প্রেমপিপাসা পর্ব ১৯
সুমাইয়া সুলতানা
মধ্যরাত পেরিয়ে ধরিত্রীতে নেমে এসেছে শেষ প্রহরের নিস্তব্ধতা। চারপাশ নীরবতায় থমকে আছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে পুরো শহর নিঝুম। কোনো এক অজানা আশঙ্কায় বাতাস ভারী হয়ে আছে। রাতের এই গভীরতা ভেদ করে হ্যাভেনের অফিস ভবন দাঁড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গ এক প্রহরীর মতো। তবে এই নিশ্ছিদ্র নীরবতার মাঝেও, সেই বহুতল ভবনের কোনো এক ফ্লোরে ছায়ার মতো নিঃশব্দে ঢুকে পড়েছে এক আগন্তুক।
আগন্তক অন্ধকারের কুয়াশা উপেক্ষা করে এগিয়ে যায় নিঃশব্দে, সতর্ক পায়ে। তার নিঃশ্বাস পর্যন্ত বোঝার উপায় নেই। যেন সে সুযোগ পেয়েছে কাঙ্ক্ষিত কাজটি করার জন্য। অন্ধকারের গভীরতা আর রাতের স্তব্ধতা মনে হচ্ছে আগন্তুকের পক্ষেই কাজ করছে। অফিসে হ্যাভেনের বরাদ্দকৃত কক্ষে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঢুকে দরজা নিঃশব্দে বন্ধ করে দেয় সে। সোজা গিয়ে দাঁড়ায় ডেস্কের সামনে। চারদিকে দ্রুত দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়। তারপর ধীরে ধীরে ড্রয়ারের দিকে হাত বাড়ায়। একটানে খুলে ফেলে সেটি। আগন্তুকের আঙুল অস্থির ভাবে কিছু খুঁজে বেড়ায়।
আগন্তকের চোখ চকচক করছে উত্তেজনায়, কিন্তু মনের ভেতর চাপা উদ্বেগ। খুঁজে পাওয়া চাই! যেকোনো মূল্যে! ড্রয়ার হাতড়ে সে পেয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত চাবিটি। একটানে তুলে নেয়। এক মুহূর্তও নষ্ট না করে সে সোজা চলে যায় অফিস রুমের এক কোণে রাখা ভারী ধাতব আলমারির সামনে। চাবিটি ঢুকিয়ে ঘোরায়। সঙ্গে সঙ্গেই এক ধাতব খটখট শব্দে খুলে যায় আলমারি।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ভেতরে সারি সারি ফাইল সাজানো। দ্রুত হাত চালিয়ে প্রয়োজনীয় ফাইল খুঁজতে শুরু করে সে। পৃষ্ঠা ওল্টায় একটার পর একটা, উন্মাদের মতো। কাগজের খসখস শব্দ ভেদ করে তার অস্থির নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। চোখে অসহ্য এক তীব্রতা। কোথায়? কোথায় সেটা? সময় অল্প!
