প্রেমতৃষা পর্ব ৪১

প্রেমতৃষা পর্ব ৪১
ইশরাত জাহান জেরিন

পাশের রুম থেকে হঠাৎ একটা রমণী এসে ফারাজের পাশে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করল ” কি হয়েছে?” পুরোটা কথা শেষ করার আগেই তৃষার দিকে ফিরে চাইলো। তৃষা তখনো ফারাজের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ সেই রমণী তৃষাকে দেখে বলে উঠল, “আরে তৃষা না? তুমি এখানে?”
তৃষা তার দিকে তাকালো একবার। শেষে চোখটা বন্ধ হয়ে এলো। তাল সামলাতে না পেরে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। যখন জ্ঞান ফিরল তখন সে তার রুমের বিছানায় শুয়ে আছে। সে চোখ ধীরে ধীরে খুলল। চারদিক ঝাপসা। সাদা দেয়ালের ভেতর আলো ছায়ার চলাচল। মাথাটা ভারী লাগছে। বুকের ভেতরটা কেমন শূন্য, গলার ভেতরটা শুকনো হয়ে আসছে। কিছুটা সময় পর সে টের পেল, নিজের নিঃশ্বাসের আওয়াজটা কেমন কাঁপছে। হঠাৎ কেউ তার নাম ধরে ডাকল,

“তৃষা…” স্বরে কাঁপন। সে চোখ পিটপিট করে তাকায়।
তার সামনে বসে আছে প্রেম। দু’চোখ ভেজা, ঠোঁটের কোণে একরাশ অসহায়তা। তার হাতটা আলতো করে তৃষার মাথার কাছে রাখা। তৃষা একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখের জল ধীরে ধীরে গড়িয়ে আসল কপাল বেয়ে বালিশে। সে হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে, “তুমি… তুমি সত্যি আমার সামনে? আমি মরিনি? এটা… এটা স্বপ্ন না তো?”
প্রেমের বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। সে আর সামলাতে পারে না। তৃষাকে টেনে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে। তৃষা তখন তার বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে কাঁদছে। প্রেমের কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে, “না তৃষা… স্বপ্ন না। আমি এখানে আছি। তোমার কিছু হয়নি। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” না প্রেম ওই লোক আমাকে মেরে ফেলবে? ওই লোক তুমি নও তো?!” তৃষা প্রেমকে নিজের কাছে টেনে গন্ধ শুঁকে বলল, ” হ্যাঁ সেই সুগন্ধি। এই প্রেম, তুমি খুনি নও তো? এই, এই প্রেম শুনছো?”
প্রেম ডাক্তারের দিকে তাকাতেই ডাক্তার এগিয়ে আসে। তৃষাকে একটা ঘুমের ইনজেকশন দেয়। তৃষা ঘুমিয়ে পড়তেই প্রেম ঘুমন্ত তৃষার কপালে চুমু খায়, হাত বুলিয়ে উঠে বাইরে যায়। দরজার সমানে একজন রমণী বসে আছে। সঙ্গে একটা লোক। সে আপাতত ফোন চালাতে ব্যস্ত। প্রেম বাইরে আসতেই রমণী দাঁড়িয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে প্রেমকে জিজ্ঞেস করল, ‘তৃষা এখন ঠিক আছে? ভেতরে যেতে পারব?”
“হুম।” হঠাৎ পাশ থেকে লোকটি বলল, “এই ছোটলোক বউ সব কিছুতেই সাবানার লাইট ভার্সন হয়ে যায়। এই বউ জলদি কাজ সেরে রুমে আসো। মেয়েটাকে রেখে এসেছো, ওই ব্যাটা অভ্রের ঘরের কুদ্দুসের নজর এমনিতেই আমার ফিজার দিকে।”

চিত্রা ফারাজের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘অভ্র ভাইয়ের ছেলে আর্দ্রের বয়স মাত্র ছয় মাস। সে আমাদের ফিজার দিকে নজর দিবে কি করে?”
“নজর দেওয়ার বয়স লাগে না।”
চিত্রা প্রেমের দিকে একবার তাকালো। প্রেম সিটে বসতেই সে চিত্রাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ আমার বউকে সাহায্য করার জন্য।”

