প্রেমতৃষা পর্ব ৪৩

প্রেমতৃষা পর্ব ৪৩
ইশরাত জাহান জেরিন

তৃষা পেছনে ফিরতেই দেখল প্রেমকে। তবে প্রেম তৃষাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কেবল বলল, ‘জলদি চলো এখান থেকে।’ তৃষা কোনো কিছুর মানে না বুঝলেও কেবল বুঝতে পারল এখান থেকে জলদি যাওয়াটা অতীব জরুরী। হোটেল রুমে আসতেই তৃষার মনে জেগে উঠল হাজারটা প্রশ্ন। তবে সে জিজ্ঞেস করার আগেই প্রেম তাকে স্থির করে বিছানায় বসিয়ে বলল, ” তুমি জানতে চাও সকালে আমি কোথায় গিয়েছিলাম? তাই না?”

“হুম।”
“আরে আমি তো জোগিং এ গিয়েছিলাম। তুমি যখন জঙ্গলের ওইদিকে প্রবেশ করছিলে তখন ডাকলাম তো। কত বার পেছন থেকে ডাকলাম। শেষে ভাবলাম দেখি তোমার পেছনে গিয়ে। কতক্ষণ তুমি টের না পেয়ে থাকতে পারো। শেষে টের পেলেই না।”
“প্রেম আপনি দেখেছেন? ওই বাড়িতে রক্ত? আমার ছবি টাঙানো? প্রেম চলুন ফিরে যাই। আমার সত্যি এখানে ভয় লাগছে। প্রথমে রুম নাম্বার ১০২ আর এখন এইসব। পুলিশকে জানালে হয় না? যা হচ্ছে তা তো ঠিক হচ্ছে না। আর আমার সঙ্গেই বা কেন?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমি বললাম তো ১০২ নাম্বার রুমে কিছুই হয়নি। সব ভ্রম। তবে আজকের বিষয়টি নিয়ে আমি দেখছি।”
“দেখা লাগবে না। চলুন আপনি। চলে যাই।”
“এসব সামান্য কারণ নিয়ে চলে যাবে বলছো? আর দু’টো দিন থাকি প্লিজ? তারপর তো ঢাকায় ফিরতে হবে। তোমার ভার্সিটি আছে, আমার সামনে ফাইনাল এক্সাম। আর সময় কোথায় আমাদের হাতে বলো?”
“কিন্তু প্রেম।”
“প্লিজ সোনা কোনো কিন্তু নয়।”

তৃষা আর কিছু বলল না। শরীর অনেক ক্লান্ত লাগছে তার। একটু ঘুমিয়ে নিলে হয় না? সে এখন সত্যি ভীষণ ক্লান্ত। এবার বাড়ি ফিরতে চায়। তার ভয় দিনকে দিন বেড়েই চলছে। এবার সে একটু নিস্তার চায়, কেন তার সঙ্গে এসব হচ্ছে? ওই কালো হুডি পড়া লোকটা কে? সমুদ্র পাড়েও সে একই হুডি পড়া একজন মানুষকে কয়েকবার দেখেছে, লোকটা অদ্ভুত ভাবে তার দিকে দেখা হলে তাকিয়ে থাকত। আচ্ছা দু’টো মানুষ এক নয় কি? ওই হুডি পড়া লোকটি তাকে বিশ্বাসঘাতক বলে আখ্যায়িত করেছিল। আচ্ছা এই নামে ডাকার কারণ কি? যুবরাজকে ফেলে ঢাকায় আসার পর তো এসব হয়নি। হয়েছে বিয়ের পর কক্সবাজার আসার পর। আচ্ছা খবরে যেই সিরিয়াল কিলারের বিষয়ে সে শুনেছিল, সেই কিলারের সঙ্গে কি ওই হুডি পড়া লোকের কোনো সম্পর্ক আছে কি? মাথাটা একেবারে গুলিয়ে যাচ্ছে। এদিকে হাতের ব্যথাটা এখনো সারেনি।

শেষে প্রেম, তৃষাকে একটা ঘুমের ঔষধ খাইয়ে তার পাশে কিছুক্ষণ বসে থাকে। দুপুরে ঘুম থেকে উঠে ঘরে হোটেলেই সময় কেটে যায় তৃষার। শিমলা আর সে এক সঙ্গে থাকলে অন্য কারো দরকার পরে না। অংকুর আর প্রেম বাইক নিয়ে একটু বের হয়েছে। বিকেলের দিকে বেলকোনিতে বসে হাওয়া গায়ে লাগিয়ে ফোনে মুখ গুঁজে তৃষা বসে ছিলো। হঠাৎ একটা নাম্বার থেকে ফোন এলো। ডেলিভারি ম্যানের ফোন। কিন্তু তৃষার তো কোনো পার্সেল আসার কথা নয়? আর ঘুরতে আসার পর সে কিছু অর্ডারও করেনি। তাহলে? তারপর ডেলিভারিকে যখন সে জিজ্ঞেস করল, ‘কত টাকা? ‘ তখন তিনি জানালেন পেমেন্ট ক্লিয়ার। ভারি আশ্চর্য হলো তৃষা। শিমলাকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, ‘আমি একটা অর্ডার করেছিলাম। পেমেন্ট পে করা। এটা আবার সেটা নাকি?’
তৃষা গম্ভীর মুখে বলল, ‘আগে আসুক। দেখি কি এসেছে।’

