প্রেমপিপাসা পর্ব ৩০
সুমাইয়া সুলতানা
এক সপ্তাহ পেরিয়ে গিয়েছে। হ্যাভেন পুরোপুরি সুস্থ। পিঠের জ্বলন্ত পোড়া চামড়া শুকিয়ে গিয়েছে। কিন্তু মরা চামড়া উঠে স্বাভাবিক চামড়ার দেখা মেলেনি। আরও কিছুদিন সময় লাগবে। কপালের বিদীর্ণ চামড়া কিছুটা কাঁচা। থেঁতলে যাওয়া চামড়া জমাট বেঁধে টান ধরেছে। আপাতত শরীরের কোনো অংশে ব্যথা নেই। সামান্য আঘাত তাকে রুখতে পারে না। চনমনে এক্টিভিটি নিয়ে দিব্যি নিত্যকার কাজ করতে সদা প্রস্তুত সে।
বাঁধ সাধলো অরু। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাকে কোথাও যেতে দিবে না। তার নিকট হ্যাভেন মোটামুটি সুস্থ, পরিপূর্ণ ভাবে না। হ্যাভেন বারংবার বলেছে, সে ঠিক আছে। অরু শুনতে অনিচ্ছুক। মানতে নারাজ। পইপই করে বলে দিয়েছে, যতক্ষণ না কপালের আঘাত সাড়ে ততদিন বাড়ি থেকে বের হওয়া নিষিদ্ধ। এর অবশ্য কারণ আছে। তা হলো কপালের আঘাতটা গুরুতর, সেজন্য আচানক হ্যাভেন কয়েকবার মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। জ্ঞান হারায়নি, তবে মাথা চক্কর দিতো। সেটার রেশ ধরে কমপ্লিটলি বেড রেস্ট থাকতে বলেছে।
ঘাড় ত্যাড়া হ্যাভেন কথার অবাধ্য হয়ে দিনে একবার হলেও অরু ভার্সিটিতে চলে গেলে, তাকে না জানিয়ে বাইরে যেত। অফিসে না, অন্য জায়গায়। কোথায় যায় কেউ জানে না। অরু ভার্সিটি থেকে আসার আগেই চুপিচুপি বাড়ি ফিরে আসত। ও বাইরে যায় সেটা বাড়ির সবাইকে হুঁশিয়ার করে বলে দিয়েছে, অরু যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায়। তবে শেষ রক্ষা হতো না। টুটুল গড়গড় করে সবটা জানিয়ে দিতো দায়িত্ব নিয়ে। অরু তৎক্ষনাৎ রণচণ্ডী রূপ নিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বকাঝকা সহ মিষ্টি শাসন করতো। হ্যাভেন তখন বিড়াল ছানার মতো চুপটি করে থাকত। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে, অরুর আঙুল উঁচু করে, নাক কুঁচকে, ঠোঁট নেড়ে নেড়ে শাসন করার মুহূর্তটা খুব ইনজয় করতো। মেয়েটা এ কয়েকদিন অপটু হাতে বেশ ভালোই ওর যত্ন নিয়েছে। অরুর চোখে নিজের জন্য চিন্তা, উদ্বেগ দেখে, তখন মন পিঞ্জরে সুখ পাখিরা ডানা ঝাপটাত। পুলকিত হতো সত্তা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বিগত দিনগুলোতে অরুর কর্মকাণ্ডের কথা ভেবে হ্যাভেন আনমনা হাসে। বাড়ির বাগানে বড়সড় গার্ডেন প্যাভিলিয়ন সুইং এ বসে আছে সে। সাথে অরুও আছে। পাশেই টুটুল প্লে গ্রাউন্ডে খেলছে। তার সঙ্গে যোগদান করেছে সায়র।
অরুর ভীষণ রকমের অস্বস্তি হচ্ছে। লজ্জায় নিজেকেই গুটিয়ে ফেলতে চাইছে। লাজুকতা শুধু চোখের পলকেই সীমাবদ্ধ নয়, তা রক্তমজ্জায় ঢেউ তুলেছে। কারণ, নির্লজ্জ সুদর্শন গুরুগম্ভীর বদনের লোকটা ওর দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে।
কন্ঠ খাদে নামাল ও। চাপা স্বরে ঝাঁঝালো গলায় জিজ্ঞেস করলো,
