প্রেমপিপাসা পর্ব ২৮

প্রেমপিপাসা পর্ব ২৮
সুমাইয়া সুলতানা

” নিখিলের কোনো খোঁজ পেলাম না। লাস্ট লোকেশন ঢাকা, মগবাজার ছিল। এখন ফোন বন্ধ। হয়তো সিম ফেলে দিয়েছে। ”
ভালো-মন্দ কথা বলার মধ্যিখানে, নিখিলের ব্যাপারে জানতে চাইলে, ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মুখনিঃসৃত এরূপ আশাহত বার্তায় চিড়বিড়িয়ে গর্জে উঠল হ্যাভেন। অধরের হাসি উবে গেলো তৎক্ষনাৎ। নিজের শীতল চক্ষু যুগল মূহুর্তেই অঙ্গার বানিয়ে ফেলল। কিছুটা শক্তি প্রয়োগ করে মুষ্টিবদ্ধ হাতে লিভিং রুমের দেয়ালে ঘুষি মারে। অমনি আঙুলের হাড্ডি ব্যথায় টনটন করে উঠে। এতে হ্যাভেনের ভ্রুক্ষেপ নেই। বরঞ্চ ক্রোধে ফুলেফেঁপে হাতের করতল দ্বারা থাবা বসায় সাদা রঙের টাইলসে শোভিত দেয়াল বরাবর।
অতঃপর ঝাঁঝিয়ে বলে ওঠে হ্যাভেন,

” সাডেনলি একজন জলজ্যান্ত মানুষ গায়েব হয়ে যেতে পারে না। বর্ডার ক্রস করার পূর্বে যেভাবেই হোক তাকে ধরতে হবে। ”
বন্ধু চোখ প্রকট করে। আঙুল দিয়ে চিবুক চুলকায় আলতো ভাবে। সচল মস্তিষ্ক আগাম সতর্কসংকেত জানান দিল। অমনি ললাটে প্রগাঢ় ভাঁজ ফেলে, স্বীয় নিম্ন ওষ্ঠ কামড়ে ধরল। ভাবুকতা সমেত সচকিত আওড়ায়,
” নিখিল এত সহজে বাংলাদেশ ত্যাগ করবে না। আমার অনুমান যদি ভুল না হয়, সে অরুর ক্ষতি করতে চাইবে। নিজে থেকে না চাইলেও ওই বা’স্টা’র্ড আগন্তুকের কথায় করবে। ”
হ্যাভেনের বিস্মিত মুখ। কুন্ঠায় বিমূর্ত, অস্বাভাবিক অবস্থা। সুগভীর লোচনে প্রেয়সীর জন্য আতঙ্ক। তপ্ত শ্বাস ভারী। শুধায় অবাক সহিত,
” এসবের মধ্যে অরু আসলো কোথা থেকে? ”
বন্ধুর প্রত্যুত্তর বিদ্যুতের মতো ঠোঁটের ডগায়,
” নট শিওর। বাট হতেই পারে, অরু’কে দাবার গুটি বানিয়ে তোকে ব্লাক-মেইল করবে টুটুল’কে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। সাবধানের মার নেই! ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

চোয়াল শক্ত হয়ে এলো হ্যাভেনের, যেন পাথরের মতো দৃঢ়। ব্যাধিগ্রস্ত হলো উচাটন বক্ষপট। থমথমে মুখ, চোখের গভীরে জ্বলছে দাহক আগুন। নাকের পাটাগুলো ফুলে উঠছে। মুঠোয় চেপে ধরা আঙুলগুলো কড় কড় শব্দ তুলছে। আঙুলগুলো এতটাই শক্ত হয়ে মুষ্টিবদ্ধ হলো যে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে সাদা হয়ে আসছে। ক্ষিপ্র গতিতে চোয়াল একবার কচলাল, আর সেই ছোট্ট দৃশ্যই বলে দিল, ভেতরের দহন কতটা ভয়ংকর । পুরো শরীরটা ভারিক্কি নিঃশ্বাসের তোপে ফুঁসছে , যেন আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের ঠিক আগের মুহূর্ত। কণ্ঠনালি দিয়ে বেরিয়ে এলো এক ক্ষেপা তটস্থ গর্জন,
” অরুর দিকে বিন্দু পরিমাণ নজর দিলে, চোখ উপড়ে ফেলব। একবার হাতে পাই, ওর খাতিরযত্ন নিজ হাতে করবো। ”
” খোঁজ না পেলে সেবাযত্ন কাকে করবি? আগে তার খোঁজ পেতে হবে। বাট, খোঁজ পাওয়াটাই মুশকিল। কোথায় গা ঢাকা দিয়ে বসে আছে, কে জানে। তবে আমাদের চেষ্টা চলামন। ”

