প্রেমতৃষা পর্ব ৪২ (২)

প্রেমতৃষা পর্ব ৪২ (২)
ইশরাত জাহান জেরিন

রাতের সমুদ্রের নিজস্ব ভাষা আছে। দিনের চিৎকার থেমে গেলে, যখন ঢেউয়ের গর্জন আর বাতাসের গুঞ্জনই একমাত্র শব্দ হয়ে থাকে, তখন সমুদ্র ধীরে ধীরে নিজের গল্প বলতে শুরু করে। রাতের কক্সবাজার আজ থেমে আছে শুধুই প্রেমতৃষার জন্য। চাঁদের আলো নেমে এসেছে সমুদ্রের জলে, ঢেউয়ের মাথায় রুপোলি ফেনা ঝিকিমিকি করছে তাদের চোখের প্রতিচ্ছবির মতো। সমুদ্রতটে সাজানো এক ছোট কাঠের ডেক। তার চারপাশে ফুল, মালা আর সারি সারি মোমবাতির নরম আলো জ্বলজ্বল করছে। বাতাসে মিশে আছে সমুদ্রের নোনাভাব আর সাদা লিলির সুবাস। তৃষা ধীরে ধীরে হেঁটে আসে।

তার নরম সাদা পোশাকে বাতাসে দোল করছে। প্রিমরোজ ফুলের জুয়েলারিতে তাকে লাগছে দারুণ। মনটা যদিও খারাপ। কারণ চিত্রা সহ বাকিরা চলে গেছে। তারাও আর এক দু’দিন থেকে চলে যাবে। সুন্দর সময় কত জলদি ফুরিয়ে যায় তাই না? ঠিক তখনই টেবিলের অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকে প্রেম তার দিকে তাকায়। প্রেমের চোখ তৃষার ওপর থেকে সরছে না। তৃষাকে কোনো অংশে ডিজনি প্রিন্সেসের থেকে কম লাগছে না। তৃষাও প্রেমের দিকে তাকায়। সাদা শার্টের ওপর হালকা ধূসর ব্লেজার, হাতের ঘড়িতে কেমন যেন একটা চাঁদের আলো পড়ে চিকচিক করছে। তার বাদামী রঙের ফক্সআই গুলো নেশালো হায়নার মতো দৃষ্টিপাত করেছে তৃষার ওপর। তৃষা তাকিয়ে থাকে, কিছু বলার আগেই তার ঠোঁটের কোণে একটা নরম হাসি জমে যায়। প্রেম চেয়ার টেনে বলল, “মাই লেডি।” তৃষা হেসে বসল। বাতাসে মোমের শিখা কেঁপে ওঠছে। টেবিলে সামুদ্রিক খাবার, হালকা সালাদ, আর একজোড়া ওয়াইন গ্লাস।
কোনো অতিরিক্ততা নেই, শুধু আন্তরিকতা, যেমন তাদের ভালোবাসা। তৃষা বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এই জায়গাটা স্বপ্নের মতো।”
প্রেম মৃদু হাসল, “স্বপ্ন না হলে ভালোবাসা কেমন?” প্রেম তৃষাকে খাবার সার্ভ করতেই বলল, ‘এখন তুমি পেট ভরে খাবে, তারপর আমার পালা।’
‘মানে?’
‘কিছু না খাও।’
‘আপনি খাবেন না?’
‘খাওয়ার জন্যই তো এত আয়োজন।’
ঢেউয়ের ছন্দে ডিনার এগিয়ে চলল । পাশেই দু’জন লোক ভায়োলিন বাজাচ্ছে। চারপাশটা সাজানো হয়েছে হলুদ বাতি দিয়ে। কি দারুণ লাগছে। ডিনার শেষে প্রেম উঠে দাঁড়ায়। দূরে বালির ওপর রাখা একটা ছোট পিয়ানো, চারপাশে গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো, আর পাশে সারি সারি মোমবাতি। সে তৃষার দিকে তাকিয়ে বলল, “আজ তোমার জন্য কিছু বাজাব।”
তৃষা হালকা অবাক হয়ে হাসে, “তুমি পিয়ানো বাজাও?”

