প্রেমতৃষা পর্ব ৩৯ (২)
ইশরাত জাহান জেরিন
প্রেমের বান্দরবানের শখের কাঠের বাড়ি প্রিমরোজে ফিরতে খুব একটা সময় লাগলো না। রুমে এসে ক্লান্ত শরীর নিয়ে প্রেম বসে পড়ল। মুহূর্তেই তার কোলে মাথা রেখে তৃষা বলল, ‘আপনাকে আমি কখনো দূরে যেতে দেব না প্রেম। জানেন আপনার জন্য আনা পুতুলটার আমি চুলের রঙ বদলে দিয়েছি? ওটা এখন দেখতে আপনার মতো।’
‘দেখা হয়নি। কখন করলে?’
‘ওই যে ওইদিন কটেজে। মাঝ রাতে আপনি যখন ঘুমিয়েছিলেন। তখন ওঠে গেলাম। নতুন চুল তো লাগাতে পারিনি তাই কটেজের একটা লোককে দিয়ে রঙ আনিয়ে রঙ করেছি বাইরে বসে বসে। এমা জানেন কি হয়েছে? হঠাৎ করে কি যে বৃষ্টি। ওইসব দেখে লোভ সামলাতে পারিনি। এই যে এই টুকুনি ভিজেছি।’
‘সকালে ড্রয়ারে সিরিঞ্জ পেয়েছি। ইনজেকশন কি তুমি আমার হাতে দিয়েছিলে?’
তৃষা একটু চুপ করে পুনরায় বলল, ‘আর কে দিবে?’
‘কিসের ইনজেকশন জানো?’
‘সুগারের।’
‘কে বলল?’
‘সন্ধ্যায় অংকুর ভাই বলেছিল। বলল প্রতিমাসে আপনার একটা নরমাল সুগারের জন্য এমনিতে নাকি ইনজেকশন দিতে হয়। এত যে নেশা করেন এসবের ফল এগুলো। অংকুর ভাই ওটা হাতে নিয়ে বলল, আজকে ইনজেকশন দেওয়ার ডেট। আপনার হাতে যেন দিয়ে দেই। পরে আমার মনে ছিল না। রাতে ঘুম ভাঙার পর মনে আসতেই দিলাম। আমি ভুল জায়গায় দিয়েছি কি? আমি তো জানি না কোথায় দেয়।’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘উঁহু পারফেক্ট ভাবেই দিয়েছো সোনা।’
প্রেম তৃষার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘তোমায় অনেক দিন ধরে বলব, বলব করে একটা কথা বলা হয়নি আমার।’
‘কি কথা?’
‘হিমিকা গুলজার আর পরাগ নেওয়াজের কথা।’
‘তারা কে?’
‘আমার পিতামাতা।’
তৃষার ওইদিনের কথা মনে পরে যায়। এই তাদের কথা তুলেই তো একমাসের জন্য হারিয়ে ফেলেছিল সে প্রেমকে। তবে এই মানুষগুলো কি করে হারালো তা এখনো জানা হয়নি। ‘আমার মা বাবার প্রেম করে বিয়ে। শুরুতে তাদের সম্পর্ক ভালোই যাচ্ছিলো। তারপর আমি জন্ম নিলাম। সবাই কত খুশি। তবে আস্তে আস্তে যত বড় হচ্ছিলাম ততই বুঝতে পারছিলাম বাবা-মায়ের সম্পর্কটা আর সুস্থ নেই। ওই যে প্রেম, প্রেম একটা বিষয় ওটা আর নেই। মা রোজ কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে ঝামেলা করতোই। বাবা বিষয়গুলোকে সামলানোর চেষ্টা করলেও মা সব বিগড়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। দেখতে দেখতে ১৯ এ পা রাখলাম। ১৯ ছিল আমার ধ্বংসের প্রথম ধাপ। দেখো তৃষা আমি কখনো খারাপ মানুষ হতে চাইনি। কিন্তু কি করে হয়েছি জানো? কারন আর দশটা মায়ের মতো আমার মা আমায় রাতে বুকে টেনে ভালো মানুষ হওয়ার গল্প শোনায়নি। ঘুম পারায়নি।