পাশ থেকে ফারাজ মুখ বাঁকিয়ে বলল, “এক হাজার, একশত এক নাম্বার হানিমুনটা করার প্রস্তুতিই নিচ্ছিলাম। আমার বউটা তোমার বউকে সাহায্য করতে গিয়ে এখন যে বায়োলজি ক্লাসে ডাব্বা মারবে তাতে কি খুব ভালো হবে?” ফারাজ আর কিছু বলার আগেই চিত্রা চোখ রাঙায়। তাতে ফারাজ চুপ করতেই চিত্রা ভেতরে চলে যায়। ফারাজ প্রেমের পাশে বসে পড়ল, ” না মানে বউ তো। তার ওপর কিছু বলাও যায় না। বউয়ের ওপর যুক্তি খাটানোও এক প্রকার ছোটলোকি কারবার শালা।”
প্রেম ফারাজের দিকে তাকাল, “ইয়ে মানে আপনার দেখা যাচ্ছে।”
“হোয়াট ডু ইউ মিন বাই দেখা যাচ্ছে?” ফারাজ নিচের দিকে তাকালো। তাতেই প্রেম বলল, ” দেখা যাচ্ছে আপনার মানসিকতা বড়োলোকি। যাকগে ভালো।”

তৃষা চিত্রাকে দেখে বের হয়ে রুমে চলে গেল। সেদিন তৃষার সঙ্গে যখন ফোনে কথা হয়েছিল তখন তৃষা বলল সে কক্সবাজারে আসবে। তাই চিত্রা ঠিক করল, এবার তাকে একটা সারপ্রাইজ দিবে। তাই বলে দিলো সে আসছে না। তবে কক্সবাজার আসতে না আসতেই ঘটে গেল বিপর্যয়। তৃষা যে এই হোটেলেই উঠবে কে জানত? আর তাছাড়া কি করে তাদের রুমে এসে পড়ল? ফারাজ বলল, আচমকা এসেছে। তবে চোখ-মুখের অবস্থা ভালো ছিলো না। তাছাড়া বাহুতে ক্ষত। চিত্রা একটু ভেবে ভেতরের রুমে যায়। আয়েশা এসেছে। মেয়েটা বাচ্চা সামলাতে পারে না। আর্দ্র কান্না করছে তা দেখে অভ্র বলে উঠল, ‘ঘরনী, বাচ্চা একটাই সামলাতে পারছো না, তাহলে ছেলেটার জন্যে বোন কি করে আনব? তোমার কষ্ট হয়ে যাচ্ছে গো। এত কষ্ট মেনে নিতে পারছি না। এক কাজ করি বাচ্চাটা সামলানোর জন্য আরেকটা বিয়ে করি?”

“সরকার ভাইয়ের বাচ্চা!”
“বউ ভুলে মুখ দিয়ে বের হয়ে গেছে।”
“তোমার ভুল পকেটে ভরে রাখো। এই চিত্রা আপা আর্দ্রকে একটু তোমার কাছে রাখো তো, আমি ওর বাবাকে বিয়ে করার শখ মিটিয়ে দিয়ে আসি।”
“ভাবী বাঁচান।”
” দোয়া করলাম ভাই, বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে।” বলেই চিত্রা হাসল। আর্দ্রকে কোলে নিয়ে ফারাজের কাছে চলে গেল। ওরা বাবা-মেয়ে কি করছে আল্লাহ ভালো জানে।

জ্ঞান ফেরার পরেও তৃষা কিছুক্ষণ পাগলামি করেছে। শেষে অনেক কষ্টে প্রেম তাকে বুঝিয়েছে কোনো কিছু হয়নি। সব ঠিক আছে। হয়তো ধারালো কোনো কিছুর সঙ্গে লেগে হাতটা কেটে গেছে। রুম নাম্বার ১০২ এ নিয়ে গেল। সেখানেও সব কিছু ঠিক আছে। ওই দৃশ্য দেখে তৃষা কতক্ষণ হা করে ছিল। কি দৃশ্য দেখেছিল আর কি হলো? তাহলে সব কি ভ্রম ছিল? কিছু মনে পড়ছে না কেন? সারাদিন রুমে শুয়ে কাটিয়েছে। কিচ্ছু ভালো লাগছিলো না। শেষে বিকেলে সবাই মিলে বাইরে যায়। চিত্রার পরিবারও ছিল। তবে ফারাজকে দেখে মনে হচ্ছিলো সে কোনো কাজেই এখানে এসেছে। ব্যস্ত মানুষ, কত কাজ! তার আরেকজনের পেছনে সময় দেওয়ার সময় আছে?

সমুদ্র তখন বিকেলের নরম রোদে ঝিলমিল করছে। আকাশটা হালকা গোলাপি আর কমলার মিশ্রণে রঙ করা। একটা শান্ত অথচ আবেগভরা সন্ধ্যা। বাতাসে লবণাক্ত গন্ধ, ঢেউগুলো ধীরে ধীরে তীর ছুঁয়ে ফিরে যাচ্ছে। তৃষা চুপচাপ বসে আছে ভেজা বালির ওপর। চুলে বাতাস লাগছে, চোখে অন্যমনস্কতা। ওর দৃষ্টি কোথাও নেই। যেন নিজের ভেতরের গভীর অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। সেই অন্ধকার থেকে ফিরিয়ে আনতে প্রেম নীরবে পাশে এসে বসে। কিছু না বলেই সে একটা ছোট কাঠের বক্স তৃষার হাতে তুলে দেয়। তৃষা অবাক হয়ে তাকায়। খুলে দেখে ভেতরে একটা পুরোনো পাথরযেটা দেখতে অনেকটা হার্ট-শেপড, সমুদ্রের ঢেউয়ে ঘষে মসৃণ হয়ে গেছে। প্রেম হাসে, বলে,