একপর্যায়ে হাত থমকে যায়। পাগলের মতো এদিক-ওদিক তাকিয়ে আগন্তুক স্বীয় মনে বিড়বিড় করে,
” ওহ, ড্যাম ইট! ”
একরাশ হতাশা ছড়িয়ে পড়ে আগন্তুকের কণ্ঠে। প্রয়োজনীয় জিনিসটা কোথাও নেই! তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে,
” এটা এখানে থাকার কথা! নেই কেন? আমি নিজে দেখেছিলাম হ্যাভেন এই আলমারিতে রেখেছিল। ”
একটু থেমে নিজের চুলে আঙুল চালিয়ে মাথাটা ঝাঁকিয়ে নেয়। তারপর আবারও হাত চালায় ফাইলের ভেতর। সময় ফুরিয়ে আসছে। আর মাত্র কয়েক মিনিট, তারপর হয়তো অফিসের সিকিউরিটি গার্ড চেক দিতে আসবে। বাইরে কোথাও কেউ দেখে ফেললে বিপদ! হ্যাভেন ঘুনাক্ষরে টের পেলে গরম তৈল আর পানির মধ্যে চুবিয়ে মারবে! ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো। ঢোকার সময় কেউ দেখেছে নাকি বোঝা মুশকিল। কেউ জানে না সে এখানে ঢুকেছে, কিন্তু এই মুহূর্তে তার মাথার ভেতর ঝড় বইছে।
সকল সিসিটিভি ক্যামেরা সে আগে থেকেই অতি কৌশলে অফ করে রেখেছে। কাজটা কমপ্লিট করে অন করে দিবে। অফিসের কোথায় কি আছে খুব ভালো করে জানা আছে তার। কিন্তু যদি ব্যাকআপ থেকে কিছু রেকর্ড হয়ে থাকে? হ্যাভেন ভীষণ ধুরন্ধর একজন মানুষ। সে মুখে বলে এক, মস্তিষ্কের ভেতর চলে আরেক! ভাসা ভাসা নিগূঢ় চাউনী যেন বাজপাখির দৃষ্টি! বলা তো যায় না, সকলের দৃষ্টির অগোচরে পুরোপুরি সেফটির জন্য অন্য কোনো ছোট সাইজের ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছে কি না? কিন্তু সেটা কোথায় লাগিয়েছে কিভাবে জানবে? কিভাবে বুঝবে? হাতে সময় নেই! এই চিন্তা মাথায় আসতেই আগন্তুক থমকে যায়। শরীরে ঘাম ছুটে গেল। পরমুহূর্তে নিজেকে বোঝালো,
” রিলাক্স ম্যান, রিলাক্স। ডোন্ট বি এক্সাইটেড। বেশি বেশি ভাবছি। এরকম কিছু নেই। আমি কোনো ভুল করিনি। সময় আছে, ঠান্ডা মাথায় ভেবে কাজটা করে বেরিয়ে যেতে হবে। ”
পুনরায় হাত চালায় সে। পেলো না যেটার জন্য এত আয়োজন! কিয়ৎক্ষণ পর আলমারির দরজা খোলা রেখেই এক পা পিছিয়ে আসে। আতঙ্কে নিঃশ্বাসের ভারী শব্দ হচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যে এক অনিশ্চিত উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো কক্ষে। শেষ মুহূর্তে কোনো কিছু পাওয়ার আগেই যদি তাকে এখান থেকে পালিয়ে যেতে হয়? তাহলে সকল প্রচেষ্টা বিফলে যাবে। এই ভাবনায় মস্তিষ্কে রাগ চেপে ধরে। অন্ধকার তার চারপাশে মোড়ানো, সময় তার প্রতিপক্ষ, আর ঘড়ির কাঁটা নীরবে এগিয়ে যাচ্ছে এক বিপজ্জনক সমাপ্তির দিকে।
রাতের নিস্তব্ধতা কেটে কোনো এক অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ কর্ণগোচর হতেই হ্যাভেনের তন্দ্রা ছুটে গেল। ঘুমের শেষাংশটুকু যেন মুহূর্তেই উড়ে গেল তার চোখ থেকে। আশপাশের নিস্তব্ধতা, গভীর রাতের ভারী পরিবেশ সব মিলিয়ে অস্বস্তিকর এক অনুভূতি দেহ-মনের ভেতর ছড়িয়ে পড়ল।