” নজর কি অন্য দিকে দেওয়া যায় না? ”
প্রতিবারের মতো অরুর রক্তজবা অধর পানে তাকিয়ে কফির মগে চুমুক বসায় হ্যাভেন। চাউনিতে ভরপুর দুষ্টুমি। ভাবলেশহীন ভাবে দৃঢ়তা সমেত জানাল,
” বউ থাকতে যে পুরুষ অন্য কোথাও নজর দেয়, সে আদতে পুরুষ নয়! তাকে চরিত্রহীন বলে। খাঁটি আঞ্চলিক ভাষায় বারো মাতাড়ি। ”
বুঝতে না পেরে কপালে ভাঁজ ফেলল অরু,
” হোয়াট ডু ইউ মীন বাই বারো মাতাড়ি? ”
হ্যাভেন ঠোঁট উল্টে জানায় মিনসে কন্ঠে,
” মেয়েরা একাধিক ছেলের উপর কুনজর দিলে তাদেরকে পাব্লিক বারো ভাতারি বলে, তো হিসেব অনুযায়ী ছেলেদের বারো মাতাড়ি! আমি সেরকম নই, সেটাই বলেছি। বুঝেছো? ”
অরু কফি খাচ্ছিল। অহেতুক কথায় বিষম খেলো। মুখ হতে তরল কফি ছিটকে বেরিয়ে আসে। চক্ষুকোটর লালিমাকৃত। হতভম্ব হয়ে গেল নির্নিমেষ। অবাক লোচনে নিষ্প্রভ দৃষ্টি ফেলল। সরল চক্ষু চূড়ায় উঠল। ও বলল কি, আর এই লোক উত্তর দিল কি?
গার্ডেনে খেলায় মত্ত সায়রের দিকে একপল চেয়ে, অরু হতবাক হয়ে শাসায় রাগান্বিত সুরে,
” একটু সিরিয়াস হলে কি হয়? আপনার ভাইয়ের সামনে বেহায়ার মতো বউয়ের দিকে সেই কখন থেকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। লজ্জা করছে না? ”
হ্যাভেন সরু চোখে তাকায়। কপাল কুঁচকালো নিমিষে। পায়ের উপর পা তুলে শুধায়,
” ভুলে গিয়েছো? ”
সে ভ্রু নাচাল,
” কি? ”
কফির মগে শেষ চুমুক বসিয়ে, সেটা সম্মুখের ছোট্ট টি-টেবিলে রেখে দিল হ্যাভেন। পরপর জোর গলায় মনে করালো নিজস্ব অভিব্যক্তি,
” সেদিন না বলেছিলাম, আমার লজ্জা নেই। তোমাকে বিয়ে করে সব লজ্জা বেচে দিয়েছি। ”
অরু চরম বিরক্ত হলো। মৃদূ চটে গেল মুহুর্তে। চিড়বিড়িয়ে ক্ষুব্ধ মেজাজের বহিঃপ্রকাশ ঘটাল,
” ভালো চান তো দৃষ্টি সরান। নয়তো গরম কফি আপনার মাথায় ঢেলে দিবো। নির্লজ্জ লোক! ”
বাক্যের যবানিকার সঙ্গে সঙ্গে টের পেলো, হ্যাভেনের একটা হাত ওর পৃষ্ঠদেশ ছাপিয়ে উদর চেপে ধরেছে। পুরুষালি উষ্ণ শরীরের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়েছে তাকে। তৎক্ষনাৎ অরুর শ্বাস কন্ঠনালিতে আটকে গেল। হৃদস্পন্দন জোড়াল হয়। শরীর জুড়ে নামে কম্পন। নিভু নিভু চোখে চাইতেই, সে
ভ্রু উঁচিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে কাটকাট তর্জন দিল,
” না নজর, আর না হাত, কোনোটাই সরাবো না। দেখি কি করতে পারো। ”
অরু দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট ঈষৎ কামড়ে ধরল এবার। প্রবল অসহায়বোধ করল। আগেই বোঝা উচিত ছিল, এই লোক ভালো হবার নয়। কেন যে ভুলে যায়? নিজের উপর রাগ লাগলো! সায়র দেখলে কি ভাববে? মুহূর্তে আদুরে ফরসা মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। গজগজিয়ে শক্ত কন্ঠে উচ্চারণ করলো,
” সায়র দেখে ফেলবে। ”
” দেখুক। ”
