প্রেমপিপাসা পর্ব ১৮

প্রেমপিপাসা পর্ব ১৮
সুমাইয়া সুলতানা

চারপাশে নৈঃশব্দের আনাগোনা। বদ্ধ রুম জুড়ে পিনপিন নিরবতা। নিস্তব্ধতা এতটাই প্রবল যে নিঃশ্বাসের শব্দও কানে বাজে। রাতের স্নিগ্ধ পরিবেশে কক্ষটা শব্দহীন শ্মশান, যেখানে অনুভূতিগুলো দাহ্য হচ্ছে ধোঁয়াহীন আগুনে। নিস্তব্ধতা এতটাই শ্বাসরুদ্ধকর, সময়ের কণাও জমাট বেঁধে গিয়েছে অদৃশ্য এক শূন্যতার দেয়ালে। আজ রুমের দেয়ালগুলোও বোবার পরিচয় দিচ্ছে। বাইরের ধুলো জমা বাতাসটাও এই বোবা বাক্যহীনতার সাক্ষী। এই নৈঃশব্দ্য এক শীতল ধ্বংসাত্মক আগুনের মতো ধীর ভাবে দুই নরনারী’কে প্রবলভাবে গ্রাস করে নিচ্ছে।

অরুর আকস্মিক কর্মকাণ্ডে বাকরুদ্ধ হ্যাভেন। বিস্মিত দৃষ্টিতে অবুঝের নিদারুণ লেলিহান। হতবিহ্বল হ্যাভেন বিস্ময়ের ঘোরে আটকে যাওয়া এক যাত্রী। সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, এই আচানক পাগলামির পবন কেন এত ভারী? এই নিরবতা কেন এত কর্কশ? মস্তিষ্কে একসঙ্গে হাজারও প্রশ্নের ঝড়, অথচ ধারালো পুরুষালি ফিনফিনে ঠোঁট নিঃশব্দ। মনোজগতে বজ্রপাতের বিকট শব্দের প্রতিধ্বনি, কিন্তু বাস্তবে সে নির্বিকার। হৃদয়ের গহীনে বয়ে চলেছে ঘূর্ণিঝড়, তবে বাইরে সে এক নির্জীব মূর্তির মতো। বিস্ময় এক মৃতব্যথার মতো ছড়িয়ে গিয়েছে ধমনিতে। নিগূঢ় দৃষ্টির গভীরতা এক ভাঙাচোরা রাজপ্রাসাদ, যেখানে রাজা নেই, শুধুই ধ্বংসাবশেষ।
নিরিবিলি চলমান নিস্তব্ধতা কক্ষের ইতি টানল হ্যাভেন। কাঁধ হতে অরুর হাত ছাড়িয়ে নিলো আলগোছে। ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ পূর্ণ দৃষ্টি তাক করল অরুর রাগত্ব মুখবিবরে। মুহূর্তে শুষ্ক ঠোঁট জোড়া নাড়ল। ধ্বনিত হলো ঠাণ্ডা অত্যন্ত ধ্রুব স্বর,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” রাত-বিরেতে কোন পেত্নী ভর করেছে? তোমার থেকে এসব পাগলামি মোটেই কাম্য নয়। ঝাঁঝালো রমণীর এরূপ মারাত্মক রুষ্ট আচরণ আহুতি দিয়ে সেথায় কাতরানো, অসহায় ভাবভঙ্গির ঠাঁই বড্ড দৃষ্টিকটু লাগছে। ”
অরু শুনল না। রসালো জ্ঞানী বাক্য আমলে নিতে অনিহা সে। দূরে সরে দাঁড়ায় না। তেতে উঠে পুনরায় চলে আসে হ্যাভেনের সন্নিকটে। খামচে ধরে হ্যাভেনের বুকের নিকট গেঞ্জি। রক্তিমা কাঠিন্য মুখশ্রীতে অগ্নিশিখার দাবানল। তীব্র জেদি আপসহীন কর্কশ আওয়াজে বলল,

” হোয়াটস ইয়োর প্রবলেম? কটাক্ষ করছেন? এ্যাটিটিউড দেখাচ্ছেন আমাকে? এ্যাটিটিউড? ছোট বাচ্চা আপনি? তাগড়া যুবক একজন মানুষ। সবকিছু বুঝতে পেরেও, এখন আমাকে ইগনোর করে নিজেকে ইনোসেন্ট প্রুফ করতে চাইছেন? নিজেকে ভোলা ভালা মানুষ রূপে প্রেজেন্ট করতে চাইছেন? আপনি তো এটাই চেয়েছেন সর্বদা। সেজন্য বিয়ে করেছেন। তাহলে এত দ্বিধা কেন? আমি নিজেকে আপনার কাছে বিলীন করতে প্রস্তুত। মিটিয়ে নিন আপনার কামুকতা। আদায় করে নিন নিজের প্রাপ্য অধিকার। খাঁটিয়ে নিন নিজের পুরুষত্ব। ”
শেষের কথাগুলো চিৎকার করে বলে, কাঁধ থেকে এক টানে শাড়ির আঁচল সরিয়ে ফেলল অরু। অবহেলায় আঁচল পড়ে রইল ধূসর সাদা রঙের টাইলস দ্বারা আবৃত ফ্লোরে। মেয়েলি নজরকাড়া ভাঁজ দৃশ্যমান হলো হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সম্মুখের পুরুষের অক্ষিপটে। তবুও পুরুষটির চক্ষুদ্বয়ে কামুকতার অভিলাষ বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সে পরিপূর্ণ স্বাভাবিক, শান্ত, স্থির। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে, রাগান্বিত চওড়া হয়ে উঠা বউয়ের মুখমন্ডলে।

