প্রেমতৃষা পর্ব ৪২
ইশরাত জাহান জেরিন
ভোর তখনও পুরোপুরি হয়নি। আকাশের গায়ে ফিকে ধূসর মেঘের ওপর প্রথম সূর্যালোকের কমলা ছোঁয়া পড়ছে। দিগন্তজোড়া সমুদ্র যেন এখনো ঘুমের ভেতর। ঢেউ আসে, ফিরে যায়, আবার আসে, যেন সে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। সবকিছুই কেমন একটা ধোঁয়াটে। হাওয়া, আলো, বালির ওপর ছড়ানো ছায়া, এমনকি মানুষের মুখও। তৃষা হালকা নীল শালটা কাঁধে জড়িয়ে বালির ওপর বসে আছে। তার চোখের নিচে কালচে ক্লান্তি, তবু আজকে সেটি নরম দেখাচ্ছে। রাতে ঘুমানোর চেষ্টা করেছিল। তবে মাঝ রাতে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখল। তারপর আর ঘুম এলো না। নিজেও ঘুমাতে পারল না, প্রেম কেউ জাগিয়ে রাখল।
তৃষার সামনে কফির কাপ। ধোঁয়া উঠছে, কুয়াশার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। দূরে, খুব দূরে, সমুদ্রের কিনারায় একাকী দাঁড়িয়ে আছে প্রেম। কালো টি-শার্ট, ভেজা পায়ের ছাপ, হাতে একটা পুরনো ক্যামেরা। তৃষা তাকাতেই প্রেম ঝুঁকে ক্যামেরায় কিছু ছবি ক্লিক করে। তারপর হঠাৎই ফিরে তাকায়। দৃষ্টিটা সোজা তৃষার চোখে এসে ধাক্কা খায়। তৃষা হাসে না, শুধু ঠোঁটের কোণে খুব সামান্য একটু নড়াচড়া। প্রেমের ঠোঁটেও উঠে আসে একটা অদ্ভুত হাসি। ধীরে ধীরে প্রেম এগিয়ে আসে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বালিতে হাঁটার শব্দটা এত কোমল যে মনে হচ্ছে প্রতিটি পদক্ষেপ সমুদ্রের তরঙ্গকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সে এসে তৃষার পাশে বসে পড়ল। একটু নীরবতা। কেবল ঢেউয়ের শব্দ, আর কফির ধোঁয়া কথা বলল নিজেদের মধ্যে। তৃষা ধীরে প্রেমকে বলল, “এখানে সকালটা অন্যরকম লাগছে।” প্রেম তাকালো না, শুধু হালকা স্বরে বলল,
“কারণ সূর্য এখনো জানে না, তুমি জেগে উঠেছো।”
তৃষা হেসে ফেলল “সবসময় এমন কথা বলেন কেন?”
“কারণ সাধারণ সকাল তো আর তোমার সঙ্গে মানায় না।” তৃষা কিছু বলল না। কফির কাপটা তুলে নিলো, ধোঁয়া তার মুখের সামনে নাচছে। প্রেমের চোখ সেই ধোঁয়ার আড়ালে তার মুখে পড়ল। একটা মৃদু হাওয়া এসে তৃষার চুলগুলো উড়িয়ে দিলো, এক ঝলকে কফির গন্ধ আর সমুদ্রের নোনতা হাওয়া মিশে যাচ্ছে। সূর্য তখন ধীরে ধীরে উঠে আসছে। আলো পড়ছে তৃষার গাল বেয়ে, চোখে এক মোলায়েম ঝিলিক।
প্রেম সেই আলো দেখতে দেখতে বলল, “তোমার মুখে সূর্যের আলো পড়তেই মনে হলো আজকের সকালটা তোমার সৌন্দর্য দেখে গান গাইছে।”
তৃষা হাসল, “আপনি আবারও কাব্যিক হয়ে গেলেন?”
