প্রেমতৃষা পর্ব ৩৩

প্রেমতৃষা পর্ব ৩৩
ইশরাত জাহান জেরিন

পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে দু’টো বাইক ছুটে আসছে বান্দরবান থেকে চট্টগ্রামের দিকে। চারপাশে অন্ধকার পাহাড়, কোথাও ঘন কুয়াশায় আলোর রেখা মিশে যাচ্ছে। তৃষার বাইকের লাইট পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে কেটে যাচ্ছে রাতের পর্দা, আর প্রেম সামনের দিকে গতি ধরে রেখেছে।

“প্রেম, এই আঁকাবাঁকা পথেও তুমি আমাকে হারাতে পারবে না,” তৃষা গর্জে উঠল হেলমেটের ভেতর থেকে।
প্রেম একপলক তাকাল পিছনে। “চলো তবে দেখা যাক, পাহাড় জয়ের পর শহরের রাস্তায় কার রাজত্ব!”
পাহাড় পেরিয়ে বাইক দু’টো নেমে এলো চট্টগ্রামের ফ্লাইওভার ঘেঁষা হাইওয়েতে। রাত তখন বারোটা ছুঁই ছুঁই। শহরের আলো পেছনে ফেলে একদল বাইক রাইডার ইতিমধ্যেই জড়ো হয়েছে। অবৈধ রেসের উন্মাদনা ছড়িয়ে আছে বাতাসে। হেলমেটের ভেতর থেকে ভেসে আসছে শিস, হাসাহাসি আর ইঞ্জিনের গর্জন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তৃষার দলের পুরোনো সদস্যগন তাকে এতদিন পর দেখতে পেয়ে খুশি। তারই মাঝে কেউ কেউ প্রেমের এটেনশন পাওয়ার জন্য তার পেছন ঘুরঘুর করছে। তৃষাদের দলের যেই সিনিয়র লোকটা সে প্রেম বাইক থেকে নেমে হেলমেট খোলার সঙ্গে সঙ্গে এসেই তার সঙ্গপ হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘গত বছর আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম। আপনার রেইস দেখার জন্য। আমি আপনার অনেক গুলো মুভিই করার চেষ্টা করি। তবুও কেন জানি আপনার মতো পারফেক্ট হয় না।’

তৃষা সেদিকে তাকালো। তার সিনিয়র তার সঙ্গে কথা না বলে এত কিসের প্রেম নেওয়াজের সঙ্গে কথা বলছে? প্রেম কথা বলে ফিরতেই তৃষা আর সে বাইক নিয়ে রাস্তায়প্রবেশ করল। তা দেখে নতুনদের মধ্যে অনেকেই অবাক হয়ে তাকাল। একজন বলে উঠল,“ওরে! মেয়ে নাকি রেস করবে প্রেমের সাথে?”
অন্যজন হাসল, “দেখ, আজ রাতটা জমবে।”
প্রেম বাইক স্টার্ট দিল, গর্জন উঠল বুক চিরে। তৃষা সমান ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গিয়ার পাল্টাল। চোখে চোখ পড়তেই দু’জনের ভেতর প্রেমময় দহন জ্বলে উঠল।
থ্রি… টু… ওয়ান… ভ্রূঁউউউমমম!!! দু’টো বাইক ছুটল একসাথে। হাইওয়ের বাতাস ছিঁড়ে যাচ্ছে, লাইটপোস্টগুলোর আলো পিছনে ঝাপসা হয়ে পড়ছে। তৃষার চুল হাওয়ায় কাঁপছে, বুকের ভেতর ঢাকের মতো বাজছে হৃদস্পন্দন। প্রেম মাথা নিচু করে গতি বাড়াচ্ছে, চোখে কেবল রাস্তার রেখা।

