প্রেমঘোর পর্ব ১৫
নার্গিস সুলতানা রিপা
এদিকে সাদাদের কলিগরা আসতে শুরু করেছে…..
তাই নৌশিনের ফ্রেন্ডরা সাদাদ আর নৌশিনের কাছ থেকে সরে অন্য দিকে চলে যায়….সবাই আড্ড-মাস্তি-খাওয়া দাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে…..
সাদাদ ওর এক এক করে ওর সব কলিগদের সাথে নৌশিনের পরিচয় করিয়ে দেয়….
সাদাদের ফ্রেন্ডরা কেউ এখনো আসে নি…..আর সাদাদের বসও এখনো এসে পৌঁছায় নি….
কলিগদের তাড়া থাকায় সবাই খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়ে তাড়াতাড়ি ই সাদাদ আর নৌশিনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়…..
এইসবের মাঝখানে একটু দূরের দুটো চোখ নিরবে শুধু নৌশিনকে দেখে যাচ্ছে…না ঠিক নৌশিনকে না-নৌশিনের হাঁসোজ্জল মুখটা দেখে যাচ্ছে…….
হুম আর কারও নয় চোখ দুটো নৌশিনের জন্মদাত্রী মা…মেয়ের সুখে মাতোয়ারা হয়ে পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মেয়ের দিকে…কারও সাথে কোনো কথা বলছে না এখন তিনি শুধু মেয়ের হাঁসিমাখা মুখ টাই দেখছে…সব মা ই এটা চায়….নৌশিনের বাবা ডেকে গেছে অনেকবার কিন্তু যান নি নৌশিনের মা…এমন একটা জায়গায় বসেছেন যেখান থেকে মেয়ের মুখটা স্পষ্ট বোজা যায়……
সাদাদের বস চলে আসে…নৌশিনের হাতে উপহার দেয়…নৌশিনকে প্যাকেট টা খুলতে বলে…
প্যাকেট খুলে ই নৌশিন একটা গহনার বক্স পায়…সাদাদের মুখের দিকে তাঁকিয়ে চোখ দিয়ে সাদাদের কাছে জানতে চায় খুলবে কি না বাক্স টা…
“আরে সাদাদের অনুমতি নিতে হবে না…খুলে ফেলো তুমি…”(বস)
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
…বাক্স টা খুলে নৌশিন পুরো হা…একটা খুব দামী হিরার নেকলেস….নৌশিন একরকম অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাঁকিয়ে রইলো..কারণ সাধারণত অফিসের কর্মচারী সে যতই উচ্চ পদস্থ হোক না কেন-কোনো বস এমন উপহার দেন না…বাট সাদাদকে দেখে মনে হচ্ছে না ও একটুও অবাক হয়েছে,সেটা দেখে নৌশিন যেন আরও একটু বেশিই অবাক হলো….কারণ এই চার বছরে সাদাদকে নৌশিন যতটা চিনেছে তাতে সাদাদের এতো দামী গিফ্টে খুশি হওয়ার কথা না…এক বার নৌশিন ভালবাসা দিবসে সাদাদকে একটা দামী হীরার রিং দিয়েছিলো তাই রাগারাগী করেছিলো……”এতো দামী রিং এর কি মানে আছে নৌশিন??”(সাদাদ)
“আরে..তুমি তো আমাকে কত কিছুই দাও..আমি তো সে হিসেবে কোনো কিছুই দেই না…আজকে দিলাম একটু সমস্যা কোথায় তাতে??”(নৌশিন)
“দিতে পারে বাট এতো দামী জিনিসের কোনো মানে নেয়…”
“ওহ…সাদাদ…প্লিজ শান্ত হও…আমি তোমার জন্য নরমাল উপহার কিনতেই বের হয়েছিলাম…বাট আমি তোমাকে অনেক বার ঘরি দিয়েছি তাই আজকে রিং টা দিলাম…”
“তো..??তাই বলে ডায়মন্ড…নৌশিন এটা ঠিক করো নি তুমি….”
“আচ্ছা…আমি যখন এনেই পড়েছি তো সেটা কি ফেরত দিয়ে দিবে তুমি?”
“গোল্ড হলেও কথা ছিলো…আর আমি ই এখন অবদি তোমায় এতো দামী কিছু দিই নি…”
“গোল্ড কি করে দিবো…ইসলামে ছেলেদের গোল্ড পড়ার অনুমতি নাই…আগে যদি জানতামম তুমি এতোটা রেগে যাবে তাহলে রূপার রিং আনতাম তোমার জন্য”
“অনেক খুশি হতাম..বাট এটাতে একদম হয় নি”
“প্লিজ ফিরিয়ে দিও না…দেখো তুমি তো বিয়েতে কত দামী দামী গহনা দিবে আমায়…আমি তো আর দিবো না কিছু তোমায়…তোমরা ছেলেরা তো খুব বেশি হলে একটা দুটো রিং ই পরো আর তো কিছু না…আমি যখন এনেই পড়েছি প্লিজ নাও না…ধরো আমি তোমাকে আমার ভাবী স্বামীরূপে আজ স্বীকৃতি দিয়ে দিলাম..”