হ্যাভেনের মৌনতা অরুর গায়ে আগুন জ্বলার মতো কাজ করল। ক্ষেপে যায়। রাগ সংবরণ করতে দুম করে পা দিয়ে সজোরে আঘাত করে ফ্লোরে। নিম্নোষ্ঠ দাঁতে কামড়ায়। অধৈর্য সহিত উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
” দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আসুন, আমি বলছি, স্ত্রীর মর্যাদা দিন আমাকে। স্বামীর দায়িত্ব পালন করুন। ”
হ্যাভেন স্তব্ধ, বিমূঢ়। বউয়ের অযাচিত আচরণে তাজ্জব সে। বিফল শ্বাস ছাড়ল। ঝারা মেরে অরুর হাত সরিয়ে দিল। রুষ্ট, রুক্ষ চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। অতঃপর ধমকে গমগমে গলায় বলল,
” স্টপ দিস ননসেন্স! কি শুরু করেছো? ঘূর্ণায়মান ঝড়ের তান্ডব নিজের উপর কেন বর্তাতে চাইছো? ভালো চাও তো, এক্ষুনি থামো অরু। ”
অরুর কম্পমান ওষ্ঠপুটে একরাশ বিষণ্ণ বিতৃষ্ণা জন্মেছে। কম্পিত ওষ্ঠ নেড়ে নেড়ে জানতে চাইল,

” আমার প্রতি এত অনিহা হলে বিয়ে করেছেন কেন? কিসের স্বার্থ লুকিয়ে আছে আমাকে বিয়ে করার মাধ্যমে? বলুন? জবাব দিন? ”
হ্যাভেন ফিচেল হাসে। ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বিদ্রুপ সরূপ রাশভারী কন্ঠে উত্তর দেয়,
” শরীর গরম করার জন্য। ইউ নো, আমার নিউমোনিয়া প্রবলেম রয়েছে। এছাড়া বডি ম্যাসাজ করার জন্য। আসলে সুখে থাকতে ভুতে কিলায়। ত্রিশ টা বছর ধরে সিঙ্গেল কমিটির সভাপতি হয়ে থাকতে থাকতে আমার তাগড়া যৌবনটা কেমন নেতিয়ে পড়েছিল। যৌবনকে তরতাজা, চাঙ্গা করতে কারো নরম তুলতুলে হাতের ছোঁয়া চাই। তাই ভাবলাম একটা বিয়ে করি। নয়তো তোমার প্রতি আমার কোনো বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই। ”

বুক চুরমার করে কান্না পাচ্ছে অরুর। দমে গেল না। চটে যাওয়া বিহ্বলিত হ্যাভেনের বিস্ময় প্রবল করতে, পেছনে হাত নিয়ে ব্লাউজের ফিতা খুলতে উদ্যত হয়। ফিতায় হাত চালিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে ধরাশায়ী গলায় বলে,
” আমি কিছু শুনতে চাই না, কিছু বুঝতে চাই না। এক্ষুনি আপনি আমায় স্ত্রীর মর্যাদা দিবেন। ”
হ্যাভেনের চক্ষু চড়কগাছ! বিস্মিত, স্তম্ভির সে। এই মেয়ের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। কি করছে এসব? আজও হুঁশ আছে তার? হ্যাভেন অরু’কে থামাতে চাইল। অরু থামতে নারাজ। ফিতা খোলা অবসান।
হ্যাভেন শক্ত করে অরুর বাহু চেপে ধরল। অবিরত ঝাঁকাতে লাগলো অরুর অনুভূতি শূন্য জীর্ণ শরীর। চোখে চোখ রেখে, তিরিক্ষি মেজাজে নিয়ে অবিশ্বাস্য সুরে প্রশ্ন করে,

