প্রেমপিপাসা পর্ব ২৫
সুমাইয়া সুলতানা
নিভে আসা রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে দিগন্তের কোণে ধূসর আলোর ক্ষীণ রেখা জেগে উঠলেও, বাতাসে এখনো শীতল কুয়াশার বিষণ্নতা লেগে রয়েছে। দমচাপা ঠান্ডায় চামড়া কেঁপে ওঠে, ভেজা মাটির গন্ধে কেমন যেন বিষণ্ন আবেশ মিশে আছে। দূরের কোনো তেঁতুলগাছের শুকনো পাতারা ক্ষীণ বাতাসে একে অন্যের গায়ে ঘষা খেয়ে কর্কশ সঙ্গীত তোলে, যেন বিদায়ী রাত্রির শেষ আর্তনাদ। অদৃশ্য নিশাচর প্রাণীগুলো তখনো আধো-অন্ধকারে নিশিপাখির মতো বিচরণ করে, কাকচক্ষু সজাগ। গাছের ফাঁকফোকরে আটকে থাকা কুয়াশার ধূসর কুন্ডলী অস্থিরভাবে দুলতে থাকে, মনে হয় রাতের কোনো প্রেতাত্মা দিগভ্রান্ত হয়ে পথ খুঁজছে। ধীরে ধীরে শূন্যতার বুক চিরে মসজিদের মিনার থেকে ধ্বনিত হয় এক দীর্ঘ নিঃশ্বাসের মতো ফজরের প্রথম আযান একটি সুরময় আহ্বান, যা নিস্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করে।
আশ্রয়হীন বাতাসের থমথমে ভারে গোডাউনের বাতাস ভারী হয়ে আছে, জানান দিচ্ছে বহু পুরোনো সময় আটকে আছে তার বুকের মধ্যে। পুরোনো কাঠের বাক্সগুলোর ছিদ্র দিয়ে ফাঁটল ধরা আলো ঢোকে, কিন্তু আলো এখানে অপরাধী, তাকে কেউ গ্রহণ করতে চায় না। কোণে জমে থাকা ধুলোয় পোকামাকড়ের আনাগোনা, তাদের ক্ষুদ্র পদসঞ্চারের শব্দ পর্যন্ত শোনা যায় নীরবতার বুকে।
এমন সময় অন্ধকারের গভীর থেকে শোনা যায় এক বিভীষিকাময় আর্তনাদ মানুষের, যা অমানুষিক! সেই চিৎকারে যন্ত্রণার সব রঙ মিশে আছে, ক্ষতবিক্ষত কণ্ঠের এক অশরীরী অভিশাপ! মৃদু অন্ধকারাচ্ছন্ন দেয়ালের সঙ্গে প্রতিধ্বনিত হয়ে চিৎকারটা আরো কর্কশ হয়, আর্তচিৎকার এতটাই প্রবল যে, মনে হচ্ছে শত বছরের বন্দিদশার আর্তি এক লহমায় ছিটকে বেরিয়ে আসছে। আতঙ্কের হিমশীতল ছোবল বাতাসের শিরা-উপশিরা দিয়ে রক্তের মতো প্রবাহিত হয়ে ধরা দিচ্ছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
গোডাউনের শীতল, আঁধারাচ্ছন্ন বাতাসে ধুলো ভেসে বেড়াচ্ছে, প্রতিটি শ্বাসে বিষের মতো কুন্ডলী পাকিয়ে ঢুকে যাচ্ছে ফুসফুসের গভীরে। স্যাঁতসেঁতে দেয়াল বেয়ে মদের জল গড়িয়ে পড়ছে। এখানকার প্রতিটি ইঞ্চি এক অজানা আতঙ্কের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শক্ত নাইলন দড়ি দিয়ে বাঁধা অসহায় শরীরটা ক্রমশ ঘামে ভিজে নরম কাদার মতো নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছে। আর্তনাদ করতে চাইলেও গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে গিয়েছে প্রচণ্ড ভয় ও যন্ত্রণার ভারে।
হ্যাভেন হাতে থাকা চকচকে ছুরিটা উল্টে পাল্টে দেখছে। গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সম্মুখের ভঙ্গুর হাত, পা বাধাপ্রাপ্ত মেঝেতে পড়ে থাকা দুর্বল শরীরটার পানে। ঠোঁট জোড়া গোল করে ভারিক্কি বাতাস ছাড়ল পবনে। গ্রীবা বাঁকিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুর নিকট একপল চেয়ে তাকাল। পরক্ষণেই একদম ধীর কদমে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু ভেঙে বসলো লোকটার সামনে। হ্যাভেনের শান্ত, কপটতা, পৈশাচিক হাবভাবপূর্ণ মুখমন্ডলে নজর পড়তেই লোকটার বুক ছ্যাঁত করে উঠে। নিমিষে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল ভয়ার্ত মুখে। চেহারা ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করেছিল আরও আগেই, এখন হ্যাভেনের কাছাকাছি তা বৃদ্ধি পেয়েছে। গলবিল এক ফোঁটা পানির অভাবে শুকিয়ে বালুকাময় মরুভূমির মতো শুকিয়ে আসছে। শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাঁপছে সবেগে।