“প্রেম! আজ কিন্তু আমি হারব না,” তৃষার কণ্ঠ ভেসে এলো ইঞ্জিনের শব্দের ফাঁক দিয়ে।
প্রেম হেসে উঠল, নিটরো আরও টেনে দিল, “আমাকে হারাতে হলে কেবল গতি নয়, হৃদয়ের সাহসও চাই, তৃষা।”
গতি ছুঁলো ১৪০… ১৫০… ১৬০ কিলোমিটার। রাস্তায় হঠাৎই একটা ট্রাক ঢুকে পড়ল পাশ থেকে। মুহূর্তের সিদ্ধান্তে দু’জনেই বাইক কাত করে বেরিয়ে গেল ট্রাকের পাশ দিয়ে। চাকায় ঘর্ষণের শব্দ ছড়িয়ে পড়ল রাতের নিস্তব্ধতায়। দর্শকরা শিস দিল, উত্তেজনায় হাততালি বাজল। শেষ ল্যাপের সময় দুই বাইক এতটাই পাশাপাশি এল যে হ্যান্ডেল প্রায় ছুঁই ছুঁই। দু’জনের চোখেই উত্তেজনা। কেউ ছাড়বে না কাউকে।

ব্রিজের কাছে এসে হঠাৎ প্রেম গিয়ার পাল্টে গতি বাড়িয়ে দিল। অল্প কয়েক ইঞ্চি সামনে চলে গেল সে। তৃষা সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে প্রেম এক নিশ্বাসের ব্যবধানে ফিনিশ লাইন ছুঁয়ে ফেলল।
হঠাৎ নিস্তব্ধতা। তারপর দর্শকদের চিৎকার, শিস, হাততালি। প্রেম বাইক থামিয়ে হেলমেট খুলল, ঘামে ভিজে যাওয়া মুখে জয়ের দুষ্টু হাসি। তৃষাও হেলমেট খুলে চুল ছিটকে দিল। মুখটা কালো হয়ে গেল। সঙ্গে অজানা একটা ভয়। কি করে হারল? তার জয় তো নিশ্চিত ছিল? রাগ হচ্ছে তার। ভীষণ রাগ হচ্ছে। কি করে সে একজন প্রফেশনাল রাইডার হয়ে প্রেম নেওয়াজের কাছে এইভাবে হেরে গেল? প্রেম বাইক থেকে নেমে আসতেই চারপাশের মানুষজন ছুটে এসে তাকে ঘিরে ধরল। ছবি তোলার জন্য, কেউ নিজেদের শরীরে অটোগ্রাফ লিখিয়ে নিতে। প্রেমের চোখ তখন যেমন তৃষার দিকে, তৃষার চোখও ভীড় ঠেলে প্রেমের দিকে। প্রেম এগিয়ে তৃষার সামনে এসে দাঁড়িয়ে কানের সামনে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, ‘এখান থেকে বাড়িতে যেতে দুই-আড়াই ঘন্টা লাগবে। এত অপেক্ষা করার সময় নেই সোনা আমার হাতে।’

তৃসা এগিয়ে এসে বলল, “এক মুহূর্তে জিতেছো, প্রেম। কিন্তু মনে রেখো আমি হেরে যাইনি, শুধু থেমেছি।”
প্রেম হেসে উঠল, কণ্ঠ নরম হয়ে এলো, “এই জন্যই তো তুমি আমার সবচেয়ে প্রিয় প্রতিদ্বন্দ্বী… আর বিটারহার্ট।”
হাইওয়ের ফিনিশ লাইনের পর ভিড় জমে গেছে। হাততালি, শিস, আর উন্মাদনার মাঝেই হঠাৎ এক তরুণী এগিয়ে এলো প্রেমের দিকে। গায়ে লেদারের জ্যাকেট, লম্বা চুল খোলা। লেদার জ্যাকেটের চেইন খুলে রেখে বারবার চুল নাড়িয়ে যাচ্ছে। চোখ দু’টো প্রেমকে আকর্ষণ করার চেষ্টায় ব্যস্ত। তৃষা বেশ কিছুক্ষণ ধরেই মেয়ের কান্ড কলাপ দেখছে। এসব দেখতে তার আবার মন্দ লাগে না। মেয়েটি প্রেমের কাছে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আমি ফ্রি আছি। চলো ওইপাশে যাই।’