জানালা, বেলকনির ফাঁকফোকর দিয়ে ধেয়ে আসা আশপাশের ঠান্ডা বাতাস পর্যন্ত হ্যাভেনের মনে হলো অগ্নিস্ফুলিঙ্গ! চারপাশের পরিবেশও আজ বোধহয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে। কেমন গুমোট বাতাবরণ। ওর ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভ মুহূর্তেই যেন বিস্ফোরিত হবে। দাঁতে দাঁত পিষে ক্রোধ সংবরণ করছে।
পরক্ষণেই তীর্যক কঠোর চাহনি নিভে আসে, সেথায় ঠাঁই নেয় শীতলতা। ঘনঘন রুদ্ধশ্বাস স্বাভাবিক গতি পায়। হাতের মুঠো ছেড়ে দেয়। বন্ধুর কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো না, অত্যন্ত ভাবনার বিষয়।
হাজারো প্রশ্নের দাপাদাপি নিয়ে, আকস্মিক হ্যাভেনের গলবিল হতে ধ্বনিত হলো অপ্রত্যাশিত বাক্য,
” অরুর ভার্সিটি যাওয়া অফ করে দিবো? ”
ছুটন্ত গমগমে কথায়, চমকে উঠল বন্ধু। ত্বরিত মাথা নাড়ল,

” শালা, পাগল হয়েছিস? অরুর পড়াশোনা বন্ধ করতে চাইছিস কেন? ”
নিমিষেই জোড় ভ্রু কুঁচকে ফেলল হ্যাভেন। মুখবিবরে ছেয়ে গেল তীব্র বিরক্তি। মৃদুস্বরে ছুড়ল থমথমে হুংকার,
” পড়াশোনা অফ করবো কখন বললাম? বাড়িতে পড়া কন্টিনিউ করবে, টিচার লাগলে রেখে দিবো। শুধু পরীক্ষার সময় গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসবে। ”
ঘোর বিরোধিতা জানায় বন্ধু। হুড়মুড়িয়ে চড়া কন্ঠে তর্জন দিল,
” ঘর বন্দী হয়ে থাকার মতো মেয়ে অরু নয়৷ সুতরাং জেদ করিস না। ওর উপর অতিরিক্ত প্রেশার ক্রিয়েট করলে, রেগে উল্টা-পাল্টা কিছু করে বসবে। তখন, তোর কলিজা এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাবে। যার ধকল আমার উপর চাপিয়ে মাথায় উঠে নাচবি! আর আমি সেটা চাইছি না। ”
প্রচন্ড রাগ হচ্ছে হ্যাভেনের। কি থেকে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। মাংসপেশিগুলো টানটান হয়ে গিয়েছে। গভীর, তীক্ষ্ণ চোখ দুটোতে ভয়ংকর ঝলক, ঠিক যেন অতর্কিত ঘটনা ঘটার পূর্বে নেমে আসা নিস্তব্ধ অন্ধকার। শিরদাঁড়া সোজা হয়ে উঠল। শ্বাস ভারী হয়ে গেল। বুকের ভেতর দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলছে। ঠোঁটের কোণে অন্ধকার হাসির একটুখানি ছায়া, যেটা আসলে আসন্ন ভয়াবহ, ভয়ের তাণ্ডবের পূর্বাভাস।
চিন্তিত ভঙ্গিতে হ্যাভেন ভ্রু উঁচায়,