“কি???”
“কেন??মানবে না আমায় বউ হিসেবে???”(চোখে বিনা কারণেই যেন নৌশিনের পানি এসে গিয়েছিলো)
…সাদাদ নৌশিনের চোখে পানি দেখে ওকে জড়িয়ে ধরেছিলো নিজের বুকে খুব শক্ত করে….
“এই মেয়ে…কাঁদবি না একদম….মানবো না তোকে বউ হিসেবে-কি বলছিস এটা আমি তো তোকে অনেক আগে থেকেই নিজের বউ বলেই মানি…তুই শুধু আমার…”
“তাহলে নাও এটা…”
….সাদাদ নৌশিনকে ছেড়ে দেয়…
“ওকে…”
…নৌশিন সাদাদের হাতে রিং টা পড়িয়ে দিতে যায়…সাদাদ বলে ওঠে”দাঁড়া”….পকেটে হাত দেয় সাদাদ কি একটা বের করে বসে পড়ে মাটিতে….খুলা একটা মাঠে ছিলো দুজনে সেদিন……সন্ধ্যার আবছা আলোয় দুজনে দুজনকে দেখছিলো…সাদাদকে এভাবে নিচে বসতে দেখে নৌশিন অবাক হয়ে গিয়েছিলো…সাদাদ নিজের মুখটা উঁচু করে নৌশিনকে দেখছিলো…হঠাৎ নৌশিনের মুখের দিক থেকে নজর সরিয়ে-নৌশিনের পায়ে হাত দেয়….নৌশিন এক লাফে সরে দাঁড়ায়”এই কি করছো???পাগল হয়ে গেলপ নাকি??পায়ে কেন হাত দিচ্ছো….?”
সাদাদ কোনো কথা না বলে বসা অবস্থাতেই নৌশিনের কাছে যায় আবার…পায়ে হাত লাগায়…নৌশিন সরে যেতে চাইলে সাদাদ বাঁধা দেয়…নৌশিন চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে….পায়ে সাদাদের ছোঁয়া পায় আর সাথে শীতল একটা কিসের ভর অনুভব করলো…..চোখ খুলে পায়ের দিকে তাঁকিয়ে নৌশিন পুরো হা…..এতো সুন্দর একটা পায়েলে…..নৌশিন নুপুর পড়ে না বাট এক পায়ে পায়েল পড়তে ওর বেস লাগে…তাই সাদাদ এনেছিলো সে দিন….”এই তোকে স্কীকৃতি দিলাম আমার বউ হিসেবে…রিং পড়িয়ে নয়…পায়েল পড়িয়ে আমার করে নিলাম…”….নৌশিন খুশিতে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলো-সুখ যেন কান্নায় পরিণত হয়ে গিয়েছিলো মেয়েটার…তাই সাদাদ ওঠে আবার জড়িয়ে ধরে নৌশিনকে..নৌশিনের সুখ কান্না এতে আরও বেড়ে যায়…”কি রে…কেঁদেই যাবি??পড়াবি না আমায়…?কি আনছিস তো দেখলাম পড়িয়ে দে..”
…নৌশিন চোখ মুছে মুখে হাঁসি নিয়ে সাদাদের হাতে রিং টা পড়িয়ে দেয়…..
দু বছর পার হয়ে গেছে সে সে দিনটা থেকে…আজ বিয়ের পরও নৌশিনের পায়ে সেই পায়েল টাই আছে…আর সাদাদের হাতে নৌশিনের দেওয়া রিং টা…সাদাদ কখনো রিং পড়ে না বাট নৌশিনের উপহার হওয়ায় খুলে নি আর…..
….যে সাদাদ নৌশিনের দামী উপহারে রাগ করতো তার বউকে তার বস এতো দামী উপহার দেওয়াতে কিছুই মনে করলো না…নৌশিন অবাক দৃষ্টিতে সাদাদের দিকে তাঁকিয়ে…
“কি রে মা?কি ভাবছিস???দিতে পারি না ছেলের বউকে একটু??…নৌশিন যেন আরও অবাক হলো…কি বলছে লোকটা…
…সাদাদ চোখের ইসারায় নৌশিনকে পড়তে বলে নেকলেসটা..এতে নৌশিন আরও অবাক হয়…সাদাদ আবার ইশারা করায় নৌশিন নেকলেস টা পড়ে নেয়…সাদাদ নৌশিন আবার ইশারা করে সালাম করতে বলে…নৌশিন তাই করলো…পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো সাদাদের বসকে….
