প্রেমতৃষা পর্ব ১১

প্রেমতৃষা পর্ব ১১
ইশরাত জাহান জেরিন

ঝর্ণাটা ছেড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে তৃষা। আজ এতটা অসহায় লেগেছিল। বাবা সবসময় বলতেন, ‘এমন ভাবে চলবে যেন গায়ে একটা পিঁপড়াও বসতে না পারে।’ পিঁপড়াটা আজ বসেই গেল। তৃষার অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল তবুও বলতে পারেনি। ওই প্রেম নেওয়াজ আসলেই একটা জঘন্য একটা মানুষ। সম্মান, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা কোনোটাই তার মধ্যে নেই। ওই রকম মানুষরা কেবল ছোট করেই দেখতে পারে। তাদের কাছে মেয়ে মানুষ মানেই তাদের শরীরটা সব। মন, অস্তিত্বের দরকার নেই। মোটেও দরকার নেই।

তৃষা গোসল সেরে বের হতেই পাশের রুম থেকে শিমলার মায়ের কটুকথা শুনতে পেল। বিনে পয়সায় এখানে খাচ্ছে, থাকছে, কবে যাবে কিছু ঠিক করে না বললে তো সব বাড়ির মানুষই এমন রিয়াকশন দেখাবে। তৃষা ব্যাগ থেকে পার্সটা বের করল। হাতে টাকা-পয়সা নেই। যা ছিল তাও ফুরিয়ে আসছে। তাকে কিছু তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে। কাজ খুঁজতে হবে। শিমলাকে সে এই বিষয়ে বলে রেখেছে। টিউশন হলেও চলবে। শিমলা খোঁজ রাখবে বলেছে। এই শিমলা মেয়েটার সঙ্গে প্রথম পরিচয় গত বছরের শুরুর দিকে ফেসবুকে। তৃষার ফেসবুকে উপন্যাস পড়া হয়। পছন্দের একটা লেখিকার মেসেঞ্জার গ্রুপে এড হলো সে একদিন। সেই গ্রুপ থেকেই শিমলার সঙ্গে পরিচয়। পরিচয়হীন একটা মানুষের সঙ্গে যে এত ভালো সম্পর্ক হয়ে যাবে কখনো ভাবতে পারেনি তৃষা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তৃষা শিমলাকে নিজের পছন্দ অপছন্দ সব ধরনের কথাই বলত। পালানোর বিষয়টা নিয়ে যখন বলেছিল তখন সেই বলল এখানে আসতে। মেয়েটা কত্ত ভালো। তৃষা পুরনো আইডিটা নষ্ট করে ফেলেছে। সিমটাও ফেলে দিয়েছে। এখানে এসে সব কেনা নতুন করে। নতুন একটা আইডিও তো খুলেছে। হোয়াটসঅ্যাপটা লগইন করে সেদিন চিত্রার নাম্বারটা সেইভ করেছিল। ফোনটা হাতে নিতেই দেখল চিত্রার দু’টো কল এসেছে। তৃষা বিপদে পড়লে কিংবা সিদ্ধান্ত নিতে গেলে যখন দ্বিধায় পড়ে তখন যেই মানুষটির কাছে নিঃসঙ্কোচে সাহায্য, পরামর্শ চাইতে পারে সে হচ্ছে ফারাজ এলাহীর ভালোবাসার রমণী। ফারাজ এলাহীর নামটা নেওয়ার কারণ আছে, কারণ যতবার চিত্রাকে স্মরণ করবে ততবার ফারাজের চিন্তা আপনাআপনি চলে আসবে। ফারাজের সঙ্গে কখনোই তেমন ভাবে ফোনে কথা হয়নি। আসলে হবে কেমন করে? বউপাগল একটা লোক। অন্য কারো সঙ্গে কথা বলার সময় আছে?