“না, কেবল সত্যিটা বললাম।”
তৃষা তার দিকে গভীরভাবে তাকালো। তার চোখে কিছু কথা জমে আছে, যা বলা হয়নি কখনও। তবুও প্রেম বুঝে যায়। কারণ তার এই নীরবতাই সবচেয়ে জোরালো উচ্চারণ। কয়েক মিনিট এভাবেই কেটে যায়।
দু’জন চুপচাপ বসে থাকে, কেউ কিছু বলে না।
তৃষা কফির শেষ চুমুক নেয়, তারপর কাপটা বালির ওপর রাখল। বালিতে আঙুল দিয়ে একটা নাম লিখল।“প্রেম”। তারপর ঢেউ এসে মুছে দিলো সেটা।
প্রেম দেখে, একটু হেসে বলল, “তুমি জানো, নামটা মুছে গেলেও সমুদ্র সেটা ধরে রাখে। ” একটু থেমে সে যোগ করল, “তুমি কি কখনও ভেবেছো, ভালোবাসা হয়তো সূর্যোদয়ের মতো? শুরুটা নিঃশব্দ, আলোর আগমনের আগে একরাশ কুয়াশা, তারপর আস্তে আস্তে সবকিছু দৃশ্যমান হয়ে ওঠে?”
তৃষা চুপ থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “হয়তো তাই। হয়তো সেই কুয়াশার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে ভালোবাসার আসল রূপ।” তৃষা তাকিয়ে থাকে দিগন্তের দিকে। সূর্য এখন পুরোপুরি উঠে গেছে।
আলো ছড়িয়ে পড়েছে সাগরের ঢেউয়ের গায়ে, বালির ওপর, তাদের মুখে। তবুও তৃষার মনে হয়, সকালটা এখনো অর্ধেক জেগেছে। প্রেমের হাত আলতো করে তৃষার হাত ছুঁয়ে যায়। তৃষা চমকে ওঠে না, কেবল আঙুলের ভেতর আঙুল মেলিয়ে নেয়। তাদের হাতের ফাঁকে জমে থাকা নরম উষ্ণতা যেন পুরো সকালটাকে জাগিয়ে দেয়। তৃষা বলে, “যদি কখনও এই মুহূর্তটাকে ভুলে যাই?” প্রেম শান্ত গলায় বলে, “তাহলে চোখ বন্ধ করবে, দেখবে মুহূর্ত ফিরে এসেছে।” তৃষা চুপ করে থাকল। তার মুখে সূর্যের আলো, চোখে সাগরের প্রতিফলন। দূরে একটা ছোট নৌকা যাচ্ছে, ঢেউয়ের ফেনা বাতাসে উড়ে এসে তাদের মুখে লাগে।
প্রেম হঠাৎ ক্যামেরা তোলে। ক্লিক করে একটা মুহূর্ত চিরকালের জন্য বন্দি করে ফেলে। তৃষা বলল,,
“ছবি তুললে?”
“হ্যাঁ, কারণ সময় থামানো যায় না, কিন্তু তার ছায়া ধরা যায়।”
তৃষা হাসল। তার হাসি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় বাতাসে, কুয়াশায়, সমুদ্রের গর্জনে। সবকিছু মিলেমিশে এক অদ্ভুত লহমা তৈরি হয়। সূর্য এখন উঁচুতে।
তবুও তাদের চারপাশে যেন এখনো সেই প্রথম আলোর মায়া রয়ে গেছে। প্রেম হাত ধরে বলল,
“চলো, একটু হেঁটে আসি?”
তৃষা বলল, “হাঁটব কোথায়?”
“যেদিকে সূর্য গেছে।”
তারা হাঁটতে থাকল, একসাথে।
তাদের পায়ের নিচে বালির ওপর পড়ে থাকে ছায়া দু’জনের, একটার ভেতরে আরেকটা। তৃষা একবার পেছনে তাকায়। ওখানে, বালির ওপর এখনো হালকা করে লেখা আছে তার নামের কিছু ভাঙা অক্ষর।
ঢেউ এসে আবার মুছে দিচ্ছে। তৃষা শক্ত করে প্রেমের হাত ধরে তার কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে হাঁটল। হঠাৎ কি একটা ভেবে জিজ্ঞেস করল, ” আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেন?”