” কি হয়েছে তোমার? এরকম উগ্রতা দেখাচ্ছো কেন? ফাজলামো বেশি হয়ে যাচ্ছে! ”
অরুর ভেতরে গুমরে ওঠা অভিমান, দুঃসহ এক ব্যথার মতো ছড়িয়ে আছে চারপাশ। অশ্রুতে ভেজা চোখের গভীরে চাপা বেদনার ঢেউ, ঠোঁটের কোণে একটুকরো থমকে থাকা অভিযোগ, আর মনের কোণে জমে থাকা অভিমানের ছাইয়ে একরাশ হতাশার ধুলো। সে কিছু বলতে চায়, কিন্তু শব্দগুলো কণ্ঠে আটকে আছে, অনুভূতিগুলো আঠালো হয়ে রয়েছে পাথরের মতো। নিজেকে সংযত রাখছে এক অসমাপ্ত যুদ্ধের ক্লান্ত সৈনিকের মতো। ঠোঁটের কোণে জমাট বাঁধা নীরবতা আসলে এক রক্তাক্ত অভিশাপ, যা উচ্চারণ না করেও চিৎকার করছে হাহাকারের ভাষায়।
অরু ডুকরে কেঁদে ওঠে। ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া অসহায় রমণীর ন্যায় কাতর গলায় উন্মাদের মতো বলতে লাগলো,
” আমাকে এভয়ড করতে পারেন না আপনি। প্লিজ হ্যাভেন, আপনি নিজের অধিকার খাটান। আমি বাঁধা দেবো না। বলুন তো, আমি কি কোনো নিছক খেলার বস্তু? সবাই আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য কেন করে? আমি কি অপয়া? এতদিন তো স্বইচ্ছায় আমার কাছ ঘেঁষতেন। এখন যখন আমি বলছি, তখন কেন আসছেন না? আপনিও আমায় মেনে নিতে চাইছেন না? আপনিও কি মনে করেন আমি অভিশপ্ত, কালনাগিনী মেয়ে, যেই সংসারে যাব সেই সংসার ধ্বংস হয়ে যাবে? ”

হ্যাভেন মনোযোগ সহকারে অরুর সকল কথা শ্রবণ করল। অরুর বাহু ছেড়ে দিল তৎক্ষনাৎ। ফ্লোর থেকে আঁচল উঠিয়ে অরুর গায়ে জড়িয়ে দিল। নজর ফিরিয়ে নিলো মুহূর্তে। অন্যদিকে চেয়ে ভারিক্কি তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। পরপর কড়া গুরুগম্ভীর জোরালো কন্ঠে বলে ওঠে,
” চেঞ্জ করে আসো। কথা শোনো আমার। তোমার লজিকল্যাস কথাবার্তায় বিরক্ত লাগছে। ”
অরুর বুক ভেঙে গেল। মুখজুড়ে মেঘেদের পায়চারি। মুখবিবরে আঁধার মেখে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। এমনটা তো আশা করেনি। যা ভেবেছিল তার যে কিছুই হলো না। ও ভেবেছিল, হ্যাভেন আজ ওর রূপে দিওয়ানা হয়ে যাবে। সেরকম কিছু ঘটলো না। কুণ্ঠায় মরমর দশা। যার তোপে ভৎসনা পেলো স্বীয় সত্তা থেকে। নিজের ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায় মেয়ে হয়ে ও একধাপ এগিয়ে গিয়েছে স্বামীর নিকট, অথচ সে ফিরিয়ে দিচ্ছে! অপমানিতবোধ হবে না? লজ্জা লাগবে না?
অরু জ্বলজ্বল ক্ষিপ্ত ভঙ্গুর লোচনে তাকায় হ্যাভেনের সাবলীল আদলে। ফুঁসে উঠল সর্বাঙ্গ। রাগান্বিত সুরে ব্যঙ্গাত্মক সমেত প্রতিধ্বনি হলো বিষাক্ত বাক্য,

” বিরক্ত লাগছে! লাগবেই তো। নতুন কোনো শরীরের সন্ধান পেয়েছেন বুঝি? হয়তো তার মতো আমার শরীর এত আকর্ষণীয় নয়! ”
হ্যাভেন’কে উসকে দিতে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে অরু কথাটা বললেও, ঘুনাক্ষরে টের পেলো না মেয়েটা, এটার ফলাফল কতটা ভয়াবহ আতঙ্কের হতে পারে। বুঝতে সক্ষম হলো না, কথাটার ভারী ওর উপর কি পরিমাণ বর্তাবে!
কথার বাজখাঁই আওয়াজ পবনে বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত ফুরসৎ পেলো না অরু। বাক্যের যবনিকার ন্যায় নিটল মানবের করালগ্রাস আবদ্ধ করল তাকে। কিছু বুঝে ওঠার পূর্বে কোমরে মৃদু চিনচিন ব্যথা অনুভব হলো। অস্ফুট স্বরে কন্ঠনালী ভেদ করে ব্যথাতুর শব্দ মুখ থেকে বেরিয়ে আসলো। হ্যাভেন আচমকা অরু’কে ধাক্কা দিয়ে ডিভানে ফেলে দিয়েছে।