তবে চিত্রা স্বামীর জয়গান, প্রশংসা করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। সেই বর্ননা, সেই বুলি শুনলে যুবতী কেন বুড়ো একটা মহিলাও আফসোস করে বলবে, ‘আমার একটা ফারাজ এলাহী চাই।’ ফোন দিয়েছিল দুই ঘণ্টা আগে। এখন ব্যাক করা কী ঠিক হবে? ভাবতে না ভাবতে দিয়েই ফেলল। প্রথম কলটা তুলল না চিত্রা। পরের বারেরটা তুলতেই, ওপাশ থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসল, ‘আরে রোমান্সের সময় কোন ছোটলোক ডির্স্টাব করে? এত চুলকানি কেন?’ কথাগুলো যিনি বলেছেন তিনি ফারাজ এলাহী। আর যাকে বলেছেন সে অসময়ে বিরক্ত করা তৃষা। যদিও কে কলটা করেছে দেখেও নি হয়তো। বিরক্ত মনে হয়েছে তাই চিত্রার থেকে ফোনটা কেড়ে বলে দিয়েছে। চিত্রা কিছু বলতে গিয়েও পারল না। ফারাজ ফোনটা কেটে দিলো মুখের ওপর। তৃষার বুঝতে বাকি রইল না, যে-সে একটু নয় বরং পুরোই অসময়ে জরুরী কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। কিন্তু এখন বেলা কয়টা বাজে ইতালিতে?

এই ফারাজ নামক লোকটার কী সব সময় এমন জরুরী কাজ থাকে নাকি? যেদিন তৃষা নিজ থেকে কল দেয় সেই দিনই এমন হয়। সেদিন পুরোটা রাত কেবল এপাশ-ওপাশ ফিরে তৃষা। ঘুমাতে পারে না। এতটা কষ্ট লাগে। প্রত্যুষকে কল করেছিল ব্যাক করেনি। লাইনেও এলো না আজকে। থাক তাকে বিরক্ত করে লাভ নেই। তার তো অনেক কাজ। তৃষার মতো বেকার নাকি? তবে যতবার রাতে ভাবল, তার হাতে তো টাকা নেই, বাসায় ফেরার উপায় নেই। বাড়িতে ফিরলে যুবরাজ তুলে নিয়ে গিয়ে হলেও তাকে বিয়ে করবেই। ওই লোককে বিয়ে করা সম্ভব নয়। বয়সে কত তফাৎ তাদের। আর পছন্দ অপছন্দেও। যতই ক্ষমতা হোক, মানুষ তার জন্য পাগল থাকুক না কেন, এমপি হোক না কেন তৃষা ওই রাজনীতিকে চরম ভাবে ঘৃণা করে।

ভালো মানুষও রাজনীতি, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে খারাপ পথ বেছে নেয়। ওই পথ কাউকে ভালো থাকতে দেয় না। অসুরে বদলে ফেলে। তবে ভার্সিটির সেই ঘটনার কথা যখন যখন মনে পড়ল তৃষার তখন চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। প্রেম নেওয়াজ খারাপ মানুষ সে জানত, কিন্তু এতটা জঘন্য তা জানত না। ভালো হলে তো ছেলে দু’টো তার সামনে কথাই বলতে পারত না। দিত ধরে কেলানি। এত শরীর ফিট রেখে, বডি করে লাভ কী যদি একটা ছেলে একটা মেয়েকে নোংরা কথা বলে তার প্রতিবাদ না করে উল্টো তালে তাল মেলানো? তৃষা পাশ ফিরল। চোখের জল গিলে বলল, ‘তৃষা তুই তো দূর্বল না? জানোয়ারকে জানোয়ারই ভাববি। মানুষ ভাবার দরকার নেই। আর প্রেমের থেকে এর চেয়ে বেশি কি বা আশা করিস তুই?’

সকালবেলা পুরান ঢাকার অলিগলি ভেদ করে হেঁটে গেলে দূরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকটা চোখে পড়ে। চারিদিকে গাছপালা। বিজ্ঞান অনুষদের চারপাশে কতগুলো কৃষ্ণচূড়া ফুল। কি সুন্দর দেখতে যে লাগে। আজকে সকাল থেকে প্রেম নেওয়াজকে দেখতে পাইনি সে। ভালোই হয়েছে। ওই লোককে দেখলে ঘৃণায় শরীর জ্বলবে। ক্লাস শেষে বের হতেই শিমলার ফোনে একটা কল এলো। সে রিসিভ করে কথা বলে তৃষাকে জানালো, ‘ জানিস তোর জন্য একটা গুড নিউজ আর আমার জন্য একটা বেড নিউজ আছে। কোনটা শুনবি আগে?’
‘দুটোই একসঙ্গে বল।’
‘তোর জন্য চাকরি পেয়েছি। একটা ছাত্রী পড়াতে হবে।’
‘আহামরি খুশির কিছু নয়। একটা ছাত্রী পড়ালে কতই বা বেতন পাওয়া যাবে? থাকা-খাওয়া, চলাফেরার খচর উঠে যাবে।’
‘আরে যাবে যাবে।’
‘কিভাবে?’