হ্যাভেন ছুরিটার সরু মাথা লোকটার উন্মুক্ত বুক বরাবর লাগিয়ে আঁচড় টানতে লাগলো। হ্যাভেনের অমানবিক নির্যাতনের তোপে লোকটা গলা ছেড়ে ব্যথাতুর শব্দ করছে, আর গুঙিয়ে যাচ্ছে। হ্যাভেনের তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে আপন কাজে অটল। লোকটার চিৎকার ওকে স্বস্তি দিচ্ছে। এই আর্তনাদ গোডাউনের দেয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, বাইরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। হ্যাভেনের এই বাড়িটা বাইরে থেকে দেখতে কত সুন্দর পরিপাটি মনে হয়, কিন্তু তিনতলায় অন্ধকারময় গোডাউন বানিয়ে রেখেছে।
” জা’নো’য়ারটাকে কি ভালো মতো খাতিরযত্ন করো নি? নয়তো এখনো চুপ করে আছে কেন? ভালোবাসার ডোজ কম পড়ল নাকি? ”
টিমের ছেলেদের দিকে চেয়ে গমগমে গলায় বিদ্রুপ সরূপ কথাটা বলল হ্যাভেন। একজন রয়েসয়ে বিনম্র সহিত উত্তর দিল,
” স্যার, রাত থেকে এ পর্যন্ত কম টর্চার করা হয়নি, তবুও শালা মুখ খুলছে না। ”
হ্যাভেন নজর ফিরিয়ে নিলো। দৃষ্টি তাক করল দড়ি বাঁধা লোকটার উপর। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে বিদীর্ণ লোকটাকে। লোকটার চোখ দুটি বিস্ফারিত, ভিতরে কী এক অগ্নিশিখা দাউদাউ করে জ্বলছে, আবার নিভেও যাচ্ছে অনিশ্চয়তার কালো অন্ধকারে। কপালের শিরাগুলো ফুলে গিয়েছে, রক্তের ধমনীগুলো চাপের জ্বালায় ফেটে যাবে যে কোনো মুহূর্তে। ঠোঁটের কোণে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত জমাট বেঁধে আছে, জিভের আগায় লোনাজল আর ভয় মিশে এক তীব্র পিপাসার সৃষ্টি করেছে, কিন্তু একফোঁটা জল চেয়েও সে মুখ খুলতে পারছে না। তার মুখের কাঠামো নিষ্ঠুর নির্যাতনের চিহ্ন বহন করছে। চোয়ালের হাড় বেরিয়ে এসেছে চামড়ার নিচ থেকে, অসংখ্য ডোরাকাটা চাবুকের আঘাতে শরীর বিভৎস অবস্থা। ক্ষতবিক্ষত যন্ত্রণা মিশে গিয়েছে প্রতিটি কোষে। চোখের নিচে গাঢ় ছায়া, নিদ্রাহীন বিভীষিকাময় টর্চার রাতের সাক্ষ্য দিচ্ছে। ভয় তার চোখের মণিতে স্থায়ী ছাপ রেখে দিয়েছে, সেগুলো আর কখনো আগের মতো স্বাভাবিক দেখাবে না। কিন্তু তবুও সে মুখ খুলতে রাজি নয়।
লোকটার থেকে দৃষ্টি সরাল। পরপর বন্ধুর দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ রাশভারী কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ল হ্যাভেন,
” আরেকজন কোথায়? দু’জন ছিল না? ”
বুকে হাত গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুর নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সাবলীল জবাব,
” পালিয়ে গিয়েছে। ”
হ্যাভেন গজগজিয়ে উঠল। হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়। চিবিয়ে চিবিয়ে বাক্যবহর মুখনিঃসৃত ঘটল,
” তোরা কি করছিল? আটকাতে পারলি না? ”
বন্ধু ফোঁস করে ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলল। ঘূর্ণায়মান চলন্ত ফ্যানের নিচে এসে দাঁড়াল। দৌড়ঝাঁপ করায় শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। গায়ে থাকা জ্যাকেট খুলে ফেলল। ভোরে ঠান্ডা পড়ে, সেজন্য পড়েছিল, ধরণিতে এখনও সূর্যের আলোর দেখে মেলেনি তবুও ভ্যাঁপসা গরম লাগছে। ভারী জ্যাকেট বিরক্ত হয়ে খুলে ফেলেছে। নিরুদ্বেগ সহিত ক্ষেপে যাওয়া হ্যাভেনের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় প্রত্যুত্তরে জানিয়ে দেয়,
” সর্বোচ্চ চেষ্টা চলমান ছিল, ত্রুটি রাখা হয়নি, কিন্তু আমাদের টিমের যে ছেলেটা তাকে ধরে রেখেছিল, আচমকা তার চোখে ঘুষি মারে। হাতের বন্ধন ঢিলা হওয়া মাত্র তৎক্ষনাৎ সে পালিয়ে যায় অন্ধকারময় গহীনে। ”
হ্যাভেন ক্রোধে ফুঁসতে থাকল। লোকটার কাঁধ সমান চুল শক্ত করে মুঠোয় বন্দি করে টেনে তুলে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসায়। লোকটা টলছে। বসে থাকতে পারছে না। একপল ফুরসৎ না দিয়ে, হ্যাভেন গর্জে উঠে হাতে থাকা ছুরিটা লোকটার চার আঙুল মেঝেতে বিছিয়ে মাঝ বরাবর চেপে ধরল। লোকটা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠে। কন্ঠনালী ভেদ করে কথা আসছে না। অতিরিক্ত অযাচিত ব্যথা সবটা শুষে নিয়েছে।
দাঁতে দাঁত পিষলো হ্যাভেন। বলে উঠল রাগান্বিত সুরে,