প্রেম বলে, “এই তো এমনে এমনে শেখা।” সে পিয়ানোর সামনে বসল, আঙুল ছোঁয়ালো পিয়ানোতে। সমুদ্রের গর্জনের মাঝখানে ভেসে উঠল সুর। নরম, ধীর, ভালোবাসায় ভেজা একটা মেলোডি। তৃষার সাদা গাউনটা অত্যাধিক লম্বা হওয়ায় বাতাসে সব কেমন যেন উড়ছে। তৃষা পেছন থেকে প্রেমের কাঁধে তার হাতটা রাখল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনল সেই সুর। তার চোখে মোমের আলো ঝিকিমিকি করছে। মাঝে মাঝে বাতাসে তার চুল উড়ে এসে প্রেমের মুখ ছোঁয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে সুরটাও ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে ঢেউয়ের আওয়াজে, রাত আরও গভীর হয়। সুর থেমে গেলে প্রেম ধীরে ধীরে উঠে আসে, তার হাত বাড়িয়ে দেয়।

“নাচবে?” তৃষা হেসে বলল, “সুর তো শেষ।”
প্রেম মাথা নাড়ল, “না, এখন শুরু।” পেছনে বাজতে শুরু করল নরম জ্যাজ। স্যাক্সোফোনের হালকা ঝংকার, সমুদ্রের ছন্দে মিশে গেল। তৃষা তার বুকের কাছে এসে দাঁড়ায়, প্রেম তার কোমরে হাত রাখে।
মোমবাতির আলোয়, চাঁদের তলায়, ঢেউয়ের ছন্দে
দু’জনের ছায়া বালির ওপর দুলে ওঠে। তৃষার মাথা ঠেকে থাকে প্রেমের কাঁধে, প্রেমের ঠোঁট ছোঁয়ায় তার চুলে, বাতাসে শুধু একটাই সুর, তা হচ্ছে “ভালোবাসা।”
ঢেউ এসে আলতো ছুঁয়ে যায় তাদের পা, মোমের আলো কেঁপে ওঠে তাঁদের বুক। পাশে সমুদ্রের গর্জন, বাতাসে তৃষার চুল উড়ে এসে প্রেমের মুখে লাগে। প্রেম মৃদু হেসে বলল, তোমার চুলেও কি সমুদ্রের গন্ধ লেগে আছে, বিটারহার্ট?

তৃষা তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর হেসে বলে, “গন্ধটা আমার নয়, তোমার তীব্র স্পর্শের।”
“আজ তোমাকে কিছু বলতে ইচ্ছে করছে।”
“বলুন, থামছেন কেন?”
জানো, এই সমুদ্রটাকে যতবার দেখি, মনে হয় ও আমার মতোই। বাইরে শান্ত, কিন্তু ভেতরে তোলপাড়।
” তাহলে আমি কী?”
“তুমি সেই ঢেউ, যে আমায় প্রতিদিন ছুঁয়ে যায়, আবার ফুরিয়ে যায়।”
তৃষা সমুদ্রের ঢেউয়ের দিকে তাকায়। “ফুরিয়ে গেলে আর থাকি কেমন করে?”
” স্মৃতি তো থাকবে, আর সেটাই সবচেয়ে ভয়ংকর সুন্দর। দূরে আরেকটি ঢেউ ভেঙে পড়ল তীরে।
“আপনি জানেন আমি কখনও কাউকে এত ভয় পাইনি যতটা আপনাকে হারানোর ভয় পাই।”
” আমি তো তোমারই, হারাবে কিভাবে?”
” মানুষ হারায় না, তবে সময় যে তাদের হারিয়ে দেয়।”
” তাহলে সময়কে আটকে রাখো।”
“কী দিয়ে?”
“তোমার একটুখানি ভালোবাসা দিয়ে।”

তৃষা হেসে মাথা নাড়ল, ” আপনি সবকিছুর উত্তর ভালোবাসায় দেন।”
“কারণ সেটাই একমাত্র উত্তর, যেটা ভুল হলেও সুন্দর লাগে।”
“আচ্ছা আপনার জীবনে যদি আমি না থাকতাম?
“তাহলে এই সমুদ্রটা শুধু এক টুকরো জল হতো, ঢেউহীন, প্রাণহীন, আর জীবনটা হতো সেই প্রাণহীন সমুদ্রের মতো।”
“ওই দেখুন মোমবাতিটা নিভে যাচ্ছে প্রেম।”
” নিভে যেতে দাও। আলো থাকলে মুখ দেখা যায়, আর অন্ধকারে হৃদয়।
তৃষা একটু থেমে বলল, কখনো কি ভাবেন, যদি এই মুহূর্তটাই শেষ হয়?”
” না, কারণ তোমার সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্তই অনন্তের মতো।”
” আর যদি অনন্ত শেষ হয়?”

