প্রেমতৃষা পর্ব ৩৯

প্রেমতৃষা পর্ব ৩৯
ইশরাত জাহান জেরিন

কারাগারের স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে আছে প্রেম। মুখ গুঁজে রেখেছে দুই হাঁটুর ফাঁকে, দেহ কাঁপছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। এক্ষণই ওকে ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। অংকুর নিজ হাতে দিয়েছে। প্রেমের পুরনো সমস্যা যখনই মানসিক আঘাত বা অতিরিক্ত ট্রমা আছড়ে পড়ে, তখনই শরীরে সুগারের মাত্রা হঠাৎ নেমে যায় বিপজ্জনক পর্যায়ে। কিছুক্ষণ আগেও সে জ্ঞান হারিয়েছিল ঠান্ডা ঘামে ভিজে গিয়েছিল তার জামাকাপড়, ঠোঁট নীল হয়ে এসেছিল। তখনই অংকুর দৌড়ে গিয়ে ইনজেকশনটা পুশ করে, না হলে হয়তো এ মুহূর্তে প্রেম নিথর দেহ হয়ে পড়ে থাকত। ভাগ্যিস অংকুর নিজের কাছে প্রেমের এই ইনজেকশনটা রাখে। প্রেমকে কতবার বলেছে সবসময় এসব নিজের সঙ্গেই রাখতে। প্রেম এখন আগের থেকে ভালো আছে। কিন্তু শরীর সামলে উঠলেও মন তো এখনো তাণ্ডব করছে ভেতরে। মাথাটা ভনভন করছে, চোখদুটি রক্তাভ।

হাতে যেন স্থিরতা নেই, অবিরাম কাঁপছে। বারবার অংকুরের দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট গলায় বলছে,
“ভাই… তৃষাকে নিয়ে আয়… তৃষাকে ফিরিয়ে আন… প্রত্যুষ কোথায় নিয়ে গেল ওকে?” অংকুরের কণ্ঠ কাঁপছে তবু সে শান্তভাবে বোঝাতে চেষ্টা করে,
“সব ঠিক হয়ে যাবে প্রেম। তৃষা ফিরে আসবে। এই তো বাইরে কথা বলছে সে।” কিন্তু প্রেম কি বোঝে যুক্তি?
যার হৃদয়ে আগুন লেলিহান, সেখানে আশ্বাসের পানি ছুঁয়ে দিলেও , পৌঁছায় না। সে হঠাৎ মুখ তুলে তাকায়। মনে অনেক প্রশ্ন। প্রেম যেন নিজেই এখন প্রজ্জ্বলিত প্রশ্নচিহ্ন। যে প্রশ্নের উত্তর কারাগারের দেয়ালও জানে না।
থানা থেকে কিছুটা দূরে, নিঃসঙ্গ ও গাছপালায় আচ্ছাদিত একটা নির্জন প্রান্তর। বাতাসে কেবল পত্রপাতের মৃদু শব্দ, আর দূর থেকে ভেসে আসা কোনো পথভোলা কুকুরের ডাকে শূন্যতা আরও ঘন হয়ে উঠেছে এই স্থানে। সেই নিস্তব্ধতার মাঝখানে লোহার শীতল বেঞ্চটিতে পাশাপাশি বসে আছে প্রত্যুষ ও তৃষা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রত্যুষ দীর্ঘক্ষণ নীরব ছিল। অবশেষে, এক অদ্ভুত সংকোচ আর ক্ষীণ সাহস মিশ্রিত স্বরে প্রশ্ন করল,
“তুমি কি আমায় ভালোবাসো না, তৃষা? তোমায় তো প্রেম জোর করেই বিয়ে করেছিল, তাই না?”
তৃষা ধীরে মুখ তুলল। তার চোখ দুটি প্রত্যুষের চোখে স্থির হয়ে রইল। সেই দৃষ্টিতে একধরনের নির্ভীক স্থিতি।
সে বলল, “দেখুন, আমি ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে কথা বলতে জানি না। সরলভাবে সত্য কথাটাই বলব। আপনার ভাই, প্রেম নেওয়াজ—তাকে প্রথম দেখাতেই আমার ভালো লেগেছিল। তবে কখনো তা প্রকাশ করিনি, কারণ তখনও নিজের অনুভূতির গভীরতা বুঝিনি।