” বাঁচতে চাইলে বল, কার কথায় টুটুল’কে কিডন্যাপ করতে গিয়েছিলি? তোর সাথের সঙ্গীটা কে? ”
লোকটা নির্বিকার। হাঁপানি রোগীদের মতো জোরে জোরে শ্বাস টানছে। পিটপিট করে তাকায়। মুখে কথা ফুটছে না। আসলে সে মাত্রাতিরিক্ত আঘাতে নেতিয়ে পড়েছে, তাই কথা বলতে সময় নিচ্ছে। কিন্তু হ্যাভেনের মনঃক্ষুণ্ন হলো। লোকটার মৌনতা পারদের মতো তেজ ছড়িয়ে পড়ল শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। মাথার মধ্যে আগ্নেয়গিরির জলন্ত লাভার মতোই রাগ উগরে উঠছে ভলভল করে। মাথায় আকাশ সমান জেদ চড়ে বসে। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল মুহুর্তে। খেই হারিয়ে ফেলল। ক্রোধের তোপে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে অচিরেই ছুরি দ্বারা চেপে ধরা চারটা আঙুল কে*টে ফেলল নিরদ্বিধায়। তীরের মতো রক্ত ছুটে বাইরে বেরিয়ে ভূপতিত হচ্ছে। লোকটা তড়পাচ্ছে, সমান তালে গুঙিয়ে যাচ্ছে। হ্যাভেনের মায়া লাগলো না। রক্তচক্ষুর নিগূঢ় চাউনি লোকটার উপর বর্তায়। নির্দয় ভাবে ত্বরিত গতিতে ছুরিটা লোকটার এক গালে দাবিয়ে চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে ধারালো ছুরি গেঁথে গিয়ে লোকটার গালের খরখরে অমসৃণ ত্বক কেটে জলকণার ন্যায় রক্ত বেরুতে শুরু করল।
হ্যাভেন চোয়াল শক্ত করে ক্ষুদ্ধ মেজাজের বহিঃপ্রকাশ ঘটাল তৎক্ষনাৎ,
” আমার প্রশ্নের জবাব দে। শুধু শুধু দুটো পয়সার জন্য, অন্যের হয়ে কাজ করে কেন নিজের মূল্যবান জীবনটা দিতে চাস? মরণের ভয় নেই? ”
লোকটা কাঁপছে, শরীরের প্রতিটি পেশি টানটান হয়ে আছে। নিজেই নিজের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। পাঁজরের হাড়ের নিচে আটকে থাকা প্রতিটি শ্বাস ভয়ের ভারী শিকল টেনে ধরেছে। নিঃশ্বাসের শব্দে আতঙ্কের গা শিউরে ওঠা সুর বাজছে। আশপাশের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চাপা গোঙানি, যা কানফাটানো চিৎকারের মতো মনে হচ্ছে এই ভয়াবহ নিস্তব্ধতার মাঝে। তার শরীর আর্তনাদ করছে, দেয়ালে ছায়া পড়ে ভয়ংকর বিকৃত আকারে, মনে হচ্ছে কোনো শয়তানি আত্মা এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মৃত্যুর ছায়ায় তার মুখের রেখাগুলো আরেক ধাপে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে।
লোকটা এক লহমায় বেঁচে থাকার ইচ্ছা পোষণ করল। সহ্যশক্তি যবানিকা টেনে জরানো গলায় থেমে থেমে অস্ফুট স্বরে ক্ষুদ্র বুলি আওড়াল,
” নিখিল নামের এক ছেলে ছিল সাথে। আর বস, মানে যার কথায় কিডন্যাপ করতে গিয়েছিলাম, তাকে সামনাসামনি কখনো দেখিনি আমি। তবে বস এর কাছের একজন লোক আছে, যার সাথে কাজের বিষয় সবকিছু আলোচনা করেন, তিনি আমাদের দিকনির্দেশনা দেন। তার মুখে একবার বস এর নাম শুনেছিলাম। ”
এতটুকু বলেই লোকটা অনিমেষ হাঁপাচ্ছে। হয়তো সময় ফুরিয়ে এসেছে। নিঃশেষ হতে চলেছে এই অন্ধকার গোডাউনে তার জীবন।
লোকটার কথা শুনে হ্যাভেনের নেত্রদ্বয় চকচক করে উঠল। বিগলিত হয় বক্ষপট। উন্মাদের মতো উদ্বিগ্ন চিত্তে কন্ঠনালী ভেদ করে বেরিয়ে আসে,
” নামটা বল? জলদি বল, কি নাম তার? ”
লোকটা অস্ফুট স্বরে বলতে যাবে, তক্ষুনি কোথা থেকে আগুনের উত্তপ্ত লোহিত খঞ্জরের ন্যায় একটা বুলেট এসে তীরের মতো বিঁধে গেল লোকটার কপাল বরাবর। একদম ঠিক চওড়া কপালের মাঝখানে। এতে বোঝা যাচ্ছে, গুলিটা যে করেছে, সে রিভলভার চালাতে কতটা পারদর্শী।
লোকটা তৎক্ষনাৎ ঢলে পড়ল রক্তাক্ত মেঝেতে। আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছে সবাই। হ্যাভেনের মুখবিবরে প্রজ্জ্বলিত আলো দপ করে নিভে গেল। মেজাজ যেন চূড়ায় পৌঁছাল। কি থেকে কি হলো বোধগম্য হচ্ছে না। সবকিছু ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে করছে। গুলির কোনো শব্দ নেই অথচ লোকটার কপাল ফুটো! তারমানে রিভলভার এ সাইলেন্সার লাগানো ছিল! অবশ্যই ছিল, নয়তো আওয়াজ কেন হলো না?