তাহলে আমি আবার জন্ম নেব, শুধু তোমাকে ভালোবাসার জন্য।”
তৃষা আস্তে বলল, “আপনি জানেন প্রেম, ভালোবাসা কখনও একদিনে হয় না।
” জানি, তবু আমি প্রতিদিন নতুন করে তোমায় ভালোবাসি।”
” এই সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো?”
” না, ঢেউ তো ফিরে আসে। আমি ফিরব না, তোমার ভেতরেই থাকব।
তৃষা হালকা হেসে বলল, ” কথাগুলো সিনেমার মতো শোনাচ্ছে। কোন সিনেমার সত্যি করে বলুন তো!”
“সিনেমা নয় কিন্তু একটা কথা কি জানল? ভালোবাসা হচ্ছে সিনেমার চেয়েও সত্যি।”

” তাহলে বলুন, সবচেয়ে প্রিয় জিনিস আপনার কী?”
” এই মুহূর্ত, যেখানে তুমি আছো, আমি আছি, আর সমুদ্র আমাদের সাক্ষী।” প্রেম একটু থেমে বলল,
“তৃষা?”
” বলুন।”
“এই সমুদ্রটা কেমন লাগে তোমার?”
“বিশাল। আপনার ভালোবাসার মতো, যার শেষ আমি খুঁজে পাই না।”
“আজ চাঁদটা দেখেছো?”

” হ্যাঁ, কিন্তু আপনার চোখে জোছনার চেয়ে বেশি আলো। আচ্ছা আপনার আবারও খিদে পেয়েছে?
” হ্যাঁ, কিন্তু খাবার নয়,তোমার কথার ক্ষুধা।”
“বাতাসটা বেশ ঠান্ডা। আপনার ঠান্ডা লাগছে না?”
” সমস্যা নেই। তোমার গভীর স্পর্শে উষ্ণ হয়ে যাব। আচ্ছা তুমি জানো, এ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শব্দ কী?”
” বলুন।”
“তৃষা।” ঢেউতেও এর প্রতিধ্বনি শোনা যায়।”
তৃষা হেসে বলে, আর আমার প্রিয় শব্দ?
“প্রেম?”
“ভুল বললে।”
” তাহলে কী?”
“আমরা।”

প্রেম আর তৃষা রাতে বিচের একটা রুমেই রাত কাটায়। চোখে যখন শেষ রাতে তৃষা তীব্র ঘুম ঠিক তখনই হঠাৎ করে তৃষা প্রেমকে বলল, “আমার না লাল গোলাপ ছুঁয়ে দেখতে মন চাইছে। আচ্ছা লাল গোলাপ আপনার কেমন লাগে?” প্রেম তৃষাকে বুকে জড়িয়ে বলল, “তুমি এখন ঘুমাবে? জলদি ঘুমাও তো সোনা।” তৃষা আর কিছু বলল না। প্রেমের বুকে মাথা রাখল।
ফজরের সময় যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখল প্রেম উঠেছে। ঘুমের চোখে এত পাত্তা দিলো না। ভাবল আর কই যাবে? নিশ্চয়ই ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্যই উঠেছে। সবে সকাল সাতটার দিকে তৃষার দরজায় কে যেন কড়া নাড়ল। কয়েকবার কড়া নাড়ার পর ঘুম ভাঙল তার। চোখ কচলে পাশে তাকাতেই দেখল, “প্রেম নেই।” মানে কি? প্রেম কোথায় গেল? মনে পড়ে গেল ফজরের কথা। তার মানে কি? প্রেম কি তখন বাইরে গিয়েছে? কিন্তু এত ভোরে কেন? সে উঠে দরজা খুলতেই দেখল হোটল ম্যানেজমেন্ট থেকে একজন লোক এসেছে। সে তৃষাকে দেখে বলল, “স্যার আপনার জন্য এই লাল গোলাপের বুকে পাঠিয়েছে।” লোকটা তৃষাকে একটা কাগজ দিয়ে বলল, ‘স্যার আপনাকে এটাও দিতে বলল।”