“ সুন্দর জীবনের জন্য কখনো কখনো মনকে পাথরের মতো শক্ত করতে হয় । মনে রেখো ঢেউ যতই আঘাত দিবে, তোমার সৌন্দর্য ততই বাড়বে।” তৃষার চোখে জল এসে যায়। প্রেম আস্তে করে তার কাঁধে হাত রাখে।
“তৃষা, আমি সবসময় তোমার পাশে আছি। সমুদ্রের বুকে যেমন ঢেউ থাকে, তেমন ভাবেই আমি আমৃত্যু তোমার পাশে থাকব।” তৃষা কিছু বলল না। শুধু ধীরে ধীরে মাথাটা প্রেমের কাঁধে রাখে। ঢেউয়ের শব্দ তখন তাদের নীরবতার ভেতর ছন্দে ছন্দে সুর তুলল । প্রেম আস্তে করে তৃষার চুলে হাত বুলিয়ে বলে, “চোখ বন্ধ করো।” তৃষা চোখ বন্ধ করল প্রেম পকেট থেকে ছোট একটা কাঁচের বোতল বের করল, যার ভেতরে জ্বলজ্বল করছে ছোট্ট ফ্লোরোসেন্ট আলো৷ মিনিয়েচার ফেয়ারি লাইট। সে বলল, “দেখো, এই আলোটা তোমার জন্য। অন্ধকার যতই হোক, এর মতো একটা আলো তোমার ভিতর আলোকিত করতে সর্বদা থাকবে। তোমার ভয়কে এই আলো ছুঁয়ে যাক।”

তৃষা চোখ খুলে তাকায়। ওর ঠোঁটের কোণে এক টুকরো নিঃশব্দ হাসি ফুটে ওঠে।প্রেম তখন পুনরায় বলল, “এবার তুমি চাইলে আমরা হাঁটতে পারি, শুধু ঢেউয়ের শব্দে, কোনো কথা নয়। আজ আর কোনো ব্যথা নয়, শুধু সমুদ্র আর আমরা।”
তারা দু’জন ধীরে ধীরে হাত ধরে হাঁটতে শুরু করল। সূর্য তখন দিগন্তে ডুবে যাচ্ছে, আর সেই অস্তরাগে তৃষার মুখে ফিরে আসছে আলো, যে আলো জীবন থেকে বার বার সরে সরে যাচ্ছিলো। দু’জনে মিলে কিনারার আবেশে হারিয়ে যায়। হঠাৎ তৃষার খুব টক খাওয়ার ইচ্ছে হলো। প্রেম এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল কোনো আচার বিক্রেতা আছে নাকি। শেষে প্রেম উঠে দাড়িয়ে বলল, ‘একটু অপেক্ষা করো। দেখছি আমি৷ ওই যে ওদিকে আছে।”

“আচ্ছা।”
প্রেম ওঠে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা বেলুন বিক্রেতা ছোট্ট মেয়ে দৌড়ে এলো তৃষার কাছে। তৃষা মেয়েটিকে বলল, ‘উঁহু কিনব না।’ সেই কথা শুনে মেয়েটি বলল, না আপা একখান চিঠি দেবার আসছি।”
“চিঠি?”
“হয়।”
“কে দিলো?”

প্রেমতৃষা পর্ব ৪০ (৩)

“ওই যে ওইখানে দাড়াইয়া আছে ভাইয়াডা।” তৃষা মেয়েটির ইশারাকৃত স্থানে তাকাতেই দেখল ভিড়ের মাঝে কেউ নেই। সে কিছু না ভেসে কাগজের ভাজ খুলতেই দেখল তাতে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। বড় করে লেখা আছে,” মানুষের মাংসের বিরিয়ানি খাব। তোমার কোন অংশের মাংস বেশি সুস্বাদু?” তৃষা এবার ঘাবড়ে গেল। বাচ্চা মেয়েটা চলে গেছে। আশপাশে কত মানুষ। তৃষা মেয়েটির দেখানো স্থানে পুনরায় তাকাতেই দেখল দূরে দাঁড়িয়ে আছে কালো হুডি পরহিত এক লোক। মুখটা খোলা। কোনটি কেবল তাকিয়ে আছে তার দিকে, কে এই লোক? তার উদ্দেশ্য কি?

প্রেমতৃষা পর্ব ৪২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here