লোকটার গালে চাপড় মেরে, শরীর ঝাঁকিয়ে অস্থির হয়ে ডাকল হ্যাভেন,
” শুনতে পাচ্ছিস? অ্যাই, নামটা বল? মরার আগে নামটা অন্তত বলে যা। প্রমিস করছি, অনেক বড়ো ধুমধাম করে তোর জানাজা পড়িয়ে, মেজবানীর আয়োজন করবো। প্লিজ নামটা বল না রে। বলে যা নামটা। ”
লোকটার কোনো সাড়া নেই। গুলি লাগার সাথে সাথেই সে মারা গিয়েছে। হ্যাভেনের বাজখাঁই চিৎকার তার কর্ণগোচর হচ্ছে না। এদিকে আগে থেকেই টিমের সবাই, হ্যাভেনের বন্ধু সহ তন্নতন্ন করে পুরো বাড়ি, ছাঁদ, বারান্দা, লিভিং রুম খুঁজল কিন্তু তেমন কিছু পেলো না, আর না তো সন্দেহজনক কাউকে চোখে পড়েছে।
হ্যাভেনের মৃত লাশটার সঙ্গে এরূপ কথোপকথনে বিরক্তিতে নাকমুখ বিকৃত করল বন্ধু। ত্যাড়া চোখে চেয়ে ক্ষিপ্ত মেজাজ দেখাল,
” তোর মেজবানীর টাকা বেঁচে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি উঠে আয়, সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে দেখি কোনো সুরাহা পাওয়া যায় কি না। ”
কথাটা শেষ করে বন্ধু ফুটেজ দেখতে লাগলো। কিন্তু প্রশ্ন হলো বদ্ধ, ইট, সিমেন্ট, পাথরের তৈরী বিল্ডিংয়ের মধ্যে কেউ ঢুকে অকস্মাৎ গুলি করার সুযোগ পেলো কিভাবে?
হ্যাভেন উঠে দাঁড়ায়। জহুরি চক্ষুদ্বয় চারপাশ অবলোকন করল কিয়ৎক্ষণ। আচানক নিগূঢ় দৃষ্টি স্থির হলো জানালার উপর। এগিয়ে যায় ত্রস্ত কদমে। ভ্রু কুঞ্চিত করে তীর্যক চাহনি বর্তায়, জানালার উপরের অংশে। জানালার ছোট খিড়কির এক-তৃতীয়াংশ কাঁচের তৈরী। যা বর্তামানে অর্ধেক ভাঙাচোরা। শক্ত হাতের থাবায় ভাঙা হয়েছে, নয়তো ভারী কোনো বস্তু ছুড়ে মারা হয়েছে। সেখানে গোল চিহ্ন অর্থাৎ গুলি এখান থেকে করা হয়েছে। হ্যাভেন জানালা দিয়ে তাকায় নিচের দিকে। দড়ি বাঁধা নেই, তাহলে তিনতলায় কিভাবে এসে গুলি চালাল কেউ?
বন্ধুকে উদ্দেশ্যে করে বলে উঠল হ্যাভেন,
” এটা দেখ। ”
সে উঠে আসতেই হ্যাভেন দেখাল এবং ব্যাপারটা জানালো। বন্ধু উঁকি দিয়ে দেখল, আশেপাশে। পরপর হ্যাভেন’কে ভাবুকতা সমেত বলে,
” মেবি পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে ছিল সেই আগন্তুক। ছাদে থেকেই গুলি চালিয়েছে। ওখানে চেক করে দেখতে পারি, তবে মনে হয় না তেমন কিছু পাওয়া যাবে। ”
হ্যাভেন নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে, সম্মুখের প্রায় অনেকটা কাছাকাছি বিল্ডিংয়ের ছাদে তাকিয়ে থাকল। কে হতে পারে? সে কি হ্যাভেনের এই গোপন বিল্ডিংয়ের কথা জানতো? না জানলে এখানে আসলো কিভাবে? এখানে কি হচ্ছে জানলো কিভাবে?