সে অকপটে জানায়। অরু গাল ফোলায়। কাচুমাচু মুখের কন্ঠস্বর শৃঙ্গে,
” প্লিজ গেট অ্যাওয়ে ফ্রম মি। ”
শিশুসুলভ চাহনি নিয়ে একবার চোরা চোখে তাকাল, মুক্তি পাবার আশায়। হ্যাভেন চোখ -মুখ অপরিবর্তিত রেখে একই ভঙ্গিতে বলল,
” নেভার। ”
সে বিস্মিত হয়ে ক্ষুব্ধ দৃষ্টি তাক করল। বিশ্রী শব্দ গলায় জমা হয়, তুরন্ত তেতে আসা কথার বাণ গিলে নিলো। রাগান্বিত অক্ষিপট জ্বলে উঠতে চেয়েও নিভে গেল। হার মানল লোকটার নিকট। ব্যগ্র কণ্ঠে অনুনয় করে,
” প্লিজ। ”
প্রকৃতি হতে মৃদুমন্দ বাতাস ধাবিত হচ্ছে এদিকে। বাতাসে অরুর অল্পস্বল্প চুল উড়ছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অবিন্যস্ত ভাবে ললাটের চারপাশে।
বাঁকা হাসল হ্যাভেন। গ্রীবা বাঁকিয়ে কেমন অদ্ভুত ভাবে চাইল। শিরদাঁড়া সটান রইল। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িযুক্ত গাল বাড়িয়ে দিল হম্বিতম্বি মেয়েটির ঠোঁটের নিকট। উৎফুল্ল চিত্তে ঢালল নিদারুণ উচ্ছ্বাস,
” গালে ঠোঁট বসালে ভেবে দেখবো। ”
নেত্রদ্বয় বড়ো করে তাকায় রমণী। লজ্জায় ঊর্ধ্বগগনে ছুটছে সে। সায়র’কে পরখ করল নিখুঁত দৃষ্টিতে। হতাশার দম ফেলল। বলল কন্ঠ চেপে,
” ভালো হচ্ছে না কিন্তু! ”
” লাগবে না চুমু। আরেকটু কাছে আসো। একটু ছুঁয়ে দিই তোমায়। ”
স্পষ্ট জবাবটায় মেয়েটা তব্দা খাওয়ার জোগাড়। কী সর্বনাশের কথা! ছোটার জন্য মোচড়ামুচড়ি করছে। হকচকিয়ে হৃষ্ট চিত্তে আওড়ায়,
” দূরে যান। ছুঁবেন না। ”
” তাহলে কাকে ছুঁবো? তোমার নানিকে? আচ্ছা, তাকে ডেকে আনো। ”
অরু তৎক্ষনাৎ খোঁচা মারল,
” আছে না আপনার বিদেশি সাদা বিড়াল। ”
পুরুষালি মোটা জোড় ভ্রু কুঁচকে গেল সহসা। জানতে চাইল সচকিত হয়ে,
” সাদা বিড়াল আসলো কোথা থেকে? ”
ওর কন্ঠনালি দিয়ে বেরিয়ে এলো এক অমায়িক ক্ষেপা গর্জন,
” জাজলিন। ”
হ্যাভেনের কুঁচকানো ভ্রু তার আগের রূপ ফিরে পায়। ক্ষণিকের আড়ালে ভড়কে যাওয়া ধাত সামলে নিলো মুহুর্তেই। চকচকে মুখখানায় তৎক্ষনাৎ সূ্যের কিরণ এনে, ঠোঁট কামড়ে হাসল। মৃদুস্বরে শুধায় অতি আগ্রহ নিয়ে,
” জাজলিন’কে হিংসা করো? ”
থমথমে খায় অরু। বৃথা উজ্জ্বল মুখশ্রী বানিয়ে ঠোঁট উল্টায়,
” কখনোই না। ”
” না করলেই ভালো। শোনো, আমি হলাম পিউর চরিত্রবান মানুষ। জাজলিন হোক কিংবা তোমার নানি, বউ ছাড়া যাকে খুশি তাকে ছোঁয়া হারাম। আমি আবার খুব বউ ভক্ত। তোমার তো খুশি হওয়ার কথা। খুশিতে আমাকে অন্তত শ’খানেক বড়ো বড়ো চুমু খাওয়া উচিত। খেয়েছো? খাওনি! কেন খাওনি? আসলে, তুমি হলে টু মাচ কিপ্টা। আমি তো কিপ্টা না। আমার মন মহাসমুদ্র থেকেও বিশাল বড়ো। বউকে চুমু খেতে বিন্দু পরিমাণ কিপ্টামি আমার ডিকশনারিতে নেই। বুঝতে পারছো, কত ভাগ্যবতী তুমি? ”
লাগামহীন বাক্যবহরে কান গরম হয়ে গেল অরুর। আরক্ত মুখবিবর লজ্জায় বুঁদ হয়ে শশব্যস্ত দৃষ্টি নামায় ভূপৃষ্ঠে। ক্ষীণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠল আচমকা,