” ভার্সিটিতে অরুর সঙ্গে সিকিউরিটি গার্ড পাঠাবো? ”
” পাঠাতে পারিস। তোর যেটা ভালো মনে হয়। ”
হ্যাভেন তৎক্ষনাৎ ক্ষুদ্র মেজাজের বহিঃপ্রকাশ ঘটাল,
” এমনিতেই অরু আমাকে নিয়ে ইদানীং বেশি ঘাটাঘাটি করছে। গার্ড পাঠালে পুরো মাথা চিবিয়ে খেয়ে নিবে। ”
বন্ধু অধর প্রসারিত করে অট্টহাসি দিল। হ্যাভেনের ক্ষিপ্রতা উপলব্ধি করতে পেরে, সহসা চমৎকার হাসিটা গিলে নিলো। প্রতিবাদ করল নিভু স্বরে,
” অল্পতেই এত হাইপার কেন হোস? গার্ডের কথা আমি বলেছি? তুইই তো বললি। শোন, গার্ড সঙ্গে পাঠানো দরকার নেই। আই মিন, গার্ড পাঠাবি আড়ালে, অরুর দৃষ্টির অগোচরে, যাতে সে বুঝতে না পারে।”
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ চুপ থাকল হ্যাভেন। বাম কান হতে ডান কানে ফোন নিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল। কিয়ৎক্ষণ পর জানান দিল উদাসীন ভাব,
” ওকে। নিখিল’কে খোঁজার জন্য আরও লোক লাগা। ”
” তোকে বলতে হবে না। আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট। ”

অরু জানালার পাশে কাউচে বসে মনোযোগ সহকারে পড়াশোনা করছে। অনেক দিন ঠিক মতো পড়ালেখা হচ্ছে না। ভার্সিটিতে গেলেও একটা-দুইটা ক্লাস করে চলে আসে। সামনে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের সেমিস্টার পরীক্ষা। নিয়মিত পড়াশোনা না করলে, অনেকটা পিছিয়ে যাবে। পাশেই স্টাডি ডেস্ক, তবে চেয়ারে বসে পড়তে ভালো লাগে না তার। বাবার বাড়ি থাকাকালীন সময়েও টেবিলে পড়তো না, বিছানায় কিংবা সোফায় বসে পড়তো। মেরুদণ্ড বাঁকা করে, গোল হয়ে বসে, কিছুক্ষণ পর পর কলম মুখে দিয়ে পড়ার অভ্যাস অরুর। এই বদঅভ্যেস পরিবর্তন হয়নি। সেই সুবাদে এখন মুখে কলম গুঁজে, ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে, চোখ সংকুচিত করে পড়ায় সম্পূর্ণ মগ্ন সে।
এদিকে অরুর এহেন কান্ডে, হ্যাভেন অসন্তোষে নাকমুখ বিকৃত করে রেখেছে। বিছানায় বসে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছে ও। কাজের ফাঁকে আড়চোখে অরু’কে দেখতে ভুলছে না। ওর ভীষণ রকমের হিংসা হচ্ছে। যেমন-তেমন হিংসা না, একেবারে মহাসাগরের ন্যায় বিশাল মারাত্মক হিংসা। মুখমন্ডল জুড়ে কাঠিন্য রূপ। বারংবার একা একাই কটমটিয়ে দাঁতে দাঁত পিষছে। কিঞ্চিৎ গোলাপি ওষ্ঠদ্বয় চূড়াতে ঠেকেছে। বিড়বিড় করল শশব্যস্ত,

” নির্লজ্জ, ম্যানারলেস কলম! তোর কি লজ্জা নেই? কোথায় আমার বউয়ের ঠোঁটে আমার ঠোঁট থাকবে, সেখানে তুই স্কচটেপের মতো চিপকে আছিস! অন্যের বউয়ের ঠোঁটে আঁটি গেঁড়ে বসেছিস, নূন্যতম লজ্জা থাকা উচিত। তোর মধ্যে কি ন্যায়পরায়ণতা বলতে কিছু নেই? দূরে গিয়ে মর, বেয়াদব কলম! ”
হ্যাভেন ফের একপল চাইল। অরু এবার কলমের মাথা কামড়াচ্ছে। ব্যস! হ্যাভেনের ধৈর্যশক্তির বাঁধ ভেঙে গেল। তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়। ব্যস্ত কদমে ছুটে আসে অরুর নিকট। একদম অরুর পিঠ ঘেঁষে পাশে বসে পড়ল। টান মেরে অরুর মুখ হতে কলমটা কেড়ে নিলো। অপেক্ষা করল না, পরপর কলমটা খোলা জানালা দিয়ে অদূরে ছুড়ে মারল। অরুর উরুর উপর হাত রেখে নিশ্চুপ হয়ে ভদ্র সেজে বসে থাকল। ভাবখানা এমন, যেন কিছুই হয়নি!
পড়ায় ব্যাঘাত ঘটায় অরুর মনঃসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। চকিতে ঘাড় ঘোরালো। রাগে মুখশ্রী রক্তিম আভায় ছেয়ে গিয়েছে। রাগান্বিত চোখে তাকায়, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে থাকা অসহ্যকর লোকটার পানে। অমনি দাঁত কিড়মিড়িয়ে তেতে উঠল মুহূর্তে,