হ্যাভেন একদম কাকভোর সকালে বেরিয়ে গিয়েছে বাড়ি থেকে। অরু তখন গভীর ঘুমে আচ্ছাদন ছিল। তিমিরে ঢাকা পরিবেশ ভয়ংকর গা কাঁপানো নৈঃশব্দ্যে থমথমে এক পরিস্থিতি। অরু ঘুটঘুটে আঁধারে ভয় পায়। হ্যাভেন থাকলেও ডিম লাইট জ্বালিয়ে ঘুমায়। অরু ঘুমিয়ে গেলে হ্যাভেন মৃদু আলোর ডিম লাইট অফ করে দেয়। কারণ, নূন্যতম আলোতেও তার ঘুমাতে অসুবিধা হয়। যাওয়ার পূর্বে টুটুল’কে সায়রের রুম থেকে এনে অরুর পাশে শুইয়ে দিয়ে যায়। সায়র দরজার ছিটকিনি কিংবা চাবী লক করে ঘুমায় না, জাস্ট দরজা ভিড়িয়ে আলগোছে লাগিয়ে রাখে।
হ্যাভেন কখন চলে গিয়েছে অরু টের পায়নি। যখন টুটুলের আধো আধো মিষ্টি আওয়াজ, আর মুখশ্রীতে আলতো হাতের পরশ পেয়েছে, তখন ঘুম ভেঙেছে। হ্যাভেন’কে দেখতে না পেয়ে অবাক হয়েছিল ভীষণ। সায়রার থেকে জানতে পারে, হ্যাভেন কোথায় গিয়েছে তিনিও জানেন না। অতঃপর টুটুলের সঙ্গে কিছুক্ষণ আদুরে আলাপ করে, ফ্রেশ হয়ে ভার্সিটির জন্য রেডি হতে শুরু করে। অল্পস্বল্প সাজগোজের জন্য ড্রেসিং টেবিলের কাছে আসতেই নজর পড়ে, অরুর কানের দুল রাখা বক্সের নিচে সাদা চিরকুট। কৌতূহল মেটাতে চিরকুট হাতে তুলে নেয়। তাতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ছিল,
” ইম্পর্ট্যান্ট কাজে যাচ্ছি, অরু পাখি। ভার্সিটি যেতে চাইলে সায়রের সঙ্গে চলে যেও অথবা বাড়ি গাড়ি নিয়ে যেও। আমার গাড়ি আজকে পাবে না, সেটা আমি নিয়ে যাচ্ছি। রাগ করো না, তুমি চাইলে নতুন গাড়ি কিনে দিবো। ”
অরু বুঝলো, বক্সের নিচে রেখেছে ইচ্ছে করে, যাতে ও সহজেই হাতে পায়। আনমনে হাসে সে। অজান্তেই মন পাখি পুলকিত হলো। লোকটার টুকটাক যত্নশীলতা কেন যেন ভালোই লাগে ওর। পরক্ষণেই মুখ বাঁকায়। ভেংচি কেটে দর্পণে একপল তাকিয়ে নজর ফেরায়। হ্যাভেনের গাড়ি না পেলে ও রাগ করবে কোন দুঃখে? যত্তসব ঢং!
অরু বাড়ির গাড়ি করে ভার্সিটি যায়। একটা ক্লাস করে বেরিয়ে আসে। আজকে মিষ্টি ভার্সিটিতে আসেনি, সেজন্য তার কিঞ্চিৎ মন খারাপ। অন্য বন্ধুবান্ধব থাকলেও মিষ্টি একটু বেশি ঘনিষ্ঠ। ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে বাড়ি যায়নি। কি মনে করে হ্যাভেনের অফিসে যাবে বলে ঠিক করল। বাবাকে দেখে না কয়েকদিন ধরে। দেখাও হয়ে যাবে, সাথে একটু ঘোরাঘুরিও। যেই ভাবা সেই কাজ। রাস্তায় টেক্সির জন্য দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির গাড়ি আসবে ভার্সিটি ছুটির সময়। ড্রাইভার তো জানে না, অরু এ-সময় ক্লাস না করে চলে আসবে। ড্রাইভারের ফোন নাম্বার অরুর কাছে নেই যে থাকলে তাকে ফোন করে আসতে বলবে। কি আর করার? অগত্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাবলিক গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।
বেশ কিছুক্ষণ পর একটা খালি টেক্সি পেলো। গাড়িটা অনেকটা রাস্তার মাঝখানে। আশেপাশে তেমন গাড়ির ভীড় ছিল না বলে অরু হেঁটে যাচ্ছে সেদিকে। গাড়ির কাছে যেতে নিবে তক্ষুনি চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল। প্রবল বেগে গমগমে শব্দে, কার্বনডাইঅক্সাইড ধোঁয়া উড়িয়ে ওর দিকে হর্ন না দিয়ে ধেয়ে আসছে দোতলা একটা বড়সড় বাস গাড়ি। গাড়িটা মাত্র অল্প একটু দূরে। অরু আতঙ্কিত হয়ে বাঁচার আশা ছেড়ে দিল। ছিটকে দূরে সরে না গিয়ে, উল্টো নেত্রদ্বয় খিঁচে বুজে ফেলল। সর্বাঙ্গ মাঘ মাসের শীতের ন্যায় থরথর করে কাঁপছে। পা দুটো মনে হচ্ছে অদৃশ্য কোনো শক্তি আটকে রেখেছে, নয়তো অরু নড়তে পারছে না কেন?