” আল্লাহর দোহাই, থামুন। সায়র, টুটুল যখন-তখন এদিকে চলে আসবে। হাত সরান। ”
হ্যাভেনের বিন্দু পরিমাণ ভাবান্তর ঘটলো না। মুখ ঘুরিয়ে যেভাবে ছিল, সেভাবেই ঠায় বসে। অরু দাঁতে দাঁত পিষল। ক্রোধে ফুঁসছে। নাকের পাটাতন ফুলছে। মুখশ্রী কাঠিন্য হয়ে গিয়েছে। নিমিষে ফুরফুরে মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। চেয়েও কিছু করতে পারছে না। কিয়ৎক্ষণ পর অকস্মাৎ মস্তিষ্ক জুড়ে হামলা চালাল অপার্থিব লজ্জাকর আচরণ। কাজটা করবে কি করবে না, দ্বিধাগ্রস্ত সে। আইঢাই ভাব বুকে চেপে আস্তেধীরে মাথাটা নির্দ্বিধায় এলিয়ে দিল স্বীয় পুরুষের প্রসস্থ বক্ষপটে।
চমকে উঠল হ্যাভেন। কেঁপে উঠল বক্ষপিঞ্জর। ত্বরিত বেগে গ্রীবা বাঁকায়। হম্বিতম্বি হতবিহ্বল দৃষ্টি ফেলল, বুকের মধ্যে খিঁচে ঘন নেত্রপল্লব বুজে থাকা মুখাবয়বে। চক্ষুপটে অবিশ্বাস। কৌতূহল কন্ঠে কিছু বলবে, তার আগেই শুনতে পেলো মিহি স্বরে মেয়েলি মোলায়েম বাক্য,
” কথা শুনলে রাতে আর কক্ষনো রুম ছেড়ে অন্য রুমে ঘুমাবো না। ”
হ্যাভেনের হৃৎস্পন্দন থমকে যায়। ভেতরটা বিষণ্ন উত্তাপে ছটফট করে উঠে। হঠাৎ করে শরীরের প্রতিটি কোষে জমে উঠেছে এক অজানা ব্যাকুলতা। অপ্রত্যাশিত কথায় হোঁচট খেয়েছে। একধরনের মোহমায়া, বিপন্নতা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। বিস্ফোরিত অদৃশ্যভাবে যেন কেউ তার সমস্ত শক্তিটুকু শুষে নিয়েছে। স্নায়ুকোষ অস্বাভাবিক গতিতে লাফাচ্ছে।
অরু অনুভব করতে পারছে হ্যাভেনের হৃৎপিণ্ডের ধকধক। মুহূর্তে একরাশ লজ্জা ঘিরে ধরল তাকে। মাথা উঠাতে তীব্র হাঁসফাঁস লাগছে।
বিমূর্ত, স্থির হ্যাভেন সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। ধুরন্ধর হ্যাভেনের বুঝতে সময় লাগলো না, বউয়ের সম্মোহনীর বিষয়টা। ওকে বশিভূত করার কৌশল ভালোই রপ্ত করেছে চঞ্চল রমণী। ঠোঁট এলিয়ে এক চিলতে হাসল। তপ্ত শ্বাস ঝাড়ে। অরুর মাথায় এক হাত রেখে ফিচেল গলায় বলল,
” আমি চাইলে তোমার সাধ্যি ছিল না টুটুলের রুমে ঘুমানোর। দরজা গড়তে পারলে সেটা ভাঙার ক্ষমতাও রাখি। ”
মুখ তোলে সে। বুক হতে মাথা উঠায়। মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকায়। হ্যাভেন পুনরায় উচ্চারণ করল মেঘমন্দ্র কন্ঠে,
” ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায়, বলে যখন দিয়েছো তখন কথাটা মাথায় রেখো। ”
সহসা সম্বিত ফিরল উচাটন অরুর। হ্যাভেনের হাত শিথিল হতেই আলগোছে ছাড়িয়ে ধড়ফড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। গর্জে উঠে সহসা। প্রত্যুত্তরে কিড়মিড়িয়ে স্বল্প রাগের চোটপাট দেখাল,
” ছাড়া পেতে মিথ্যা বলেছি। মাথায় রাখবো কোন দুঃখে? ”