হকচকিয়ে ঘুরে তাকায় অরু। পরমুহূর্তে হ্যাভেন ওর শাড়ির আঁচল মুঠোয় রেখেছে দেখে অধরে হাসি ফুটলো। হ্যাভেন ওকে কাছে টানবে, স্বীয় কাজে সফল হবে ভাবতেই খুশি লাগলো। তবে সেই খুশির দীপ্তি দীর্ঘস্থায়ী শান্তিপূর্ণ হলো না, সম্মুখের পুরুষটির শক্ত চোয়াল বিশিষ্ট কঠিন মুখবিবর নজর পড়তেই, দপ করে নিভে গেল।
হ্যাভেনের চেহারায় ক্রোধ স্পষ্ট, যা একধরনের ভয়াবহ আতঙ্ক, অস্থিরতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। চক্ষু জোড়া কিঞ্চিৎ লাল হয়ে রয়েছে। গালের মাংসপেশি টানটান, কপালের রক্তনালী হালকা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভেতরের উত্তেজনা শরীরে প্রতিফলিত হচ্ছে। ভারিক্কি শ্বাস, রাগের দাপটে কাঁধের মৃদু কম্পন, হাত দুটি মুষ্টিবদ্ধ, সবকিছু মিলিয়ে এক গভীর শূন্য বেদনার অনুভূতি তৈরি করছে। মুখের রেখাগুলো ব্রীড়ানতায় সংকুচিত, যা এক অদ্ভুত ব্যাধিগ্রস্ততা ভেতরে-বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে।

আচমকা অরুর উপর হামলে পড়ল হ্যাভেন। ঈষৎ ভড়কালো মেয়েটা। হকচকানো দৃষ্টি তাক করল চটে যাওয়া পুরুষটার দিকে। মুখমন্ডল কাঠিন্য রূপ হয়ে রক্তিম আভায় ছেয়ে রয়েছে। হ্যাভেন বলিষ্ঠ এক হাতে খুব শক্ত করে অরুর নরম তুলতুলে কোমর চেপে ধরল। অন্য হস্তে ঠাঁই পেলো অরুর পেলব দু’হাত। অনুষ্ণ হাতের ছোঁয়ায় অরু কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে। সে টেনে ওকে কাছে নেয়, মিশিয়ে ধরে বক্ষপটে। উষ্ণ গরম নিঃশ্বাসের তোপে অরু চোখ বুজে ফেলল। কোমরে ক্ষীণ ব্যথা অনুভব করছে। আকস্মিক আক্রমণে অরু কিংকর্তব্যবিমূঢ়! মস্তক থিঁতিয়ে এসেছে তার। হ্যাভেনের অগ্নি চক্ষু বর্তায় অরুর ভীতিগ্রস্ত মুখবিবরে। নিখাদ কাঠিন্য মুখমন্ডলে হালকা নিভু চোখে তাকাল অরু। অক্ষিপট স্থিত হলো দু’জনের।
হ্যাভেন গলার ভারিক্কি স্বর অপরিবর্তিত রাখল। ঠোঁটে ডেবিল হাসি টেনে গম্ভীর কণ্ঠে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

” বাসর করবে? বাসর করার খুব শখ? আগে বললেই হতো, তাহলে দীর্ঘদিন কষ্ট করে নিউমোনিয়ায় ভুগতে হতো না আমাকে। ওয়েট, বাসর করার সাধ বুঝাচ্ছি তোমাকে! ”
বাক্যবাণ যবনিকা টেনে হ্যাভেন তৎক্ষনাৎ অরুর গ্রীবাদেশ ছোট ছোট আঘাতে জ্বালিয়ে দিল। দাঁতের সুক্ষ্ম শক্তি নিগূঢ় ভাবে প্রয়োগ করল অরুর মোলায়েম চামড়ায়। গলদেশ হতে সুক্ষ্ম দন্তপাটির অমানবিক বিচরণ ছড়িয়ে পড়ল অরুর ঘাড়, কাঁধ, কানের লতিতে। হ্যাভেনের সরু দাঁতের প্রত্যেকটা কামড় প্রচন্ড যন্ত্রণা দায়ক! মরণশীল বিষাক্ত ব্যথা অনুভব করে চলেছে অরু। ঘন পল্লব নয়ন জোড়া অশ্রুজলে টইটম্বুর। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে সহ্য করার বারংবার চেষ্টা করছে মানুষ রূপে হ্যাভেনের প্রতিটি দংশন! কিয়ৎক্ষণ মুহূর্ত এভাবে অতিবাহিত হলো। অতঃপর অরু আর টিকতে না পেরে ফুঁপিয়ে মৃদু আওয়াজে কেঁদে উঠল।
অরুর কান্না কর্ণগোচর হতেই হ্যাভেন সহসা মস্তক উঁচু করে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করল তারই দেওয়া প্রতিটি আঘাতের নিগূঢ় প্রলেপ। চামড়া কাটেনি, তবে ইতোমধ্যে গাঢ় লাল রঙ ধারণ করেছে সেথায়। ডিভানের একাংশ ভিজে গিয়েছে অরুর অশ্রুজলে। হ্যাভেন পাত্তা দিল না। মায়া হলো না কঠিন মানবের বক্ষপটে! পুনরায় অগ্রসর হয় স্বীয় নারীর শরীর ক্ষত-বিক্ষত করতে।

