প্রেমপিপাসা পর্ব ৩০ (২)

প্রেমপিপাসা পর্ব ৩০ (২)
সুমাইয়া সুলতানা

ভগ্ন হৃদয়ের জরাজীর্ণ মিষ্টির নিকট নীরবতায় মোড়ানো এক গুমোট প্রভাত। বাতাসে শীতের মৃদু ছোঁয়া, যেন প্রকৃতির নীরব মধুরতা ঘুমভাঙা শহরের গায়ে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আকাশ স্বচ্ছ নীলিমায় ভরা, তবুও কোথাও এক ধোঁয়াটে কুয়াশার আবরণ, নানান ব্যস্ততার আড়ালে হারিয়ে যাওয়া কোনো স্মৃতির মতো। প্রকৃতির প্রতিটি স্নিগ্ধতা ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে এক রহস্যময় কাব্যিকতায়। বৃক্ষের পাতাগুলো মিষ্টির ভাষাহীন বেদনাদায়ক সময়ের নিঃশব্দ সাক্ষী, আর বাতাসে ভেসে বেড়ানো ধূলিকণাগুলো ক্ষণিক অতীতের মতো ভঙ্গুর অথচ অনন্য। সূর্য তার কিরণে জমে থাকা জড়তা গলিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু তাপ নয় একরকম নীরব আগুন, যা শুধু অনুভব করা যায়। এই বাতাবরণ মিষ্টির মনের অনুভূতিহীন দুঃখবিলাসের মতো। না প্রশান্তিকর, আর না অস্বস্তি! একটা অনিশ্চিত দ্বিধার মতো, যা শুধু হূদয়ের গভীরে কিছু অনুভব জাগিয়ে রেখে যায়।

” আপনি জানেন না, কিন্তু আমি জানি। আপনার প্রতিটা ভাবনা, প্রতিটা স্মৃতি আমার বুকে গভীর পোড়া দাগের মতো গেঁথে আছে। আপনি ভাবেন আমি ভুলে গিয়েছি, কিন্তু জানেন কি? আপনার কথা মনে পড়লে, আপনার নাম উচ্চারণ করলে এখনও আমার হৃদস্পন্দন এক সেকেন্ডের জন্য থেমে যায়। আপনি চলে গিয়েছেন, আমি আজও বেহায়ার মতো আপনার পথ চেয়ে থাকি। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি ভার্সিটির সেই জায়গায়, যেখানে একদিন আপনি বলেছিলেন, আপনাকে ভুলে যেতে, আপনার পিছু নেওয়া ছেড়ে দিতে, সবসময় হাসতে। অথচ দেখুন, আপনার পেছনে ঘুরঘুর করা ছেড়ে দিলেও, সেদিনের পর আর হাসতে পারিনি। বহুত চেষ্টা করেও এক চিলতে হাসি ফোটাতে পারিনি এই শুষ্ক ঠোঁটে। আপনাকে ভুলতেও পারিনি। হয়তো আমি আপনার কিছুই ছিলাম না, কিন্তু আপনি আমার কাছে মহামূল্যবান ছিলেন। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এতটুকু লিখেই শূন্য দৃষ্টিতে অথৈজল পরিপূর্ণ করে ডায়েরিটা বন্ধ করল মিষ্টি। এরকম ছোট বড়ো নিজের দোনোমোনো অনুভূতিগুলো প্রায়ই কালো বল পেন দ্বারা ফুটিয়ে তোলে ডায়েরির সাদা পৃষ্ঠায়। লেখার সময় চোখের জলে ভিজে লেপ্টে যায় লেখাগুলো। আজকেও তার ব্যতিক্রম নয়। কষ্টের ভারিক্কি নিঃশ্বাস ফেলে ডেস্ক ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। পিলপিল পায়ে হেঁটে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। রাস্তার ধুলো উড়িয়ে ক্যাঁচরক্যাঁচর শব্দে একের পর এক রিকশা ছুটে যাচ্ছে। এই রাস্তায় বড়ো গাড়ি ঢুকতে পারে না। বড়োজোর প্রাইভেট গাড়ি আসা যাওয়া করতে পারে। মালবাহী ট্রাক, বাস গাড়ি যেতে পারে না।

মিষ্টির নজর দূরবর্তী বিশালাকৃতির নীলিমাতে। কী ফকফকা শুভ্র সাদা মেঘ। আপন ছন্দে উড়ছে পক্ষীকূল। উদাসীন হয়ে তাকিয়ে থাকল সেথায়। কিয়ৎক্ষণ বাদে তপ্ত শ্বাস টেনে চলে আসতে নিবে তক্ষুনি অনাকাঙ্ক্ষিত মুখাবয়ব দেখে চমকে উঠল ও। চক্ষু স্থবির হয়ে এলো। একটি পরিচিত মুখ, যা দেখা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের নীরব বিস্ফোরণ। ফ্যালফ্যাল নিষ্প্রভ চাহনি চেয়েই রইল। চোখ বিশ্বাস করতে চাইছে না। মন মানতে চাইছে না। মস্তিষ্ক অস্বীকার করছে। সময় যেন দাঁড়িয়ে গেল, ব্যথাতুর হৃদস্পন্দন এলোমেলো হয়ে ছিটকে পড়ল বুকের প্রাচীর ভেঙে। মেয়েটির কণ্ঠ রুদ্ধ, শ্বাস আটকে গেল। যার রেশ নিষ্ঠুর বিস্ময় ভাবে ছড়িয়ে পড়ল পুরো শরীর জুড়ে।

