প্রেমতৃষা পর্ব ১৯

প্রেমতৃষা পর্ব ১৯
ইশরাত জাহান জেরিন

তৃষাকে খাটের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে প্রেম। কালো রঙের একটা হুডি পড়া সে। তার কালো রঙের ডিভানে শুয়ে শুয়ে ফোনে গেইম খেলছে সে। হঠাৎ তৃষা চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘জানোয়ার আপনি? আমি অনেক সহ্য করেছি। এবার আপনার ধ্বংস দেখব নয়তো আমার নিজের।’
প্রেমের মুহূর্তে রাগ উঠে গেল। হাতের ফোনটা আছাড় মারতেই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ফ্লোরে দিয়ে উঠে এক ঝটকায় তৃষার গলা চেপে ধরে বলল, ‘বান্দির বাচ্চা একটা কথা বলবি না। প্রত্যুষ তোর হাত ধরলে খুব আরাম লাগে? সে শরীর না ধরলে তোর শরীরের জ্বালা মিটে না ফাউল কোথাকার? এই হাত যদি আজকে আমি কেটে কুত্তারে না খাওয়াই তৃষা।’

‘আপনার সমস্যা কী? আপনার এত সমস্যা কিসের আমাকে খুলে বলেন তো।’
‘সমস্যা একটাই আমার বাড়িতে এসব নষ্টামি চলবে না। তুই এখন নেওয়াজ বাড়িতে আছিস, যতদিন এই বাড়িতে থাকবি তোর ঢলাঢলি চলবে না। আমার মাইন্ড যে বিগড়ে ফেলছিস তৃষা তুই, আন্দাজ করতে পারছিস? আমার দিকে তাকা তৃষা। দেখ প্রেম ভালো নেই। প্রেমকে তুই ভালো থাকতে দিচ্ছিস না। এর শাস্তি কী দেই তোকে?’
‘আপনি সাইকো প্রেম ভাই। আমি আপনার বিবাহিত বউও নই আর প্রেমিকাও নই। আমার ওপরে আপনার কিসের এত অধিকার খাটানো? আমার হাত যা মন চায় ধরবে তাতে আপনার এত কী আসে যায়?’
‘অধিকার খাটানোর জন্য তোর মতো নোংরা মেয়েকে এখন প্রেম নেওয়াজের বিয়ে করতে হবে? রাস্তায় বের হলে তোর চেয়েও হাজারগুন সুন্দর গুলো প্রেমের পেছনে ঘুরে। আর তুই তো আমার বালডা দেখতে। শালী কথা বলবি না একে বারে জানে মেরে ফেলব।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘আমিও মারতে জানি। ছেড়ে আমিও আপনাকে দেব না। আপনি আমায় একবার আগুনে পুড়ালে আমি আপনাকে আগুনে ঘি ঢেলে শতবার পুড়িয়ে মারব।’
‘আমি অপেক্ষা করছি সোনা। দেখি তুই আর কতখানি আমায় পুড়াতে পারিস।’
‘আপনার প্রতি ঘৃণার পরিমানটা কেবল এখন তীব্র হচ্ছে প্রেম ভাই। আপনার মতো মানুষগুলোকে ভালো ভাবাও আমাদের মতো মানুষদের জন্য ভুল সিদ্ধান্ত।’

‘ওহ যাদের ছোঁয়া শরীরে লাগলে উত্তেজনায় চোখ বুঁজে আসে তাদেরকে ভালো ভাবা সঠিক সিদ্ধান্ত তাই না সুইটহার্ট? না না তোকে সুইটহার্ট বললেও ভুল হবে তুই হলি গিয়ে বিটারহার্ট।’ বলেই প্রেম তৃষার হাতের দিকে তাকালো। ব্যথার স্থানে চেপে ধরল আরো শক্ত করে। তৃষা চিৎকার করতেই গালটা ঠেসে ধরে বলল, ‘প্রেম তোর জন্য তৃষা দুঃস্বপ্ন। আজাব চিনিস? প্রেম নেওয়াজ তোর জন্য একটা ভয়াবহ আজাব। প্রেমের নিষিদ্ধ বাগানে তুই ফুলের আশায় প্রবেশ করেছিলি কিন্তু তুই হয়তো জানিস না এইটা কাঁটার বাগান। ফুলতো বহু আগেই মরে গেছে। আমি যেন নেক্সট টাইম তোর হাতাহাতি না দেখি। যদি দেখি একেবারে সরাসরি নিষিদ্ধ পল্লীর দুয়ারে লাথি মেরে ফেলব তোকে।’

