প্রেমপিপাসা পর্ব ২৮ (২)

প্রেমপিপাসা পর্ব ২৮ (২)
সুমাইয়া সুলতানা

নিশীথের সুনসান নীরবতায় হালকা শিহরণ জাগানো বাতাস বয়ে যাচ্ছে, যেন প্রকৃতির কোমল স্পর্শে কঠিন কোনো প্রতিশ্রুতি লুকিয়ে আছে। চারপাশ নিস্তব্ধ, তবু কোথাও এক অদৃশ্য সুর বাজে। একটি স্তব্ধতার সুর, যা কানে শোনায় না, অনুভবে কাঁপন তোলে। বাতাসের চলনে হিমেল ছোঁয়া, অথচ তার গভীরে লুকিয়ে থাকা উষ্ণতার ইঙ্গিত, ধীরে ধীরে জমতে থাকা শীতলতার মধ্যে এক আগুনের কণা বহন করছে। অদ্ভুত এক বিপরীতের সহাবস্থান শীতল, উষ্ণ, স্থির, সঞ্চলনশীল, নীরব, কিন্তু বোধের গভীরে এক প্রচণ্ড শব্দ তোলার অপেক্ষায়।
বিশুদ্ধ, প্রশান্তি-দায়ক বাতাবরণ আবহাওয়ায়, এই রাত্রিতে বাড়ির বাগানে অঙ্কিতা দাঁড়িয়ে আছে। বেলী-ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ বাতাসে মৌ মৌ করছে। সে হাঁটতে হাঁটতে বেলী-ফুল গাছের কাছে এসে থামল। কন্ঠ খাদে এনে চাপা স্বরে সায়রের সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। কথা না বলে উপায় নেই। দেখা গেল, রেগে রাতে বাড়ি চলে আসবে। জোরে জোরে অঙ্কিতার রুমের জানালা কিংবা বারান্দায় এসে ডাকাডাকি শুরু করবে। ছেলেটা আসলে পাগল!

সেদিন ভার্সিটিতে শ্রেণীকক্ষে চুমু খাওয়ার জন্য যখন সায়র উদগ্রীব হয়েছিল, তখন অঙ্কিতার মুখনিঃসৃত ঘৃণার বাক্য শুনে থেমে গেলেও মেয়েটার পিছু ছাড়েনি। তবে সেদিনের পর থেকে অঙ্কিতার সামনাসামনি বেশ কিছুদিন যায়নি। আড়ালে লুকিয়ে তার অগোচরে দেখতো৷ সায়র’কে ডিস্টার্ব করতে না দেখে, অঙ্কিতার গভীর দৃষ্টি না চাইতেও তাকে খুঁজত। বাঁধন হারা মন একপ্রকার মিস করতে লাগলো। ও চাইত সায়র ওকে আগের মতো বিরক্ত করুক। ভার্সিটির গেট দিয়ে ঢোকার সময়, ঢোকার পর চোরা চোখে আড়চোখে এদিক ওদিক সায়রের দেখা পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকত। দেখা না পেয়ে আনমনা হয়ে পড়ত। খারাপ লাগতো ভীষণ। তারপর হঠাৎ কয়েকদিন পর সায়রের ফোন কল পেয়ে আহত চোখ চকচক করে উঠল। ঠোঁটে ফুটে উঠেছিল প্রাণবন্ত হাসি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অধরে হাসির ঝলক লুকিয়ে কন্ঠে যথাযথ গাম্ভীর্য টেনে কথা বলেছিল। অঙ্কিতা বুঝতে না দিলেও সায়র জানে অঙ্কিতা তাকে এ-কয়েকদিন কতটা মিস করেছে। সেজন্য অঙ্কিতার রাগান্বিত চওড়া কথায় একটুও রাগ করেনি। বরঞ্চ কৌশলে দুজনের মধ্যকার দুষ্টু মিষ্টি রাগ মিটমাট করে ফেলেছে। এখন, অঙ্কিতা সায়রের সঙ্গে কথা বলে স্বাভাবিক ভাবে। মুখে ভালোবাসি না বললেও সায়রের উপস্থিতিতে বুকের ভেতর স্বস্তি পায়। সায়রের বাচাল হাবিজাবি কথাবার্তা মুগ্ধ হয়ে শোনে। সায়র হাত ধরলে, কপালের উড়ন্ত ছোট চুল নিজ হাতে গুছিয়ে দিলেও কিছু বলে না। মুখ ফসকে অঙ্কিতা একদিন বলে ফেলেছিল, সেও সায়র’কে পছন্দ করে। এতেই সায়র লাই পেয়ে আগের তুলনায় অতিরিক্ত অঙ্কিতার পিছু পিছু ঘুরবে আর প্রেমের কথা বলবে। বর্তমানে অঙ্কিতা সায়রের প্রতি আসক্ত হয়ে গিয়েছে।
অঙ্কিতা বাবা-মায়ের রুমের দিকে তাকাল একপল। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে গাছের পাতা ছিঁড়তে ছিঁড়তে মৃদুস্বরে বলল,