” বদমাশ লোক! দেখছেন না পড়ছি। ডিস্টার্ব করছেন কেন? ”
” পড়ো। আমি চুপটি করে বসে থাকবো। ”
চেহারা গুটিয়ে চেয়ে থাকে অরু। ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ঝাড়ে। হ্যাভেনের খামখেয়ালি বরাবরই বিরক্তিকর! রাগান্বিত সুরে বলে,
” আমার উরুর উপর থেকে হাত সরান। ”
হ্যাভেন নিষ্পাপ চোখে চেয়ে, হাত সরিয়ে নিলো। তবে বিন্দু পরিমাণ সড়ল না। নড়লও না। উল্টো অরুর কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে, পেছন থেকে উদর চেপে ধরল। দু হাতে শক্ত করে ধরেছে। হ্যাভেন অরুর এতটা নিকটে অবস্থান করায়, অরুর ঘাড়ে হ্যাভেনের উষ্ণ গরম নিশ্বাস আছড়ে পড়ছে। মেয়েলি সত্তা এলোমেলো লাগছে। নিঃশ্বাস ভারী হচ্ছে। দেহশ্রী মৃদু ভাবে কাঁপছে। অন্তঃপটে কেমন তুফান বইছে! কন্ঠনালি শুকিয়ে আসছে। কুন্ঠায় বিমূর্ত, হাঁসফাঁস লাগছে। হার্টবিট ফাস্ট হচ্ছে। উথাল-পাতাল আইঢাই ভাব থামানোর চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি হৃদপিণ্ড বাহিরে চলে আসবে!
নিজেকে তুরন্ত সামলে সময়ের পলকে গজগজিয়ে উঠে অরু। ছাড়া পাওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি করছে। সে ছাড়ল না। ক্ষুদ্ধ দৃষ্টি তাক করল হ্যাভেনের আদলে। ফুঁসতে ফুঁসতে মুখনিঃসৃত স্বল্প রাগের চোটপাট দেখাল,

” এতটা বেহায়া কেন আপনি? উদর কি অন্য কারোর? এটা কি আমার শরীরের বাইরে? আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন। পড়তে দিন। ”
বাক্যের যবানিকা টেনে এক ঝটকায় হ্যাভেনের বাঁধন হতে নিজেকে মুক্ত করল। পুনরায় বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পড়ায় মন দেয়। হতভম্ব হয়ে গেল বিপরীত লিঙ্গের মানুষটা। ওই কলমটাকে তো সানন্দে গ্রহণ করেছে, তাহলে ওকে কেন করল না? অন্যায়, ঘোর অন্যায়!
আক্রোশে ফেটে পড়ল হ্যাভেন। মুখ তীব্র অন্ধকারে ডুবে গেল। সত্তা মনঃক্ষুণ্ন হলো। একটু কাছে থাকলে কি এমন ক্ষতি হয়? মেয়েটা এত পাষাণ কেন? কেন বুঝতে চায় না, অন্তঃকরণের হাহাকার? ওর ভারিক্কি কন্ঠে ছুটে চলল বিস্ময়,