‘ছাড়ুন আমাকে। আপনার নাটক বন্ধ হলে। আপনার চাকর না, তাই আগেও বলেছি আমার সঙ্গে বারাবাড়ি করবেন না। আমিও করব না। আমি অনেক চেয়েছি যাতে কোনো ঝামেলা না হয়। তবুও আপনি তো নিজেই ঝামেলা। ওটা ছাড়া শ্বাস চলে নাকি আপনার? প্রত্যুষের সঙ্গে কথা বলেছি, আরো হাজারবার বলব। আপনার কথা শুনতে হবে এমন কোনো দায় বদ্ধতা তৃষার নেই।’ তৃষা সেই কথা বলতে দেরি ওমনিই প্রেমের তার গালে কোষে চড় বসাতে একটা মুহূর্ত ব্যয় হয়না। তৃষার চোখ দিয়ে কেবল জল পড়ে। আজকে চট্টগ্রাম, বাবা-মায়ের পাশে থাকলে প্রেমের মতো ছেলেদের সাহস হতো তার গায়ে হাত তোলার?

এই শহর, এই শহরের মানুষগুলো এত নিষ্ঠুর কেন? এই মুহূর্তে এসে নিজেকে অসহায় লাগছে। এখন আর তৃষার বাড়িতেও যায়গা হবে না। শিমলার বাড়িতেও থাকার উপায় নেই। কি করবে তৃষা, কোথায় যাবে মাথায় ঢুকছে না। তৃষা মুখ খুলে কিছু বলতেও পারছে না। যদি প্রেম রাগের মাথায় উল্টোপাল্টা কিছু তার সঙ্গে করে বসে? তৃষা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। এভাবে চেঁচিয়ে এই পাগলের সঙ্গে কোনো সমাধানে আসা যাবে না। আর তৃষার ব্যক্তিগত জীবন। সে যা মনে চায় করবে তাতে আরেকজনের এত আপত্তি কিসের? প্রেম দূরে সরে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালো। কিছুক্ষণ চেয়ে রইল তৃষার হাতের দিকে। তৃষা তখনো ভেতর থেকে রাগে গজগজ করছে। ভাবছে কি করা যায়? এভাবে জীবন চলে না। আর চলবেও না। হঠাৎ প্রেম তৃষার কাছে এসে বসল। খুব কাছে এলো তার। এসে চুলগুলো আলতো করে ছুঁয়ে তৃষাকে বলল, ‘যন্ত্রণা হচ্ছে তোমার সোনা? আমি কি তোমায় খুব কষ্ট দিচ্ছি? ইশরে মনে হচ্ছে কষ্টের পরিমাণটা খুব কম হয়ে গেছে। আরেকটু বাড়িয়ে দেই?’

প্রেম তৃষার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, ‘তোমার এখানে ব্যথা? এই যে ডান হাতের কব্জিতে? এখানে প্রত্যুষ স্পর্শ করেও ব্যথা কমাতে পারেনি? আচ্ছা আমি কমিয়ে দিচ্ছি। ‘ বলেই সে হাতের ব্যান্ড এইড ট্যাপটা এক টানে উঠিয়ে ফেলতেই ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠে তৃষা। চোখে তার জল। প্রেম সেই জলের দিকে তাকিয়েও চোখ ফিরিয়ে নেয়। হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলল, ‘লাগছে সোনা? আরেকটু জোরে দেব নাকি আস্তে? আই উইল বি জেন্টল ডৌন্ট ওয়রি সুইটহার্ট।’ বলেই সে ঠোঁটে চেপে রাখা সিগারেটটা তৃষার সেই ক্ষতর ওপর লাগাতে যন্ত্রণায় ছটফট করে ওঠে তৃষা। চিৎকার করতে চাইছে তবে প্রেম তার মুখটা চেপে ধরে রাখায় পারছে না। এ কোথায় এসে পড়ল? এমন একটা জাহান্নামে এসে পড়েছে যেখান থেকে বের হতে গেলে বার বার শিকলবন্দী হবে তৃষা।