অরুর শাড়ির আঁচল সরিয়ে উদরে উষ্ণ ওষ্ঠের ছোঁয়া দিল হ্যাভেন। এই ছোঁয়ায় যন্ত্রণা নেই, আবার স্বস্তিও নেই। অরু পূর্বের তুলনায় শব্দের জোর বাড়িয়ে কান্না শুরু করল। হ্যাভেন মুখ তুলে চাইল একপল ক্রন্দনরত রমণীর রক্তিম মুখশ্রীতে। পরক্ষণেই সজোরে কামড় বসালো অরুর কোমল থুতনিতে। এই আঘাতে অরুর প্রাণপাখি ছটফট করে উঠল। নিজের থেকে সরিয়ে দিতে পারলো না, নিষ্ঠুরতম লোকটাকে। হাত জোড়া তো কঠিন মানবের করতলে বন্দী! পাষাণ লোকের এ কেমন অযাচিত হিং’স্র রূপ? অশ্রুসিক্ত নয়নে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে বিধ্বস্ত কাতর অরু।
কিয়ৎপরিমাণ পর হ্যাভেন অরু’কে ছেড়ে দিল। পরপর হাত ধরে অরু’কে টেনে দাঁড় করালো। পরমুহূর্তে অরুর চোয়াল শক্ত করে চেপে ধরল। এমন ভাবে ধরেছে যেন পাঁচ আঙুলের চারটা আঙুল গাল ছিঁড়ে ঢুকে যাবে অরুর মুখগহ্বরে! হ্যাভেনের রাগমিশ্রিত মুখাবয়ব দেখে, ভয়ে অরুর গাত্র গুটিয়ে এলো। হতবাক হয়ে নিস্প্রভ দৃষ্টিতে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রয়েছে।

হ্যাভেন ক্রোধে গর্জে উঠে হাতের জোর বাড়াল খানিকটা। তৎক্ষনাৎ কোনোকিছু না ভেবে অরু অসহায় জলে টইটম্বুর নেত্রদ্বয় বড়ো বড়ো করে নজর আবদ্ধ করল, পর্বতের ন্যায় অটল দাঁড়িয়ে থাকা রাগান্বিত হ্যাভেনের উপর। ব্যাকুল চিত্তে কাঁপাকাঁপা ক্ষীণ স্বরে আর্জি জানায়,
” ছেড়ে দিন। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। ”
ক্রোধে বহ্নিশিখার ন্যায় জ্বলে উঠল হ্যাভেন। ইস্পাত-দৃঢ় বক্ষঃস্থল ঘনঘন ফেঁপে উঠছে। ললাটের নীল শিরা দৃশ্যমান হলো। নিগূঢ় তীর্যক চাউনীর তোপে যেন ভৎস করে দিবে সম্মুখের রমণীকে। সরু নাকের ডগা ফুলে উঠতেই চোয়াল ছেড়ে, শক্ত হাতে অরুর দুইবাহু চেপে ধরল। অরু সেই অবস্থায় কিছুটা পিছিয়ে গেল। মসৃণ কোমল পৃষ্ঠদেশ গিয়ে ঠেকল দেয়ালে। ভয়ে তটস্থ অরু, পরপর গায়ের সবটুকু জোর খাটাল হ্যাভেনের থেকে ছুটতে কিন্তু পারলো না। বলিষ্ঠ হ্যাভেনের কাছে সে বরাবরই তুচ্ছ।
হ্যাভেন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে খিটখিটে মেজাজ নিয়ে চওড়া কন্ঠে বলল,

” ছাড়বো কেন? বাসর তো এখনো শুরুই করলাম না।”
বলেই ঈষৎ ধাক্কা দিয়ে অরু’কে সরিয়ে দিল। ধাক্কার দাপটে অরু ছিটকে পড়ল খাটের নিকট। আর একটু হলে বিছানার শক্তপোক্ত কাঠের সাথে লেগে বিদীর্ণ হতো নরম কপাল।
এতটুকুতে ক্ষান্ত হলো না নির্দয় মানব! তেড়ে এলো সহসা। ঠোঁটে লেপ্টে রয়েছে রহস্যময় ক্রুর হাসি। তার বলিষ্ঠ খসখসে করতল জায়গা দখল করল অরুর মোলায়েম গলদেশ। বেশি জোরে না, অল্প ভাবে গলা টিপে ধরল ভয়ে তটস্থ থাকা রমণীর। অথচ গলা শুকিয়ে কাঠ হলো নাজুক মেয়েটির। বক্ষঃস্থল ছ্যাঁত করে উঠল। আতঙ্কের তোপে অর্ধেক মরণ কবুল করল সে।
রক্তিম শূন্য চাউনীতে তাকায় হ্যাভেন। ভরাট কন্ঠে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলে,