প্রেম তৃষার কপালে চুমু দিয়ে গুনগুনিয়ে গানের স্বরে বলল,
~ কঠিন
তোমাকে ছাড়া একদিন
কাটানো এক রাত, বাড়াও দুহাত
হয়ে যাও আজ বাধাবিহীন~
সকাল শেষ হয়ে দুপুর গড়িয়ে এসেছে।
আকাশে তখন সাদা। সোনালি আলোর বিস্তার। সূর্য মাথার ওপরে, কিন্তু বাতাসে লবণমিশ্রিত একটা ঠান্ডা ছোঁয়া এখনো রয়ে গেছে। সমুদ্র তখন জেগে উঠেছে সম্পূর্ণ। তৃষা হাঁটু গেড়ে বসে আছে বালুর ওপর।
তার পাশে প্রেম, বালু দিয়ে ঘর বানানোর চেষ্টা করছে।
তৃষা হাসছে, “আপনি তো পুরো বাচ্চা!”
প্রেম চোখ না তুলে বলল, “না, আমি তোমার ভবিষ্যত বাচ্চার বাবা।” তৃষা হেসে ফেলল। তার হাতের মুঠোয় ভেজা বালু, সে তা প্রেমের মাথায় ছুঁড়ে দিল।
প্রেম অবাক হয়ে চুল থেকে বালু ঝাড়তে ঝাড়তে বলে,
“ওহ, যুদ্ধ চাও বুঝি?”
“হ্যাঁ! এখন যুদ্ধ।” প্রেম মুঠো ভর্তি করে বালু নিতেই তৃষা দৌড় দিলো। প্রেম তার পেছনে ছুটতে ছুটতে বলল, “এবার ধরতে পারলে ফেরার সময় দাদার বংশধর নিয়ে ফিরব রে তৃষার বাচ্চার।”
“ধরে তো দেখান মিস্টার হাইব্রিড করলা।”
“শালীর ঘরের বউ থাম।”
তৃষা থামলো না। দৌড়াতে দৌড়াতে পেছন ফিরল। তারপর গতি আরো বাড়িয়ে খিলখিলিয়ে উঠল।
ওদিকে অংকুর ও শিমলাও বালুর ঘর বানাতে ব্যস্ত।
অংকুরের মাথায় রোদ পড়েছে, ঘাম গড়িয়ে পড়ছে গলায়, তবু সে অমনোযোগে বালুতে কাঠি গেঁথে ছোট ছোট দেয়াল তুলছে। শিমলা একদিকে নারকেলপাতা এনে সাজাচ্ছে তাদের “বালুর ঘর।”
সে হেসে বলল, “এই ঘরে আমি থাকতে পারি, যদি পাশে তুমিই থাকো।”
অংকুর চুপচাপ, হাসি থামিয়ে তাকায় শিমলার দিকে।
তার চোখে সোনালি আলো। রোদ পড়ে তার গালের পাশে একরাশ আলোর রেখা তৈরি করেছে।
অংকুর ধীরে বলল, “তাহলে ঘরটা ভাঙতে দেব না।”
শিমলা বলল, “ঢেউ তো তবু আসবে।”
“আসুক। আমি আবার বানাব।” তাদের কথা শুনে দূর থেকে প্রেম মুখ বাঁকিয়ে বলে, ” শালা ঘর বানানো বাদ দিয়ে তোর ভাবীকে বোঝা। বংশের বাত্তি শালীর জন্য জ্বালাতি পারছি না। বার বার সুইচ অফ করে দিচ্ছে। শালীর ঘরের বউয়ের জন্য ওপরে বসে বসে বাচ্চাগুলো আমার অভিশাপ দিচ্ছে।” প্রেমের কথা শুনে সবাই হেসে ওঠে। হাসির মধ্যে ঢেউ এসে ঘরটার এক পাশ ভেঙে দিল। তা দেখে শিমলা বলল, “দেখলে?”
অংকুর শান্তভাবে বলল, “ঘর ভাঙলেও, হাতটা তো এখনো ঠিকঠাক আছে? আবার বানাবো সমস্যা নেই।”
শিমলা মৃদু হেসে মাথা নিচু করে বলল, “তুমি ঘর বানাও, ঘর ভর্তি তোমার বাচ্চা মানুষ করার দায়িত্ব আমার। ” সেই কথা শুনে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তৃষাকে প্রেম মুখ বাঁকিয়ে বলল, “তৃষার পা ধোঁয়া লিকুইড খেয়ে কিছু শিখ শালীর বউ।”
তৃষা মুখ বাঁকিয়ে পুনরায় একটা দৌড় দিলো। অভ্র আর আয়েশা একটু দূরে দাড়িয়ে, দু’জনেই পানিতে। একেবারে অল্প পানিতে। হাঁটছে তারা মৃদু কিনারার সেই জলে। বাতাসে আয়েশার চুল উড়ছে, সমুদ্রের ফেনা তার হাঁটুর কাছে লেগে আছে।
অভ্র হাত ছুঁইয়ে দেয়, বলে, “ভয় লাগছে না?”