হ্যাভেন কঠিন চাউনি নিক্ষেপ করে কটমটিয়ে তেড়ে আসতেই, অরু দাঁত কেলিয়ে হেসে টুটুলের নিকট ছুট লাগায়। সে চোয়াল শক্ত করে এগিয়ে আসে। তক্ষুনি ওদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে, মেইন রোডে হাঙ্গামা দেখে পদযুগল থামাল হ্যাভেন। টানটান কপালে প্রগাঢ় ভাঁজ ফেলে, কি হচ্ছে জানার অভিলাষে সেদিকে পা বাড়াল।
ভয়ানক আঘাতে গলা ফাটিয়ে চিৎকার জুড়েছে তাগড়া পুরুষালি কন্ঠস্বর! বুক চিঁড়ে ধ্বনিত হচ্ছে ভয়ার্ত আর্তনাদ। তীব্র যন্ত্রণায় গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করছে। কেউ বাঁচাতে আসছে না। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। একজন লোককে ভরা রাস্তায় মৌমাছির মতো ঝাঁক বেঁধে একদল মানুষ মিলে পেটাচ্ছে। কেউ লাঠি, কেউ জুতো, কেউ ঝাড়ু দিয়ে মারছে। বাকিরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। তাদের জন্য অনেক ছোট বড়ো গাড়ি রাস্তার মধ্যিখানে আটকে রয়েছে। এমতাবস্থায়, শোরগোল সকলের হৈচৈ নিমিষে ঠান্ডায় বদলে গেল, হ্যাভেনের দাম্ভিক রাশভারী ভয়েসে,
” কি চলছে এখানে? ”
প্রত্যেক মানুষের হাত থেমে যায়। তারা সকলে নড়েচড়ে দাঁড়ায়। উদগ্রীব হয়ে একবার হ্যাভেন’কে দেখল, পরপর মস্তক নিচুতে নামায়। হ্যাভেনের পাশে অরু এসে দাঁড়ায়। ওকে বেরিয়ে আসতে দেখে তৎক্ষনাৎ পিছু পিছু চলে আসে।
গাড়ির টিটটিট হর্ন ব্যতীত ভিন্ন আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। অনেকেই গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করছে। তবে সেসব কর্ণগহ্বরে স্পষ্ট ভেসে আসছে না। জনগণের নীরবতা তুঙ্গে উঠিয়ে ফের প্রতিধ্বনিত হলো তেজি চওড়া কন্ঠ,
” উনাকে মারছেন কেন? ”
সকলেই নীরব। পরিস্থিতি থমথমে। সূর্যের সহনশীল তাপমাত্রা বেড়ে ভ্যাঁপসা গরমে রূপ নিয়েছে। চারপাশে বিরাজমান গুমোট বাতাবরণ। নিশ্চুপতা আগুন জ্বালিয়ে দিল হ্যাভেনের গুরুগম্ভীর বদনে। হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো। চিরচেনা দাপট দেখাতে তৎপরতা চালাতে প্রস্তুত হয়। তর্জনী উঁচিয়ে গা কাঁপানো ক্ষুদ্র বুলি ছোড়বার পূর্বে সকলের মাঝ হতে একজন বলে ওঠে,
” সাহেব, এই হারামজাদা বিবাহিত চার-পাঁচটা বাচ্চা জন্ম দেওয়া মহিলাদের সঙ্গে পরকীয়ায় মেতে থাকে। দর্জি কাজ করে যা টাকা পায় বউয়ের থেকে তা ছিনিয়ে নিয়ে নেশা করে। বউ বাঁধা প্রদান করতে চাইলে বিভৎস ভাবে তাকে মারধর করে। ”
শান্ত কন্ঠে শুনল। অমনি রাগ তরতর করে বৃদ্ধি পেলো হ্যাভেনের। আক্রোশে ফেটে পড়ল। ভেতরের উত্তেজনা দমিয়ে রাখতে চাইছে। সফল হচ্ছে না। ক্ষোভ, অসহিষ্ণুতা একদম চূড়ান্তে পৌঁছে গিয়েছে। জোর দিয়ে দন্তপাটি পিষছে। চোয়ালদ্বয় আগে থেকেই কঠিন হয়ে আছে। নিগূঢ় সূঁচালো চাউনি অগ্নিগিরি লাভা। চোখের পাতা কাঁপছে ক্ষণে ক্ষণে। নয়ন মণিতে লালচে আগুনে জ্বলছে।
গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো হ্যাভেন,