ওদের বাড়ির নিচে মিষ্টির সইসই দাঁড়িয়ে, রাহাত ওর দিকেই আহত চোখ তাকিয়ে আছে। তাকে দেখেই বিদঘুটে তিক্ত কিছু স্মৃতি মিষ্টির মস্তিষ্কের ভেতর দাপাদাপি করতে লাগলো। রাহাতের ঘামে শার্ট ভিজে জুবুথুবু হয়ে আছে। ঘামযুক্ত মুখশ্রী জুড়ে ক্লান্তির ছাপ। গরমে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় হাঁপাচ্ছে। মিষ্টি বারান্দা থেকে খুব ভালো মতো বুঝতে পারলো। মিষ্টি মুখ ঘুরিয়ে বারান্দা থেকে চলে যায়। মানুষটাকে দেখলে বিদীর্ণ হয় বক্ষপট। দেখবেও না, তার কাছে যেতেও মন চাইবে না। আড়ালে লুকিয়ে উঁকি দিয়ে একপল দেখল, রাহাত এখনো সেখানে দাঁড়িয়ে। মিষ্টি অভিমান দমিয়ে রাখতে পারছে না। চিরচেনা সেই অনুভূতির অঙ্গার হানা দিয়েছে সবেগে। চেয়েও আটকে রাখতে সক্ষম হলো না। কাছ থেকে দেখার লোভ সামলাতে না পেরে উড়নচণ্ডী মুক্ত শালিকের ন্যায় বিলম্বহীন ছুট লাগালো নিচে।

রাহাতের থেকে স্বল্প দূরত্বে থাকাকালীন পদযুগল থামাল সে। দুজন দুজনের দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছে। তৃষ্ণার্থ চক্ষু জোড়া ভাষাহীন শূন্য অনুভূতিতে ভেসে যাচ্ছে। নির্বিকার ভঙ্গিতে দুজনেই দাঁড়িয়ে। কথা কি ফুরিয়ে এসেছে নাকি কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না, বোঝা বড়ো দায়! রাহাত শান্ত চাহনি অবলোকন করছে। মিষ্টির হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা বিলীন হয়ে সেথায় ঠাঁই পেয়েছে ব্যাকুল, করুণ মুখবিবর। সময় গড়ালো। অতিবাহিত হয় কিয়ৎক্ষণ। মিষ্টি’কে ওভাবেই স্থির থাকতে দেখে, নিরাশ দম ফেলে এগিয়ে যায় রাহাত। দূরত্ব ঘোচায়। মুখোমুখি হয় দুটি নাজুক সত্তার অস্তিত্ব। মিষ্টি জলে টইটম্বুর নেত্রদ্বয়ে চেয়ে আছে। অধর নেড়ে ক্ষুদ্র বাক্য বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। সব আবেগ কন্ঠনালিতে আটকে গেল। বক্ষপট ভার হয়ে এলো। চক্ষুপট হতে অবিরত গড়িয়ে পড়া নোনাপানির স্রোত কোনো বাঁধা মানছে না৷

মেয়েটির ক্রন্দনরত মুখশ্রীতে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আদুরে গলায় শুধাল রাহাত,
” কেমন আছো মিস মিষ্টি? ”
মনঃক্ষুণ্ন হলো মিষ্টির সত্তা। ক্ষত সৃষ্টি হয়ে দগ্ধে রূপ নিয়েছে হৃদয়। এতক্ষণ ভাবছিল, রাহাত ওকে বুকে জড়িয়ে ধরবে। বিগত দিনগুলোতে ওকে একা করে দেওয়াতে ক্ষমা চাইবে। অথচ সেরকম কিছুই ঘটলো না।
মেয়েটির নেত্রদ্বয় ভরে উঠে ফের। প্রবল বর্ষার স্রোত যেন দু’চোখে উথলে পড়েছে। অশ্রু টলমলে ঝাপসা দৃষ্টি । শব্দ ভান্ডার ফুরিয়ে এসেছে। ঝটপট চোখের জল মুছে নিলো। থেমে থেমে উচ্চারণ করল বহুকষ্টে,
” খুব ভালো। আপনি? ”
হেলাফেলা জবাব পছন্দ হলো না রাহাতের। তবে পাল্টা সূঁচালো বাক্যও ছুড়ল না। উত্তরে জানালো দ্বিধাহীন সরল স্বীকারোক্তি,