‘যেই মেয়েকে পড়াতে হবে সে এক নাম্বারের গবেট শুনলাম। মেয়ে মানুষ তো? তার মা আবার মহিলা টিচার চায়। তাও এমন মহিলা টিচার যে তাদের বাড়িতেই থাকতে পারবে আর ২৪ ঘন্টা টাইট দিয়ে মেয়েটাকে সোজা করতে পারবে বদ থেকে। তার মানে তুই সেখানে থাকতে পারবি, খেতে পারবি, মাস শেষে ভালো মাইনেও আছে। এছাড়া তোর দরকারি জিনিসপত্রের খরচ তো তারা দিবেই।’

তৃষার মন খুশিতে ছলছল করে উঠে। তবে এত সুযোগ সুবিধা কী এখনকার যুগে কেউ কাউকে দেয়? একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না? শিমলার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে তৃষা শান্ত চত্বরের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখল সেখানে প্রেমের বাইকটা দাঁড় করানো। সেখানে কেবল যে প্রেমের বাইকটা রাখা সেটা বললেও ভুল হবে। কারণ সেখানে অংকুর,সহ আরো অনেকগুলো ছেলে ছিল। প্রেমকে সবাই ঘিরে রেখেছে। প্রথম দেখায় যে কারো লাগতে পারে কোনো মানুষ মরে গেছে আর সবাই তাকে দেখার জন্য ভিড় করেছে। তৃষা গানের শব্দ পেয়ে দুইপা এগিয়ে যেতেই দেখল ভিড়ের মধ্যে একটা ছেলে বসে আছে। দুইপাশের মানুষ তার দিকেই হা করে তাকিয়ে আছে মনোযোগ সহকারে।

সে এগিয়ে গিয়ে ভালো করে তাকালো সেই ছেলেটির দিকে। ডান হাতে কালো ব্রিডেড ব্রেসলাইট পড়া। গলায় কালো মতো একটা লকেট। মনে তো হচ্ছে কালো একটা কাইটনের সঙ্গে গিটারের মতো দেখতে একটা লকেট লাগানো। ছেলেটির পরনে একা চ্যাক শার্ট। ঝাঁকড়া চুল গুলো পড়ে আছে চোখের সামনে। শার্টের সঙ্গে রোদ চশমাটা ঝুলানো। তৃষা কাছে আসতেই সেই ছেলেটির তীক্ষ্ণ চাহুনি তার দৃষ্টির সঙ্গে মিলিত হয়। ছেলেটি গিটারটা কোলে নিয়ে টুংটাং শব্দ তুলে তৃষার চোখের দিকে চেয়ে গান ধরল,

~আমি তোমাকে আরো কাছে থেকে
তুমি আমাকে আরো কাছে থেকে
আমি তোমাকে আরো কাছে থেকে
তুমি আমাকে আরো কাছে থেকে
যদি জানতে চাও, তবে
ভালোবাসা দাও ভালোবাসা নাও
ভালোবাসা দাও ভালোবাসা নাও~

হঠাৎ আকাশ ভেদ করে বৃষ্টি নামে। শিমলা তাড়া দেয় তৃষাকে যাওয়ার জন্য। তবে তৃষা একই ভাবে চেয়ে থাকে প্রেম নেওয়াজের দিকে। মানুষজন জায়গা ছেড়ে কোথাও নড়ছে না। প্রেম নেওয়াজের এই বৃষ্টি ভেজা গানের আসর ছেড়ে কোথাও যাওয়া যায় নাকি? শিমলা আর তৃষার সামনে গিয়ে দুটো মেয়ে যাচ্ছিল। তাদের মধ্যকার একজন শিমলাকে বলে, ‘আরে খবর পেয়েছো?’
‘কী?’