পরে আপনার সঙ্গে পরিচয় হলো। প্রথমে ভেবেছিলাম, হয়তো আপনিই সেই মানুষ, যাঁর সঙ্গে জীবনটা কোনো শান্ত বাঁধনে বাঁধা যেতে পারে। কিন্তু সময়—সময় সবকিছু বদলে দিয়েছে। আজ আমি নিশ্চিতভাবে জানি, প্রেম নেওয়াজ ছাড়া আমি কিছুই নই।
দিনের পর দিন, তার অনুপস্থিতিতে আমি নিজেকে হারাতে বসেছিলাম। তাকে হারিয়ে যে যন্ত্রণা পেয়েছি, তা কেবল আমিই জানি, তার কোনো পরিমাপ নেই।

তাই ক্ষমা করবেন, আমি আপনাকে কিছুটা ব্যবহার করেছি। আপনার আবেগের উপর ভর করেই আমি চেষ্টা করেছি প্রেমকে ফিরে পেতে। যদি সেদিন আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে না ঠিক হতো, হয়তো প্রেম কোনোদিন ফিরে আসত না। আপনি ভালো মানুষ, মিস্টার দেওয়ান। আপনি এমন একজন নারী ডিজার্ভ করেন, যে সত্যিই আপনাকে ভালোবাসবে, আমার মতো নয়। নিজেকে ভালো রাখুন। সুখে থাকার উপায় নিজেই খুঁজে বের করুন। একটি সামান্য বিষয়কে এত বিশাল করে তোলার কোনো মানে হয় না। আর আমাদের মধ্যে কোনো গভীর সম্পর্কও তো ছিল না—একটু সহানুভূতি, সামান্য যোগাযোগ, এই পর্যন্তই। আমি প্রেম নেওয়াজকেই ভালোবাসি। সে-ই আমার সবকিছু।
তার জায়গা কেউ নিতে পারবে না, কোনোদিনও না।

আপনি আজ আপনার নিজের ভাইকে জেলের অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছেন। নিজের হাতে হাতকড়া পরিয়েছেন—একবার ভেবে দেখুন, মানুষটা আপনি কী করেছেন! ক্ষমতার প্রদর্শন যতই মধুর মনে হোক, তারও একটা সীমা থাকা প্রয়োজন। আমি চাই, আমি যেমন সব ভুলে গেছি, আপনিও ভুলে যান। কিন্তু মনে রাখবেন আমার স্বামীর গায়ে একটিমাত্র আঁচড় পড়লেও, আমি আর নীরব থাকব না। এই সতর্কবার্তাটাই আমার শেষ কথা, মিস্টার দেওয়ান।”
তারপর তৃষা উঠে দাঁড়াল। চোখে কোনো জল নেই, কণ্ঠে কোনো কাঁপন নেই। আছে কেবল ভয়ংকর দৃঢ়তা, যা নীরব রাতের বাতাসকে ছেদন করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

“তোমার মাথা ঠিক আছে, তৃষা? কী বলছ তুমি? তুমি ভুলে গেছ, তোমায় তো প্রেম অপহরণ করেছিল! কী জাদু করেছে ও তোমার ওপর?”
তৃষা শান্ত, অনড় কণ্ঠে জবাব দেয়, “তার আমার ওপর কোনো জাদু করার প্রয়োজন নেই। আমি প্রথম থেকেই ওর প্রতি আকৃষ্ট ছিলাম।”
প্রত্যুষ বিস্ময়ে কেঁপে ওঠে, “সত্যি বলছো?”
“একদম সত্যি।”
“তোমার বুক কাঁপছে না?”
“কাঁপছে। কিন্তু যার জন্য এই কাঁপন, তাকে আপনি বন্দী করে রেখেছেন। আপনি যদি সত্যিই আমাকে ভালোবাসেন, তবে অনুরোধ করছি—সব ভুলে যান।
প্রেমকে মুক্ত করুন। আমাদেরকে আমাদের মতো করে থাকতে দিন। আপনি নিজেও শান্তি পাবেন, আমরাও আমাদের সুখ ফিরে পাব।”