তৃষা সেখানে একটা ঠিকানা দেখতে পেল। সেই সঙ্গে লেখা,” তোমার অপেক্ষায় বিহারহার্ট।”
তৃষা মনে মনে খুশি হলো। বলল, “আর কত সারপ্রাইজ দিবেন হাইব্রিড করলা?”
সে তৈরি হয়ে ঠিকানার উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করল। হোটেলের পশ্চিমে একটা বিরাট ঝাউ বন। একটা লোককে বিচে জিজ্ঞেস করে সেদিকটায় হাঁটা ধরল। ৭:৩০ এর মতো বাজে। এখনই কত মানুষ বিচে। তবে ওই ঝাউ বনের দিকটা ফাঁকা। মানুষ নেই বললেই চলে। কিছু শিশু বনের শুরুর দিকে বসে ছিল। তৃষার দিকে একবার কেমন করে যেন তাকালো। তৃষা পাত্তা না দিয়ে বনের মধ্যে প্রবেশ করল। প্রেমের চিঠি অনুযায়ী একটা বাড়ি থাকার কথা। খুঁজে পাচ্ছে না সে। অনেকটা হেঁটে ভেতরে দিকে এগিয়ে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ আঁধার আরো বেশি ঘনিয়ে আসতে শুরু করল। শেষে বনের মাঝ বরাবর একটা কাঠের বাড়ি দেখে থমকে গেল। খুশিতে চোখ জ্বলজ্বল করল। দৌড়ে গেল সেই বাড়ির সামনে। ভাঙা একটা কাঠের বাড়ি।

অনেক পুরোনো মনে হচ্ছে। তৃষার কেমন যেন গা ভার হচ্ছে। সে তবুও একবার মৃদু কণ্ঠে তৃষার নাম ধরে ডাকতেই পুরো নিস্তব্ধ জঙ্গলে কেবল তারই গলা ভেসে এলো। সে ফাঁকা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে হঠাৎ বলল, “প্রেম আছেন?” রুমে পা রাখতেই চোখ ছানাবড়া। রুমটা জীবন্ত আতঙ্কে থরথর করছে। তৃষা ভেতরে পা রাখতেই বাতাসের গন্ধ বদলে গেল। নোনাধরা সমুদ্রের গন্ধটাকে ছাপিয়ে উঠল এক অদ্ভুত লোহাধাতুর গন্ধ, “রক্তের গন্ধ।” ছাদ থেকে একফোঁটা পানি পড়ছে টুপটাপ শব্দে, কিন্তু সেটাও যেন রক্তের ছন্দে মিলিয়ে যাচ্ছে। মেঝেটা স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকারে লালচে ছোপগুলো আলোর রেখা পেলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, হয়তো কেউ এখানে দীর্ঘক্ষণ কষ্টে ছটফট করেছে, রক্ত গড়িয়ে গেছে মেঝের ফাঁক বেয়ে। হঠাৎ পুরোনো একটা গ্রামোফোনের হুইসেল শোনা গেল,
চিরচেনা সুরে ভেসে এলো,

“প্রেম আমার… প্রেম আমার…”
তৃষা স্তব্ধ হয়ে গেল। তার নিঃশ্বাস আটকে গেল গলার কাছে। দেয়ালজুড়ে সারি সারি ফ্রেম—সব ছবিতেই তৃষা নিজে। এক ছবিতে সে সমুদ্রের ধারে হাসছে, অন্যটায় তার চোখে কান্না, আরেকটায় তার হাতের সেই ক্ষত।
সব ছবিতেই লাল দাগে ঘেরা। তৃষার চোখের কোণ কাঁপতে লাগল, একটা ছবির নিচে সে দেখল নিজের নামের পাশে লেখা, “শেষ সাক্ষাৎ।”
হঠাৎ বাতাসে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল প্রচণ্ড শব্দে।

প্রেমতৃষা পর্ব ৪২

বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে রুমের আলো নিভে গেল। রক্তমাখা দেয়ালগুলো যেন আরও কাছে এগিয়ে আসছে। তৃষা পেছনে ফিরতেই দেখল—দরজার পাশে ঝুলছে একটা কালো হুডি। হঠাৎ অনুভব হলো কেউ পেছন থেকে এগিয়ে আসছে। তৃষা পেছনে ফেরার আগেই পেছন থেকে এক জোড়া হাত তাকে ঝাপটে ধরে বলল, “উফস তৃষা, মৃত্যুর কত কাছাকাছি চলে এসেছো!”

প্রেমতৃষা পর্ব ৪৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here