সে দৃষ্টি প্রথমেই বিছানার পাশে রাখা বেড সাইড ল্যাম্পে রাখল। আবছা আলোয় মিশে থাকা ল্যাম্পটি নিঃসঙ্গ এক প্রহরীর মতো, অপেক্ষায় যেন কেউ সুইচ টিপবে। হ্যাভেন এক ঝটকায় উঠে বসল। বেড সাইড ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিল। চারদিকে একঝলক চোখ বুলিয়ে নিলো। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। কাঁটা কাঁপতে কাঁপতে তিনটায় এসে স্থির হয়েছে। গভীর রাতের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে সময়, দিনের আলো ফোটার ঠিক আগমুহূর্তে।
হ্যাভেনের চোখ তীক্ষ্ণ, অনুসন্ধিৎসু। হঠাৎ নজর পড়ল মোবাইল ফোনের ওপর। হাত ধীরে সরে গেল বেড সাইড টেবিলের মোবাইলের আলো জ্বলজ্বল করছে সেটার দিকে। অন্ধকারের ফাঁকে স্ক্রিনের আলোর ম্লান ছটা স্পষ্ট হলো। সেই আলোয় ফুটে উঠল এক অদ্ভুত দৃশ্য। অফিসের নিরাপত্তা ক্যামেরার লাইভ ফিডে ধরা পড়া এক ছায়ামূর্তি, যে এখন হ্যাভেনের অন্ধকার অফিস কক্ষে উন্মাদের মতো কিছু খুঁজে চলেছে! দৃশ্যপট চক্ষু সম্মুখে স্থির হওয়া সত্ত্বেও হ্যাভেন’কে কোনো প্রকার বিচলিত হতে দেখা যাচ্ছে না। বরং অধর কামড়ে বাঁকা হাসল সে। ফোনটা পুনরায় টেবিলে রেখে দিল।
ফোনের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাশে শুয়ে থাকা অরুর দিকে তাকাল হ্যাভেন। মাত্র এক হাত দূরত্বে পড়ে আছে সে। স্থির, অস্থির এক ভগ্নহৃদয়ের রমণী। অন্ধকারের ফাঁক গলিয়ে শরীরের বেদনা দায়ক দাগগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। চোখের কোণে আলোতে চিকচিক কিছু একটা ঝলসে উঠল। অশ্রু! অরুর চোখের জল! হ্যাভেনের ভ্রু কুঁচকে গেল। অরুর নিঃশব্দে কাঁদছে?
সে সরু চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হাত বাড়াল অরুর কাঁধের কাছে। আলতো টেনে তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো। অরুর চোখ খোলা, পল্লব ভেজা, নোনাজলে মোড়া। ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু শব্দ নেই।
অরুর মুখ থেকে মৃদু বিড়বিড় শব্দ বেরোল, যা বোঝা যায় না। যেন কোনো স্বপ্নের গভীর থেকে কথা বলছে। যেন নিজের ভেতরকার দুঃস্বপ্নে বন্দি হয়ে পড়ে আছে, বাস্তবের সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে।
হ্যাভেন একটু ঝুঁকে এলো। কান পেতে শব্দ বোঝার বৃথা চেষ্টা করল। কোনো অর্থ খুঁজে পেলো না।
হ্যাভেনের বুক মুচড়ে উঠল। বক্ষঃস্থলে সুক্ষ্ম চিনচিন ব্যথা অনুভব করল। এভাবে চুপ করে থাকা, এভাবে নিজের মধ্যে ডুবে যাওয়া, একজন মানুষকে পুরো ধ্বংস করে দেয়। সেটা ও খুব ভালো করে জানে। অস্বস্তি আর অজানা আশঙ্কা হ্যাভেনের শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এলো শীতল স্রোত। এক ঝটকায় সে অরুকে টেনে নিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখল কিছুক্ষণ। বক্ষপট কেমন অস্বাভাবিক গতিতে কাঁপছে। অরুর শরীর শিথিল, হালকা গরম। কিন্তু মেয়েটার হৃদয়ের গভীর থেকে কোনো না বলা যন্ত্রণা কতটা ভয়ংকর, তা কি টের পাচ্ছে নিষ্ঠুরতম হ্যাভেন?