লোকটা নৌশিনের মুখে হাত দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠলো….নৌশিনের কিছুই ডুকছে না মাথায়….একটা লোক তার অফিসের একটা কর্মকতা আর তার বৌ এর সাথে এতটা অমায়িক কি করে হতে পারে…যদিও সাদাদ ওনার চেয়ে বড় লোকের ছেলে তবুও সাদাদ তো ওনার অধীনস্ত……এইসব ভাবতে থাকে নৌশিন…কোনো উত্তর খুঁজে পাওয়ার আগেই লোকটা সাদাদ আর নৌশিনকে একসাথে নিজের বুকে নিয়ে হাওমাও করে কাঁদতে থাকে….নৌশিনেরও চোখে পানি এসে যায় লোকটার এমন কান্নায়….পুরো পরিবেশ যেন মুহুর্তেই নীরব হয়ে যায় মানুষটার এমন আহাজারিতে……”বাবা বলে ডাকবি আমায়??একবার ডাকবি?”(নৌশিনকে লোকটা বললো)
..নৌশিন নিশ্চুপ থাকায় লোকটা আবার বলে ওঠে”একবার শুধু একবার ডাক…”
…নৌশিন কিছু বলার আগেই সাদাদ বলে ওঠে”ও…এখন ছেলের বউ পেয়ে আমাকে ভুলে যাওয়া তাই তো…আমার একার ডাকে হয় না তোমার?”
…নৌশিন তো পুরোই থ…সাদাদ ওর বসকে বাবা বলে ডাকে!!!(মনে মনে)
….”বল মা…একবার ডাক বাবা বলে..”
….নৌশিন আর সহ্য করতে পারছে না লোকটার এমন আর্তনাদ…কেন লোকটা এমন করছে কিছু জানে না ও…কিন্তু এক মুহুর্তে লোকটার কান্না যেন নৌশিনের হৃদয় ছেদ করে দিলো….তাই নৌশিন আর কোনো কিছু না ভেবেই লোকটাকে বাবা বলে ডেকে ফেলে….লোকটা আবার সাদাদ আর নৌশিনকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলো….এ যেন সারা জীবনের জমে থাকা কষ্টের আহাজারি….লোকটা ওদের বুকে নিয়ে-উপরের দিকে
তাঁকিয়ে”দেখো…তোমরা চলে গেছো…এই যে আমার নতুন ছেলে আর ছেলের বউ….”…..উপস্থিত সবাই যেন হতবাক…..লোকটা ডুকড়ে কাঁদতে থাকে…”বাবা আর কাঁদবে না প্লিজ…এবার কিন্তু আমার খারাপ লাগবে…তুমি বউ দেখবে বলে তাড়াতাড়ি বিয়ে করলাম আর তুমি এমন করছো.?”(সাদাদ)
…সাদাদ বসের চোখটা মুছিয়ে দেয়..”এই ওয়েটার এই দিকে মিষ্টি দাও…”(সাদাদ)
“তোমার তো মিষ্টি খাওয়ার খুব ইচ্ছে তাই না???ডায়বেটিসের জন্য খাও না… আজ আমি নিজে খাইয়ে দিবো….”(সাদাদ)….ওয়েটার মিষ্টি নিয়ে এলো…যে সাদাদ ভাত টা পর্যন্ত চামচ দিয়ে খায় সে সাদাদকে আজ চামচ ছাড়া মিষ্টি খাইয়ে দিতে দেখলো নৌশিন…মনের অজান্তেই নৌশিনের চোখের পানির বেগটা আরও বেড়ে গেলো….লোকটাও চামচ ছাড়াই একটা মিষ্টি প্রথমে নৌশিনকে পড়ে সেটাই আবার সাদাদকে খাইয়ে দেয়….অবাক করা আরও একটা বিষয় হলো নৌশিন কোনো দিন মিষ্টি খায় না…মিষ্টি মুখে দিলেই ওর বমি হয়…আর আজ নৌশিন কোনো কথা ছাড়াই লোকটার হাত থেকে অর্ধেক মিষ্টি অনায়াসেই খেয়ে নিলো….
“বাবা…..আর কোনো দিন এভাবে কাঁদতে দেখলে ঠিক হবে না কিন্তু”(সাদাদ)
“আরে কি শুরু করলি তুই??আমাদের ছেলের বিয়ে আর তুই কান্না শুরু করলি!!চল খাই দাই ফর্তি করি…”(সাদাদের বাবা)
…..”ওহ…সিউর সিউর চল…ছেলে মেয়েরা কি একাই সব মজা করবে নাকি😃😃আমাদেরও মজার বয়স আছে-জোর আছে….দেখুক ছেলে-মেয়েরা আমরাও পারি….”
(বস)
“তোমার তো ডিল আছে আজ একটা একটু পরে…”(সাদাদ)
প্রেমঘোর পর্ব ১৪
“আরে…পরশু দিন ডেট দিয়ে দিছি…তুই গিয়ে করে নিস…পারবো না আমি…আজকে আনন্দ করি একটু”(বস)
…সাদাদের বাবা আর বস ওদের কাছ থেকে চলে এসে আনন্দ উল্লাসে মেতো উঠে…এক সময় নৌশিনের বাবাকেও জোড় করে এনে সামিল করে নেয় সাদাদের বাবা…ওদের খুশি যেন আর ধরে না…..
…প্রায় ঘন্টা খানেক হলো…নৌশিনের হঠাৎ করেই গলার দাগ টার কথা মনে পড়ে যায়….
সাদাদকে কথাটা বলবে…..
তখনি!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!