” আমি ভালো নেই। ”
মিষ্টির নজর নিষ্প্রাণ। শুধু অনুভূতিহীন তাকিয়ে আছে। রাহাত পুনরায় হতাশ হলো। স্পষ্ট চেহারায় বিব্রত ভাব। স্বস্তি আকাশে উড়ে গিয়েছে। হতচেতন আওড়াল,
” জানতে চাইবে না কেন ভালো নেই? ”
মেয়েটা এবার মুখ খুলল। তার অভিব্যক্তি শক্ত,
” প্রয়োজনবোধ করছি না। ”
কাটকাট প্রত্যুত্তরে রাহাত কষ্ট পেলো। তবে সেটা প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক। জবাবটা ঠিক যুতসই হলো না। চিবুক ক্রমেই কেমন শক্ত হয়ে উঠছে। লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করল। রাশভারী কন্ঠে প্রসঙ্গ পাল্টায় অবলীলায়,
” তুমি নাকি ঠিক মতো ভার্সিটিতে যাচ্ছো না? এটা কি ঠিক? পড়াশোনায় খামখেয়ালি বরদাস্ত করবো না আমি! ”
মনের এক কোণে হোঁচট খেলো মিষ্টি। বিহ্বলিত নয়ন ঝাপটে রাহাত’কে দেখল। পরপর আবেগে ভাসা দৃষ্টি জ্বলে উঠল। কঠিন তার মুখ। এই লোক ওকে শাসাচ্ছে? কিসের ভিত্তিতে? তেজি গলায় বলে ওঠে,
” আমাকে এসব বলার অধিকার আপনার নেই। ”

অবাক হতে দেখা গেল না রাহাত’কে। ও জানে মিষ্টি মন থেকে বলেনি। তবুও খারাপ লাগছে ওর। আক্ষেপ হচ্ছে কিছু একটা ভেবে। মুখমণ্ডলে বিভ্রান্তিকর স্তব্ধতায় ভেসে উঠছে এক অস্বস্তিকর গতি। ললাটের দুপাশে সামান্য কুঁচকে থাকা ভাঁজ প্রগাঢ় হয়। ঠোঁটের কোণ হতে বেরিয়ে আসে নিঃসঙ্গ চাপা শ্বাস, আর চিবুকের নিচে অস্ফুটভাবে কম্পমান এক ধরনের আত্মগ্লানি।
তার নিঃশ্বাসের মধ্যে যেন কোনো অনুচ্চারিত অপরাধবোধ ধরা আছে, যা সে প্রকাশ করতে চায় না, অথচ গোপনও রাখতে পারছে না।
ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছাড়ল রাহাত। চওড়া কন্ঠে তার প্রবল অধিকারবোধ,
” আছে কি না সেটা সময় আসলেই বোঝা যাবে। বেহুদা টেনশন ত্যাগ করে পড়াশোনা করো। সামনে পরীক্ষা। ”
সে অকপটে জানায় ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে,

” আমার ইচ্ছা হলে পড়বো। না হলে পড়বো না। ”
রাহাত গম্ভীর কণ্ঠে শান্ত হুমকি দিল,
” একটা দাঁত যখন মাড়ি থেকে খসে পড়বে, তখন বুঝবে পড়তে হবে কি না। ”
মেয়েটা ভ্রু গোটাল,
” কি বলতে চাইছেন? ”
দাঁতে দাঁত চাপল রাহাত,
” থাপ্পড় চেনো? থাপ্পড়? ”

মিষ্টি বুঝতে পারলো রাহাত ক্ষেপে গিয়েছে। সে ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে অতিরিক্ত কথা পছন্দ করে না। খুব ভালো করে জানা আছে ওর। তাই তো ইচ্ছে করে খোঁচা মারল ফের,
” আমাদের বাড়িতে এসেছেন কেন? আমার খোঁজ নিতে? নাকি আবারও দুঃখের সমুদ্রে নিপাতিত করতে? আপনি অলরেডি সাকসেসফুল। এবার বিদায় হোন। ”
মিষ্টির কথাতে সূক্ষ্ম কষ্টের উত্তেজনা। রাহাতের মুখাবয়ব যেন এক অপ্রকাশ্য ব্রীড়াবোধের গহন প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। চোখের কোণায় জমানো একরাশ জড়তা, যেটা ধীরে ধীরে লালাভ আভায় ডুবে গিয়েছে। নিগূঢ় দৃষ্টি আত্মরক্ষার ব্যর্থ প্রয়াসে মাটিতে গেঁথে রাখা, উঠে আসার স্পর্ধা নেই একরত্তিও। তার দৃষ্টির পেছনে লুকানো সেই গোপন কুন্ঠা, যা শব্দহীন অথচ প্রকট। চোখের পাতায় একটানা কম্পন, যেটা কেবল অনিচ্ছাকৃত নয়, যন্ত্রণার গাঢ় ছায়ায় জর্জরিত।
রাহাত কৌশলে কথা ঘুরিয়ে জানতে চাইল,

” এভাবে অগ্নিকন্যা হয়ে কথা বলছো কেন?
” তো কীভাবে বলবো? ”
” তোমার মনে কি চলছে? ”
তাচ্ছিল্য হাসল মিষ্টি। কান্না থেমে গিয়েছে আরও আগে। এখনো কান্নার তোড়ে নাকের পাটাতন ফুলছে। বলল বিদ্রুপ সরূপ,
” যেখানে মুখের কথা কাউকে বোঝাতে পারি না, যেখানে মনের কথা বোঝানো তো বিলাসিতা! ”
” কটাক্ষ করলে?
” তাই মনে হয়? ”
” আমি বুঝি কি চলছে তোমার মনে। ”