ঘরে অশান্তি করে মা রান্না বন্ধ করে দিতো। বাবা রাগ করে বাইরে থাকত। ওমন সময় দাদু আমায় যা পারতেন, দেখা শুনা করতেন। মায়ের শাসন, যত্নের অজান্তে কখন যে খারাপ হয়ে গেলাম। আমি জীবনে প্রথম মদ খেতে দেখেছিলাম কাকে যানো? আমার মাকে? বাবার বিজন্যাস ফ্রেন্ড মুইন কাকা প্রায় আমাদের বাসায় আসা-যাওয়া করতেন। মানুষটিকে পছন্দ করতাম। কেন জানো? কারণ প্রতিবার বাড়ি বাসার সময় সঙ্গে করে আমার জন্য চকলেটের বক্স নিয়ে আসতেন। তার চকলেটের কোম্পানি ছিল বাবা সেখানকার ৩০% শেয়ার হোল্ডারের মালিক ছিলেন। সেই চকলেট খেয়ে আরামের ঘুম দিতাম। তখনো বুঝতে পারিনি আমার পছন্দের আংকেল আমাকে নেশাযুক্ত চকলেট খাইয়ে ঘুম পারিয়ে আমার মায়ের সঙ্গে এক বিছানায়……. ‘ প্রেম থামল।
কথা গুলো বলতে গিয়ে ঢোক গিলতেও কষ্ট হলো। তৃষা উঠে বসে আরো মনোযোগ দিলো। প্রেম পুনরায় বলা শুরু করল, ‘আমার বয়স যখন ১৯ সেদিন আমি প্রথম মা আর সেই আংকেলকে ওইভাবে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় আবিষ্কার করি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে সময় লেগেছ আমার।’ সেই রাতে আমি রুমের মেঝেতে পরে ছিলাম। সুগার লো হয়। বেহুঁশ হয়ে মেঝেতে পরে ছিলাম। পরদিন বাবা এসে আমায় হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানেই জানতে পারলাম মা বাবাকে ডিভোর্স লেটার দিয়ে বাসা থেকে চিঠি লিখে পালিয়ে গেছে। অনেকদিন মাকে দেখিনি। তারপর মাঝে মা ফিরে আসে। তখনো আমি বলতে পারিনি আমি মাকে, কার সঙ্গে কোন অবস্থায় দেখেছিলাম। ওই নোংরা শব্দ গুলো উচ্চারণ করার ক্ষমতা আমার আজও হয়নি। আজও না।
মাকে নিয়ে কি করে এসব বলি? মা হয় তো। শেষে বাবা আর মায়ের ডিভোর্স হয়। তার বছরের পর বছরের পর পরকীয়া করার বিষয় জানার পর নেওয়াজ পরিবারের সবাই ভেঙে যায়। বাবা ডিভোর্সের পক্ষে কখনো ছিল না। সে সুযোগ চেয়েছিল। তাতে মায়ের কি? সে আমাকে, বাবাকে রেখে নতুন স্বামীর সঙ্গে চলে গেল। বাবার ব্যবসা ধ্বসে পড়ল। মা নতুন স্বামীর সঙ্গে চলে যাওয়ার ছয় মাসের মাথায় জানতে পারলাম তার ভয়াবহ মৃত্যু হয়েছে। খুন হয়েছে সে। সেই খুনের রহস্য আজও অজানা। মা তার পরিবারের বিপক্ষে গিয়ে আমার বাবাকে বিয়ে করার পরই নাকি শুনেছিলাম তার পরিবার তাকে মেনে নেয়নি। বিয়ের পর তার বাবা-মায়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। মেয়ের মৃত্যুর খবরও জানতে পারেনি তারা। যাক সেইসব কথা বাদ।
তবে শুনেছিলাম মুইন আংকেলই নাকি মাকে খুন করেছিল। মানুষ এটাই বলত। ওই লোকও এখন বেঁচে নেই। এক্সিডেন্ট করেছিল। কয়েক বছর বেঁচে ছিল ওই অবস্থায়। পরে মারা যান। ছোট থেকেই বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখে বড় হওয়া এই আমিটা একগুয়ে ছিলাম। ঝগড়া করতাম, ঘরের মধ্যে বন্দী থাকতাম। আচ্ছা এসবের জন্য আমি দায়ী ছিলাম তৃষা? পেরেন্স ডে তে সবার বাবা-মা আসত, আমার পরিবারের মানুষ আসত এখানে আমার দোষ কথায়? ওই দাদু ছাড়া কেউ আমায় বুঝেনি তৃষা। ধীরে ধীরে সময় কাটে। আমি ২৩ এ পা রাখি। মা চলে যাওয়ার পর বাবা সব ছেড়ে আমার টেককেয়ার করেছেন। ভরসা যুগিয়েছেন, সাহস যুগিয়েছেন। আমি ভাবলাম এই বুঝি আমার জীবন এত পরে হলেও এখন সুন্দর হতে চলেছে। তবে ২৩ এ আমার সঙ্গে কি হলো?