“সমুদ্রের ভয় নেই, কিন্তু তোমার চুপ থাকা ভয় পাই।”
অভ্র কিছু বলল না। দূরে তাকিয়ে থাকে। ঢেউয়ের দিকে, যেখানে সূর্যের আলো ভেঙে ঝিকমিক করছে।
তারপর ধীরে বলল, “চুপ থাকলে যদি তোমার চোখে আমার কথা শোনা যায়, তাহলে আর কিছু বলার দরকার কী?” আয়েশা তার হাত চেপে ধরল।
তাদের চারপাশে নোনাজল উড়ছে, গাঙচিল উড়ছে মাথার ওপর দিয়ে। আয়েশা অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, ” অনেক ভালোবাসি তোমায়।”
“তাহলে আরো চারটা বিয়ে করতে দাও,প্রমাণ চাই আমার।”
আয়েশা রেগেমেগে একাকার সে কথা শুনে। ক্ষেপা কণ্ঠে বলল, “সরকারের বাচ্চার, তোর খাবারে থু দেব, লুঙ্গিতে তেলাপোকা ছাড়ব। রাতে বাথরুমে শোয়াবো।”
“এই ঘরণী মাফ চাই বউ, আর ভুলবাল কথা মুখ থেকে বের হবে না।” অভ্রের কথা শুনে পাশ থেকে ফারাজ বলল, “ছোটলোক মানুষের সঙ্গে ছোটলোকি কারবারই হবে। দাড়া ভাই এবার ঝমেলার সঙ্গে তোর একটা সেটিং করিয়েই ছাড়ব।”
“ভাই পেছনে আমার গুলি মারেন বন্দুক ঢুকিয়ে। তাও এইসব বইলেন না।” ফারাজ মুখ বাঁকিয়ে চিত্রার কাছে চলে গেল। ফারাজের চোখে সানগ্লাস, শরীরে সমুদ্রের জল টলমল করছে। সে খালি গায়ে সমুদ্রের জলে নেমেছে। চারপাশে কত মেয়ে মানুষ। ফারাজের শরীরের দিকে তাকিয়ে আছে। চিত্রার রাগ হচ্ছে খুব। বেহায়া মেয়েলোক। বিবাহিত পুরুষের দিকে নজর দেয়। মন তো চায় জলে চুবিয়ে মারতে সব গুলোকে। ” এই হয়েছে অনেক ভিজেছেন। উঠে পড়ুন এইবার।”
“আরে আগুন সুন্দরী এখনো আবার সুরক্ষা বস্ত্রও ভিজেনি। আর তুমি বলছো উঠে আসতে?”
“আর ভেজানোর দরকার নেই। উঠুন। মেয়ে মানুষ আপনাকে নেংটা দেখে জ্বালা মেটাচ্ছে, হা করে তাকিয়ে আছে এসব দেখতে খুব ভালো লাগছে?”
“কোন শালী নজর দেয়? ওরা কি জানে না দুনিয়ার সব নারীর আব্বা লাগি। আমি খালি আমার বউয়ের স্বামী।”
“বউয়ের তো স্বামীই হবেন। নানা তো আর না? এখন ঢং না করে উঠে আসুন।”
ফারাজ উঠে এসে চিত্রার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “চলো রুমে যাই। গরম গরম লাগছে। গরম লাগলে কি করি আমি জানো না?”
প্রেমতৃষা পর্ব ৪১
“ছি আপনি এত মানুষের সামনে এসব কি বলছেন?”
ফারাজ অসহায়ের মতো তাকালো চিত্রার দিকে। বলল, “গরম লাগলে এসির বাতাস খাই। সেটাই বলেছি।”
“উফস ওইটা? আমিও না।”
“আবুলের নানতি যা গিয়ে সমুদ্রের নোনা জল নিয়ে কালা মাইন্ডটা পরিষ্কার করে সাদা বানিয়ে আন। হুহ!”