” ছলনা জিনিস আমি সবচেয়ে অপছন্দ আর ঘৃণা করি অরু! হোক সেই ছলনাকারী ছেলে কিংবা মেয়ে। এরকম ধাঁচের মানুষের প্রতি আমি বড্ড অনিহা! তুমি সেই ছলনার আশ্রয় নিলে কোন সাহসে, উত্তর দাও? ”
অরুর মাথা ঘুরছে। অক্ষিকোটর ছাপিয়ে টপটপ করে অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ছে অরুর মসৃণ কপোল বেয়ে। টলমল দৃষ্টিতে তাকাল হ্যাভেনের দিকে। লোকটার কথার আগামাথা বোধগম্য হলো না। তবে এতটুকু বুঝতে পারছে, ওর আজকের কাজকর্ম হঠাৎ হ্যাভেনের নিকট উন্মুক্ত করায়, সে মেনে নিতে পারছে না।
স্বীয় বোকামির কারণে, নিজের দূর্বোধ্য পরিনতি আঁচ করতে পেরে অচিরেই বাকরুদ্ধ হয়ে থমকে গেল অরু। ভয়ে জীর্ণ শরীর কনকনে শীতের ন্যায় থরথর করে কাঁপছে। তৎক্ষনাৎ ছোট ছোট কদমে নিজের জরাজীর্ণ শরীরটাকে টেনেটুনে পিছু হটার ক্ষুদ্র প্রয়াস চালাল। তবে ফুরসৎ পেলো না। কারণ, পিছু হটার জায়গা নেই। কন্ঠনালী বিধিবাম কম্পমান। উচাটন চিত্তের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় জেঁকে বসেছে আতঙ্কের প্রলয়।
অরু খুব কষ্টে আহত চোখে থেমে থেমে মুখ খুলল,

” আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। সঠিকভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। ”
সম্বিত ফিরল হ্যাভেনের। আলগোছে হাত আলগা করে। মুখ ঘুরিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ল। লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করার স্বল্প প্রয়াস চালায়। সফল হয়েছে বটে।
অরু কাশছে। দীর্ঘক্ষণ একটা যুদ্ধ করে হাঁপিয়ে উঠেছে জীর্ণ শরীর। হ্যাভেন বেড সাইড টেবিল হতে গ্লাসে পানি নিয়ে অরুর হাতে দেয়। অরু ঝটপট পানি পান করল, যেন বহুদিনের জলের অনুসন্ধানের থাকা কোনো তৃষ্ণার্ত পথিক।
অরু ধপাস করে খাটে বসে পড়ল। নেতানো শরীরটা বড্ড ক্লান্ত। ঘেমে জুবুথুবু অবস্থা। ঘনঘন শ্বাস টানছে। বালিশের কাছ থেকে রিমোট নিয়ে এসির টেম্পারেচার বাড়িয়ে দিল। হ্যাভেন ঠায় দাঁড়িয়ে। আপাতত তাকে শান্ত, স্থির দেখাচ্ছে।
হ্যাভেন দাঁড়িয়ে থেকেই তীক্ষ্ণ গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,

” তোমার এই রূপ আমার ভালো লাগছে না। বিশ্বাস করো শান্তি পাচ্ছি না। তোমার চোখের দৃষ্টি অদ্ভুত ভিন্ন। মনে হচ্ছে জবরদস্তি আমার জন্য নিজেকে প্রস্তুতি করছো। ”
অরু থতমত খেলো। প্রখর কৌতূহলে বেঁকে গেল ভ্রু দুটো। নিঃশ্বাস নিলো ধীরে। এতক্ষণ তাকিয়ে ছিল হ্যাভেনের দিকে। কিন্তু তার কথায় চোখ নামিয়ে নিলো। সচকিত হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল বিরস মুখে,
” তখন ছলনার কথা বললেন কেন? আমি তো পূর্বে আপনাকে তেমন চিনতাম না। তাহলে ধোঁকা কখন দিয়েছি? ”
হ্যাভেন মৃদু হাসল। যেই হাসিতে মেশানো বিদ্রুপ, তাচ্ছিল্য। স্পষ্ট কন্ঠে অরুর দৃঢ়তার বিরোধিতা জানিয়ে বলল,
” তোমার হরিণী নেত্রদ্বয়ে আমার জন্য ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছি না। তাহলে কিসের ভিত্তিতে নিজেকে আমার নিকট সমর্পণ করতে চাইছো? এটাও একপ্রকার ধোঁকা! ”