কিছু মনে পড়তেই তৎক্ষনাৎ মস্তিষ্ক সচল হয়। অরু’কে ছেড়ে বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে দাঁড়াল সে। ঝটপট বেড সাইড ল্যাম্প বন্ধ করে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিল। ব্যস্ত কদমে বাইরে চলে গেল। সোজা চলে যায় রান্নাঘরে। ফিরে এলো দশ-পনেরো মিনিটের মাথায়৷ হাতে ধোঁয়া উঠা গরম গরম খাবার। এক্ষুনি গরম করে নিয়ে এসেছে।
খাবার বেড সাইড টেবিলে রেখে, অরুর নিকট এসে বসলো। বাক্য বিনিময় না করে হাত টেনে এক ঝটকায় অরু’কে টেনে তুলল। ঘুমে ঢুলুঢুলু অরু হকচকিয়ে পিটপিট করে তাকায়। সম্মুখে হ্যাভেনের সাবলীল আদল দেখে, কয়েক ঘন্টা আগের মুহূর্ত স্মরণ হয়। তৎক্ষনাৎ প্রতিটি কোষ নাড়া দিয়ে উঠল। ভয় হচ্ছে। এখন উল্টাপাল্টা কিছু করবে না তো এই লোক? তটস্থ ভয়ে, আতঙ্কে, জড়বৎ পাথর বনে কাঁপতে থাকল। ভীতিগ্রস্ত কে জয় করার এক ভয়ংকর তান্ডব প্রশমিত করার স্পর্ধা দেখাতে পারলো না।
অরুর অস্বস্তি, ভয় বুঝতে পেরেও কর্ণপাত করল না হ্যাভেন। কঠোর গলায় আদেশ ছুঁড়ল,
” সোজা হয়ে বসো। খাবার এনেছি, খেয়ে নাও। ”
অরু মুখ ঘুরিয়ে নিলো। কোমর ব্যথায় জর্জরিত! বসে থাকতে পারছে না। পুরো শরীর চাবুকের আঘাতের ন্যায় যন্ত্রণা হচ্ছে। অরু পুনরায় বিছানায় ঢলে পড়ল। সেভাবে থেকেই তিরিক্ষি মেজাজ সহিত ত্যাড়ামি করে বলল,
” খাবো না। খিদে নেই। ”
ক্ষেপে গেল হ্যাভেন। চটে যায় মুহূর্তে। রাগান্বিত সুরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
” তখন শিক্ষা হয়নি, তাই না? নাউ, ডু অ্যাজ আই সেড। আদারওয়াইজ…! ”
কী গমগমে রুষ্ট শানিত কণ্ঠ! অরুর বুক ছ্বলাত করে উঠল। আঁচ পেলো হ্যাভেনের ক্ষুব্ধ মেজাজের। কয়েকঘন্টা পূর্বে বজ্জাত লোকের কর্মকান্ড স্বচক্ষে অবলোকন করেছে। সে প্রচণ্ড রেগে থাকলে আওয়াজ এমন গম্ভীর শোনায়। শুষ্ক ঢোক গিলল। দুরুদুরু চিত্তে উঠতে চাইল অরু। কোমরের হাড় ব্যথায় টনটন করল সহসা। হ্যাভেন সাহায্য করল উঠতে। ভীষণ বেগে কলমি ডগার মতো লতিয়ে দাঁড়াতে চাইল মেয়েটা। সক্ষম হলো না। নিজের প্রতি হতাশায় দ্বিখণ্ডিত বুক। হ্যাভেন দাঁড়াতে নিষেধ করল। পেছনে বালিশ রেখে হেলান দিয়ে নির্বিঘ্নে বসিয়ে দেয়।
নিজের হাতে ভাত মেখে, ছোট করে লোকমা বানিয়ে অরুর মুখের নিকট এগিয়ে দিল হ্যাভেন। অরু মিনমিন করে জানালো,
” আমাকে দিন। আমি নিজের হাতে খাবো। ”
রাশভারী গলায় সাবলীল বিরোধিতা করল হ্যাভেন,
” চুপচাপ হা করো। ”
অরু তবুও চাপা স্বরে নিস্প্রভ গলায় বলে,
” আমার হাত আছে। ”
হ্যাভেন গম্ভীর কণ্ঠে ধমকে বলল,
” থাপ্পড় মেরে মুখ বাঁকা করে ফেলবো। রাগ উঠাবে না। ”
অরু থেমে যায়। আধার নামে সুশ্রী মুখে। অশ্রুসিক্ত নয়নে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকল। ধমকে বুক ভারী হলো সহসা। কান্না পাচ্ছে ভীষণ। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না সংবরণ করার ব্যর্থ চেষ্টা চালাল।
ফোঁস করে ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছাড়ল হ্যাভেন। না দেখার ভান করে চওড়া কন্ঠে ফের বলে ওঠে,