” এত রাতে আব্বু বাইরে দেখলে রেগে যাবে। এখন, রাখছি। ”
সায়র পড়ার টেবিলের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
” তুমি বাইরে এসেছ কেন? ”
” না এসে উপায় আছে? আমার রুমে, আমার কাজিন ঘুমাচ্ছে। সে টের পেলে আব্বুকে জানিয়ে দিবে। ”
সায়র কাঁধ উঁচায়। জবাব দেয় ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে,
” জানলে জানুক। একদিন তো জানবেই। ”
” যখন জানবে, তখন দেখা যাবে। কাল কথা বলবো। ওকে? ”
” নট ওকে। ”
” বোঝার চেষ্টা করুন। ”
” কি বোঝাতে চাও? ”
” নাথিং। ”
” এই যে তোমার একটু দূরে থাকা, আমার মন ভারী হয়। আমি তোমাকে প্রচণ্ড মিস করি। তোমার কণ্ঠ শোনার অপেক্ষায় থাকি। তোমার জন্য কতখানি ব্যাকুল আমি, বোঝো না? ”
অঙ্কিতা রয়েসয়ে মুখ খুলল,
” বুঝে কী হবে? ”
দাঁতে দাঁত পিষল সায়র,

” নিষ্ঠুর মেয়ে, এই অনুভূতি গুলো মানে, আমি তোমাকে ভালোবাসি। ”
অঙ্কিতার সত্তা খুশিতে বিগলিত হয়। চনমনে ফুঁসে ওঠে অন্তঃপট। বাবার গলা কর্ণগহ্বরে ভেসে আসতেই, ফট করে কল কেটে দেয়। তড়িঘড়ি করে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল।
সায়র হতভম্ব, স্তব্ধ। এভাবে মুখের উপর কল কেটে দিল? নির্বাক হয়ে থাকল কিয়ৎক্ষণ। অতঃপর স্তম্ভিত আওড়ায়,
” অবহেলা করছিস কর, যদি সত্যি ভাগ্যে থাকিস, তাহলে বিয়ের পর বোঝাবো আমি কি। ”
” কী বিড়বিড় করছো? ”
অরুর কন্ঠে সায়র চমকে পেছন ফিরল। ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মাথা চুলকে ক্যাবলা মার্কা হাসি দিয়ে জানায়,

” অঙ্কিতার সাথে কথা বলছিলাম। ”
” কথা শেষ? ”
সায়র ঠোঁট উল্টে বলে,
” আমার কথা কখনো শেষ হয় না। সে কল কেটে দিয়েছে। ”
অরু অমায়িক হেসে বলল,
” দুঃখ পালন না করে খেতে চলো। আমাদের ডেকে তুমি লাপাত্তা হয়ে গেলে? ”

প্রেমপিপাসা পর্ব ২৮

হ্যাভেন অরু’কে ডাকতে ডাকতে সায়র পুনরায় অঙ্কিতা’কে কল করে। ভাবেনি রিসিভ হবে। ভাগ্য ভালো থাকায় রিসিভ হয়। কথা বলতে বলতে সায়র রুমে চলে আসে। ডিনারে তাকে না দেখে, সায়রা অরু’কে পাঠায় ডেকে নিয়ে আসতে। অঙ্কিতার ব্যাপারে সায়র প্রথমেই জানিয়ে ছিল। খুব ভালো বন্ধু তারা। সায়র সিনিয়র হওয়ায়, অরু আপনি, ভাই বলে সম্বোধন করত। কিন্তু সায়র ঘোর বিরোধিতা করে বলে, তাকে নাম ধরে ডাকতে এবং তুমি করে বলতে। যদিও বয়সে সায়র বড়ো এবং পড়াশোনার খাতিরে ভিন্ন পাশাপাশি ভার্সিটির সিনিয়র। তবে সম্পর্কে অরু বড়ো ভাইয়ের বউ। সম্মানিত মানুষ। সেজন্য সায়র অরু’কে ভাবী আর তুমি বলে সম্বোধন করে। অরু নাম ধরেই ডাকে।

প্রেমপিপাসা পর্ব ২৯