হঠাৎ খসখসে করতলের ছোঁয়া স্বীয় বাহুর মধ্যে অনুভব করতেই অরু তড়াক করে চোখ মেলে তাকাল। শরীর এখনো সমান তালে কাঁপছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে গিয়েছে। নিজেকে ঠিকঠাক দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। পরপর নজর বর্তায় টেক্সি গাড়ির উপর। গাড়িটা উল্টে পড়ে আছে। আগুন ধরেনি, তবে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছে। ইতোমধ্যে ভীড় জমেছে রাস্তায়। ড্রাইভার আহত হয়েছে সামান্য। কয়েকজন ধরাধরি করে কাছাকাছি হসপিটালে নিয়ে গেল তাকে। বাস চালককে আটক করে পাবলিক মারধর করল। জরিমানা দাবী করছে, টেক্সি চালকের হয়ে। একপ্রকার হট্টগোল বেঁধে গিয়েছে।
পাবলিক হতে দৃষ্টি সরিয়ে অরু জীবন বাঁচানো লোকটার দিকে তাকায়। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আশ্চর্য কন্ঠে শুধায়,
” আপনি এখানে? ”
মৃণাল হাস্যোজ্জ্বল মুখে উত্তর দেয়,
” জি, একটু দরকারে এদিকে এসে ছিলাম। এসে ভালোই হলো, বলুন? মানবতার কাজ করতে পারলাম। ”
অরু জিভ দ্বারা ঠোঁট ভেজায়। চিবুক গলাতে নামিয়ে ধীম স্বরে বলে,
” ধন্যবাদ। ”
মৃণাল শব্দ করে হাসল। মাথা চুলকে ভণিতা ছাড়া সাবলীল জানায়,
” আজকে ধন্যবাদ না দিলেও সেধে সেধে চাইতাম না। যতই হোক, আপনি হ্যাভেন স্যারের ওয়াইফ। ”
বিনিময়ে অরু মিষ্টি হাসি উপহার দিল। চঞ্চল ভঙ্গিতে জানত চায়,
” অফিসে যাবেন না? ”
ঠোঁটে চওড়া হাসি টেনে উৎফুল্ল চিত্তে বলে মৃণাল,
” যাব, তার আগে আপনাকে দায়িত্ব নিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি। ”
অরু তৎক্ষনাৎ বিরোধিতা করে,
” বাড়িতা না, আজকে আপনাদের অফিসে যেতে চাই। ”
” সিরিয়াসলি? ”
” ইয়েস। ”
মৃণাল অমায়িক হেসে বলল,
” চলুন। ”
জামশেদ ক্রাচের সাহায্যে হেঁটে হেঁটে অফিসের কর্মচারীরা কাজ ঠিকঠাক করছে কি না দেখে চলেছেন। যারা নতুন জয়েন করেছে, তাদের সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। ওনার আপাতত কাজ এই একটাই, সবকিছু দেখাশোনা করা। হ্যাভেন তাকে কাজে আসতেই নিষেধ করে দিয়েছে, কিন্তু জামশেদ তার কথা শুনতে নারাজ। ফ্রীতে মেয়ের জামাই থেকে হাত পেতে টাকা নেওয়াটা বেমানান এবং তিনি আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ। কারো দয়া সহ্য হয় না৷
হ্যাভেনের এই অফিসের বিল্ডিং পনেরো-তলা বিশিষ্ট। জামশেদ পঙ্গু বলে নিচ তলায় থাকেন। সিঁড়ি দিয়ে উপরে যেতে অসুবিধা হয়। আরো তিনটা বড়সড় অফিসের বিল্ডিং আছে, তবে সেখানে হ্যাভেন তেমন যায় না। ছোট চাচা প্রত্যাশ সেগুলোর দায়িত্ব নিয়েছেন। তাছাড়া, রাশিয়ায় হ্যাভেনের বাড়ি, অফিস রয়েছে। বাড়িতে কেউ থাকে না, ভাড়াও দেয়নি, শুধু কয়েকজন লোক রেখেছে বাড়িটা দেখাশোনা করা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য। বাংলাদেশে থেকেই সেখানকার অফিস সামলায়।
” আব্বু? ”
চেনা-পরিচয় কলিজা জুড়ানো আপন ডাক কর্ণগহ্বরে ভেসে আসতেই ত্বরিত পেছনে ফিরে চাইলেন জামশেদ। অরু প্রাণবন্ত উৎসবমুখর হাসি ফুটিয়ে দৌড়ে ছুটে আসছে। চোখের পলকে মিশে গেল বাবার উষ্ণ বুক জমিনে। জামশেদের মনে হলো, বুকের মধ্যে কেউ ঠান্ডা বরফ খন্ড রেখে দিয়েছে। এক হাতে আলিঙ্গন করলেন মেয়েকে।
” ভার্সিটি না গিয়ে অফিসে কি করছে আমার মা?”
