ছিলাম না। ও কি কথা দেবে? আমি কথা দিচ্ছি আমার ভাগ্নে বউকে আমি মাথায় তুলে রাখবো। ”
শেহজাদ আর সাফায়াত হেসে উঠলো। শেরহাম বলল,
” মাথায় তোলাটা ঝুঁকিরও বটে। ”
সকলেই তার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলো।
নাদির চলে গেল সেদিন। সাফায়াত মহলে এসে চুপিসারে শাহানাকে জানালো প্রথমে। শাহানা বলল,” হায় আল্লাহ! এমনিতেই ছেলেটার উপর রেগে আছেন উনি। তারউপর এটা শুনলে কি বলবে? ঘরবাড়ি করেছে ওই ছেলে? ওর মামার সাথে তো কথা কাটাকাটি হয়েছিল নিকাহ করবে না বলে। ”
” আপনি এতকিছু না ভেবে এটা ভাবুন যে, শবনম নিজেও এটা চায়। তনী আমাকে বলেছে। জিজ্ঞেস করুন তনীকে। তারউপর ছেলে ভালো। চোখবন্ধ করে ভরসা করতে পারেন আম্মা। এই ছেলেটাই কিন্তু আপনার মেয়েকে সুরক্ষিত অবস্থায় তুলে দিয়েছে আপনার হাতে। তার হাতেই মেয়ে তুলে দেবেন। আগেপরে ঘরবাড়ি করে নেবে সে। আপনি আব্বাকে রাজী করান। ”
শাহানা ছেলের কথা শুনলে গলে গেল। সোলেমান মাহমুদের কাছে ইনিয়েবিনিয়ে কথাটা পাড়তেই তিনি রেগে আগুন। শবনম ওসব আর কানে নেয়নি। সে ভেবেছে বাবা তখনকার ঘটনাটির জন্য চিৎকার চেঁচামেচি করছেন। সে কক্ষ থেকেই বের হয়নি। সোলেমান মাহমুদ চিৎকার চেঁচামেচি করে সারামহল মাথায় তুললেন। কিছুতেই ওই ছেলের সাথে তার সহজসরল মেয়েকে তুলে দেবেন না। শাহানা বলল, ” আপনি তো একটা গুন্ডার হাতে তুলে দিচ্ছিলেন। শেরহামকে জিজ্ঞেস করুন, ইমরানের মতো কোনো খারাপ কাজের আশেপাশেও নেই ছেলেটা। আসলেই ভালো ছেলেটা। পয়সাও ভালো কামাই।”
সোলেমান সাহেব আড়চোখে শেরহামকে দেখলেন। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, ” যে যেরকম তার পছন্দও তো সেরকমই হবে। ঘাড়ত্যাড়া বেয়াদব। ”
বলেই উনি হনহনিয়ে চলে গেলেন। এই প্রসঙ্গ নিয়ে প্রায় সপ্তাহখানেক যুদ্ধ চললো মহলের অভ্যন্তরে।
সোলেমান মাহমুদ মত দিলেন না, আবারও পীড়াপীড়িও করলেন না। মৌন থাকলেন।
শবনমকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সবটা জানতে চাচ্ছিলো সায়রা, সোহিনী। শবনম ওদের হাত থেকে কিছুতেই নিস্তার পাচ্ছেনা। চাদরের কথাটা বলতেই সায়রা আর সোহিনী হেসে লুটোপুটি। হাসতে হাসতে বলল, ” বাহবা এতদূর! আগে বলিসনি কেন?”
শবনম বলল, ” দেখ তোদের বলেছি বলে লজ্জা দিতে থাকবি এ কেমন কথা?তুই আগে তো ডাক্তার সাহেবকে সহ্যও করতে পারতিনা। এখন তো চোখে হারাস। ”
সোহিনী বলল, ” তোকে বলেছি আমি চোখে হারাই? ”
” চোখে হারাস বলেই তো যেতে দিসনি। ”
সায়রা তার সাথে তাল মিলিয়ে বলল, ” ও কিন্তু মিথ্যে বলেনি। ”
সোহিনী বলল, ” মাগোমা তোকে যে সাফায়াত ভাইজান বানু বানু বলে ডাকে তখন,,
সায়রা জিভে কামড় দিল। ঠাস করে চড় মেরে বলল, ” উনার বোনদের সামনে এসব কি বলছিস?”
শবনম আর আয়শা মিটিমিটি হাসলো। তটিনী কক্ষে প্রবেশ করতেই সকলেই চুপ হয়ে গেল। বলল,
” শবনম আজকে নাকি উনারা আসছেন। বিকেলে। তুমি কোন শাড়িটা পড়বে, ঠিক করো?”
সায়রা বলল, ” আচ্ছা আমরা আছি তো আপু। ঠিক করে দেব। ”
” ঠিক আছে। রূপাকে বলেছি শাড়ি দেখাতে। ও নিয়ে আসবে। ”
তটিনী বেরিয়ে গেল। সে বেরিয়ে যেতেই শাড়ি নিয়ে রূপা এল। বলল,
” এত হাসাহাসি কিসের ভাই? ”
সোহিনী বলল, ” আরেহ এসো এসো। শবনমের কান্ড দেখো..
