প্রেমতৃষা পর্ব ১৪

প্রেমতৃষা পর্ব ১৪
ইশরাত জাহান জেরিন

প্রেম একটু একটু করে এগিয়ে আসে তৃষার দিকে। তৃষা একটা ঢোক গিলে পেছানোর জন্য প্রস্তুত হতেই এক মুহূর্তে প্রেম তৃষার গলা চেপে ধরে একেবারে নিজের কাছে নিয়ে আসে। প্রেমের উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের পতন তৃষার শরীরে পড়তেই তৃষার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। গলাটা এই লোক এত জোরে চেপে ধরেছে। তৃষা ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই প্রেম তার হাত দু’টো এক করে পেছনের দিকে নিয়ে জোরে করে চেপে ধরে। তৃষা রাগে তখন ফেটে একাকার। মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। প্রেম তা দেখে বোধহয় আনন্দই পাচ্ছে। সে একবার তৃষার ঠোঁটের দিকে তাকায়। একেবারে কাছে এসে নমনীয় কণ্ঠে বলে, ‘এটা জাহান্নাম তৃষা। এখানে তোমায় স্বাগতম।’ বলেই তৃষাকে ছেড়ে দেয় প্রেম। ধাক্কাটা এতই জোরে ছিল যে নিজেকে সামলাতে তৃষার ভালোই কষ্ট হয়। কোনো মতে তৃষা নিজেকে সামলে উঠে দাড়িয়ে বলল, ‘আপনি মানুষ নাকি জানোয়ার? আমার গায়ে হাত দেওয়ার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে? আমি কি এমন সর্বনাশ করেছি আপনার?’

‘আমার বাড়ির মধ্যে অনুমতি ব্যাথিত প্রবেশ নিষিদ্ধ। জবাব দাও কেন এসেছো জুনিয়র এখানে?’
‘আমি কি জানি আপনার এই পাগলখানায় আসা নরমাল মানুষদের জন্য নিষিদ্ধ?’
প্রেম তৃষার দিকে এগিয়ে আসতেই তৃষা দুই কদম পিছিয়ে যায়। প্রেম তা দেখে থেমে গিয়ে বলল, ‘আরেকটা বাজে বকলে থাপড়ে মুখের জিওগ্রাফি বদলে দেব।’
‘বদলাতে আমিও অনেক কিছু জানি।’
‘আমার বাল জানো তুমি।’
‘মুখে লাগাম টানুন প্রেম ভাইয়া।’
‘তোর ভাইয়ার গুষ্টির তুষ্টি।’
‘আমি গেলাম। আর কখনো এই বালের বাড়িতে আসব না। এটা বাড়ি হলো? মনে হচ্ছে ভ্যাম্পায়ের বাড়িতে ভুল করে ঢুকে পড়েছি।’
‘তুমি ওই ভুল করে ঢুকতেই পারবা। বের হওয়ার ক্ষমতা নেই।’
‘যাচ্ছি।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রেম পেছন থেকে তৃষার হাত ধরে পুনরায় তাকে নিজের কাছে টেনে আনে। এবার আর আঘাত নয়। চোখে চোখ রেখে মুখের ওপর এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘নিজের ইচ্ছায় এসেছো যাবে আমার ইচ্ছায়।’
‘আমার লাগছে প্রেম ভাই।’
‘বার বার ভাইয়া বলে হৃদয়ের ক্ষত বাড়িয়ে দিও না সোনা।’
প্রেম তৃষাকে উল্টো ঘুরায়। তৃষার চুলগুলো একবার পেছন থেকে স্পর্শ করে মুখ গুঁজে দেয়। নিমিষেই তার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসে। তৃষার যেন একেবারে সহ্য হচ্ছে না। সে ছ্যাৎ করে উঠল, ‘আপনার ক্ষতের মধ্যে আমি লবণ চিপড়ে দিব।’

‘দেখ সোনা তুমি নিজেকে বেশি সুন্দরী আর সাহসী ভাবছ বোধহয়। প্রেম তোমাকে এখনো ধরেইনি। যেদিন ধরবে সেদিন আর ঘুম ভাঙবে না তোমার। তাই তর্ক আমার সঙ্গে করো না। মুখে মুখে তর্ক আমার একেবারে অপছন্দ। এসব অপছন্দের কাজ করে আমাকে রাগাও কেন বার বার? লুক, কত ভালো করেই তো কথা বলছি?’
‘আপনি ছাড়বেন?’
প্রেম আরো শক্ত করে তৃষাকে চেপে ধরে। ব্যথায় তৃষার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লে প্রেম সেই জল আঙ্গুল দিয়ে মুছে দিয়ে বলল, ‘এখন তো এই বাড়ির চাকর তুমি। টাকা গিলছো, খাচ্ছো। খালি এসব করলেই কি হবে? প্রেম নেওয়াজকেও তো খুশি করতে হবে না?’