জামশেদের কথায় বুক হতে মাথা উঠায় অরু। মন ভার করে বিরস মুখে শুধায়,
” খুশি হওনি? ”
জামশেদ মৃদু হেসে প্রত্যুত্তর করলেন তৎক্ষনাৎ,
” মাকে দেখে খুশি না হয়ে থাকতে পারি আমি? এমনি জানতে চেয়েছি, তুমি তো এই সময় ভার্সিটিতে থাকো তাই। ”
অরু থমথমে মুখে পুনরায় বাবাকে জড়িয়ে ধরে চনমনে গলায় বলে,
” সারপ্রাইজ দিতে এসেছি। ”
” খুব ভালো। ”
অরু মুখ ঝামটি মারে,
” কচু ভালো! একবারও দেখা করতে যাও না। ”
জামশেদের কাতর চোখের হতাশ কন্ঠ,
” সময় স্বল্পতা। ফোনে তো প্রতিদিন কথা বলি। রেগে থেকো না মা, আব্বুর কষ্ট হয়। ”
” রাগ করিনি, মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। ”
জামশেদ স্নিগ্ধ হাসলেন। বাবা মেয়ের কথা চলছে সেই সময় হ্যাভেন ক্যাবিন ত্যাগ করে বেরিয়ে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছিল। মৃণাল’কে অনেকক্ষণ ধরে দেখছে না, ফোনেও পাচ্ছে না, সেজন্য হ্যাভেন ক্যাবিন থেকে বাইরে বেরিয়ে অন্য পরিচিত লোকদের থেকে তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে এসেছে। অরুর দিকে নজর পড়তেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। ভাসা ভাসা চক্ষু জোড়া আঙুল দ্বারা কচলে ফের তাকাল হাসিমাখা অরুর পানে। অমনি ললাটের ভাঁজ টানটান হলো। প্রফুল্লচিত্তে হৃদয়টা গদোগদো হয়। মৃণালের কথা ভুলে বাঁকা হেসে উলটো ঘুরে পা বাড়াল নিজ ক্যাবিনে। ঝটপট কল করল জামশেদের নাম্বারে। হ্যাভেনের কল পেয়ে তড়িঘড়ি করে রিসিভ করলেন তিনি। তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হ্যাভেন নিজের মতো নির্লজ্জ বেহায়া মার্কা ভাষণ ছুড়ল,
” শ্বশুর মশাই, আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। শরীর চাঙ্গা করতে বউয়ের সেবাযত্ন দরকার। চটজলদি আপনার মেয়েকে আমার নিকট ট্রান্সফার করুন। ”
হ্যাভেন হাত কচলাতে কচলাতে রুম জুড়ে পায়চারি করছে, আর দরজার বাইরে তাকাচ্ছে। অপেক্ষা যেন শেষ হচ্ছে না। এতক্ষণ লাগে আসতে? আদতে অরু আসবে তো? নাকি ভাব দেখিয়ে চলে যাবে? হ্যাভেনের উৎকন্ঠিত বক্ষঃস্থল অস্থির হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। অবশেষে হ্যাভেনের লাফালাফি করা হৃদয়টা প্রশান্তির হাওয়া বইয়ে দিতে মিনিট পাঁচ এর মধ্যে অরুর আগমন ঘটলো। হ্যাভেনের অক্ষিপট টলমলে জলরাশির ন্যায় জ্বলজ্বল করে উঠল। অরু ভেতরে আসতেই দরজা লক করে দিল।
হুড়মুড়িয়ে অরুর হাত ধরে বাচ্চাদের মতো আহ্লাদী হয়ে অভিযোগ জানায় হ্যাভেন,
” দেরি করলে কেন? আরও পাঁচ মিনিট আগে খবর পাঠিয়েছি। ”
অরু ঝাড়া মেরে হাত ছাড়িয়ে নিলো। ঝাঁঝালো গলায় বলে ওঠে,
” ফাজিল লোক! ডেকেছেন কেন? ”
” শরীর প্রচন্ড দুর্বল। এনার্জি দিতে তোমাকে লাগবে। ”
” মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে আপনার। ”
” সব দোষ তোমার। ”
অরু ভড়কে গেল। রূঢ় সুরে শুধাল,
” আমি কি করেছি? ”
” কি করোনি? সবই করেছো। তোমার জন্যই আমি অসুস্থ। ”
” বাজে কথা বাদ দিয়ে ডাকার কারণ বলুন? তা এত ভোর সকালে কোথায় গিয়েছিলেন? ”
” বউ তুমি ডাকতেই পারি। আর চিরকুটে তো জানিয়ে এসেছি ইম্পর্ট্যান্ট কাজ ছিল। ”
” কি কাজ সেটাই জানতে চেয়েছি। ”
” কাজের কথা পরে, আগে আমার অসুস্থতা সাড়িয়ে দাও। ”