অঙ্গারের ন্যায় তেতে উঠল মিষ্টি। মুহূর্তে কন্ঠনালি হতে বেরিয়ে এলো এক ক্ষুদ্ধ তটস্থ গর্জন,
” বুঝেও পুরোনো আঘাত তাজা করতে এসেছেন? কঠিন থেকে কঠিনতম দাগ মুছে ফেলা যায় চিরতরে। কিন্তু আমার মস্তিষ্ক জুড়ে বেড়ে ওঠা আপনি নামক এই অসামান্য ক্ষতচিহ্নকে চাইলেও যে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। বারংবার আঘাত করে কি মজা পান আপনি? ”
বলতে বলতে কন্ঠ বুজে আসে। পুনরায় কান্না পাচ্ছে। সরু নাক লালিত। একটু পরপর ফোঁপাচ্ছে। ওষ্ঠদ্বয় চেপে রেখেছে দৃঢ়তা সমেত। সময় নিয়ে হৃষ্ট চিত্ত সামলে নিজেই ফট করে বলে বসলো,
” জমিয়ে রাখা ডায়েরির পাতায় পুরানো মনের কথা পড়তে গিয়ে কতটা কী মনে পড়ে যায় আমার, জানেন? সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে আপনার চলে যাওয়া। সিনেমার দৃশ্যের মতো ভার্সিটির চত্বরে দাঁড়িয়ে লম্বা ভাষণ ছুড়ে, আপনার চলে যাওয়া পায়ের প্রতিটি কদম আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমি কোনোদিনও ভুলবো না তা। ”
ইতোমধ্যে রাহাতের কণ্ঠ শুকিয়ে এসেছে, মেয়েটির ধারালো বাক্যবাণে। শব্দ আটকে গিয়েছে গলায়। দৃষ্টিটাও অপরাধীর মতো মাটির দিকে আটকে আছে। নিজেকে আর নিজস্বতা দু’টোকেই তুচ্ছ, তুচ্ছতর মনে হতে লাগলো তার।

হৃদয়ের ভেতর জমে থাকা শব্দহীন আর্তি যেন অসহনীয় ভার হয়ে তার বুকচাপা কান্নায় রূপ নিচ্ছে। আর সহ্য হচ্ছে না মিষ্টির যন্ত্রণা। ওর অন্তরও দাউদাউ করে পুড়ছে প্রণয়ের দহনে।
অনুভূতির মিশেলে পুরোপুরি স্তম্ভিত রাহাত। অকস্মাৎ মিষ্টির মলিন অক্ষিপুট দু’টো বাঁধন হারা নোনাজলে, যা দেখে ঘাবড়ালো রাহাত। তৎক্ষনাৎ উদগ্রীব হয়ে বলতে চায়,
” মিষ্টি আমি সে…! ”
মাঝ পথে পেলব হাত উঁচু করে থামিয়ে দিল নাজুক মেয়েটি। জিভে শুষ্ক অধর ভিজিয়ে প্রকম্পিত স্বরে জানাল,
” আমি আপনাকে পেতে গিয়া বিভৎস ভাবে নিজেকে হারালাম! একটা পরিশুদ্ধ হৃদয় উন্মোচনের অভিলাষে, নিষ্প্রভ ফ্যাকাশে একটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হৃদয় পেলাম। কাঁপনের ন্যায় স্বচ্ছ, মন দিয়ে কলঙ্কে আঁকা একটা মন পেলাম! তবুও আপনাকে পেলাম না! ”

রাহাতের নীরস অভিব্যক্তিতে সত্যি উন্মোচিত করার প্রবল উদ্বেগ। ওষ্ঠের আগায় তা দুলছে সমান তালে। কিছু বলতে উদ্যত হয়। মুখ খুলবে সেই মুহূর্তে অতর্কিত ফোন কল ব্যাঘাত ঘটায়। ফোনের কর্কশ আওয়াজে প্রচন্ড মেজাজ বিগড়ে গেল। রিসিভ করে কানে তুলল। ওপাশ হতে বক্তব্য শুনে অস্বস্তি মাখা চাউনি তাক করল মিষ্টির উপর। ব্যস ভঙ্গিতে উচ্চারণ করল হাস্যহীন,
” পড়াশোনায় মনোযোগী হও। ভাগ্য থাকলে যা চাইছো, তা পেতেও পারো। ”
” রংধনু ঘেরা শহরে সবকিছু পাওয়া যায়, কিন্তু সত্যিকারের ভালোবাসা আর বিশ্বাসী মানুষ
পাওয়া যায় না। ”
ও তর্কে গেল না। মিষ্টির অশ্রুজলে সিক্ত গালে এক হাত রেখে মোলায়েম গলায় আশ্বাস দিল,
” শুনেছি তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে মোনাজাতে উপর ওয়ালার নিকট কিছু চাইলে, তাকে তিনি ফেরান না। তুমি হয়তো জানো না, কেউ আছে, যাকে তুমি ভালোবাসার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছো। সে তোমার আগে ভালোবাসা শব্দটা না চিনলেও, এখন সে তোমাকে তোমার চেয়ে শতগুণ বেশি ভালোবাসে। তোমাকে পাওয়ার লোভে সে মোনাজাতে তোমাকে চাইছে। ”