” নির্দয় রমণী! আমি অসুস্থ জানা সত্ত্বেও রীতিমতো ইগনোর করছো! সমস্যা কি? ”
অরু হতবাক হয়ে গেল। হতবিহ্বল অক্ষিপটে ড্যাবড্যাব করে তাকায়। ঘনপল্লব বিশিষ্ট হরিণী নেত্রদ্বয় স্থির করল ভোঁতা মুখ বানিয়ে রাখা সম্মুখের মানুষটার আদলে। হ্যাভেন ক্ষুদ্র চোখে চেয়েছিল। নজরে নজর মিলন ঘটলো দুজনের। পরক্ষণে মেয়েদের মতো মুখ বাঁকিয়ে, হ্যাভেন অন্য দিকে চেয়ে থাকে।
অরু ফোঁস করে নিরাশ দম ফেলল। ক্ষিপ্র ভাব তুঙ্গে উঠে যায়। চাহনিতে বিরক্ত। ইচ্ছে করছে, লোকটার গলা টিপে দিতে! খিটখিটে মেজাজে দুর্বোধ্য বুলি আওড়িয়ে ঝংকার তুলল,
” আই ফীল দ্য সেইম ওয়ে। হোয়াটস ইয়োর প্রবলেম? দেখছেন পড়ছি, তবুও ডিস্টার্ব করছেন! ”
হ্যাভেন পাশ ফিরল। গ্রীবা বাঁকিয়ে তাকাল ঠিক চোখের দিকে। বড়ো শীতল নিগূঢ় সেই চাউনি। অথচ অরু চটজলদি নামিয়ে নিলো দৃষ্টি। ওই কূয়োর ন্যায় তীক্ষ্ণ গহিন নেত্রযূগলে বেশিক্ষন চেয়ে থাকা যায় না। চাইলেই যেন মৃত্যু দেখে নিজের।
সে ভ্রু উঁচিয়ে তুরন্ত জানালো ভাবলেশহীন প্রত্যুত্তর,

” ডিস্টার্ব কখন করলাম? তুমি পড়া কন্টিনিউ করো। ”
অরুর বিরস স্বর ব্যাকুল শোনালো,
” আপনি কাছে থাকলে আমার পড়তে অসুবিধা হয়। প্লিজ দূরে যান। ”
হ্যাভেন শুনল না। ফের আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরল। এবং ঘোর বিরোধিতা করে প্রতিবাদ করল তৎক্ষনাৎ,
” আমি সঙ্গে থাকলেই তোমার পড়াশোনা একদম ফাটা-ফাটি চলবে। দুজনে রোমান্স করতে করতে খুব ভালো স্টাডি হবে। ”
উচ্ছ্বসিত স্বরে চোখ তোলে অরু। চঞ্চল ঠোঁটে গা জ্বালানো উত্তর তৈরি,
” আপনার মস্তিষ্কে হামেশাই রোমান্স ঘোরে? ভুলে যাবেন না, একটা ছেলেকে পছন্দ করি আমি৷ ”
এতক্ষণের ভালো মুড নিমিষে বিগড়ে গেল হ্যাভেনের। খুশিতে ফুঁসে উঠা অন্তঃপট সহসা নেতিয়ে যায়। মুখমন্ডল অস্তমিত রবির ন্যায় রক্তিম। চোয়াল কাঠিন্য করে অরুর দুই বাহু শক্ত হস্তে চেপে ধরল। রক্তচক্ষু নিয়ে গমগমে আওয়াজ তুলল এবার,
” পছন্দ করা বের করছি! বিয়ে হয়েছে, স্বামী রেখে অন্য ছেলেকে পছন্দ করো। আবার সেটা জাহির করে স্বামীকে বলতে লজ্জা করছে না? ”

অরু তোয়াক্কা করল না। ভাবভঙ্গি দায়সারা। চনমনে কন্ঠস্বর শৃঙ্গে,
” লজ্জা লাগবে কেন? পছন্দ করা, ভালোবাসা কি অন্যায়? ”
” স্বামী থাকতে পরপুরুষে আসক্তি হওয়া মারাত্মক অপরাধ। ”
” বলেছি একটা ছেলেকে পছন্দ করি, কোন ছেলে সেটা তো বলিনি। ”
ক্রোধে জর্জরিত হ্যাভেন। ওর বিস্ফোরিত মগজ, অরুর কথাটা গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হলো না। উদগ্রীব হয়ে নিজের মতো বলতে লাগলো,
” ছেলেটা কে, বলো আমাকে? নয়তো তার সাথে সাথে তোমার জীবনও নরক বানিয়ে ছাড়ব! ”
অরু একরত্তি ভয় পেলো না। আর না সাহস ফুরিয়েছে। ঠোঁটে অদ্ভুত শয়তানি হাসি। চক্ষুদ্বয়ে দুষ্টুমির আনাগোনা। তিরস্কার করল নাক ছিটকে,
” আপনাকে যখন আমি কিছু জিজ্ঞেস করি, আমাকে যথাযথ উত্তর দেন না। তখন বলেন, অযথা কৌতূহল দেখাচ্ছি। এখন তো আপনিও অযাচিত প্রশ্ন করছেন! বলে দিয়েছি একবার, আপনার থেকে কোনো কথা জানতে চাইবো না। সুতরাং আপনিও আমার কাছে জানতে চাইবেন না। পারলে নিজে খুঁজে বের করুন, ছেলেটা কে। আমাকে বিরক্ত না করে সরুন। ”