” খেয়ে নাও। ”
কান্নার তোপে অরু ঠোঁট উল্টে রিনরিন শব্দে প্রশ্ন করলো,
” এখন? ”
হ্যাভেনের ভরাট স্বরের স্বাভাবিক জবাব,
” খাবারের জন্য সময় নির্দিষ্ট ভাবে ফিক্সড করা নাকি? বাবার বাড়ি থেকে ফিরে সেই যে রুমে এসে ঘাপটি মেরে বসে ছিল, সারাদিন আর খাওনি। আমি বাড়িতে ফেরার পর অল্প খেয়েছো, তবে খাবার না, আমার কামড়। যদিও তুমি নিজের দোষে খেয়েছিলে। মনমালিন্যের পর খাবার না খেয়ে, চিৎপটাং হয়ে জেদ ধরে শুয়ে ছিলে। এতক্ষণে নাড়িভুড়ি হজম হয় গিয়েছে মেবি। কথা বাড়িয়ে কাজ নেই। জটপট মুখ খোলো। আমিও না খেয়ে আছি। ”
ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও অরু খাবার খেলো। হ্যাভেন যত্ন সহিত অরু’কে খাইয়ে, নিজে খেয়ে নিলো। এঁটো প্লেট, বাটি রান্নাঘরে রেখে আসলো হ্যাভেন। আসার সময় এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে এসেছে। দুধ দেখে মুখমন্ডল বিকৃত করে নিলো অরু। ও খুব ভালো করে বুঝতে পারছে, এখন দুধ ওকে গেলাবে বজ্জাতটা?
হ্যাভেন ভরাট কন্ঠে কঠোর আদেশ ছোড়বার আগে আকুতি নিয়ে অরু হুড়মুড়িয়ে বলে,
” দুধ খাবো না। এটা খেলে এক্ষুনি বমি করে ভাসিয়ে দিবো। যা খেয়েছি পেটে সেটুকু খাবারও অবিশিষ্ট থাকবে না। ”
হ্যাভেনের কোনো ভাবান্তর ঘটলো না। দুধের গ্লাসে ব্যথা আর জ্বরের মেডিসিন দিয়ে, গ্লাস ঝাঁকিয়ে নিলো। মেডিসিন মিশ্রিত দুধের গ্লাস অরুর মুখের সামনে ধরল। অতঃপর শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
” তোমার শরীর দুর্বল। ভণিতা ছাড়া যা বলছি শোনো। ফিনিশ ইট। ”
দুধের কড়া গন্ধ নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করতেই অরুর গা গুলিয়ে উঠল। দু’হাতে মুখ চেপে ধরল। নাকমুখ কুঁচকে ফেলল মুহূর্তে। তিমিরে ঢাকা মুখশ্রীতে তাকাল, নিজের বাক্যে অটল থাকা হ্যাভেনের পানে। বারবার দু দিকে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো, ও খাবে না।
অরুর না কে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ক্ষেপে উঠল হ্যাভেন। চোখ পাকিয়ে নিরবে শাসায়। কঠোর গলায় বলল,
” খেতে বলেছি। ”
অরু অসহায় মুখভঙ্গিতে তাকায়। গোমড়া মুখে দুধের গ্লাস হাতে নেয়। নাক চেপে অল্প অল্প করে খাওয়া শুরু করে। খাওয়ার মাঝে ললাটে প্রগাঢ় ভাঁজ ফেলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল হ্যাভেনের আদলে। সরু চোখে চেয়ে জানতে চাইল,
” আপনি কিভাবে জানেন? ”
হ্যাভেন ভ্রু উঁচিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে,
” কোন ব্যাপারে? ”
” এই যে আসার সময় নিখিল’কে রাস্তায় অপ্রত্যাশিত অবস্থায় দেখে ছিলাম। যদি না জানেন, তাহলে নিখিলের বর্বরতা সম্পর্কে অবগত হয়ে আমি তখন পাগলামি করেছি, সেটা নিয়ে আমাকে এত জ্ঞান দিতে পারতেন না। ”
তীর্যক চাহনি সহ দুর্বোধ্য হাসল হ্যাভেন। আঙুল ফোটাতে ফোটাতে মৃদুস্বরে দাম্ভিক সমেত দৃঢ় ভাবে প্রত্যুত্তর করলো,
” বউ আমার, গাড়ি আমার, ড্রাইভার আমার, ভিডিও কলে থাকা ড্রাইভারের মোবাইল ফোনটাও আমার টাকায় কেনা। আমি না জানলে কে জানবে?