এতটুকু বলেই রাহাত হড়বড়িয়ে নিজ গন্তব্যে প্রস্থান করল। পেছনে রেখে গেল বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় মেয়েটিকে। রাহাতের ঝটকা মারা বিস্ফোরিত বাক্যবাণে থমকে গেল পুরো ধরিত্রী, সেই সঙ্গে মিষ্টির হৃৎস্পন্দন। যুক্তিহীনতা আর বাস্তববোধের দ্বন্দ্বে, তার মস্তিষ্কে জন্ম নেয় একরকম কগনিটিভ ডিসোন্যান্স। হৃদয় নিঙড়ানো বাক্যে নিঃশব্দ অথচ ধ্বংসাত্মক তার কানে ঢুকে বারংবার ধ্বনিত হচ্ছে স্বপ্ন পুরুষের কথা। কথাগুলো একটানা কাঁপতে থাকা হৃদয়ের শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে দেয় বিস্ময়ের আগুন।
চেতনার পরিসরে যেই মুহূর্তে কথাটি ঢুকল, অর্নিবচনীয় এক স্তব্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল তার স্নায়ুতন্ত্র। অলৌকিক এক ব্যাখ্যাতীততা ঘিরে ধরল চিন্তাজগৎকে। শব্দটা যেন ধ্বনিত হল স্নিগ্ধ নৈঃশব্দ্যের ভেতর, কিন্তু এর প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ল অন্তর্মনের প্রতিটি কোটরে। হৃৎপিণ্ডের ধমনিতে অনাহূত এক কগনিটিভ কোলিশন শুরু হলো। চেতনার প্রান্তর জুড়ে বয়ে গেল নির্বাক বিস্ময়ে। তার ভেতরটা যেন মুহূর্তেই গ্রাস করল অভ্যন্তরীণ বিপর্যয়, নিঃশব্দ আতঙ্ক, যুক্তিহীন এক বোধহীনতা। সে অস্ফুটস্বরে ঠোঁট নেড়ে প্রশ্ন করল নিজের মনকে
” কি বলে গেল রাহাত? যা বলেছে সত্যি ছিল কি? ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে একপ্রকার নিজের কথা বলল তা কি আমি বুঝিনি? এও সম্ভব? ”
ওর মন উত্তর দিল না। মন, মস্তিষ্ক তখন শব্দহীন এক অবচেতনায় নিমজ্জিত।

গগন রক্তিম লালিমায় ছেয়ে রয়েছে। সময়টা এখন বিকেলের কাছাকাছি। ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে রয়েছে সায়র। পুরোপুরি মনোযোগ ফোনের স্ক্রিনে। অধর চোখা করে গোমড়া মুখে, কুশন বুকে চেপে ফোনে অঙ্কিতার ছবি দেখছে। তাকে ছাড়াই পার্টিতে যেতে হবে। সেজন্য বেজার তার মুখাবয়ব। এদিকে টাট্টাবাজ সায়র পার্টিতে সুন্দরী মেয়েদের দেখতে পাবে সেটার লোভ সামলাতে ব্যর্থ। হ্যাভেনের থেকে শুনে অরু ওকে বলেছে, বিদেশি অনেক মানুষ থাকবে। তার মানে বিদেশি মেয়েরাও থাকবে। সায়র’কে তো যেতেই হবে। অঙ্কিতার ছবি দেখছে এজন্য, যাতে সুন্দরী মেয়েদের উপর পিছলা না খায়। মনে মনে আওড়াচ্ছে, অঙ্কিতা বাদে বাকি সব সুন্দরী মেয়ে ওর খালার বয়সী। শুধু একটু তাদের হাত, কোমর ধরে নাচানাচি করবে। এর বেশি দূর যাবে না।
হ্যাভেন তৈরি হয়ে টুটুল’কে ঘুম পাড়াতে চলে যায়। দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়ে ছিল, খানিকক্ষণ পরে উঠে যায়। হ্যাভেন’কে এ সময় জাঁকজমকপূর্ণ সাহেবি পোশাকে দেখে পার্টির কথা মনে পড়ে যায়। তৎক্ষনাৎ কাঁদতে আরম্ভ করে। হ্যাভেন হাজারো জারিজুরি বহু কসরত করে ছেলেকে থামিয়েছে। কাঁধে নিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতেই সে ফের ঘুমিয়ে পড়ে।

টুটুলের রুম থেকে বেরিয়ে হ্যাভেন নিজের রুমে চলে আসে। হ্যান্ড ঘড়ি পড়তে ভুলে গিয়েছে। অরু ততক্ষণে তৈরি হচ্ছিল। রুমে প্রবেশ করতেই মুখ হা হয়ে গেল। ওষ্ঠপুট ছড়িয়ে যায় দু’দিকে। অরু বেশি সাজেনি। সাজার মধ্যে মুখে হালকা মেকআপ, চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক। অন্যত্র প্রসাধনী ব্যবহার করেনি। গায়ে স্বর্ণের অলঙ্কার নেই। সবটা ডায়মন্ডের। কানের দুল, চুড়ি, নেকলেস সবগুলো। কোমরের একটু নিচে ঢেউ খেলানো কেশবহুল পুরোপুরি বাঁধনহারা। পড়নের সিল্কের শাড়ি এলোমেলো। হয়তো এক্ষুনি পড়বে, গোছাচ্ছে সে।
এরকম অবস্থায় বউকে দেখে হ্যাভেনের মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়। অচিরেই থমকে গেল অন্তঃপট। ভেতরটা অমায়িক কেঁপে ওঠে। বক্ষপিঞ্জরের সবটা শক্তি ক্ষয় হয়ে গেল। প্রণয়ের জলোচ্ছ্বাসে ছন্নছাড়া হলো সমগ্র অস্তিত্ব। তীক্ষ্ণ ধ্বংসাত্মক আবেগ মাত্রা ছাড়ালো। টললো হিমালয়। প্রস্ফুটিত হলো আবেগের জোয়ার। উদগ্রীব পুরুষালি চাহাত প্রমত্ত চিত্তে গ্রাস করতে চাইল সম্মুখের নেশা ধরানো রমণীর সর্বত্র।