সেই রাতের পর থেকে আজকে ৪ দিন কেটে গেল। তৃষা ঘরবন্দী ছিল। ঘর থেকে বের যদি না হয় তাহলে কারো সঙ্গে দেখাও হবে না আর ঝামেলাও বাঁধবে না। তবে তৃষার এখনো অনেক কিছু বুঝবার বাকি। যেই ঝামেলা একবার শুরু হয় তাকে শেষ করতে গেলে যে তা আরো তরতর করে বেগ পায় তা তৃষা সত্যিই জানে না। চারটা দিন রুমের মধ্যে জ্বরে ভুগেছে। সিমটা ভেঙে কোথায় ফেলেছে জানা নেই। শরীর পুড়েছে তার। রাতে কাঁপুনি জ্বর উঠলে মায়ের নাম ঝপতো। বাবাকে স্মরণ করত। তবে তাদেরকে যে তৃষা নিজের ইচ্ছায় হারিয়ে ফেলেছে। আমরা মানুষ তখন বুঝতে পারি যখন আমাদের হাতে আর কোনো উপায় থাকে না। বাঁচার পথ থাকে না, ফিরে পাওয়ার সুযোগ থাকে না। কেবল তখন কান্না আর একাকীত্ব ছাড়া পাশে থাকে না কেউ।

তৃষার মাথাটা এখনো ঝিমঝিম করছে। এই চারটা দিন প্রত্যুষ অনেক ব্যস্ত ছিল। তবুও সকল ব্যস্তটার মাঝেও রোজ একবার করে রাতে এসে কিংবা সকালে কাজে যাওয়ার সময় তার খোঁজ নিয়ে যেত। এই মানুষটার মতো মানুষ হয়না। এখন কি মনে হচ্ছে তৃষার? মনে হচ্ছে প্রত্যুষকেও ভালোবাসা উচিত হয়নি। তার নষ্ট জীবনের সঙ্গে সে কি করে পারে একটা ভালো ছেলের জীবনটা জড়িয়ে নষ্ট করে ফেলতে? প্রত্যুষ তৃষার মতো মেয়েকে ডিজার্ব করে না। সে আরো ভালো কিছু প্রাপ্য। ভালো একটা মেয়ে সে পাওনা। যার কোনো অতীত নেই। যে বিয়ের আসর ছেড়ে পালায় নি। পরিবারের সম্মান নষ্ট করেনি। ভার্সিটির সিনিয়রের থেকে কখনো রেগ খায়নি। যার নামের সঙ্গে কেবলই পবিত্রতা আছে তেমন কারোরই অধিকার আছে প্রত্যুষের সঙ্গে জীবনটা পার করার। আজকাল কিছুই ভালো লাগে না। তৃষা আর আগের মতো নেই। চোখ বন্ধ করলেই সে অন্ধকার দেখতে পায় আর চোখ খুললেই বাস্তবতা। প্রত্যুষের সঙ্গেও সে কথাবার্তা বলা কমিয়ে দিয়েছে। আচ্ছা দেহ থেকে জানটা বের হলেই কী মানুষ মরে? এই যে তৃষা মরে যাচ্ছে রোজ বেঁচে থেকেও এটাও কি কোনো মৃত্যুর থেকে কম?

ভার্সিটির চত্বরে গিটার হাতে বসে আছে। প্রতি বৃহস্পতিবার এখানে গানের আসর বসায় প্রেম। সবাই উপস্থিত হতেই প্রেম ঘড়ির কাঁটায় সময় দেখে। একটা কল করতেই ওপাশ থেকে আবারও ভেসে এলো সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এই যে এই চারটা দিন চাইলেই তৃষার সঙ্গে রুমে গিয়ে দেখা করে আসতে পারত প্রেম। দেখা করেনি ইচ্ছে হয়নি তার। কেন জানি একটুও ওই মুখটা দেখতে ইচ্ছে করেনি। কেন করবে? দেখার মতো কোনো কিছু হলো নাকি ওই মুখ? যেই মুখটিকে সবাই দেখে সুন্দর বলে প্রেমের চোখে দুনিয়ার সবচেয়ে কুৎচিত মুখখানা হলো সেটা। অংকুর পাশে বসল প্রেমের। ডান হাতের কব্জির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ক্ষত এখনো শুকায় নি?’