বিস্মিত হলো অরু। অকস্মাৎ অক্ষিপট বড়ো বড়ো করে তাকায়। থমথমে মুখবিবরে থাকা শুষ্ক নরম ওষ্ঠপুট নিমেষে ঈষৎ ফাঁকা হয়ে গেল। অবাক হওয়ার দরুন মুখশ্রী জুড়ে রয়েছে একটা গুমোট বাতাবরণ ভাব!
অরুর রিয়াকশন উপলব্ধি করে, হ্যাভেন অগোচরে মৃদু হাসে। নিজে থেকে পুনরায় বলে,
” সকলের মাঝে ভালো, খারাপ দুটো দিকই রয়েছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী তা বেরিয়ে আসে। নিখিলের ক্ষেত্রেও তাই। ”
অরু বিরস মুখে নিরব ভাবে সবটা শুনল। বলার মতো কথা খুঁজে পেলো না। অর্ধেক দুধ খেয়ে লম্বা শ্বাস টানল। পরক্ষণে বুকে হাত গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হ্যাভেনের নিকট দৃষ্টিপাত করল। ম্লান মুখে আমতা আমতা করে জানায়,
” খেতে পারছি না। বমি আসছে। ”
হ্যাভেন কোনো প্রকার বাহানা শুনতে নারাজ। ভরাট কন্ঠে গমগমে আওয়াজ তুলল,
” পুরোটা শেষ করো। ”
বহু কষ্টে, অনেকটা সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে দুধের গ্লাস খালি করল অরু। উপরের ঠোঁটে লেগে থাকা দুধের ফেনার সাদা বুদবুদ বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে সন্তর্পণে মুছে দিল হ্যাভেন। আলতো করে দ্বিধাহীন ভাবে চুমু খেল অরুর থুতনিতে। পরপর তড়িৎ গতিতে সরে যায়। অরু হতবিহ্বল অক্ষিপটে চমকে ওঠে। বারকয়েক পলক ঝাপটায়। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকল।
হ্যাভেন রুমের লাইট অফ করে ডিম লাইট জ্বালিয়ে দিল। অরুর দুরত্ব বজায় রেখে ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে। হ্যাভেনের সহ্য হলো না। ফুঁসে উঠল তৎক্ষনাৎ। সবেগে দাঁত পিষলো। চোয়াল শক্ত করে, কনুই চেপে অরু’কে নিজের কাছাকাছি নিয়ে আসে। দুরত্বে থাকা দুটো বালিশ একত্রে মিলিত করে চোখের পলকে। অরু মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে উঠল। গ্রীবাদেশ ব্যথায় টনটন করছে। রাক্ষসটা ইচ্ছে মতো কামড়েছে না, ব্যথা তো করবেই! অল্প ডিম লাইটের হলদেটে আলোতে অরুর গলদেশে হাত ছোঁয়ায়। ব্যাথায় অরু অস্ফুট স্বরে শব্দ করে ওঠে।
হ্যাভেন তুরন্ত হাত সরিয়ে নিলো। অপরাধীর ন্যায় মুখাবয়ব বানিয়ে মিহি স্বরে জিজ্ঞেস করে,
” ব্যথা কমেনি? ”
অরু দুরত্ব বাড়ায়। ওপাশ ফিরে কাত হয়ে শুয়ে ক্রন্দনরত অবস্থায়, অভিমান মিশ্রিত রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে গলায় বলে,
” শুনে কি করবেন? আমি তো খেলার পুতুল। সবাই শুধু আমাকে আঘাত করতে জানে। কেউ কথার বিষাক্ত বাণ ছুঁড়ে হৃদয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে, আবার কেউ নিজের শরীরের জোর খাটিয়ে নরম চামড়া ছিন্নভিন্ন করে। আমার দুঃখ বোঝার সময় আছে কারোর নিকট? সবাই শুধু নিজেরটা বোঝে। তাদের সকল চাওয়া-পাওয়া নিরদ্বিধায় আমার উপর চাপিয়ে দেয়। অথচ আমার যে ছোট্ট একটা মন আছে, সেখানে কতশত অভিযোগ, বেদনা লুকিয়ে রয়েছে কেউ তা শুনতে চায় না। আর না তো শোনার চেষ্টা করে! ”