চোখা নেত্রে চাইল সে। রাশভারী কন্ঠে বেরিয়ে এলো নীরব হুমকি,
” জানে মেরে ফেলব। ”
” ক্ষমতা আর সাহস থাকলে মেরে দেখান। ”
অরুর কন্ঠে দৃঢ়তা। হ্যাভেন চটে গেল তৎক্ষনাৎ। অরু জানে, হ্যাভেন এখন ওর উপর চওড়া হবে। হয়তো বিদীর্ণ করা হবে নরম চামড়া। হোলও তাই। হ্যাভেন অরুর গলদেশে মুখ ডুবিয়ে দিল। কেঁপে উঠল মেয়েটির শরীর। শাস্তি পেতে প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। অরু’কে স্থির থাকতে দেখে, হ্যাভেন ভ্রু কুঁচকে ফেলল। গলা হতে মুখ উঠিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল নির্বিকার, ভয়হীন, অটল, চোখমুখ খিঁচে থাকা কোমলপ্রাণ মেয়েটির দিকে।
ঝড়-ঝাপটার রেশ না পেয়ে অরু আস্তে-ধীরে চোখ খুলল। চক্ষুপটে ভেসে উঠে, হ্যাভেনের শূন্য দৃষ্টি, হতভম্ব মুখশ্রী। তা দেখে বাঁকা হাসল। বিস্মিত হ্যাভেনের মুখবিবর পরখ করে, সতর্ক হয়ে গেল। চেঁচিয়ে উঠল আচমকা,
” কি হলো, মারুন। ”
ছেলেটা বিব্রত হয়। ভাসা ভাসা সুগভীর আঁখি যুগল এখনো বিহ্বলিত। তবে ভালো মেজাজখানাও সুপ্তভাবে চটে যায় বটে। তাড়াহুড়ো করে, অরু’কে ছেড়ে পা বাড়াল খাটের নিকট। হৃষ্ট চিত্তে আওড়ায়,
” আজকাল বড্ড সাহস বেরে গিয়েছে। ”
অরু ফিক করে হেসে ফেলল। পরপরই ঠোঁট চেপে ধরল থামাতে।
হ্যাভেন হঠাৎই কেমন করে চাইল আবার। দূর্বোধ্য দুটো অক্ষি। লম্বা শরীরটা আধশোয়া খাটে। তীক্ষ্ণ চাউনি অরুর হাস্যোজ্জ্বল মুখে বর্তায়। সে এতটা খুশি, যেন বিরাট যুদ্ধে জয়লাভ করেছে।
হ্যাভেন নিদারুণ, অবুঝ দুই লোচনে চেয়ে শুধাল,
” হাসছো কেন? ”

সে নিরুত্তর। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। শুধু অধরে মিটিমিটি হাসি। হ্যাভেন কপাল কুঁচকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। অতঃপর গম্ভীর কণ্ঠে ডাকল,
” এদিকে আসো। ”
অরু পরিতোষ নিরদ্বিধায় এগিয়ে গেল। কিন্তু চোখে-মুখে নার্ভাসনেসের চিহ্ন। ও যেতেই হ্যাভেন উচ্চারণ করল মেঘমন্দ্র কন্ঠে,
” তুমি আমার বউ, তাই সুযোগ দিচ্ছি। একটা কাজ করতে পারলে, সব ভুল ক্ষমা করে দিবো। ”
মেয়েটা আশ্চর্য হয়। ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চায়,
” কেনো ভুল করিনি। তাহলে ক্ষমার প্রসঙ্গ আসছে কেন? ”
” আমাকে রেখে, অন্য ছেলেকে ভালোবেসে ভুল করেছো। ”
অরু চাপা হাসে। মিহি স্বরে শুধায়,
” কি কাজ? ”
” করবে? ”
” আগে বলুন। ”