অরু মিয়িয়ে যায়। ও সত্যি হ্যাভেন’কে ভালোবাসে না। অথচ, হ্যাভেন নিখিলের চেয়ে এবং অরুর এযাবৎ দেখা সকল যুবক পুরুষদের থেকে একটু বেশি সুন্দর। যেমন গায়ের রঙ, তেমন মুখমন্ডলের আকৃতি, শারীরের অবকাঠামো মারাত্মক সুন্দর। স্পেশালি হ্যাভেনের জোড় ভ্রু, সরু গোল নাক আর চাপ দাঁড়ি নজরকাড়া। যদিও হ্যাভেন দাঁড়ি রাখে না। সর্বদা ক্লীন শেভ করে। তবে যখন খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গজায়, তখন পুরো চকলেট বয় লাগে দেখতে। এটা অরু নিরদ্বিধায় স্বীকার করতে বাধ্য। তবুও লোকটার প্রতি ভালোবাসা নেই। ভালোবাসা জোর করে হয় না। এখন কী উত্তর দেবে? শুষ্ক ঢোক গিলল সে। আত্মগ্লানিতে স্তব্ধ হয় হৃদয়। অরু কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকল। ওর চোখ দুটো গভীর জলাশয়ের মতো, যেখানে ঢেউ নেই, শুধু গভীর অথৈ নীরবতা।
অরু জিভে ঠোঁট ভেজায়। মস্তক নিচুতে করে নিলো। অস্বস্তি মাখা কন্ঠে রিনরিন শব্দে আস্তে করে জানালো,
” আমি শুধু আমাদের মধ্যবর্তী সম্পর্ক ঠিক করতে চাচ্ছিলাম। ”
হ্যাভেন দাঁতে দাঁত চেপে ধরল। চোখ বুজে রাগ সংবরণ করতে চাইল। পাতলা কিঞ্চিৎ লালীমাকৃত ঠোঁটে হতাশ বাঁকা হাসি ফুটিয়ে রাশভারী গলায় বলে ওঠে,

” বিশ্বাসের মর্মে আঘাত করে এমন এক যে? মেনে নিতে হৃদয় হয় চূর্ণ, তবুও মেনে নিতে বাধ্য! তোমার মুখনিঃসৃত বাণীতে ভালোবাসি থাকলেও, তোমার হৃদয়ের অন্তর্গত স্পন্দনে তার অনুরণন অনুপস্থিত। সেই হৃদয়হীনের অনুরণন স্বচ্ছতা সমেত দৃঢ় ভাবে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে, তোমার হরিণী নেত্রদ্বয়ে। তোমার চোখে আমার জন্য মন থেকে সাজ দেখতে পাচ্ছি না। তোমার চাহনি অন্য কিছু বলছে। হয়তো আমাকে ইমপ্রেস করতে চাচ্ছিলে, বাট ইটস নট ফেয়ার! ”
অরু মাথা তুলে তাকায়। একটু থেমে লম্বা শ্বাস টানল হ্যাভেন। অরুর বিহ্বলিত নয়নে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। পরপর মুচকি হাসল। শান্ত, শীতল চওড়া গলায় বলল,

” নিখিলের বর্বরতা, উচ্ছৃঙ্খল, উগ্রতা স্বীয় চক্ষুদ্বয়ে অবলোকন না করলে, আমার প্রতি জবরদস্তি ক্ষুদ্র সময়ের জন্য ভালো লাগার সুক্ষ্ম রেশ সৃষ্টি হতো না তোমার বক্ষঃস্থলে। তুমি ভাবছো নিখিল তোমাকে ধোঁকা দিয়েছে। খারাপ ছেলে। সে যদি তোমাকে ইগনোর করে বিন্দাস লাইফ ইনজয় করতে পারে, তাহলে তুমি কেন স্বামী নিয়ে সুখকর মুহূর্ত কাটাতে পারবে না। কিন্তু না! তোমার ধারণা ভুল! সত্যি বলতে, তুমি নিখিল’কে কখনো ভালোই ভাসোনি! তার প্রতি তোমার ক্ষণিকের জন্য আকর্ষণ ছিল শুধু। যা সময় মতো প্রকাশ পেয়েছে। তুমি যেটা ভালোবাসা ভেবেছো এতদিন? সেটা মোহ ছিল। একটি মানুষ যখন বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে ভালোবাসে, তখন তার ভালো, খারাপ সবকিছু নিয়েই ভালোবাসতে হয়। তুমি জানো সে খারাপ, তবুও তাকে ভালোবাসো। তাহলে সেটাই প্রকৃত ভালোবাসা। সবাই ভালো জিনিস খোঁজে। মন্দ জিনিস সহ কাউকে হাসি মুখে মেনে নিয়ে তাকে আপন করার স্বপ্ন দেখলে, সেটাই খাঁটি সত্যিকারের ভালোবাসা। ”