পার্সেলটা হাতে নিয়ে খুলে দেখতেই চিৎকার করে উঠল তৃষা। একটা বাক্স ছোট্ট মতো দেখতে। তাতে কাটা চুল আর গলা কাটা বিশ্রী রকমের একটা পুতুল। শরীর কেঁপে উঠল তৃষার। শিমলা জলদি তৃষার সামনে থেকে বাক্সটা সরিয়ে নিয়ে তাকে রুমে নিয়ে গেল। পানি খাইয়ে বলল, ‘এবার শরীর ঠিক লাগছে?’

তৃষা আপনাআপনি কান্না করে উঠল। ভীষণ ভয় করছে তার। তার হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘তুই প্রেমকে কল কর। আমি আর এক মুহূর্তও এখানে থাকব না। এখানে আমি আমার মরণ দেখতে পাচ্ছি।’
শিমলা কোনো মতে তৃষাকে সামলে প্রেমকে কল করলো। খুব একটা সময় লাগল না প্রেমের রুমে ফিরতে। শেষে সারাটা সন্ধ্যা প্রেমকে নিজের বুকে আগলে রাখতে হয়েছে তৃষাকে। মেয়েটা ছাড়ছিলোই না। কেবল বাড়ি যাওয়ার জন্য বায়না করছিল। তবে প্রেম কত ধরনের কথা বলে বুঝিয়েছে আরেকটু সময় থেকে গেলে কিছু হবে না।
রাত তখন দশটার মতো বাজে। তৃষা এখন অনেকটা স্বাভাবিক। প্রেম টেলিফোন করে খাবারটা রুমে যেন রুমে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তার ব্যবস্থা করতে উঠে পড়ে। টেলিফোন তুলে কল দিবে এমন সময় তার ফোনে একটা কল আসে। স্ক্রিনের নাম্বারটা দেখা মাত্র গলার শব্দ নিচু হয়ে যায়।

সে উঁকি মেরে একবার বেড রুমের দিকে তাকায়৷ তৃষা বোধ-হয় ঘুমিয়ে গেছে। টেলিফোনটা জায়গায় রেখে নিজের ফোনটা প্যাকেট থেকে বের করে রিসিভ করল। ওপাশে কেউ একজন গম্ভীর স্বরে কথা বলেই যাচ্ছে। হঠাৎ প্রেম তাকে নামিয়ে বলল, ‘চুল আর পুতুল দিয়ে তুমি কি করবে? মরার শখ তোমারও হয়েছে নাকি? না, ওইসব তোমাকে দেওয়া যাবে না। তবে তুমি চাইলে কিন্তু আমি এর থেকেও বেটার কোয়ালিটির গুলো তোমার ঠিকানায় পাঠাব। ফোন রাখলাম,সাবধান! জানোই তো দেয়ালে একবার ছবি লেগে যে এই রহস্যের গল্পে মৃত্যু নিশ্চিত?’ বলেই ফোনটা কেটে পেছন ফিরতেই দেখল তৃষা তার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রেম কিছুটা অবাক হলো। থতমত খেয়ে বলল,’ সোনা তুমি ঘুমাও নি? আমি আরো ভাবলাম ঘুমিয়ে গেছো। আরে জানো না অংকুর ফোন করেছিল, তোমার কথাই জিজ্ঞেস করল। আর ওই যে পার্সেল ওইটা নিয়ে একটু মজা করছিলো আর কি!’ তৃষা জবাব না দিয়ে বলল, ‘ক্ষুধা পেয়েছে একটু জলদি খাবার পাঠাতে বলুন।’