অরুর কোমর প্যাঁচিয়ে কাছে নিয়ে আসে হ্যাভেন। অরু ছটফট করল না। বাধ্য বউয়ের ন্যায় শান্ত থাকল। এতে হ্যাভেন ঈষৎ হোঁচট খেলো। বক্ষঃপিঞ্জর অস্বস্তিতে বুঁদ হলো। পরমুহূর্তে ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক করে। জিজ্ঞাসু চোখে তাকানো মেয়েটার গোছানো চুল, ফের গুছিয়ে দিতে দিতে হ্যাভেন জানালো,
” কাজটা করলে তোমার কৌতূহলের, একটা সিক্রেট বলবো। ”
অরুর বিষাদে ভরা বিক্ষিপ্ত হরিণী নেত্রদ্বয় চকচক করে উঠল। অবুঝের মতো আগেপিছে না ভেবেই বলে দিল,
” বলুন কি করতে হবে। আমি করবো। ”
” ভেবে বলছো? ”
অরুর মেয়েলি চিকণ দৃঢ় কণ্ঠ,
” হ্যাঁ। ”

হ্যাভেন সম্মোহনী হয়ে, অরুর মুখের উপর সামান্য ঝুঁকল। ভণিতা ছাড়া কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
” এনার্জি লাগবে। একটা চুমু খাও আমার ঠোঁটে। ”
জাদু ঢালা মোহনীয় স্বরে অরু থমথমে খায়। বাকরুদ্ধ হয়ে নরম অধর দু দিকে ছড়িয়ে গেল। নেত্রদ্বয় কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম। ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি, নির্লজ্জ লোক এত তাড়াতাড়ি তার পুরোনো ফর্মে ফিরে আসবে। মেয়েটা অস্বস্তি ঢাকার নিমিত্তে ঠোঁট টিপে প্রণত রাখে চিবুক। জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে মিনমিন করে,
” বুঝলাম না। ”
” চুমু দিতে বলেছি। ”
হ্যাভেনের অধৈর্য স্বর। অরুর কন্ঠনালি আস্তে-ধীরে বুজে আসছে। কটিদেশে পুরুষটির বলিষ্ঠ হাতের উষ্ণ বিচরণ। এটুকুতেই কুন্ঠায় তার মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়। আরক্ত মুখখানি গলদেশে নামায়।
বিলম্বহীন ফের হ্যাভেনের শীতল প্রশ্ন তেড়ে এলো,
” কলমটাকে কত যত্ন নিয়ে চুমু খেয়েছিলে, আমাকে চুমু দিলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? ”
তাজ্জব বনে গোল গোল চোখে জিজ্ঞেস করল অরু,
” কলমকে চুমু খেলাম কখন? কি সব যে বলেন আপনি! সবসময় ফাজলামো না করলে হয় না? ”
” অতশত বুঝে কাজ নেই। নাউ কিস মি। ”
অন্যদিকে চেয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বড়ো করে নিঃশ্বাস ছাড়ে অরু। টানটান কপাল বেঁকে এলো কিঞ্চিৎ। চেয়েও মুখাবয়বে গাম্ভীর্য ভাব ফোটাতে পারলো না। সাদা ফকফকে পরিষ্কার দন্তপাটি বের করে, প্রাণবন্ত উৎসবমুখর হেসে জানান দিল নিজস্ব অভিব্যক্তি,