লম্বা শ্বাস টেনে কিছুপল থামল। অরু ঔৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। হ্যাভেন পুনরায় দৃঢ়তা সমেত ভরাট কন্ঠে বলতে লাগলো,
” এই যে নিখিলের মধ্যে জাস্ট কিছু খারাপ আচরণ দেখেই তুমি তাকে ঘৃণা করছো? তাকে নিমিষে ভুলে নতুন ভাবে কাউকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছো? এতে এতদিনের ভালোবাসার মর্মটা রইল কোথায়? এত ভালোবাসতে অথচ ভালোবাসার মানুষটার ছোট ছোট কিছু ভুল ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখতে পারলে না? তাকে ছেড়ে দিলে, অভিশাপ দিচ্ছো অবলীলায়। চমৎকার! কখনো যদি আমার মধ্যে এমন কোনো আচরণ দেখো, তখন তুমি আমাকেও ত্যাগ করতে দ্বিতীয়বার ভাববে না! আজ যদি নিখিলের এসব ফালতু উগ্র আচরণ স্বচক্ষে না দেখতে, তাহলে আমার জন্য তোমার মস্তিষ্কের ভেতর সামান্য ভালো লাগার মতো অনুভূতি জন্ম নিতো না। হ্যাঁ মস্তিষ্ক! কারণ, মন থেকে আমার প্রতি তুমি ইন্টারেস্ট হলে, সেটা তোমার চোখে ভেসে উঠতো। তোমার নিগূঢ় চাউনী সুস্পষ্ট ভাবে জানান দিচ্ছে, তুমি নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমায় কাছে টানার চেষ্টা করছো। যা আমার সহ্য হচ্ছে না! যন্ত্রণা দিচ্ছে অন্তঃকরণে। তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে সেই বেদনাদায়ক প্রেম নামক মরণশীল বিষ! কাঁটার মতো বিঁধছে বুকের বাম পাশে! ”

অরু অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে সবটা শুনল। অবুঝ উত্তেজিত মস্তিষ্কে তোলপাড় সৃষ্টি হলো হ্যাভেনের বলা দৃঢ় কাটকাট প্রত্যেকটি কথা। হ্যাভেন এগিয়ে আসে। অরুর পাশে বসলো অবলীলায়। নজরে নজর রাখল। হাত বাড়াল। অরু ঘাবড়ে যায়। পুনরায় আঘাত করবে কি? অরুর ধারণা ভুল প্রমাণ করে, হ্যাভেন শক্তপোক্ত হাতের করতল আঁকড়ে ধরল সন্তর্পণে অরুর রক্তাভ গাল।
শান্ত নিগূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে হ্যাভেন নিরেট স্বরে বলে উঠলো,
” সময় নেও। আমার কোনো তাড়া নেই। যেদিন তোমার চোখে নিজের জন্য ভালো লাগা নয়, বরং সরাসরি ভালোবাসা দেখতে পাবো? তোমাকে মুখ ফুটে বলতে হবে না। সেদিন আমি নিজে থেকেই তোমায় কাছে টেনে নিবো। শুধু শরীর না, অদৃশ্য আত্মার সঙ্গে জুড়ে যাবে তুমি। ততদিন দূরত্ব অব্যাহত থাকবে আমাদের ভাঙাচোরা সম্পর্কের মাঝে। ”

মেয়েটা মন খিঁচে মাথা নুইয়ে রাখল। আড়ষ্টতায় ছেয়ে গেল সর্বাঙ্গ। ছিঃ! দিকবিদিক ভুলে ওইসব কী বলে ফেলেছিল তখন?
ভাবনায় বিভোর অরু অকস্মাৎ ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে। মৃদু আওয়াজে ব্যথাতুর শব্দ তুলল মুখে। আর্তনাদ করে কেঁদে উঠল মুহুর্তে। কারণ, হ্যাভেন আলতো করে ব্যথানাশক মলম লাগিয়ে দিচ্ছে অরুর বিদীর্ণ চামড়ায়। যা জ্বলে যাচ্ছে। অরু থমকে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। মায়াভরা ছলছল লোচনে অনিমেষ চেয়ে থাকল। উপলব্ধি করল বুকের ভেতর কিছু ভালো লাগার সুপ্ত উৎফুল্ল অনুভূতির ধকধকানি।

প্রেমপিপাসা পর্ব ১৭ (২)

কিয়ৎক্ষণ বাদে অতি সন্তপর্ণে হ্যাভেন উষ্ণ ওষ্ঠপুট এগিয়ে নিরদ্বিধায় গভীর চুমু এঁটে দিল, চক্ষু সম্মুখে থাকা ভগ্নহৃদয়ের রমণীর ছোট ললাট দেশে। অতঃপর গভীর নদীর মতো অত্যন্ত শান্ত, আহত, ব্যাকুল আওয়াজে উচ্চারিত করল ক্ষুদ্র এক বাক্যবহর,
” সরি অরু পাখি। আ’ম রিয়েলি সরি। ”

প্রেমপিপাসা পর্ব ১৯