প্রেম মুচকি হেসে বলল, ‘তুমি রুমে যাও। আমি বলে আসছি।’
রাতে তৃষাকে বুকে জড়িয়ে চোখ বুঝল প্রেম। তবে তৃষার যে ঘুম আসছে না। আসবে কি করে? প্রেমের কথা গুলো তখন মোটেও স্বাভাবিক লাগেনি। তাছাড়া অন্য সময় হলে প্রেম তৃষার কোনো কথা ফেলে না, আর সেখানে তার সঙ্গে এত বড় বড় বিষয় ঘটে যাচ্ছে তবুও প্রেম ধরে-বেঁধে এখানেই থাকতে চাইছে? রাত বাড়ে। বৃষ্টির শব্দ থেমে যায়। কোথাও একটা জানালা কিঞ্চিৎ খোলা, তার ফাঁক দিয়ে ঢুকছে নোনা বাতাসের হালকা গন্ধ। তৃষার চোখ আধখোলা, আধবোজা। সে মনে করে, প্রেমের হাত এখনো তার কাঁধে। কিন্তু ধীরে ধীরে, অজান্তেই, চোখ লেগে যায়। হঠাৎ একটা শব্দে তার ঘুম ভাঙে— ঠিক বোঝে না শব্দটা কিসের। রুমে ঘন অন্ধকার। সিলিং ফ্যানের মৃদু ঘূর্ণন ছাড়া কিছুই শোনা যায় না। এসিটা রাতে বন্ধ করে শুয়েছিল মনে আছে।
তৃষা হাত বাড়ায়, পাশের জায়গাটা ছুঁয়ে দেখে।

ঠান্ডা। একদম ঠান্ডা। কারণ যে প্রেম নেই। তার বুকের ভেতরটা ধীরে ধীরে জমে যায় বরফের মতো।
সে নিঃশব্দে চুপসে যায়। পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরে থেকে একটা ক্ষীণ আলো পড়ছে। তৃষা দরজার কাছে গিয়ে থামে। দরজার নিচে দেখা যাচ্ছে হালকা নড়াচড়া। কারও ছায়া যাচ্ছে মনে হয়। একটা খটখটে শব্দ। হ্যান্ডেল নড়ল, দরজা খুলল, তারপর নিস্তব্ধতা।
তৃষার বুক ধড়ফড় করে ওঠে। প্রেম? এত রাতে সে কোথায় যাচ্ছে? সে চপলভাবে দরজাটা অল্প ফাঁক করে বাইরে উঁকি দেয়। হোটেলের করিডোরে নিঃসাড় হলুদ আলো জ্বলছে, বাতাসে পুরনো ডিটারজেন্ট আর আর্দ্র কাঠের গন্ধ। আলোয় লম্বা ছায়া পড়েছে দেয়ালে।

তৃষা নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়ল। কক্সবাজারে আসার পর প্রেমের এমন পরিবর্তন, সম্ভবত ইদানীং হুটহাট সে হাওয়া হচ্ছে। এমন না জানিয়ে যায় টা কোথায় সে? আজকে সব প্রশ্নের জবাব যাই। এখানে কিছু তো একটা হচ্ছে। তবে কি হচ্ছে তাই জানতে হবে এবার। আর রহস্য মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। তৃষার পায়ে জুতা নেই। তার খালি পায়ের কারণে কার্পেটের ওপর পায়ের শব্দ হয় না, তবু মনে হচ্ছে পদক্ষেপগুলো খুব জোরে প্রতিধ্বনি তুলছে তার বুকের ভেতর। করিডোরের মোরে এসে আচমকা থেমে গেল সে। ওই তো সামনেই প্রেম। এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। পড়নে একটা কালো হুডি। অন্য হাতে ফোন। সে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু স্ক্রিন জ্বলছে না। কারো ফোনের অপেক্ষা বুঝি? তৃষা এক পা, দুই পা, তিন পা—চুপচাপ তার পেছনে এগোয়। কিন্তু হঠাৎ বামে বাঁক নিতেই
প্রেমটা যেন হাওয়ার মতো মিলিয়ে গেল। তৃষা থেমে দাঁড়ায়। চারপাশে কেবল বাতির ঝিম ধরা আলো।

প্রেমতৃষা পর্ব ৪২ (২)

কোনো শব্দ নেই। ঠিক তখনই টিক করে একটা শব্দ হলো। একই সঙ্গে সব আলো নিভে গেল। অন্ধকারে তৃষার নিঃশ্বাস আটকে যায়। সে পেছনে ফিরে যেতে চায়, কিন্তু কিছু দেখতে পায় না। এমন অন্ধকার যে নিজের হাতও চোখের সামনে অদৃশ্য। তার হৃদস্পন্দন কানে ঠকঠক করে বাজছে। সে ধীরে ধীরে পেছাতে শুরু করে। হঠাৎ কেউ একজন জোরে পেছন থেকে তার মুখ চেপে ধরে।ঠান্ডা, ভেজা, শক্ত সেই হাতের স্পর্শ। তৃষা চেঁচাতে পারে না। চোখের সামনে ঘন অন্ধকার নড়ে ওঠে, যেন অন্ধকারেরই একটা অংশ তার গায়ে লেপ্টে গেছে। তার নিঃশ্বাস ছটফট করে বেরিয়ে আসে নাক দিয়ে। হঠাৎ সেই শীতল হাতের মালিক তার কাঁধের কাছে থুতনি ঠেকালো। ফ্যাস ফ্যাস শব্দ করে হেসে বলল, ‘হ্যালো সুইটহার্ট!’

প্রেমতৃষা পর্ব ৪৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here