বাবাকে আবিষ্কার করলাম একটা মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে ওই মেয়ে টা আর কেউ না আমার ভার্সিটির ফ্রেন্ড।।তাও নিজের বাসায়। আমার পরিবারের কারণে আমার পড়ালেখা অনেক বার থেমেছে। কবেই এই পড়ালেখা শেষ হয়ে যেত! ভার্সিটিতে যাওয়ার পর অনেক বন্ধ হয়। আমার কাঠের বাড়িটায় সবাই মিলে আড্ডা দিতাম, গানের আসর বসাতাম। আমাদের সার্কেলে রাফা নামক একটা মেয়ে ছিল। সেও আমাদের বাসায় প্রায় আসা যাওয়া করত। বাবা নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসত। তার নাকি মেয়ের অনেক শখ ছিল। তবে মেয়ে হতে পারল কই? বাবা আর বিয়ে করেননি। জীবনটা বিলিয়ে দিয়েছিল শেষে প্রেমকে মানুষ করার তাগিদে।
সেই বাবাকে যখন নিজের ক্লাসমেটের সঙ্গে আবিষ্কার করলাম ঠিক ১৯ বছরের ঘটনা পুনরায় মনে পরে গেল। সেদিন মারাত্মক শরীর খারাপ হয়। এক সপ্তাহের মতো হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। অংকুরটা না থাকলে কি যে হতো। বাসায় ফিরে বাবাকে দেখতে পেলাম না। সেই থেকে এখন পর্যন্ত বাবাকে দেখেনি। কি হয়েছে তার, কোথায় আছে জানি না। তবে জিনিয়া রাফার লাশ দেখেছিলাম। আত্মহত্যা করেছিল সে। এক সপ্তাহের মধ্যে ঘটনাগুলো ঘটে। আজও পুলিশ আত্মহত্যার পেছনকার রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি। দেখো তৃষা ওইসবের পর থেকে ভরসা নামক কোনো শব্দকেই আমি বিশ্বাস করেনি। এসব বিশ্বাস, ভরসা করা ছেড়ে দিয়েছি। নেশা, বাজে কাজে এত ভয়াবহ ভাবে লিপ্ত হয়ে যাই। তৃষা এখনো মাঝে মাঝে আমার মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যায়।
১৯ আর ২৩ বছরের সেই দুটো দুঃস্বপ্ন আমায় ঘুমাতে দেয় না। আমি ভরসা করব তো কাকে করব? দেখো আমি তোমার আগে কাউকে ভালোবাসিনি। কি করে ভালোবাসতে হয় জানা নেই। আমার ভালোবাসায় অনেক ভুল ক্রুটি থাকতে পারে। তুমি অন্তত আমায় ভুলে যেও না। এবার তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করলে আমি নিশ্চিত মারা যাব। আমায় আর কেউ মৃত্যুর হাত থেকে ফেরাতে পারবে না তৃষা। মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে তোমায় ভালোবেসেছি, আমায় যুদ্ধে হারিয়ে পরাজিত সৈনিক সাব্যস্ত করো না।’ প্রেম তৃষাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। এক মুহূর্তে সে অন্য এক প্রেমকে আবিষ্কার করল। এত ভয়ানক শৈশব? এই ট্রমা এখনো লোকটিকে মেরে খাচ্ছে?