টপটপ করে অরুর হরিণী নেত্র থেকে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। থেমে থেমে নাক টানার শব্দ কর্ণকুহরে ভেসে আসছে।
হ্যাভেন চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শীতল গলায় বলল,
” আমাকে রাগিয়ে ছিলে কেন? ”
অরু কিছু বলল না। চুপটি করে রইল। হ্যাভেন আচানক ফিচেল হাসে। চাউনীতে দুষ্টুমির চিহ্ন। ব্যঙ্গাত্মক করে বলে উঠলো,
” কলিজা ছোট। এইটুকুতেই এই অবস্থা? সারাজীবন আমাকে সামলাবে কিভাবে? এত ক্ষুদ্র সত্তা নিয়ে আমাকে সিডিউস করার চেষ্টা করছিলে কোন সাহসে? ”
এ পর্যায়ে অরু ঘুরে তাকায়। বিহ্বলিত নয়নে চেয়ে শুধাল,
” আপনি সিডিউস হয়ে ছিলেন? ”
হ্যাভেনের সরল স্বীকারোক্তি,
” কেন হবো না? তোমার কি আমাকে পুরুষ মানুষ মনে হয় না? পাশে হালাল নারী, তারউপর পাতলা শাড়ি পড়ে হাজির হয়েছিলে সম্মুখে, সিডিউস না হয়ে উপায় আছে? প্রথমবারই ম্যানলি আচরণ করে বাবা হওয়ার ক্ষমতা রাখি। দেখতে চাও? ”
অরু ভড়কে গেল। থমথমে খায়। আড়ষ্টতায় নুইয়ে পড়ল মুহূর্তে। চার প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট হৃৎপিণ্ডটা ধরাস ধরাস করছে। ধুকপুকানি বাড়ছে তীব্র বেগে। শুষ্ক ঢোক গিলল। হা করে কিছু বলতে উদ্যত হতেই আকস্মিক গলদেশে ভেজা শীতল চুমুর পরশ পেলো। একটা, দুইটা পরপর অনেকগুলো। অরু ছটফটিয়ে উঠল। হ্যাভেন সময় নিয়ে আলতো করে চুমু খেয়ে মাথায় উঠায়।
অরু হুড়মুড়িয়ে আরেকটু ছিটকে দূরে সরে যায়। রিনরিন করে বলল,
” আপনি একটা বেহায়া, অসহ্যকর পুরুষ! ”
হ্যাভেন ভ্রুক্ষেপহীন তুরন্ত জবাব দিল,
” একবার উসকে যখন দিয়েছো, তখন নিয়মিত হুটহাট চুমুর ডোজ সামলানোর জন্য প্রস্তুত থেকো। আর হ্যাঁ, এখন রেহাই দিয়েছি বলে খুশি হয়ে লাভ নেই। খুব শীঘ্রই তোমার পাতলা গড়নের দেহাঙ্গ ব্যথায় কুঁকড়ে দিতে আমি যেকোনো সময় হাজির হতে পারি। সো বি কেয়ারফুল! ”
অরুর মুখ চুপসে যায়। ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে তরতাজা নিরব হুমকিতে আতঙ্কিত হলো মুখশ্রী। জরাজীর্ণ দেহকে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। বোধহয় এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে যাবে। ঈষৎ কেঁপে উঠছে বারংবার।
রাত্রি শেষ হতে চলেছে। দুই কপোত-কপোতী দু’দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। ঘুম নেই কারো চোখে। একজনের মনগহীনে গভীর বিষাদ। অন্য জনের বধূয়ার ছোঁয়া পাওয়ার প্রখর নেশা! ছেলে চড়ুই পাখি অস্বস্তিতে ভুগছে। নিজের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার তীব্র আশঙ্কায় কাতরাচ্ছে নিরবে নিভৃতে!