শবনমকে ইচ্ছেমতো পঁচালো সবাই মিলে। সোনালী রঙের একটা শাড়ি বাছাই করে তার মাথার উপর জড়িয়ে দিয়ে রূপা বলল,
” দেখো তো, কেমন লাগছে। ”
সায়রা শবনমের গাল টিপে দিয়ে বলল,
” তোকে যা লাগবে না এটা পড়লে। ক্যাপ্টেন সাহেব আপনি কোথায়য়য়য়?”
শবনম তার পিঠে দুম করে কিল বসিয়ে দিল। সকলেই হেসে উঠলো সশব্দে।
নাদিরের অভিভাবক হিসেবে নাদিরের বোন নাদিয়া আর তাঈফের পরিবার এসেছে। শবনমকে দেখে নাদিয়া ভীষণ খুশি। শবনমকে শাড়ি পড়া আগাগোড়া দেখে মুখ ছুঁয়ে বলল,
” মাশাল্লাহ! জানো, ওকে জিজ্ঞেস করলাম মেয়েটা কেমন দেখতে? কি বললো জানো? বললো, মেয়েরা যেমন হয়, তেমন। বোঝো কান্ড?”
শবনম মৃদু হাসলো। নাদিয়া তার থুঁতনি ছুঁয়ে বলল,
” খুব মিষ্টি! আমার ভাইয়ের পাশে খাপে খাপ। তোমাকে দেখে আমার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। মা বলতো, ওর বউ ঘরে এলে দেখবি তোদের বাড়িটা আর একা একা পড়ে থাকবে না। আমাদের ঘরবাড়ি কিন্তু সব আছে। মেরামত করতে হবে ঠিক কিন্তু তোমার থাকার জায়গার অভাব হবে না। তোমাদের মতো বড় মহল না থাকলেও কুটিবাড়ি কিন্তু আছে । তুমি তো মানুষ ছোট, ওটাতে হবে না? ”
শবনম সলজ্জ হেসে বলল, ” জ্বি, আর কে কে এসেছে?”
তার ছটফটানি বুঝে নাদিয়া হেসে বলল,
” ও এসেছে। কিন্তু মহলে আসেনি। কাশিফকে নিয়ে বাইরে বাইরে ঘুরছে। বাঁদরটাকে কিন্তু তোমাকেই ঘরবন্দী করতে হবে। ”
অপরূপা এসে বলল, ” আপু ভাইয়া এখনো এল না যে। খাবার সাজিয়ে ফেলেছি টেবিলে। ”
অনুপমাও এসেছেন সবার সাথে । উনি বললেন
” নাদু আংটিটা পড়িয়ে দাও আগে। ”
অপরূপা বলল, ” ওটা ভাইয়া নিজে পড়ালে ভালো লাগবে। ”
সকলেই হেসে উঠলো। নাদিয়া বলল, ” ওটা এমনিতেও ওর কাছেই আছে। ”
আলিজা এসে শবনমকে দেখামাত্র বলল, ” চবনমফুপ্পী বোউ?”
অপরূপা বলল, ” হ্যা হ্যা। ”
” আলিচাও বোউ। ”
অনুপমা তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে চুমু দিতে দিতে বলল,
” আমার আপু। ছোট আপু। আপু বউ হবে?”
আলিজা হাসতে লাগলো। অপরূপা বলল, ” মা, কে উনি? ”
আলিজা বলল, ” নান্নুমুনি। ”
বলেই ফিক করে হেসে দিল। অপরূপা তার গাল টেনে দিয়ে বলল, ” সব জানেন উনি। ”
নাদিরকে এক ধাক্কায় সদরকক্ষে ঢুকিয়ে দিয়ে সগর্বে হাসলো কাশিফ। শবনমকে বলল,
” ভাবিমণি শাদী মোবারক। ”
শবনম হেসে নাদিরের দিকে চোখ তুলতেই নাদির হাত দ্বারা ঘাড় মালিশ করতে করতে নাদিয়ার পাশে এসে দাঁড়ালো পেছনে হাত ভাঁজ করে । তার গায়ে একটা কালো ভারী পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা। নাদিয়া বলল,
” আংটিটা পড়া ওকে। ”
প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ২১+২২
নাদির পকেট থেকে আংটিটা বের করলো। সায়রা, তটিনী শবনমের পেছনে দাঁড়িয়েছে। নাদিয়া দুজনকে মুখোমুখি এনে দাঁড় করালো। বলল,
” নে পড়া। ”
শবনম হাত তুললো। নাদির আংটিটা পড়িয়ে দেয়ার সময় শবনম জানতে চাইলো,
” আপনার হাতের ক্ষত শুকিয়েছে?”
নাদির আংটিটা পড়ানোর সময় তার একটা আঙুল জোরে চেপে ধরে উত্তর দিল, ” একটুখানি। ”
অতঃপর বিয়ের ধুমধাম শুরু হলো সুলতান মহলে।