প্রেম মেয়েটির হাত নিজের কাঁধের থেকে সরিয়ে কাঁধটা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, ‘ফ্রি মাল প্রেম গিলে না। আমার কাছে ইনটেক ব্যান্ডেড প্রোডাক্ট আছে।’ মেয়েটির মুখটা কালো হয়ে গেল। সে আরেকবার প্রেমকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তৃষা এসে প্রেমের সামনে দাঁড়ালো। চোখে চোখ রেখে প্রেমের বুকে হাত রাখল। প্রেম কেবল চেয়ে আছে। মেয়েটি এখনো পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তার রাগ হচ্ছে। যেখানে সে একটা কথা বলাতেই এই ছেলের এমন উত্তর সেখানে এই মেয়ে তো শরীর স্পর্শ করছে। তাকে কেন কিছু বলছে না? তৃষার হাতের ছোঁয়া একটু একটু করে বুক বেয়ে নিচে নামতে শুরু করল। প্রেমের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি। তৃষার হাত আচমকা থমকে গেল প্রেমের হোলস্টারে। পিস্তলটা বের করে এক মুহূর্ত দেরি না করে তাক করল মেয়েটির কপালের কাছে। মেয়েটি যেন আন্দাজই করতে পারেনি তার সঙ্গে এমন কিছু হবে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তৃষা তাকে বলল, ‘পুরুষ মানুষ দেখলেই গায়ে ঢলে পড়তে ইচ্ছে করে? ৩ সেকেন্ডের মধ্যে রাস্তা না ধরলে তোমার জায়গা মতো এই পিস্তল ভরে দেব শালী লাফাঙ্গা কোথাকার।’

মেয়েটি ভয়ে চলে যেতেই প্রেম তৃষার দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল, ‘উফ এখনি জেলাস। যাই হোক বউ তোমার সময়, যাকে মন চায় পিস্তল ভরে দিতে পারো আপত্তি নেই। আমি তো রেসে জিতেছি পরের বার তোমার পালা।’
তৃষা জবাব দিলো না। কেবল এখান থেকে কেটে পড়লে বাঁচে। একটু হেরেছে বলে বার বার খোঁচা দিতে হবে নাকি? পরেরবার একেবারে মজা বুঝিয়ে দেবে।

ঠিক তখনই ভিড়ের ভেতর থেকে কয়েকজন নেশাগ্রস্ত বাইকার গণ্ডগোল শুরু করল। হাতে বোতল, কারও হাতে ছুরি। তারা হৈ-হুল্লোড় করে অন্য গ্যাংয়ের লোকের সঙ্গে মারামারি শুরু করে দিলো। ঝামেল
পরিস্থিতি মুহূর্তেই উত্তপ্ত হয়ে উঠল। চারপাশে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ল। হঠাৎই রাতের নিস্তব্ধতা চিরে ভেসে এলো পুলিশের সাইরেন “পুলিশ! পুলিশ চলে আসছে!” কেউ চিৎকার করে উঠল।
এক’মুহূর্তেই চারপাশ অস্থির হয়ে উঠল। রাইডাররা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে শুরু করল। প্রেম দ্রুত বাইকে উঠে চিৎকার করল, “তৃষা! ওঠো এখন নয় তো আর কখনো না!”

তৃষা এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে তার বাইকে চেপে বসল। গিয়ার ঘুরতেই ইঞ্জিন গর্জে উঠল। পাহাড়ের দিকের অন্ধকার ফাঁকা রাস্তায় দু’টো বাইক ছুটে গেল বজ্রগতিতে। চারপাশে কেবল বাতাসের হুইসেল, কানে বাজতে থাকা পুলিশের সাইরেন, আর পেছনে ঝাপসা হয়ে যাওয়া আলো। তৃষা হেলমেটের ভেতর দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ বৃষ্টি নামবে বোধ-হয়।’
প্রেম গতি বাড়িয়ে পাশ ফিরে হেসে বলল, ‘তাহলে তো প্রসেসিং আরো নতুন ভাবে ঘটিত হবে।’
‘আচ্ছা যদি এখন আমি আপনাকে ছেড়ে এখন চলে যাই?’