বলেই অরু’কে অফিসের ফাইল রাখা লোহার ডিজাইনার আলমারির সঙ্গে চেপে ধরল। অরু হকচকিয়ে যায়। হতবিহ্বল নেত্রপল্লব বারকয়েক ঝাপটিয়ে বড়ো বড়ো করে তাকায়। হতভম্ব মুখখানা বাতাসবিহীন বেলুনের মতো চুপসে গিয়েছে। হ্যাভেন অরুর হাতের আঙুলের ফাঁকে আঙুল গুঁজে দুটো হাতই আলমারির সাথে লাগিয়ে ঠেসে ধরেছে। তড়িৎ গতিতে মস্তক ঝুকিয়ে অরুর ওষ্ঠাদ্বয় ছোঁয়ার পূর্বেই অরু মুখ ঘুরিয়ে নিলো। হ্যাভেন বিরক্ত হয়। একটা হাত ছেড়ে আলতো করে চিবুক স্পর্শ করে অরুর মুখ নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো। পুনরায় স্বীয় কার্য হাসিল করতে উদ্যত হয়, অরু তৎক্ষনাৎ হাত দিয়ে হ্যাভেনের বেহায়া ওষ্ঠ ঢেকে ফেলল। হ্যাভেন ছটফটিয়ে ওঠে। নিগূঢ় দৃষ্টিতে অসহায়ের ছাপ। অরু তবুও হাত সরাল না। অরুর ধরে রাখা হাতের তালুতে হ্যাভেন চুমু খেল। নরম করতলে হ্যাভেনের উষ্ণ ওষ্ঠপুটের ছোঁয়া পেতেই শিউরে উঠে হাত সরিয়ে নেয়। অসহ্যকর লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ায়।
হ্যাভেন বেজায় চটে গেল। ক্ষুদ্ধ হয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,
” চুমু খেতে দিলে না কেন? এটা রীতিমতো অবিচার! নিষ্পাপ স্বামী নির্যাতন! মানবাধিকার বিরোধী কাজ। এভাবে আমার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হরন করতে পারো না। ”
অরু তিরিক্ষি মেজাজ সহিত তেতে উঠলো,
” অফিসে এসব করার জন্য আসেন? ”
হ্যাভেন টেবিল হতে পানির বোতল তুলে ঢকঢক করে পানি পান করল। অতঃপর ভাবলেশহীন ভাবে কাটকাট জবাব দিল,
” আগেই বলেছি, তোমার বিশ্রী ঠোঁট দেখলে আমার পিপাসা পায়। আমার থেকে যথাসাধ্য দূরত্ব বজায় রাখবে এই ভয়ংকর জিনিসকে। একবার ভুল করেও যদি ছুঁয়ে ফেলি শত বাঁধা দিয়েও কাজ হবে না। আমার কথা শুনলে না। তোমার ব্যাড লাক, অলরেডি নজর দিয়ে ফেলেছি। এক্ষুনি ছুঁতে চাইনি, কিন্তু রাতে ছোঁয়ার পর মন কন্ট্রোলেস হয়ে পড়েছে। এখন আমাকে আটকানোর সাধ্যি তোমার নেই। ”
অরু নাক ফুলিয়ে দাঁতে দাঁত পিষল,
” আমার ঠোঁটকে বারংবার বিশ্রী বলে আপনি আমাকে অপমান করছেন! ”
হ্যাভেন ঠোঁট কামড়ে হাসে। প্রত্যুত্তরে কন্ঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে সুমধুর ব্যঙ্গাত্মক বাক্য,
” তোমার ঠােঁট তো বিশ্রীই! বিশ্রী বলেই এখানে বারংবার আমার নজর পড়ে। ঠোঁট আর থুতনি এত বিশ্রী, কি বলবো? আই জাস্ট ক্যান্ট বিলিভ দিস, মেয়েদের থুতনি আর ঠোঁট এতটা বিশ্রী হয় সেটা তোমাকে না দেখলে জানতাম না। যেই আমি জীবনেও আপেল খাই না, সেই আমি এখন বউয়ের আপেলের মতো টোল পড়া থুতনি দেখেলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না। বিশ্রী না হলে আমাকে বশিভূত করে কেন তোমার ঠোঁট আর থুতনি? ”
তর্জনী আঙুল উঁচু করে চিড়বিড়িয়ে বলে অরু,
” দেখুন। ”
হ্যাভেন ঝুঁকে আসে খানিকটা অরুর নিকট। অরু দু’কদম পিছিয়ে টেবিলের সঙ্গে লেগে যায়। হ্যাভেন আরও কাছাকাছি চলে আসে। টেবিলের দু’পাশে হাত রেখে অরু’কে বেষ্টনী করে ফেলল। অরুর নাকে স্বীয় সরু নাক ঘষে নিরেট স্বরে জানায়,
” এখানে না, বাড়িতে গিয়ে বেডরুমে দেখবো। ”
অরু মাথা পেছনের দিকে সরিয়ে নিলো। কন্ঠ খাদে এনে চেঁচিয়ে উঠল মুহূর্তে,
” বদমাশ লোক, আমি ওসব মিন করিনি। মস্তিষ্কের ভেতর সর্বদা উল্টাপাল্টা বিষয় ঘোরে? মাথায় বারি মেরে উগ্র চিন্তা বের করে ফেলবো। ”
হ্যাভেন ক্রুর হাসল। অরুর তেজি মুখাবয়ব, দীপ্তিময় অক্ষিপটে চেয়ে দিল নীরব হুঁশিয়ার,
” এই জেদি অরু’কে এত কেন ভালো লাগে আমার? সুস্থ মস্তিষ্কে সাবধান করছি বউ। এতটা ভালোবাসতে বাধ্য করো না, যাতে পরের দিন বিছানা থেকে উঠতেই না পারো। ”
” আপনি সত্যি অভদ্রতার সীমা লঙ্ঘন করছেন! ”
হ্যাভেন ঘোর বিরোধিতা জানালো,
” অসম্ভব! আমি ভদ্র ছেলে। ভদ্র বলেই তুমি এখনো খালি পেট নিয়ে ঘুরঘুর করছো, নয়তো এতদিনে তোমার পেট ফুটবলের মতে ফুলো থাকত। ”
প্রেমপিপাসা পর্ব ২৪
অরু প্রথমে বুঝতে পারলো না হ্যাভেনের কথার মানে। কিয়ৎক্ষণ পর হ্যাভেনের দুষ্টু মিটিমিটি অধরের গা জ্বালানো হাসি দেখে, তৎক্ষনাৎ বুঝতে পারলো কি বোঝাতে চেয়েছে নির্লজ্জটা! অমনি অরুর চক্ষু চড়কগাছ। বিস্ময়ে ফ্যালফ্যাল করে নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে থাকল, হ্যাভেনের নির্লিপ্ত আদলে।