‘ওই ছাত্রলীগ নেতা আর তার চামচা এখন হাসপাতালে ভর্তি। আল্লাহ জানে কাল তো ভালো ছিল। কে এমন ভাবে পশুর ন্যায় পেটাতে পারে? জানো কিছু?’
শিমলা মাথা দু’পাশে নাড়াল। সে জানে না কিছু। তবে মেয়ে দু’টো চলে যেতেই একবার প্রেমের দিকে তাকালো। তারপর তৃষাকে হিসহিস করে বলল, ‘কিরে আমার তো মনে হচ্ছে প্রেম ভাই মেরেছে। তুই কিছু জানিস নাকি?’
তৃষার দৃষ্টি এবার আরো গভীর ভাবে মিলল প্রেমের দৃষ্টির সঙ্গে। দু’জনের দৃষ্টি একে ওপরের দিকে। তবুও কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে না। তৃষা প্রেমের দিকে তাকিয়ে শেষবার মনে মনে সুধিয়ে উঠল, ‘আপনি যে ওই ছেলে দু’টোকে কুত্তার মতো উদম কেলিয়েছেন তা বুঝতে তৃষার নেনো সেকেন্ডও খরচা করতে হয়নি। আহা প্রেম ভাই আপনার এতগুলো রূপ নিয়ে চলাফেরা করতে বুঝি একটু কষ্ট হয় না?’

তৃষার ব্যাগ গোছাতে গোছাতে সন্ধ্যা হয়। এখন মনটা ফুরফুরে লাগছে। লাগার কারণ আছে। ওইযে প্রেম নেওয়াজ যে কেলানি দিয়েছিল। শালার ঘরের শালার জন্য কত লিটার চোখের পানি অপচয় হয়ে গেল রে! এসব কত কষ্ট করে বাঁচিয়ে রেখেছিল সে। প্রত্যুষের সঙ্গে যেদিন তার বিয়ে হবে সেদিন একটু কান্না করতে হবে না? না কাঁদলে বিয়ের ফিলিংস আসে নাকি?কিন্তু এত দামি মেক-আপটা যদি খাল্লাস হয়ে যায়? শিমলা ওই বাড়ির ঠিকানা তৃষাকে দিয়েছে। জিনজিরায় বাড়িটা। নামটা এত খেয়াল করেনি। আগে তো ওই এলাকায় গিয়ে পৌঁছাতে হবে। যাওয়ার সময় শিমলা এমন ভাবে কাঁদছিল যেন তৃষা মরে-টরে গেছে। আর কখনো দেখা হবে না। আর ওর মাকে দেখো। সে তো কত ঢং করে বলল, ‘এখানে থেকে গেলেই পারতে মা।’ ইশ কী ঢং। অথচ পাশের রুমে তৃষা এখনো যায় না কেন তা নিয়ে কাহিনী করেছে। ছ্যাহ!

বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে শিমলাকে আবার কল দেয়। ভুল কোনো ঠিকানা দিলো না তো? শিমলা নিশ্চিত হয়ে জানালো তার দেওয়া ঠিকানায় কোনো ভুল নেই। ভুল হতেই পারে না। তৃষা গেটের সামনে তাকিয়ে আরো একবার নামফলকের দিকে দৃষ্টি স্থির করল। বাড়ির নাম নেওয়াজ কুঠির। ওই ঘুরেফিরে নেওয়াজই রাখতে হলো? ধ্যাৎ যেখানে যায় সেখানেই নেওয়াজ চলে আসে। আর ভালো লাগছে না রে। তবে নেওয়াজ তো বাংলাদেশে কত নেওয়াজই আছে। প্রেম নেওয়াজের সঙ্গে এই বাড়ির কোনো সম্পর্কে থাকতে পারে না।

প্রেমতৃষা পর্ব ১০

এটা অন্য কোনো নেওয়াজদের বাড়ি হবে। তৃষা দারোয়ানকে বলে ভেতরে ঢুকতেই দেখল একটা কালো প্রিমিও ভেতর থেকে বের হচ্ছে। প্রথমে দেখতে পায়নি তৃষা। আচমকা গাড়ির সামনে পড়তেই থমকে যায় সে। ড্রাইভিং সিটে বসা ব্যক্তিকে দেখার আগেই সে গ্লাস নামিয়ে আঙ্গুল বের করে ইশারা করে তৃষাকে কাছে আসার জন্য। তৃষা কাছে এসে তাকাতেই থমকে যায়। একই সঙ্গে থমকে যায় সেই মানুষটিও। দু’জনে একসঙ্গে বলে ওঠে, ‘প্রত্যুষ আপনি?’
‘তৃষা তুমি?’

প্রেমতৃষা পর্ব ১২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here