প্রত্যুষের চোখে তখন কুয়াশার মতো ঝাপসা জল৷ জল জমে আছে চোখের কোণে কিন্তু সে তা ফেলতে পারছে না। তার কণ্ঠ ভারী, তবুও কোনো অভিযোগ নেই, কোনো প্রতিরোধও নেই। শেষবার তৃষার চোখের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “যদি কোনোদিন মনে হয়, তোমার ফেরা প্রয়োজন, ফিরে এসো। আমার দরজা সর্বদা খোলা থাকবে। আমি, প্রত্যুষ দেওয়ান—তোমায় আমার হৃদয়ও দিলাম, মুক্তিও দিলাম। তুমি আমার মন নিতে চাওনি, নিয়েছো স্বাধীনতা। আমি তোমার ভালোবাসার পথে আর কোনোদিন দাঁড়াব না। কখনো হয়তো আর বলব না ভালোবাসি, কিন্তু ভালোবাসা থেমে থাকবে না।”
তৃষা ঠাণ্ডা গলায় বলল, “কথা শেষ? এবার থানায় চলুন। আমি আমার স্বামীর সঙ্গে না গিয়ে আপনার সঙ্গে এসেছি কেবল এই কথাগুলো বলার জন্য।
প্রথমে সমাধান, তারপর বাকিটা দেখা যাবে।”

প্রত্যুষ উঠে দাঁড়ায়। মুখে যেন কোনো অনুভূতি নেই। তবু চোখের ভেতরে অস্থির স্রোত বইছে।
নিজেকে সামলে বলল, “আমার কিছু বলার অধিকার নেই আর, কথা তো ফুরিয়েই গেছে।”
তৃষা মাথা নাড়ল, “চলুন, থানায়।” থানায় পৌঁছে প্রত্যুষের নির্দেশে প্রেমকে কারাগার থেকে মুক্ত করা হয়।
দরজার ওপাশে পা রাখতেই প্রেম ছুটে এসে তৃষাকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে, যেন সে নিজের প্রাণ ফেরত পেয়েছে। তৃষা তার কপালে চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বলল, “আপনি ঠিক আছেন? শরীর কেমন?”
প্রেমের গলা রুদ্ধ, “তুমি কোথায় গিয়েছিলে, তৃষা?”
তৃষা মৃদু হাসে, “কোথাও যাইনি। আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবও না। বিশ্বাস রাখুন। চলুন, বাড়ি যেতে হবে সব শেষ, এখন শুধু আমাদের গল্প শুরু।”

প্রেম চলে যেতে উদ্যত, এমন সময় অফিসার ঠান্ডা স্বরে বলল, “একটু স্থির থাকুন, মিস্টার প্রেম। একটি কাগজে স্বাক্ষর বাকি আছে। তারপরই আপনি যেতে পারবেন।”
প্রত্যুষ তখন বাইরে বেরিয়ে এসেছে। জীবনের নির্মম পরিহাস যেন তার সমস্ত অস্তিত্বকে বিদ্ধ করছে। এই জীবনের খেলাটা এমন নির্মম কেন? কী পেল সে? কী হারাল? আর তার সঙ্গে যা ঘটল, তা কি প্রাপ্য ছিল তার? প্রেমের বুকে তৃষাকে দেখে প্রত্যুষের বুকের ভেতর যেন কাচের মতো ভেঙে গিয়েছিল। নিজের ভালোবাসার নারীকে অন্য পুরুষের বাহুবন্ধনে দেখা— এর চেয়ে যন্ত্রণাদায়ক দুঃস্বপ্ন আর কিছু হতে পারে না। সেই মুহূর্তে সে বুঝল, ভালোবাসা আসলে স্বর্গীয় নয়, সর্বনাশী। ভালোবাসা মানে কখনও কখনও নিজের বিনাশ মেনে নেওয়া, প্রিয়জনের মঙ্গল চেয়ে নিজের সর্বনাশকে আলিঙ্গন করা। প্রত্যুষ জানে, সে যদি তৃষার জীবনে থাকে, তবে হয়তো তৃষার সুখে আঁচড় পড়বে। তাই সে সরে যাবে, অনেক দূরে। এমন দূরে, যেখানে তার ছায়াটুকুও যেন তৃষার সুখে বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়। তবু তার না-হওয়া ভালোবাসার মাঝে, তৃষা যেন সুখে থাকে সেই কামনাই সে করে। তার না-হওয়ার মধ্যেও তৃষার অস্তিত্ব যেন চিরস্থায়ী হয়ে থাকে তার বুকে, প্রতিটি নিঃশেষিত নিশ্বাসে। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে প্রত্যুষ একবার চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল। তারপর হাতের উল্টো পাশে চোখের জল মুছে মৃদু হেসে বলল,