‘দেহেরটা না হয় একদিন শুঁকিয়ে যাবে তবে মনেরটা?’
‘শুন ভাই প্রেম! মন যা বলছে করে ফেল। নিজের ওপর আঘাত দিয়ে লাভ কী?’
‘এই আঘাতটা প্রেমের প্রাপ্য ছিল।’
‘এখনো অনেক সময় আছে প্রেম। আচ্ছা তুই গানটা ধর। আমি তো তোর সঙ্গে সুর মেলাচ্ছি।’
প্রেম চারিদিকে একবার তাকালো। এত খালি খালি কেন লাগছে তার? মনে হচ্ছে কি একটা নেই। জিদ করে এই চারটা দিন সে তৃষার সঙ্গে দেখা করেনি নাকি অন্য কারণে? তৃষার হাতে সিগারেটের ছ্যাকা দিয়েছে বলে? তাকে কষ্ট দিয়েছে বলে চারটি দিন ওই মেয়ের সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হয় নি নাকি প্রেমের ওই মেয়ের কি হয়েছে, কেন আসেনি। কেন কল ধরছে না। রুম থেকে বের হচ্ছে না। সকালে নাস্তা খেতে আসছে না, তা জানার কোনো ইচ্ছে নেই। প্রেম গিটারটা কোলে শক্ত করে তুলে নেয়। শিমলা এসে উপস্থিত হতেই প্রেম তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘সে আজকেও আসে নি?’

‘না ভাইয়া। আচ্ছা আমি বাসায় গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলব।’
‘দরকার নেই।’
প্রেম ফোনের দিকে তাকিয়ে সময় দেখে এবার গলা ছাড়ল। সেই মাতাল করা তার গলার স্বর ছেদ করে বেরহের ধ্বনিতে বেড়িয়ে এলো।
~ভাদ্র মাসের আকাশেতে
সাদা মেঘের ভেলা…
কোথায় রইলা প্রাণ বন্ধুয়া
রাখিয়া একেলা…
ভাদ্র মাসের আকাশেতে
সাদা মেঘের ভেলা…
কোথায় রইলা প্রান বন্ধুয়া
রাখিয়া একেলা…
কষ্টে কানে দিন রজনী
বুকে ব্যাথার ঢেউরে…
বন্ধু মনে রং লাগাইয়া
প্রাণে দিলো জ্বালারে
বাড়ির পাশে মধুমতি
পুবাল হাওয়া বয়রে.
বন্ধু মনে রং লাগাইয়া
প্রাণে দিলো জ্বালারে
বাড়ির পাশে মধুমতি..~

প্রেমা সন্ধ্যায় তৃষার কাছে পড়তে বসেছে। পড়া শেষ করে তৃষা কথায় কথায় প্রেমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ওইদিন যে একটা ছেলে তোমার সঙ্গে কথা বলল ওইটা কে গো প্রেমা?’
‘নানাভাইয়ের ডান হাত মোখলেস নানা আছে না? ওনার ছেলে মেহরাব। আমাকে পছন্দ করে। পাবনায় একটা কাজে পাঠিয়েছিল ওনাকে। কিন্তু সে প্রেমের টানে নাকি থাকতে পারল না। চলে এলো।’
‘ছেলে তো দেখতে ভালোই।’
‘তা জানি। কিন্তু আমার হিরো তো আছেই।’
‘প্রেম করো নাকি?’
‘না না প্রেম করি না। তবে প্রেমকে করি।’
‘প্রেমকে করো মানে?’
‘মানে প্রেম ভাইকে লাভ করি।’
‘কিহ! তুমি ওনার প্রেমিকা?’

‘এত সৌভাগ্য আমার কই? সে তো ফিরেও চায় না। আমার জন্মের পর দিন থেকেই তাকে জানপ্রাণ দিয়ে লাভ করি। পাত্তায়ই দেয় না। খালি কথায় কথায় ধমক দিতে পারে আর কান টেনে চড় দিতে। জানো মা কি বলে?’
‘কি বলে?’
‘বলে প্রেম ভাইয়ের কোলে নাকি ছোট বেলায় আমাকে জোর করে একদিন দেওয়া হয়েছিল। প্রেম ভাই চেচামেচি, কান্না, বকবক সহ্য করতে পারে না। তো সেদিন নাকি বাড়িতে অনুষ্ঠান ছিল। সবাই জোর করে প্রেম ভাইয়ের কোলে আমাকে দিলো। আমি যদিও ডায়পার পড়া ছিলাম। কিন্তু হাগু করার সময় নাকি অনেক কান্না করতাম।
‘তোমার কষা ছিল নাকি?’