মাতাল চোখের নিগূঢ় দৃষ্টি ধরে রেখে, হ্যাভেন স্বীয় গালে এক হাত ঠেকিয়ে ধীম স্বরে আওড়ায় শশব্যস্ত,
” আমার প্রিয় স্নিগ্ধ মনোহারী, নিভৃত বিস্ময়ে চমকে উঠি তোমার প্রতিটি উচ্চারণে, যেন ভাষার অলিন্দে কোন মহাজাগতিক সুরের অনুরণন। চক্ষু জুড়ানো অন্তর ছাঁচে অম্লান ঢেউ তুললে।
তুমি এক অনুপম উপমার অতীত, ছন্দের গভীরে ছায়াপথ বেয়ে বয়ে যাওয়া নক্ষত্রপতনের নিসর্গ।
তোমার হরিণী চোখ এক রহস্যময় অনুকম্পার অতল, যেখানে অন্ধকারও আলো খুঁজি আমি।
তোমার সত্তা সময়ের সংজ্ঞাহীনতা ছুঁয়ে আসা এক অনন্ত সম্ভ্রম, যেন হেমন্তের ধুলোকণা ছুঁয়ে গড়া কাব্যময় ঘূর্ণাবর্ত, যার প্রতিটি বাঁকে আমি হারাতে চাই নিঃশর্তভাবে। কী অপূর্ব সৃষ্টি খোদার। তোমার কাজল টানা নয়ন, রক্তজবা অধর, পদ্ম কোমল অপার সৌন্দর্যে ডুবতে রাজি আছি।
তুমি কেবল দৃশ্য নও, তুমি অনুভবের জটিলতম তান, যার প্রতিটি দোলা হৃদয়ের দর্পণে আলো ও ছায়ার সূক্ষ্ম মিশ্রণ তোলে আমার অন্তঃকরণে। ”
বধূয়ার রূপের প্রশংসা করতে করতেই কর্ণগহ্বরে ভেসে আসে অরুর কথা। শুনতে পেলো,

” ওহ-হো! এত ভারী! ”
সহসা সম্বিত ফিরল তার। বুক ভরে দম টানল। ত্বরিত জেগে উঠা প্রণয়ের জলোচ্ছ্বাস থামানোর চেষ্টা চালাল। মন্ত্রমুগ্ধ চাউনি নিয়ে ফিচেল গলায় বলল,
” সামান্য শাড়ির ভার সহ্য করতে পারছো না। তাহলে ৭৮ কেজির আমিটাকে সামলাবে কীভাবে? বক্ষঃস্থলে পিষে যাবে মুহূর্তে। একটাও হাড্ডি-গুড্ডি সহিসালামত থাকবে না। ”
বলতে বলতে এগিয়ে যায় অরুর নিকট। রঙিন পাথর, পুঁথির কারুকার্যে শোভিত ভারী শাড়ি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে মেয়েটা। হ্যাভেনের বেশরম কথায় চোখ পাকিয়ে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে সিল্কেরশাড়ি হওয়ায় এখনও সেফটিপিন না লাগানোর দরুন কাঁধ হতে আঁচল পড়ে গিয়ে তা মেঝেতে গড়ায়। চক্ষু সম্মুখে উন্মুক্ত হলো মেয়েলি প্রতিটি নজরকাড়া সূক্ষ্ণ ভাঁজ! তৎক্ষনাৎ হ্যাভেনের গলবিল শুকিয়ে কাঠ। চোখের তারায় আফিম জেগেছে ওর। নেশার সবটা লুটপাট হচ্ছে অরুর মুখের তরে। এক মুহূর্ত বিলম্ব নয়, ঝড়ের বেগে পেছন থেকে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে নাকমুখ ডুবিয়ে দিল। এহন কাজে হকচকিয়ে যায় অরু। রেগে ঝাড়া মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো।
হ্যাভেন শিশুসুলভ সহজসরল চাহনি তাক করল। বুকে হাত রেখে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ভোঁতা মুখে বিড়বিড়ালো,

” এই মেয়ে আমায় হার্ট অ্যাটাক করে মারবে। ”
” আপনি রুমে কেন? ”
আঁচল উঠিয়ে অরু বাজখাঁই গলায় প্রশ্ন ছুড়ল। হ্যাভেন নিরুদ্বেগ সহিত জানায়,
” লেট হচ্ছিল, তাই…! ”
কথার মধ্যিখানে ফোড়ন কাটল অরু,
” বেরিয়ে যান। ”
” কেন যাব? ”
” শাড়ি পড়বো। ”
হ্যাভেন ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বলল সোজাসাপটা,
” পড়ো। আমি দেখছি। ”
দাঁত খিঁচল অরু। কন্ঠে নিদারুণ তেজ,
” অসভ্য। আমি আপনার সামনে শাড়ি পড়তে পারবো না। ”