“তারপর?
তারপর সে হাসল, আমি কাঁদলাম।
সে খুঁজে পেল আলো, আমি হারালাম আঁধারে ।
তারপর তার হলো মুক্তি, আমার হলো বন্দিত্ব।
সে হয়ে গেল দূর নক্ষত্র, আমি অন্ধকারের চাঁদহীন রাত।
শেষে আমি শুনলাম কেবল নিজের ভেতর ভাঙার শব্দ।
সে শুনল না, সে বুঝল না। সে আমাকে আমার মতো বাঁচতেও দিল না।” প্রত্যুষের বুকভাঙা আর্তনাদে যেন প্রকৃতির প্রতিটি সুর ভেঙে যাচ্ছে। বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসছেঅদৃশ্য সঙ্গীত, এক পুড়ে যাওয়া প্রেমের শোকগাথা। এই প্রত্যুষ যদি তৃষার সামনে দাঁড়িয়ে শেষবার বলতে পারত,
“তোরে মন দিয়া, মন দিয়া আগুন জ্বালায় যে মনে…
মনের আগুন মনে জ্বলেরে…” তবে হয়তো পৃথিবীটা এত নিষ্ঠুর লাগত না।
তৃষা প্রেমকে ভেতরে রেখে থানার গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। অংকুর বাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। থানায় তার দমবন্ধ লাগে। তৃষা অংকুর কাছে গিয়ে বলল, “কিছু খাবারের বন্দোবস্ত করে নিয়ে এসো তো। আমি প্রেমের কাছে গিয়ে বসি। খেয়ে বাইকে উঠব। বাড়ি যাব।”
“প্রেমকে এই শরীরে বাইক চালাতে দিবে?”
‘নেভার। আমি আছি না?”

থানার অন্দরমহলে সোরগোল। জমজমাট মানুষের পদচারণা, কাগজের ভাঁজে পুলিশের ঘরোয়া ভ্রূকুটি। মাঝ বেঞ্চে বসে আছে শিমলা ও প্রেম। বেঞ্চের একপ্রান্তে বসা লোকজনের ভিড়। তাদের মাঝে একটি মেয়ে। কপালে চিন্তার রেখা, পাশে থাকা লোকের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বদ্ধ করে বসে আছে। আচমকা এক তরুণ ছুটে এলো। মুখে রক্তচাপের অস্থিরতা। পুলিশের চোখ মুহূর্তেই তাকে টেনে ধরে। পুলিশ গর্জন করে বলপ, “এটা থানা — মাছের বাজার নয়।” কথা শুনে ছেলের বুদ্ধিমত্তায় কাঁটা পড়ে; তাকে থামিয়ে আনা হলো। লোকটিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় সে চেঁচিয়ে বার বার একই কথা বলতে লাগল। ‘পাঁচটা বছর জানোয়ার তুই আমার সঙ্গে প্রেম করে এখন বড়লোক মাল ওয়ালা দেখে বিয়ে করেছিস? আমার জীবনের পাঁচটা বছর নষ্ট করে এখন তুই সুখে থাকবি? মেরেই ফেলব তোকে।’

শিমলার পাশে বসে থাকা মেয়েটি তখন তার পাশে বসে থাকা নিজের স্বামীকে বলল, ‘দেখেছো বললাম না ওই লোকের মাথায় সমস্যা আছে? এসব কি বলছে? আমি তো ওকে চিনিও না।’
‘সমস্যা নেই বউ পুলিশ বিষয়টি দেখবে। তুমি চিন্তা করো না।’ স্বামীর মুখ থেকে এহেন কথা শুনে মেয়েটি পুনরায় লোকটার দিকে তাকিয়ে স্বামীর কাঁধে মাথা রাখল। শিমলা তখন উঠে এসে প্রেমের পাশের সিটে বসল। কথা বলল না। তবে ফোনটা বের করে মেয়েটির দিকে তাকাল। চোখের চশমাটা ঠিক করে প্রেমকে মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘আজকে রাতের মধ্যেই কিন্তু এই ঝামেলা শেষ করতে হবে।’

প্রেমতৃষা পর্ব ৩৮

প্রেম জবাব দিলো না। কেবল উঠে দাঁড়ালো। তৃষা তখন ভেতরে প্রবেশ করেছে মাত্র। সে তৃষার দিকে তাকিয়ে হাসল। হেসে মৃদু স্বরে শিমলাকে জবাব দিলো, ‘সকাল হতে না হতে খবর পেয়ে যাবে চিন্তা নেই।’
‘তাই যেন হয়।’

প্রেমতৃষা পর্ব ৩৯ (২)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here