” কতদিন যাবত চলছে? ”
” তা তো জানা নেই। ”
” উনার স্ত্রী কোথায়? ”
” দেখিনি। ”
পাল্টা প্রশ্ন করার দরকার পড়েনি। একজন মধ্যবয়সী ক্রন্দনরত মহিলা এগিয়ে এসে দাঁড়ায় ওর সামনে। মহিলার বিধস্ত মুখবিবর বলে দিচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে অত্যাচার সহ্য করছেন। হাতে, গলায়, গালে, কপালে অসংখ্য মারের কালচিটে দাগ সুস্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে। ছিঁড়ে যাওয়া ময়লাযুক্ত সুতির শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে ফোঁপাতে ফোপাঁতে অভিযোগ জানালেন,
” বাবা, আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। আমার স্বামীর পরকীয়া নতুন না। বিয়ের পর থেকে এসব দেখে চলেছি। আমার বাবার বাড়ির লোক গরীব। তাদের স্বামীর কর্মকাণ্ড জানালে, তারা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তারা যেন আমাকে বিয়ে দিয়ে বেঁচে গিয়েছে। এতগুলো বছর ধরে মুখ বুজে, শত চাওয়া পাওয়া জলাঞ্জলি দিয়ে ওর সংসার করছি অবলীলায়। আর পারছি না। সহ্যশক্তির বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। আমার মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে পরের বাড়ি পাঠিয়ে ছিলাম। সেখান থেকে প্রতি মুহূর্তে মেয়ের কান্না শুনতে পেতাম। জামাই শুধু টাকা চাইত। না দিতে পারলে আমার মেয়েটাকে মারতো। তাই আমি সেলাই কাজ করে যতটুকু আয় করি, সেটা মেয়েকে দিয়ে দিতাম। কয়েকবছর যাবত মেয়েকে টাকা দিতে পারিনি, আমার স্বামী সব টাকা নিয়ে যেত। মানা করলেও শুনতো না। একদিন টাকার জন্য রেগে গিয়ে, আমার মেয়েটাকে জামাই ইটের সাহায্যে বারি দিয়ে মেরে ফলেছে। একমাত্র সন্তান ছিল আমার মেয়েটা। ”
এতটুকু বলেই ভদ্র মহিলা বিলাপ করে কাঁদতে লাগলেন। মহিলার আহাজারিতে সকলেই ব্যথিত। তার মাতৃসুলভ আর্তচিৎকারে অরুর চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। অচিরেই খামচে ধরল হ্যাভেনের পেশিবহুল বাহু। নরম মনের মেয়ে, সেজন্য কারো কষ্ট দেখতে পারে না ও।
হ্যাভেন নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। আহত চক্ষু জোড়া মহিলার উপর নিবদ্ধ। তিনি আঁচলে নাক মুছে উদাসীন মুখে পুনরায় বলতে লাগলেন,
” দিন দিন স্বামীর যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ আমি। কোনো কাজকর্ম করে না। উল্টো আমি পেট বাঁচাতে যতটুকু সম্ভব কাজ করি, সেটা নিয়ে অপকর্মে লিপ্ত থাকে। স্বামী আমার, তাই তাকে ত্যাগ করতেও পারছি না। আবার তাকে নিয়ে সংসার করাও মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। ”
বলতে বলতে বাঁধ ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। অরু এবার দৃষ্টি তুলে নির্লিপ্ত হ্যাভেনের ভাষাহীন শূন্য অক্ষিপটে তাকাল। সে শান্ত অথচ ধ্বংসাত্মক কঠোর চোখে নিভৃতে তাকিয়ে। কিয়ৎক্ষণ বাদে করুণ মহিলার দিকে চেয়ে ধ্রুব কন্ঠে শুধাল,