‘ছি কী নোংরা আপনি!’
‘এত পবিত্রতা দেখাবে না আমার সামনে। দুনিয়ায় এত পবিত্রতা থাকলে জনসংখ্যা আজ এত বাড়ত না।’
‘আপনার মতো মানুষদের জন্যই দেশের আজ এই অবস্থা।’
‘যেভাবে বলছো আমি মনে হয় আমার বিশ-পঁচিশটা বাচ্চা-কাচ্চা তোমায় ডোনেশন করেছি? তবে তুমি চাইলে একটা আপাতত করে দেখতে পারি। যদিও আমার সঙ্গে বিক্রিয়ায় যাওয়ার মতো ক্ষমতা, যোগ্যতা কোনোটাই তোমার মধ্যে নেই।’

‘আরে ভাই এখন ছাড়ুন তো। এমন চেপে ধরে যে দাগ বানিয়েছেন এখন মলমের খরচা কে দিবে? আপনার নানায়?’
‘না তোর নানা আছে না? ওইটাকে কবর থেকে তুলে এনে খরচার টাকা নিবি। তোর মতো প্রোডাক্টের ওপর তো একমাত্র ডেইট ওভার ফেনসিডিল খাওয়া পাবলিক ছাড়া কেউ ইনভেস্ট করবে না। আর আমার ভেতর এত কুতকুতানি নেই যে তোর পেছনে টাকা ঢালব। সুন্দরী হলে না হয় ভেবে দেখতাম।’

তৃষা মুখ ফুলিয়ে গালি দেয় প্রেমকে মনে মনে। এই লোকের মুখের কী ছিড়ি। একেবারে যেন লাগাম ছাড়া রেসের গরু! প্রেম তৃষাকে ছেড়ে দিতেই তৃষা বলল, ‘আপনি একদমই ভালো না প্রেম ভাই। কথা দিলাম আর কখনো আমায় এদিকটায় দেখবেন না। আপনি আমার ভার্সিটির সিনিয়র কেবল এই টুকুই জানি আমি। এছাড়া আপনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আপনাদের বাড়ির মেয়েকে পড়াই, এখানে থাকার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই টুকুই আমার পরিচয়।’ মুখে এটা বললেও মনে মনে তৃষা বলল, ‘দাঁড়া ব্যাটা শয়তান। আমার সঙ্গে সুযোগ পেয়ে আজ এমন করলি না? তোর ভাইয়ের বউ হয়ে যদি তোর উপর অত্যাচার না করি তবে আমিও তৃষা নুজায়াত না।’
‘আজকে রাতটা আমার ঘরেই থেকে যাও।’

‘মাথা আপনার শেষ। এই মাথা আর দেশের কোনো কাজে লাগবে না।’
‘মাথা কাজে না লাগুক। শরীরটা তো কারো না কারো কাজে লাগবে।’
‘কার?’
‘তোমার।’
‘আপনার শরীর দিয়ে আমি কি করব? নিজের শরীরটাই তো সামলাতে পারি না।’
‘আমারটা অনেক কাজের সোনা। এই শরীরটা দেখতে পাওয়াও কত নারীর স্বপ্ন জানো?
‘রুচি খারাপ হলে যায় হয় আর কী। অনেক প্যাচাল শুনেছি। যেই দাগ আপনি আজ বানালেন না? তা একদিন তিন ডাবল দিয়ে তৃষা উসুল করে ছাড়বে। আমি তৃষা। আমায় যেন-তেন ভাববেন না। আমি ওইসব মেয়ে না যে কেউ উঁচু গলায় কথা বললে চুপ করে থাকব। আমি তৃষা, আমার সঙ্গে গলা উঁচু করে কেউ কথা বললে আমি তার গলার রগটাই টেনে ছিঁড়ে আনি। মাইন্ড ইট।’

প্রেম তাকিয়ে বাঁকা হাসল। তারপর বলল, ‘আই লাইক ইট। গল্পে সাসপেন্স, থ্রিল না হলে নিরামিষ লাগে।’
প্রেম কাছে আসতেই এবার তৃষা দেয় এক দৌড়। তবে তাড়াহুড়োয় থাইগ্লাসটা দেখেনি। একটা বারি খেয়ে ধপাস করে পড়ে যায়। প্রেম তখনো ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে রয়। যেন কিছু হলোই না। তৃষা সামলে উঠে দাঁড়াতেই প্রেম ফ্রিজ থেকে স্ট্রোবেরি বের করে সেটা চকলেটের সঙ্গে মাখিয়ে মুখে দিয়ে বলল, ‘পরের বার এলে পারফিউমটা বদলে আসবে। এটা পারফিউম কম এয়ারফ্রেশবার লাগছে বেশি। তবে শ্যাম্পুর গন্ধটা চলে।’
তৃষা কপালে হাত ঘষতে ঘষতে উঠে দাঁড়ালো। তারপর এক দৌড়ে বাইরে চলে গিয়ে বলল, ‘পরের বার এলে ডাস্টবিনের ময়লা নিয়ে আসব প্রেম ভাই আপনার জন্য।’

‘চিন্তা নেই সোনা। ওই ময়লা তো আমি তোমাকেই খাওয়াব। জলদি এনে ফেলো।”
‘শালা তোর জন্য ড্রেন থেকে শরবত তুলে আনব।’ আপন মনে বকতে বকতে তৃষা চলে গেল। এই তো এত করে বলল, আর জীবনেও বকাবকি, গালাগাল করবে না সে। ওই বিশেষ কথা কী তার মনে আছে? নাকি ব্রেনের সেই বিশেষ অংশটা ডিলিট হয়ে গেছে?