” একটা কলমকে আপনার হিংসা হচ্ছে। ”
” স্রেফ হিংসা না, অনেস্টলি আমার জেলাসি ফীল হচ্ছে। ”
অরু এবার শব্দ করে হাসল। কিয়ৎক্ষণ পর, হিঁচড়ে আনা হাসি আড়াল করে আগ্রহভরে বলল,
” লাইক সিরিয়াসলি? ”
হ্যাভেন কাঁধ উঁচাল,
” নো ডাউট, অ্যান্ড নো মোর টক। তোমার টসটসে রক্তজবা সুস্বাদু ঠোঁট দিয়ে ফটাফট চুমু খাও। ”
বলেই নিজে থেকে উদ্যত হয়, অরুর ঠোঁটে চুমু খেতে। অরু চোখ বুজে ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। বুক কাঁপছে সবেগে। নিদারুণ কম্পন বক্ষঃস্থল জুড়ে। ভেতরে অমায়িক অস্থিরতা। বক্ষপটে ঢিপঢিপ বাজছে করতাল। নেত্রপল্লব বিধিবাম পিটপিট করেছে। অচিরেই পেলব হাত খামচে ধরেছে স্বীয় উরুর উপর থাকা ওড়না সহ প্লাজুর কাপড়। উচাটন, জরাজীর্ণ শরীর মৃদু কাঁপছে। চার জোড়া ওষ্ঠপুট ছুঁই ছুঁই ভাব, তক্ষুনি দরজায় ঠকঠক শব্দ হয়। মোহঘোরে আটকে থাকা হ্যাভেনের সম্বিত ফিরল। বিরক্ত হলো কিছুটা। বুক ফুলিয়ে জোরে জোরে বারকয়েক লম্বা শ্বাস টানল। কর্ণগহ্বরে দরজার খটখট আওয়াজ ভেসে আসতেই, হকচকিয়ে দৃষ্টি মেলল অরু। এদিক ওদিক নজর ঘোরায়। পুনরায় দরজায় শব্দ হতেই, ত্বরিত হ্যাভেন থেকে ছিটকে দূরে সরে যায়।
অসন্তুষ্ট মুখাবয়বে গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইল হ্যাভেন,

” কে? ”
ওপাশ হতে ফ্যাসফ্যাসে গলায় সায়র কটাক্ষ করে সাড়া দিল,
” আমি এক অবলা, অসহায় বাচ্চা। ”
” ডাকছিস কেন? ”
প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো সায়রের। অঙ্কিতার সঙ্গে ফোনে কথা বলছিল, মাখোমাখো একটু প্রেম প্রেম ভাব জন্মেছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে সায়রা গিয়ে বললেন, হ্যাভেন অরু’কে ডেকে আনতে। রোমাঞ্চকর পরিবেশ তৎক্ষনাৎ সায়রের অদৃশ্য ভাঙাচোরা হৃদয়ের আর্তচিৎকারে কেঁদে উঠে। চেহারায় নামে অমাবস্যার ন্যায় অন্ধকার। তারপর থেকে হ্যাভেনের উপর ক্ষেপে আছে। চিবিয়ে চিবিয়ে প্রত্যুত্তর করলো,
” আমার ঠেকা পড়েছে, সেজন্য ডাকছি। রোমান্সে ডিস্টার্ব করলাম, বুঝি? সময় পেলেই রোমান্স করার ধান্দা খোঁজো? বেঈমান! লজ্জা করে না, ছোট ভাইটাকে রেখে একা একা সারাক্ষণ রোমান্স করতে? ”

সায়র এত তেজ দেখাচ্ছে? তাও হ্যাভেনের সঙ্গে? অবিশ্বাস্য! এই ধানিলংকা আর সায়রের হয়েছে কি? দুপুরে অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে দুজনের একজনেরও কথার ছেঁড়াখোঁড়া নেই। যে যেভাবে পারছে, ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে ত্যাড়ামি করছে। তাকে একপ্রকার এড়িয়ে চলছে দুজন। কি চলছে এই দুজনের মধ্যে? কি জটলা পাকাচ্ছে?
বিভ্রান্তিতে লুটোপুটি খেলো হ্যাভেন। তীর্যক চক্ষুদ্বয় বড়ো বড়ো করে, কাচুমাচু ভঙ্গিতে লজ্জায় লাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অরুর পানে চাইল একপল। অতঃপর চিড়বিড়ে পুরুষালি গলবিল হতে ধ্বনিত হয় ক্ষুদ্র বাক্যবহর,
” ফালতু না বকে, কি বলতে চাস ক্লিয়ারলি বল। ”

প্রেমপিপাসা পর্ব ২৭

ভাইয়ের রাগত্ব স্বরকে পাত্তা দিল না সায়র। বিন্দু পরিমাণ সম্মান দেখাল না। বরং বিনম্র সহিত অরু’কে উদ্দেশ্য করে বলল,
” ভাবী, ডিনার করতে আম্মু তোমাদের ডাকছে। জলদি আসো। ”

প্রেমপিপাসা পর্ব ২৮ (২)