” মেয়ের জামাইয়ের বিচার চেয়েছিলেন? ”
” চেয়েছি। টাকা ছাড়া পুলিশ কেস নেয়নি। ”
” সে কোথায় আপনি জানেন? ”
মহিলা মাথা নাড়লেন। হ্যাভেন ফোনে ব্যস্ত হস্তে টাইপ করে কাউকে মেসেজ করল। অতঃপর আশ্বাস দিল,
” কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন এসে আপনাকে নিয়ে যাবে। আপনি তাকে আপনার মেয়ের জামাইয়ের ঠিকানায় নিয়ে যাবেন। যা জানতে চাইবে বলবেন। ভয় পাবেন না। আর আপনার স্বামীর থেকে ভবিষ্যতে এরকম হানিকর আচরণের শিকার হতে হবে না। ব্যাপারটা আমাকে আগে জানালে, হয়তো আপনার মেয়েকে হারাতে হতো না। ”
” তুমি তখন বিদেশে ছিলে। ”
মহিলার বোকা বোকা দ্বিধাহীন অকপটে জবাবে আলতো হাসল হ্যাভেন। ভরসা সরূপ স্নেহময় কন্ঠে বলে,
” যেই দেশেই থাকি, কাকুর মাধ্যমে জানালেও পারতেন। আপনার মেয়েকে বাঁচাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতাম। ”
ভদ্র মহিলা নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন। যাকে মারছিল, সেই লোক অর্থাৎ মহিলার স্বামী তটস্থ হয় মুহূর্তে। আতঙ্ক ছড়ায় শ্যামলা কালো আদলে। হাত-পা কাঁপছে সবেগে। শরীর ব্যথায় জর্জরিত। এলোমেলো ভাবে হেঁটে হাঁটু ভেঙে পিচ ঢালা রাস্তায় হ্যাভেনের সম্মুখে বসে পড়লেন। ধরাশায়ী কন্ঠে বলে উঠলেন,
” ভুল হয়ে গিয়েছে। ক্ষমা করুন। ”
হ্যাভেন বুকে হাত গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়ায়। রক্তিম ধারালো চাহনি নিক্ষেপ করল লোকটার উপর। অতঃপর চিবিয়ে চিবিয়ে আওড়াল,
” ক্ষমা আপনার স্ত্রীর কাছে চান। অবশ্য খুব একটা লাভ হবে না। তিনি ক্ষমা করলেও আমি করবো না। ”
একটু থামল। কন্ঠতালু দিয়ে বেরিয়ে আসে রুদ্ধশ্বাস। তীক্ষ্ণ চাহনি আশেপাশের স্থির গাড়ি আর মানুষের দিকে নিক্ষেপ করে গমগমে গলায় আদেশ ছুড়ল,
” যে যার কাজে যান। রাস্তা ক্লিয়ার করুন৷ ”
মেনে নিলো সকলে। অল্প সময়ের ব্যবধানে গাড়ি আসতেই স্বামী স্ত্রী দু’জনকে ক্ষণিকের পরিকল্পিত ঠিকানায় পাঠিয়ে দিল হ্যাভেন।
ঝামেলা মিটমাট হতেই বাহুতে জ্বলন অনুভব করল হ্যাভেন। জোড় ভ্রু কুঁচকে চাইল সেখানে। অরুর বৃদ্ধা আঙুলের নখ দ্বারা সামন্য পরিমাণে আঁচড় কেটেছে বাহুতে। ফোঁস করে ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। ঝাড়া মেরে হাত ছাড়িয়ে নিলো। হাত ছাড়াতেই অরুর হুঁশ ফিরল। এতক্ষণ যেন ঘোরের মধ্যে ছিল।
হ্যাভেন লঘু স্বরে খিটখিটে মেজাজে ভ্রু উঁচায়,
” রাস্তার মধ্যে খামচাখামচি করা লাগে? ”
মেয়েটির ফ্যালফ্যাল নিষ্প্রভ চাহনি। সরল দৃষ্টিতে প্রশ্ন। সে ফের বলল স্বর নামিয়ে,
” বাহুতে দেখো। ”
অরু তাকায়। খামচির দাগ দেখেও নিরুৎসাহিত রইল। ভেংচি কেটে রয়েসয়ে মুখ খুলল,
” ইটস সিম্পল। ”