রাত নয়টা বাজে কেবল তখন। উঁচু উঁচু ভবনের ফাঁক গলে সেই আকাশ দেখা যায় টুকরো টুকরো করে, কোথাও অন্ধকার ঘন, কোথাও আবার বিদ্যুতের আলোয় ফিকে। নিয়ন সাইনবোর্ড, রাস্তায় ল্যাম্পপোস্ট আর দোকানের ঝলমলে আলো মিলে আকাশকে কেমন যেন চেপে রেখেছে। তবু মাঝেমাঝে ওপরে তাকালে দেখা যায়, অর্ধচন্দ্রটা ভেসে আছে। আলোটা ঝাপসা, কারণ ধোঁয়া আর ধুলার আবরণে তার দীপ্তি ম্লান হয়ে গেছে। খুব বেশি তারা দেখা যাচ্ছে না, যেগুলো দেখা যাচ্ছে, সেগুলোও কেবল মিটমিটে বিন্দুর মতো। তবে এই আকাশেরও আলাদা একটা আকর্ষণ আছে। এই আকাশ যেন মানুষের ভিড়ের মাঝেও নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। তার গভীর কালো রঙের ভেতর একটা কথা বারংবার ভেসে আসছে, “তুমি যতই হইচই করো, আমি আমার অসীমতাই ধরে রাখবো।” নেওয়াজ বাড়ির দোতলার ঘরে প্রেমা শুয়ে শুয়ে কোরিয়ান ড্রামা দেখছে। হঠাৎ মনে হলো রুমে কিছু একটা ঢুকেছে। ওমা কোরিয়ান নায়ক নাকি? গবলিন? ওর তো ক্ষমতা আছে হুট হাট সব জায়গায় যাওয়ার। প্রেমা নড়েচড়ে বসতেই শব্টা আবার হলো। এবার কেমন কেমন জানি একটা ভয় করছে। সে বারান্দার দিকে যায়। কই কিছু তো নেই। পেছনে ফিরতেই চিৎকার করে ওঠে। তবে শব্দ হওয়ার আগেই কেউ একজন তার মুখ চেপে ধরে। গালে একটা চুমু দিয়ে বলল, ‘আমি তোমার মেহরাব গো।’

অন্ধকার রুমটার দেয়াল জুড়ে ছবি টাঙানো। টেবিলের ওপর কাগজপত্রের অভাব নেই। এখানে ওইসব নারীদের লিস্ট আছে যারা প্রতারক। আচ্ছা তাদের বেঁচে থেকে লাভ কি যারা একজনকে ভালোবেসে অন্যজনের এমন অনায়াসেই হয়ে যায়? লোকটি কালো হুডিটা গা থেকে খুলে ফেলল। মুখের মাস্কটা খুলে টেবিলের ওপর রেখেই এগিয়ে গেল শিকলের সঙ্গে বেঁধে রাখা নারীটির দিকে। নারীটি চুপসে আছে। ভয় আর আতঙ্ক তার ভেতর দানা বেঁধে আছে। লোকটি মেয়েটির সামনে বসেই তার চুল গুলো সুন্দর করে সরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কয় বছরের প্রেম ছিল?’

মেয়েটি চুপ করে রয়। ভয় তার ভেতরকার সব কথা গিলে ফেলেছে। লোকটির এই নিস্তব্ধতা একেবারেই পছন্দ হয়না। সে হাতের ছুরিটা মেয়েটির আঙ্গুল ছুঁইয়ে বলল, ‘প্রশ্ন করলে কেউ যদি উত্তর না দেয় তখন আমার ভীষণ রাগ হয়।’

প্রেমতৃষা পর্ব ১৩

মেয়েটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটি ভেচাং করে তার আঙুলটা কেটে নেয়। ঝর্ণার মতো রক্ত এসে তার মুখে ছিটকে পড়ে। পুরো ঘর কেঁপে উঠে মেয়েটির হাহাকারে, চিৎকারে। লোকটি উঠে দাঁড়ায়। পাশের ঘরে আলাদা একটা লোহার বিরাট খাঁচা আছে। তাতে হিংস্র একটা কুকুর বন্ধী। লোকটির আদরের কুকুর। সে ওই ঘরটায় গিয়ে আঙুলটা কুকুরটিকে দিতেই তা তৃপ্তি করে খেল সে। তা দেখে কেমন জানি শান্তিময় একটা হাসি ফুটে উঠল লোকটির মুখে। সে খাঁচার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে কুকুরটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর বলল, ‘এবার কোন অংশটা খাবে বলোতো?’ বলেই সে আবার গান ধরল, ~প্রেম আমার ওওওও প্রেম আমার।~

প্রেমতৃষা পর্ব ১৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here