‘আরে….’
‘সরি সরি তারপর বলো।’
‘তারপর আমি কান্না করি আর প্রেম ভাই সেই কান্নার শব্দ সহ্য করতে না পেরে দিলো আমায় বিছানায় ফেলে। মাথায় নাকি ব্যথা পেয়েছিলাম অনেক। মা এখনো বলে সেই আঘাতের পর থেকেই নাকি আমার মাথার ব্রেন আমার পেছনে চলে গেছে। তাই আমি পড়ালেখা পারি না। কিন্তু মাকে কে বোঝাবে প্রেম ভাই সেদিন আমায় ফেলে ইঙ্গিতে বোঝাতে চেয়েছে, ‘আমি তোমায় দিলাম প্রেমের প্রেমে ফেলে। তুমি সাঁতার কেটে তীরে আসো। আমি তোমার জন্য তীরে প্রেম নামক আইক্কালা বাঁশ দিয়ে অপেক্ষামান।’
তৃষা বুঝলো না এই মেয়ে প্রসংসা করল নাকি নিজেরই অপমান। প্রেমা পুনরায় বলে উঠল, ‘তুমি আমাকে সাহায্য করবে?’

‘কিসের সাহায্য?’
‘প্রেম ভাইকে পটাতে।’
‘আচ্ছা করলাম।’ তবে তৃষা মনে মনে বলল, ‘নামই তো প্রেমা। সে নাকি প্রেমের সঙ্গে প্রেম করবে। নামেই তো এই দুইটাকে লাগে আপন ভাই-বোন। ছ্যাহ!’
হঠাৎ দরজায় কড়া নড়তেই প্রেমা বলল, ‘ভেতরে আসো।’ মেহরাব দরজার সামনে এসেই বলল, ‘এভাবে মনের ভেতরে আসতে দিলেই তো হতো।’
প্রেমা তাকে দেখে চটে গেল। মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘এখানে কী তোমার? নিজের ঘরে যাও।’
‘আমার বাবুর আম্মু যেখানে আমি সেখানে।’
‘এই লোক আমি তোমার কোন বাবুর আম্মু? প্রেম ভাইকে দিয়ে আমি তোমাকে কেলানি খাওয়াবো।’
‘তুমি তো বেডি নিজেই তার হাতের কেলানি খাও।’

তৃষা পড়ে যায় বিপাকে। সে প্রেমাকে বলল, ‘তোমরা থাকো আমি রুমে যাই।’ বলেই সে রুম থেকে বের হয়ে যায় । মেহরাব অসহায়ের মতো প্রেমাকে বলল, ‘অনুরোধ করি বাবুর আম্মু তুমি আমাকে বিয়ে করে আমাদের বাবুকে জলদি দুনিয়ার আলো দেখাও। এই প্রেমা চলো না এই রাতের আঁধারে বদনা হাতে নিয়ে না মানে হারিকেন হাতে দিয়ে জাদুর ঝাড়ুর ওপর চড়ে না হয় আকাশে ভ্রমন করব?’
প্রেমা মুখ বাঁকিয়ে গান ধরল,
~চেহারায় নাই ঢক। নাম রাখছে আব্দুল হক। আমায় নিয়া ঘুরতে যাবে তার কত শখ?~

তৃষা নিজের রুমে যাওয়ার পথে হেতিজার সঙ্গে দেখা হয়। হেতিজা কথাবার্তা বলে রুমে যায়। কালুর বাপকে রুমে ডেকে বলে, ‘এই তৃষা মেয়েটির পরিবার সম্পর্কে খোঁজ নিও তো! ভালোই লাগে একে আমার।’
কালুর বাপের মাথা কাজ করছে না কারণ সেদিন একই দায়িত্বে তাকে সিদ্দিক নেওয়াজও নিযুক্ত করেছেন। এক মেয়েকে নিয়ে এক বাড়ির দুই মানুষ পড়েছে। না না এভাবে চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। আজকে রাত থেকেই এই মেয়ের ওপর নজর রাখতে হবে। একে একটা মোক্ষম কট দিয়ে না হয় একজনের গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া যাবে। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।