চোখ ছোট ছোট করে তাকায় সে। গভীর লোচন বর্তায় মেয়েটির উপর। জোর গলায় শাসায়,
” ঢঙ্গের কথা রাখো। ইট’স গটন ভেরি লেট। কথা বাড়ালে সব খুলে চোখের সামনে বসিয়ে রাখবো। পার্টিতে যাওয়ার থেকে বউকে এমন অবস্থায় দেখা ভীষণ পূন্যের কাজ। ”
অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল অরু। পরপরই চোখ-মুখ খিঁচে বলল,
” ছিঃ! অশ্লীল কথাবার্তা! ”
হ্যাভেন বিন্দু পরিমাণ টললো না। কথার বাণ আগের ন্যায় গভীর। চনমনে কন্ঠে জাদু ঢালল,
” কথার চেয়ে অশ্লীল কাজ করলে উচাটন হৃদয় শান্ত হতো। ”
অরু কথার গভীরতা উপলব্ধি করতেই চিড়বিড়িয়ে গর্জে উঠল। রাগান্বিত চোখে পরখ করল হ্যাভেন’কে অতঃপর বলল ঝাঁঝালো গলায়,
” আপনার জন্য লেট হচ্ছে। শাড়ি পড়লেই আমি রেডি। ”

হ্যাভেনের এই মুহূর্তে রুমে বউ রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না। যাওয়ার মুড নিমিষে গায়েব হতে চলেছে। সুর তুলল উৎফুল্ল চিত্তে,
” সোনারে সোনারে কাছে আয় না রে। ঠোঁট চোখা করে ছোট্ট একটা চুমু দাও রে। ”
অরু ভ্রু উঁচিয়ে মুখ বিকৃত করে,
” লাস্ট লাইনে ভুল রয়েছে। ক্লিক করে সেল্ফি লে না রে হবে। ”
হ্যাভেন দুষ্টু হাসল। ঘোর বিরোধিতা জানিয়ে করল দৃঢ় প্রতিবাদ,
” ওরা বলদ। ভুলভাল গায়। আমারটা সঠিক। চুমুই হবে। ”
” হয়েছে। এবার যান। আমি শাড়ি পড়ে আসছি। ”
হ্যাভেন ঠিক সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখের মণিতে একরাশ মাদকতা মেশানো। ঘনঘন ঢোক গিলে বউয়ের দিকে বাক্য ছুড়ল আচমকা,
” একটা চুমু খাই তোমাকে? ”

অরু হতভম্ব হয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। ওষ্ঠদ্বয় ছড়ালো দু’দিকে। হতবিহ্বল অক্ষিপট বড়ো হলো অমনি। মুহূর্তে দাঁতে দাঁত পিষল। তীব্র বিরক্তি নিয়ে বলে ওঠে,
” আমি কিন্তু যাব না! ”
হ্যাভেনের উচ্ছ্বসিত মুখবিবর তিমিরে ঢাকা পড়ল। দৃষ্টিতে কাকুতি। নিষ্পাপ বাচ্চার মতো গাল ফোলায়। অশান্ত হৃদয়ের কণ্ঠ ছটফটে,
” আই উইল জাস্ট গিভ অ্যা লিটল কিস। তোমার থুতনি আর ঠোঁট বড্ড টানছে আমায়। ”
অরুর রুষ্ট প্রশ্ন তেড়ে এলো,
” আপনি এইজন্যে এসেছেন? ”
তার সংকোচহীন উত্তর,
” ইয়েস। ”
অরু বিস্মিত হলো। তেজোদীপ্ত বক্ষঃস্থল ঢিপঢিপ করছে। গলা ছেড়ে ডাকল,
” টুটুল! ”

হ্যাভেন হতভম্ব হয়ে গেল। গমগমে কন্ঠে ছুটে চলল বিস্ময়,
” আশ্চর্য! টুটুল’কে ডাকছো কেন? ”
অরু রেগে আঙুল তুলল এবার,
” ফাজলামি রেখে যাবেন, নাকি টুটুল’কে ডেকে পার্টিতে যাওয়ার জন্য উসকাবো? ”
নিমিষে চোয়াল শক্ত হয় হ্যাভেনের। ঘুরে হাঁটা ধরল। অরু বাঁকা হাসল। তবে দীর্ঘস্থায়ী হলো না। হ্যাভেন না গিয়ে উল্টো দরজা আটকে দিল। চোখ ছানাবড়া অরু আঁতকে উঠল। এই লোকের মতিগতি ভালো ঠেকছে না। শুষ্ক ঢোক গিলল।
হ্যাভেন সামনে এসে ভণিতাহীন বাক্য ছুড়ে,
” তোমার জন্য নীলিমার থেকেও সুবিশাল একটা খাঁটি অফার আছে। ”
জোরপূর্বক হেসে দু’পাশে মাথা নাড়ল অরু,
” কোনো অফার চাই না। ”
” শান্তি মতো পার্টি টাইম স্পেন্ড করতে চাইলে অফারটা গুরুত্বপূর্ণ। ”