‘পারবে না। আমি তোমার সবচেয়ে বিপজ্জনক আসক্তি, তৃষা। এই নেশা ছাড়লে মৃত্যু নিশ্চিত তোমার।’
রাত তখন চারটা। পাহাড়ি আকাশ হঠাৎ মেঘে ঢেকে গেছে। টুপটাপ বৃষ্টি ঝরে পড়ছে, রাস্তার আলোয় চিকচিক করছে ভেজা পিচ। প্রেম বাইকের গতি কমিয়ে বান্দরবানের এক রিসোর্টের সামনে থামাল। চারপাশে নিস্তব্ধতা, শুধু বৃষ্টির শব্দ আর দূরে জঙ্গলের ঝিঁঝিঁর ডাক। তৃষা হেলমেট খুলতেই ভিজে চুল কপালের ওপর লেপ্টে এলো। বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। সে কাঁপা কণ্ঠে বলল, “প্রেম… থেমে গেলে কেন?”
প্রেম জবাব দিলো না। রিসোর্টের ভেতর ঢুকে চাবি নিয়ে সরাসরি রুমে প্রবেশ করল। তৃষার ভেজা শরীরে উসখুস লাগছে। প্রেম বিষয়টি লক্ষ করে বলল, ‘জামাকাপড় খুলে ওখানে মেলে দাও। কাজ শেষ হতে হতে ওইসব শুঁকিয়ে যাবে।’

‘মা…নে? কিসের কাজ?’
প্রেম তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে তাকালো। বৃষ্টির ধোঁয়াটে পর্দার মধ্যে দাঁড়িয়ে দু’জনেই হঠাৎ থেমে গেল। প্রেম ধীরে ধীরে তৃষার হাতটা ধরল। আঙুলের ফাঁকে আঙুল গেঁথে দিল। তৃষা প্রথমে কিছু বলল না, শুধু বুক ওঠানামা করতে লাগল দ্রুত। চারপাশে কুয়াশা, মাটির গন্ধ, ভেজা বাতাস… প্রেম তার কানে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল, “তুমি জানো, এই পৃথিবীর সব রেস আমি হেরে যেতে রাজি… যদি তুমি আমার পাশে থাকো। তবে জিতে গিয়ে যদি তোমার সঙ্গ পাওয়া যায় তবে আমি বার বার তোমায় হারিয়ে জিততে প্রস্তুত।’
তৃষার চোখ ভিজে উঠল। ভেজা ঠোঁট সামান্য কাঁপছিল। সে নিচু গলায় জবাব দিল, “কি করছেন আপনি….আমি বাড়ি যাব।’

প্রেমতৃষা পর্ব ৩২

বৃষ্টি আরও জোরে নামতে শুরু করল। রিসোর্টের বারান্দার ছাদে ফোঁটা পড়ার শব্দ যেন তাদের নিঃশ্বাসের সাথে মিশে গেল। প্রেম ধীরে ধীরে তৃষার মুখটা নিজের হাত দিয়ে সরিয়ে নিল চুল থেকে। তারপর অপেক্ষা না করে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। তৃষা কিছু বলতে গিয়েও বলার সুযোগ পেল না। প্রেমের থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আকুপাকু করল। তবে প্রেম যেন আরো শক্ত করে স্পর্শ করল তাকে। এত কষ্ট করে জিতল, ট্রফি ছাড়া ফেরার অভ্যাস নেই প্রেম নেওয়াজের।

প্রেমতৃষা পর্ব ৩৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here