এসব যদি তৃষা একবার জানত! তাহলে সেদিন রাতে কখনো প্রেমকে ওইভাবে কষ্ট দিয়ে কথা গুলো বলত না। আসলে মানুষ এমনি এমনি খারাপ হয় না, খারাপ হওয়ার জন্যও কারণ থাকা লাগে। প্রেমের মতো তৃষার চেখেও জল। সে প্রেমকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আপনাকে ছাড়া আর মৃত্যুকে বরণ করা সমান কথা। আমাদের বিচ্ছেদ এপারে হচ্ছে না। ওপারের কথা জানি না তবে ওপারে একটা সুযোগ পেলে আমি চাই আপনার আমার দেখা আবার হোক। আমরা আবার প্রেমে পড়ি একে অপরের, আবার বিবাহের মিষ্টি বন্ধনে আবদ্ধ হই।’
প্রেম বাচ্চার মতো গুটিয়ে নিয়ে পুনরায় বলল, তুমি জানো, আমি পাপি হয়ে জন্মাইনি।
আমি একসময় বিশ্বাস করতাম, ভালোবাসা মানুষকে খোদার কাছাকাছি নিয়ে যায়। কিন্ত এখন বুঝি—খোদা হয়তো হাসেন যখন কেউ এমনটা ভাবে। তবে তোমায় ভালোবেসে আমি আবার বিশ্বাস করতে চাই৷ কেবল তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। আমাকে দোষ দিও না…
আমি ভালো ছিলাম, সত্যি বলছি,
কিন্তু এই পৃথিবী আমাকে ভালো থাকতে দেয়নি। ভালোবাসেনি, আপন করে নেয়নি তৃষা।’
তৃষার চোখের জল প্রেমের সঙ্গে বেগ পায়। কথায় আছে না, “মানুষ পাপ নিয়ে জন্মায় না, তবে পাপ নিয়ে মৃত্যু বরণ অবশ্যই করে।” তবে পাপ ছাড়তেও কিন্তু পারে। সে প্রেমকে বুকের থেকে ছাড়িয়ে নিজের চোখের দিকে তাকাতে বলল, ‘এই যে আমি আছি তো। আমি আপন করেছি তো, আমি ভালোবাসি তো। পৃথিবীকে ভুল প্রমাণ করে দিব। খোদা আবার মুচকি হাসবে প্রেম, আমাদের সুন্দর সমাপ্তি দেখে এবার তিনি আবার মুচকি হাসবেন। প্রেম
কথা বলল না। কেবল তৃষার বুকে জড়িয়ে রইল। হঠাৎ বলল,’ ভালোবাসি তোমায়।’ তৃষা চোখের জল আড়াল করে জিজ্ঞেস করল, ‘কতখানি?
‘হিসাব চাইছো? ভালোবাসারও সংখ্যা আছে? পরিমাপ আছে? আচ্ছা তবুও বলছি, আমি তোমায় ভালোবাসি ঠিক ততটুকু যতটুকু অপেক্ষা মরুভূমির ক্লান্ত পথিক আকাশ পানে চেয়ে বৃষ্টির জন্য করে। আমি তোমায় ততখানি ভালোবাসি যতখানি নদী তার কূলকে ভালোবেসে দিনের পর দিন কিনারা ছুঁয়ে আবার ফিরে যায়, তবু প্রতিবার ছোঁয়ার সময় ভাবে, ‘আজই শেষবার।’
‘তাহলে আপনি কি কখনও আমাকে ছাড়বেন?’
প্রেমতৃষা পর্ব ৩৯
‘কভু নয়। তুমি যদি সূর্য হও, আমি হবো ছায়া, তুমি যেদিকে যাবে, আমি অন্ধকার হয়ে তোমার পায়ের নিচে প্রতিবার মিশে যাব। আমি আলো চাই না, আমি শুধু তোমার অস্তিত্ব চাই।’ প্রেম মাথা তুলল। তৃষার চোখের কোণের জলের দিকে তাকালো। কেমন যেন নেশা নেশা লাগছে। অত্যাধিক গরমও সেই সঙ্গে লাগছে। সে হাত দিয়ে তৃৃষার চোখের জল ছুঁয়ে দেখল। অতঃপর চোখের কোণে চুমু এঁকে দিলো। তৃষা তখনো নিশ্চুপ। হঠাৎ প্রেম বলে উঠল, ‘আমার শার্টের বোতমটা খুলে দেবে?’ তৃষা কথা বাড়ালো না। বোতামে হাত লাগাতেই প্রেম বাতি বন্ধ করল। তৃষাকে অন্ধকারে কাছে টেনে বলল, ‘আবারও বলছি ভালোবাসি।’