অরু ভ্রু গোটায়। বুঝতে না পেরে তাকাল এবার। চাউনিতে প্রশ্ন। সে গলা খাঁকারি দিল। পুনরায় বলতে লাগলো,
” চোখ খুলে নিজ ইচ্ছায় যদি আমার ঠোঁটে একটা চুমু খাও, তাহলে যাওয়ার সময় গাড়িতে সায়রের সম্মুখে ভদ্র হয়ে থাকবো। আর যদি একসাথে চার-পাঁচটা চুমু দাও, তাহলে পার্টিতে কোনোরকম অসভ্যতামি করবো না। ”
ড্রেসিং টেবিল হতে হ্যান্ড ঘড়ি কব্জিতে পড়ল। সময় পরখ করে বলল বাকি কথা,
” এখনও ২ ঘন্টা ছাব্বিশ মিনিট সময় আছে। পার্টি রাতে শুরু হবে। বন্ধুত্বের খাতিরে বিকেলে রওয়ানা দিচ্ছি। যাকগে, যদি এক ঘন্টায় যতটুকু সম্ভব বাসর সারতে দাও, তাহলে পুরো জার্নিতে মাম্মাস কি বয় হয়ে থাকবো। তুমি যা বলবে তাই শুনবো। ”
লজ্জার এমন করাল আচ্ছাদনে অরু নিজের অস্তিত্বটুকুকেও অস্বীকার করতে চাইছে। কার পালায় পড়ল? মাথা নিচু করে নিম্ন অধর কামড়ে ধরে। গালদুটি লজ্জায় অনুজ্জ্বল অথচ তপ্ত। কানের পাশ দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সেই ক্ষীণ লালাভ আভা, সবকিছু মিলিয়ে সে যেন এক ব্রীড়া উৎকন্ঠিত জীবন্ত ভাস্কর্য।
অরু আক্রোশে ফেটে পড়ল। খিটখিটে মেজাজে গলা হতে ধ্বনিত হয়,
” লিভ! ”
হ্যাভেন গেল না। মিটিমিটি হাসল। উচ্চারণ করল মেঘমন্দ্র কন্ঠে,
” পার্টিতেও যেতে হবে। এবং শাড়িও আমার সামনে পড়তে হবে। নয়তো যা বলেছি, অনুমতিবিহীন কার্যকর হবে অতি দ্রুত। ”

মেয়েটি এবার ছলছল লোচনে অনিমেষ চেয়ে রইল। এক্ষুনি কেঁদে দিবে দিবে ভাব। নাক ফুলছে সবেগে। হ্যাভেন বুঝে হার মানল। ফোঁস করে রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল। ভরসা সরূপ বলল,
” ওকে। আমি অন্য দিকে তাকাচ্ছি। ”
বাক্যের যবানিকা টেনে ঘুরে দাঁড়ায়। অরু মুচকি হাসল। ফটাফট শাড়ি পড়ায় মনোনিবেশ করে। ওপাশ ফিরেই হ্যাভেন জানতে চাইল,
” এত সেজেছো কেন? ”
অরু ঠোঁট উল্টায়। রয়েসয়ে প্রত্যুত্তর করল তৎক্ষনাৎ,
” বেশি কোথায়? মেয়েদের সাজ এরচেয়েও বেশি। তাছাড়া, আমি নিজের ইচ্ছায় সেজেছি। এনি প্রবলেম? ”
হ্যাভেনের পুরুষ চিত্তে অন্তঃকরণে এক অজানা হাহাকার। যন্ত্রণার এক ব্রীড়াজনিত, উচাটন আর্তি যেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। এক নীরব প্রেমের সাগরে নির্বিঘ্নে ফেঁসে গিয়েছে। শব্দহীন তলিয়ে যেতে থাকল এক অনির্বচনীয় অস্থিরতায়। মুখনিঃসৃত ঘটলো উদাসীন রূঢ় সুর,
” সেজেছে নিজের ইচ্ছায়, এদিকে আমি মরে যাচ্ছি। ”
অরু ঠোঁট চেপে ঈষৎ হাসে। জানাল,
” আমি রেডি। ”

হ্যাভেন তাকায়। অমনি ভ্রু কুঁচকালো। কুঁচি ঠিকঠাক হয়নি। ব্যঙ্গ করে বলে,
” মানা করেছি না, না পারলে শাড়ি পড়বে না। কুঁচির বারোটা বাজিয়েছো! ইউটিউব দেখেও তো শেখা যায়।
অরু মুখ বাঁকায়। হ্যাভেন জোরালো গলায় তাচ্ছিল্য সমেত যেভাবে বলছে, ততটাও খারাপ হয়নি। ও এখন একা একাই শাড়ি পড়তে পারে। সায়রা শিখিয়েছে। তবে কুঁচিটা একটু অগোছালো। ওর ভাবভঙ্গি দায়সারা,
“এত জানলে আপনি পড়িয়ে দিন। ”

প্রেমপিপাসা পর্ব ৩০

বউয়ের কটাক্ষ কথা আমলে নিলো না হ্যাভেন। মিররে অরুর দিকে নজর রেখে জানাল,
” আমি শাড়ি পড়াতে পারি না, তবে খুলতে পারি। খোলার সময় হেল্প লাগলে বোলো। ”

প্রেমপিপাসা পর্ব ৩২ (৩)