রাতে ঘুম না আসার ফলে তৃষা বাগানে হাঁটাহাঁটি করে একলা। প্রত্যুষ তখন সবেমাত্র বাড়ির মধ্যে ঢুকেছে। তৃষা বাড়ির মধ্যে ঢুকতে যাবে তখনই প্রত্যুষের সঙ্গে দেখা। দু’জন মুখোমুখি হতেই প্রত্যুষ বলল, ‘আমায় ইনগোর করছো কেন? দেখ আমি চারটে দিন সবাই লক্ষ করেছি।’

তৃষা প্রত্যুষকে এড়িয়ে যেতে গিয়েও পারল না। প্রত্যুষ তার চোখে চোখ রেখে বলল,’ একটু বাগানে বসি চলো।’
তৃষা না বলতে গিয়েও পারল না। অযথা একটা মানুষকে কষ্ট দিয়ে লাভ কি? ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে দোলনায় গিয়ে পাশাপাশি বসল প্রত্যুষ আর তৃষা। প্রত্যুষ গায়ের ব্লেজারটা খুলে হাতে নিলো। বলল, ‘এবার বলোতো তোমার পরিবার সম্পর্কে। আর তোমার কি হয়েছে সেটাও বলবে কিন্তু। দেখো আমি প্রশাসনের লোক। কোথায় তোমার বাড়ি, কি আসল পরিচয় জানতে আমার একটা তুড়িই যথেষ্ট। তবুও আমার যে তোমার মুখ থেকেই শোনার তৃষ্ণা পেয়েছে। তুমি কথা বলো। কথা বলে আমার তৃষ্ণা মিটিয়ে দাও।’

তৃষা প্রত্যুষকে শেষ সব খুলে বলতে বাধ্যই হলো। এখানে কিভাবে আসা। বিয়ে, ব্যক্তিগত জীবন কিছু নিয়ে বলেছে। তবে কেন জানি বলতে পারল না প্রেমকে নিয়ে। প্রেমের অত্যাচার, হুমকিধামকি দেওয়া থেকে শুরু করে তার সঙ্গে কাটানো ভয়ানক সেই প্রতিটি মুহূর্তের কথা। রুমে এসে চোখটা বন্ধ হতে খুব একটা সময় লাগল না তৃষার। আজকে অনেকটা শান্তি লাগছে। তবুও মনের ফাঁক গলে একটা সামান্য অশান্তি ভাব রয়েই গেছে।

ঘড়ির কাঁটায় তখন কয়টা বাজে তৃষার জানা নেই। রাতে প্রায় তার ওয়াশরুম যাওয়া লাগে। বালিশের কাছে একটা পানির বোতল রাখা থাকে। ঘুম ভাঙলেই সে কেবল পানি খায়। আর একটু পর ওয়াশরুম যাওয়া লাগে। তবে আজকের ঘুমটা ওইসব কারণে নয় বরং অন্য একটা কারণে ভাঙে। বারান্দা থেকে কেমন একটা শব্দ আসছে। এই নেওয়াজদের বারান্দায় গ্রিল নেই। কোনো ডাকাত কিংবা সন্ত্রাস যদি বারান্দা টপকে ভেতরে এসে চাকুর আঘাতে তৃষাকে খুন করে ফেলে? ডাকাত তো আর বিশ্বাস করবে না তৃষা যে ফকির। নিজেকে তৃষা স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করল। পানি খেয়ে উঠে বসতেই এবার ভয়টা ভালো করে তাকে চেপে ধরল। মনে হলো বারান্দায় কেউ বেয়ে কিংবা বারান্দার পাশের বড় আম গাছটা বেয়ে উপরে উঠেছে।

তৃষা কি করবে না করবে ভাবতে ভাবতে হাতে পানির বোতলটা তুলে নেয়। আজকে মারবে চোরের মাথায় একটা বারি। শালার মাথার পাতলা ঝোল বের করে ছাড়বে। এটা তৃষা। এখনো চেনে না এই বিচ্ছু চোর তৃষা কি জিনিস! তৃষা এক পা দুই করে অন্ধকারে কাছে যেতেই বারান্দায় পর্দা সরিয়ে বড় একটা ছায়ামূর্তি ভেতরে ঢুকলো। একে বাড়ি মারবে কি উল্টো ভূত ভেবে কলিজা হাতে চলে আসার উপক্রম। ভয়ে শরীরটা ঝিমিয়ে আসছে। অন্য বিষয় আলাদা কিন্তু ভূত! তবুও সে বোতল উঁচুতে তুলে বারি দেওয়ার জন্য। তবে সঙ্গে সঙ্গে সেই ছায়ামূর্তি তৃষাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসতেই তৃষার বুঝতে বাকি রইল না কে এই মহাজন? তার গায়ের সেই সুগন্ধী তৃষার চেনা। ছায়ামূর্তি তৃষাকে বুকের একেবারে কাছে ঝাপটে ধরে বলল, ‘বিটারহার্ট! তুমি আমায় মিস করো নি?’
‘আপনার সাহস তো কম নয়। আমার রুমে এই রাত বিরেতে? আপনার কী চাই প্রেম ভাই? আপনি আমায় এমন ভাবে মারছেন কেন? এক কাজ করুন বিষ কিনে আনুন খেয়ে মরে যাই।’