অরুর দিকে ফিরে হ্যাভেন মৃদুস্বরে ডাকল,
” অরু? ”
অরু সাড়া দিল না। হ্যাভেন আবার ডাকতে লাগলো। তবে এবার একটু জোরে,
” অরু, শুনছো? ”
অরু নির্বিকার। হ্যাভেন দমে গেল না। নরম কন্ঠে ডাকে,
” অরু পাখি? ”
অরু পূর্বের ন্যায় নিশ্চুপ থাকল। সবকিছু আগের মতো নিস্তব্ধতা। হ্যাভেন হতাশ হয়। অত্যন্ত নরম গলায় ফের একই ভঙ্গিতে আওয়াজ তুলল,
” অরু সোনা? ”
এবারেও কাঙ্ক্ষিত রমণীর থেকে আশাপূরণ প্রত্যুত্তর পাওয়া গেল না। হ্যাভেন তেতে উঠল। কানের নিকট মুখ এগিয়ে, আগের তুলনায় গলার স্বর কর্কশ তুলে চেঁচিয়ে ডেকে ওঠে,
” অরুউউউ? ”
অরুর চোখে ঘুম প্রায় চলে এসেছিল এতক্ষণে। হ্যাভেনের বাজখাঁই চিৎকারে তৎক্ষনাৎ ঘুম উবে গিয়েছে। শরীর ভীষণ ক্লান্ত। ঘুম প্রয়োজন আর এ লোক তখন থেকে রংতামাশা করছে! বিরক্ত হয়ে হ্যাভেনের মুখোমুখি হলো সে। ঝাঁঝালো গলায় বলল,
” কি হয়েছে? চেঁচাচ্ছেন কেন? ”
হ্যাভেন কাঁদো কাঁদো মুখভঙ্গিতে জানায়,
” একটু কাছে আসো তো। ভোরের দিকে আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা রূপ ধারণ করছে। দেখো, নিউমোনিয়া কেমন হা করে তাকিয়ে আছে। ভয় করছে খুব। আমার শরীর এখন গরম করা প্রয়োজন। ”
অরু ফোঁস করে তপ্ত শ্বাস টানল। পরপর মেজাজ তুঙ্গে তুলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। দাঁতে দাঁত পিষে কটমট করে তাকায়। নিজের মাথা নিজের ফাটাতে ইচ্ছে করছে। কপাল কতটা খারাপ হলে এরকম ধাঁচের বর জুটে! কয়েক ঘন্টা আগে ওরকম জঘন্যতম আচরণ করার পরও বেহায়ার মতো জবরদস্তি চিপকাচিপকি করছে। নির্লজ্জ লোক!
কিছু বলার আগে, হ্যাভেন আলগোছে কাছে টানে তাকে। অরু ছোটার জন্য ছটফট করছে না। কিভাবে করবে? শরীরে শক্ত থাকলে তো! নেতানো শরীরটা প্রচন্ড দুর্বল।
নিভৃতে স্বযত্নে অরুর দেহশ্রী আপন বক্ষঃস্থলে আগলে নিলো হ্যাভেন। অরুর কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে হাস্কিস্বরে বলে উঠলো,
প্রেমপিপাসা পর্ব ১৮
” তোমার মিথ্যা অনুভূতি রিজেক্ট করেছি বলে ইগোতে লেগেছে? তেজ দেখাচ্ছো আমাকে? সেটার রেশ ধরে আমি এতবার ডাকার পরও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালে না, যা ইচ্ছে তাই করছো! দিস ইজ অ্যা কাইন্ড অভ ইনফরমেশন মাই ধানিলংকা, আ’ম হ্যাভেন তালুকদার। আমি মোটেই ভালো মানুষ না। বি এলার্ট! আমার নিউমোনিয়া তড়তড় করে বেড়ে যাচ্ছে। চটজলদি বুকে আসো। নির্বিঘ্নে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরো।নয়তো মেজাজ বিগড়ে গেলে তোমার সাথে বড়োদের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে এক মিনিট সময় লাগবে না।