সে চোখ ছোট ছোট করল। শক্ত চিবুক চুলকায় হাতের উল্টো পিঠে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ভাবল, হুমকি-ধমকি দিবে নাকি? বউটা এত পাষাণ কেন? চুমুর ডোজ কম পড়েছে বোধহয়। আজ থেকে আরও বাড়িয়ে দিতে হবে। ভাবনার মধ্যিখানে অরুর রাগান্বিত তেতে বাক্য কর্ণগহ্বরে ভেসে এলো,
” পুরুষ মানুষ আসলেই অদ্ভুত। বিয়ে করতে গেলে সাধারণ ডিভোর্সি মেয়েকে পছন্দ করে না! অথচ পরকীয়া করতে গেলে চার বাচ্চার মাকেও বিশ্ব সুন্দরী মনে করে! ”
তিক্ত হলেও কথাটা সত্যি। হ্যাভেন রাগ করল না। ঠোঁট এলিয়ে হাসে। অরুর হাতের আঙুলের ফাঁকে আঙুল গলিয়ে হাঁটা শুরু করে নতুন উদ্যমে। অরু স্বামীর সঙ্গে পা চালাচ্ছে। বাড়ির গেইট পেরিয়ে বাগানে আসতেই বল বাউন্স করতে করতে সায়র সামনে আসে। অরু হাত ছাড়িয়ে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায়।
” ভাই ওদিকে হট্টগোল কিসের? ”
” নাথিং সিরিয়াস। ”
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিল হ্যাভেন। পরপরই হাত বাড়িয়ে চনমনে গলায় অপার্থিব দীপ্তিশীল অস্তিত্বকে ডাকল,
” কলিজা, আব্বুর কাছে আসো। ”
সামান্যতম আহ্বানে বিশ্ব জয়ের খুশিতে ঢেউ তুলল টুটুল। ভুবনমোহিনী খিলখিল হাসির ঝঙ্কারে মুখরিত চারিপাশ। ব্যাট ফেলে ছন্দ তুলল এলোমেলো নাজুক গতিবিধি। হেলেদুলে এক ছুটে দৌড়ে এলো। ছেলেকে কোলে তুলে আদুরে মুখে টপাটপ কতগুলো চুমু খেল হ্যাভেন। বিনিময়ে টুটুলও বাবাকে আদর দিল।
সায়র হাত কচলাচ্ছে। জিভে ঠোঁট ভেজায়। শুষ্ক ঢোক গিলে মিনমিন স্বরে ঠোঁট নাড়ে,
” ভাই, ইয়ে মানে, না মানে…! ”
হ্যাভেন তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করল তৎক্ষনাৎ,
” তোতলানো ছাড়। স্পষ্ট বল। ”
সায়র চোখ বুজে এক দমে বলে ফেলল,
” অঙ্কিতাকে নিতে পারবো? ”
হ্যাভেন ভ্রু গোটায়,
” এটা কে? ”
” ফ্রেন্ড। ”
” বিবাহিত দম্পতি ছাড়া যাওয়া নিষেধ। তুই জেদ করছিস বলে পারমিশন দিয়েছি। বাড়াবাড়ি করলে তোকেও নেবো না। ”
ঝলমলে হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা নিমিষে চুপসে যায়। মলিন চেহারা নিয়ে ভাবীর পানে তাকায়। সে মাথা নেড়ে বোঝালো, তার কিছুই করার নেই। সায়র ধুপধাপ পা ফেলে চলে যায়।
প্রেমপিপাসা পর্ব ২৯
আজ হ্যাভেনের এক ফ্রেন্ডের বাড়িতে বড়সড় পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। ওদের ইনভাইট করেছে। পার্টি মূলত কাপলদের নিয়ে। অরুর কাছ থেকে জেনে সায়র বায়না ধরেছে সে যাবে। হ্যাভেন বিনাবাক্যে অনুমতি দিয়েছে। সুযোগ কাজে লাগিয়ে সায়র অবান্তর আবদার ছুড়েছে, অঙ্কিতা’কে সঙ্গে নিবে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়।
” আব্বু তোমরা কোথায় যাবে? আমিও যাব। ”
আধো আধো স্বরে শুধায় টুটুল। ছেলের নাকের ঘাম মুছে দিতে দিতে প্রত্যুত্তরে করল হ্যাভেন,
” বড়োদের পার্টি কলিজা। তুমি যেতে পারবে না। ”