‘বাজারে বিষের অনেক দাম সোনা। তুমি বরং হারপিক খাও। টাকাও বেঁচে যাবে আর তুমিও শর্টখাটে মরতে পারবে।’
‘আপনাকে আমি ঘৃণা করি প্রেম ভাই।’
‘চিন্তা নেই আমি ঘৃণার উত্তাপে ঘি ঢেলে দেব। কারণ আমি চাই তৃষা নামক মেয়েটা আমায় কখনো ভালো না বাসুক। কেবল তীব্র ঘৃণায় আমার ধ্বংস ডাকুক।’
তৃষার চোখে জল। এই জলের উৎস কী তৃষার জানা নেই। কেন কাঁদছে সে? অন্ধকারে সে সামনের মানুষটি চেহারা ঠিক করে দেখতে পাচ্ছে না। তবুও এত আবেগ কোথা থেকে আসছে? আর যে সহ্য করা যাচ্ছে না। প্রেমের মুখটা অস্পষ্ট। তাই সেই সঙ্গে অনুভূতিও দেখতে পাচ্ছে না তৃষা। তৃষা হঠাৎ করে ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, ‘আপনি আমার জীবনের কালো ছায়া। এই ছায়া আমায় ভালো থাকতে দিচ্ছে না।’

প্রেম তৃষার গাল ছুঁয়ে বলল, ‘তুমি সাদা আর আমি কালো রঙ। একে ওপরের বিপরীত ধাতুতে গড়া আমরা। তবে জানো কি সাদা-কালো রঙটা কিন্তু একসঙ্গে মন্দ লাগে না।’
‘কি বোঝাতে চাইছেন আপনি?’
‘যেটা তুমি কখনোই বুঝবে না সোনা।’

তৃষার কান্নার শব্দ বেগ পায়। সে অনবরত প্রেমের বুকে এলোপাতাড়ি আঘাত করে বলতে থাকে, ‘চলে যান এখান থেকে। চলে যান প্রেম ভাই। আপনার ভেতরে নূন্যতম লজ্জা থাকলে আমার সামনে আর আসবেন না। আপনি আমায় ভাঙতে চেয়েছিলেন, আমি ভেঙে গেছি। আর নয়। চলে যান।’
তৃষা প্রেমকে ধাক্কা দেয়। অনবরত তার হাত চলতেই থাকে। কান্না, ধমকি সবই বাড়তে থাকে। প্রেম শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। তৃষার মুখে যা আসছে সে তাই বলছে। যখন মুখটা সহ শরীরটা ক্লান্ত হয়ে থেমে গেল। তখন নিজেই বলল, ‘থাকুন আপনি এখানে। আমিই চলে যাচ্ছি।’

প্রেমতৃষা পর্ব ১৮

তৃষা পেছন ফিরে পা ফেলতেই এবার নিশ্চুপ হয়ে সবটা শুনতে থাকা প্রেমের বাঁধ ভাঙল। সে হাত বাড়িয়ে পেছন থেকে তৃষার ঘাড় শক্ত করে ধরে তাকে নিজের কাছে এনে ঠোঁটে শক্ত চুমু গেল। তৃষা জীবন্ত মুরগির মতো প্রেমের কাছ থেকে বাঁচার জন্য ছটফট করল। তৃষা ডান হাত দিয়ে প্রেমের বুকে ঘুষি দিতেই প্রেম আরো শক্ত করে চেপে ধরল তার হাত দু’টো। হাতের মধ্যে দাগ বসে যাচ্ছে। তবুও প্রেম ছাড়ছে না। প্রেম কিছুতেই ছাড়ছে না।

প্রেমতৃষা পর্ব ২০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here