প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব ১২

প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব ১২
তানিয়া মাহি(নীরু)

আবরার হৃদিতার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকায়। নির্জীব গলায় বলে,“আর থেকে যেতে বললে?”
হৃদিতা জোরপূর্বক হেসে বলে,“বড়োজোর কিছু সময় সঙ্গ দিতে পারি, থেকে যাওয়া আমার হবে না।”
আবরার চোখ বন্ধ করে নেয়। হৃদিতা এগিয়ে এসে আবরারকে বলে,“আমি আসছি তবে।”

“যেতেই হচ্ছে?” বলেই হৃদিতার দিকে তাকায় আবরার।
হৃদিতা আবরারের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে বাহিরের দিকে চলে যায়। আবরার এক পলকে সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেদিনের কথা মাথায় আসতেই চোখ বন্ধ করে নেয় সে।
হৃদিতা ওষুধ কিনতে যাচ্ছিল এমন সময় বাহিরের দিকেই আজহার রেজা কারো সাথে কলে কথা বলছিলেন। হৃদিতাকে কাছাকাছি আসতে দেখে তিনি হাত দিয়ে ইশারায় হৃদিতাকে থামতে বলেন। হৃদিতা প্রেসক্রিপশন হাতে দাঁড়িয়ে থাকে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

আজহার রেজা ফোনে কথা শেষ করে হৃদিতাকে বলেন,“সকালে হসপিটালে আসার সময় কেউ তোমাকে দেখেছে৷ বলছে সে তোমাকে চেনে। বাহিরে অপেক্ষায় আছে, তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে।”
হৃদিতা এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,“আমার সাথে দেখা করতে এসেছে! কে?”
“দেখা হলেই জানতে পারবে।”

“ঠিক আছে। স্যার আরেকটা কথা, এশার কী খবর? এখান থেকে নাকি অন্যকোথাও নেওয়া হবে?”
আজহার রেজা ফোনটা পকেটে রাখতে রাখতে বললেন,“ সে এখন একটু সুস্থ। নেওয়ার ভাবনা বাদ দেয়া হয়েছে। আরেকটা খবর আছে।”
“জি স্যার?”

“ অফিস থেকে জানিয়েছে এশাই মেইন কালপ্রিট। খু*নের ক্ষেত্রে প্রথমবারে সফল হয়েছে কি না সেটার দ্বিধাদ্বন্দে ছিল বিধায় দ্বিতীয়বার ছুরিকাঘাত করেছিল। এশাকে অ্যারেস্ট করার অনুমতি দেয়া হয়েছে এখন শুধু তার সুস্থ হওয়ার অপেক্ষা।”
হৃদিতা বাহিরের দিকে তাকিয়ে বলে,“সবকিছু এত সহজে কীভাবে শেষ হয়ে যেতে পারে আঙ্কেল? আমি নিজে হাতে..”

আজহার রেজা হৃদিতাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “তুমি চেয়েছিলে একটা মেয়ের আর তার ভাইয়ের খু*নের সঠিক বিচার পাইয়ে দিতে। সেটা এখন সম্ভব। এশা গতকাল রাতে নিজের মুখেই স্বীকারোক্তি দিয়েছে।”
হৃদিতা হঠাৎ বলে ওঠে,“ আমি উনার সাথে দেখা করতে চাই আঙ্কেল।”

”সেটা এখন সম্ভব নয়। তুমি বাহিরে যাও তোমার জন্য একজন অপেক্ষা করছে। তুমি আপাতত এই কেইস নিয়ে ভাবা বন্ধ করে দাও। এবার যা হবে ইন শা আল্লাহ ভালো হবে। তুমি এটা জাস্ট মাথা থেকে বের করে দাও।”
হৃদিতা বাহিরে যাওয়ার জন্য এগুতেই আবার থেমে যায়। পিছে ফিরে তাকিয়ে বলে,“আঙ্কেল, আরেকটা কথা।”
আজহার রেজা এগিয়ে এসে বলেন,“হ্যাঁ বলো।”

হৃদিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,“স্যার, আবরার সাহেব তো এশাকে অসম্ভব ভালোবাসে। আমি নিজেই দেখেছি কিন্তু এখন উনি এশার নামই শুনতে চাইছেন না। কী হয়েছে বলেন তো? যাকে এত ভালোবাসে, তার অবস্থা এত খারাপ হওয়ার পরও এমন চুপচাপ কীভাবে আছে? নামই শুনতে চাইছে না।”

আজহার রেজা বলেন,“তুমি আছ কী করতে? জেনে নিবে। এখন যাও, জলদি যাও। বাহিরে ছেলেটা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। তোমাকে আসার সময় দেখেছে। এই দিকে তো কারো আসার অনুমতি নেই তাই আসতে পারেনি। জলদি যাও।”

হৃদিতা আজহার রেজার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে হৃদিতা বাহিরের দিকে চলে যায়। বাহিরে এসে একজনকে ফার্মেসিতে পাঠিয়ে দিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। আশেপাশে কাউকে খুঁজছে সে কিন্তু পরিচিত কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে কে এসেছে তার সাথে দেখা করতে? কোথায় সে?
একজনকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে হৃদিতা। ছেলেটা সামনে এসে দাঁড়ায়। বয়সে হয়তো তার চেয়ে খুব একটা বড়োও হবে না।

ছেলেটা সামনে এসে দাঁড়িয়েই বলে উঠল,“আপনি হৃদিতা না?”
হৃদিতা আন্তরিকতার সঙ্গে বলল,“জি আমি হৃদিতা। আপনি কে? আসলে চিনতে পারছি না আপনাকে।”
ছেলেটা জিহ্বা দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। জোরে একটা শ্বাস ফেলে বলল,“ আমি ইথারের বন্ধু। আপনি আমাকে দেখেননি তাই চিনতে পারেননি কিন্তু আমি আপনাকে চিনতে একবিন্দু দেরি করিনি। ইথার তো আপনার কথা সবসময় বলতো। ছবিও দেখিয়েছিল।”

‘ইথার’ নামটা শোনামাত্র বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা করে ওঠে। চোখ বন্ধ করে নেয় সে।
ছেলেটা হৃদিতার দিকে তাকিয়ে বলে,“আপনার সাথে কিছু ব্যক্তিগত কথা ছিল, আপনার যদি সমস্যা না হয় তাহলে আমরা কি সামনের রেস্টুরেন্টে বসতে পারি?”
হৃদিতা চোখ তুলে তাকায় ছেলেটার দিকে। এতদিন পর পুরোনো মানুষ কেন সামনে এলো! আর ব্যক্তিগত কথা! সেটাই বা কী!

সুরাইয়া শাশুড়ির রুমের সবকিছু ঠিকঠাক করে রাখছিল। আজ ময়না বেগমের বাড়ি ফেরার কথা। সুরাইয়া রুমের সবটা গুছিয়ে রেখে বের হবে তখনই নাহার বেগম গেইটে এসে ডাকতে থাকেন। সুরাইয়া তাড়াতাড়ি গিয়ে গেইট খুলে দেয়।

নাহার বেগমকে দেখে সুরাইয়া বলে ওঠে,“ কী হয়েছে কাকি?”
নাহার বেগম ভারি গলায় বলেন,“চাবিটা একটু রাখো তো, মা। আমি একটু হৃদির কাছে যাব। ওর নাকি রাত থেকে জ্বর। তোমার কাকা তো বাড়ি নেই। বাড়ি আসলে চাবিটা উনাকে দিও। আমি উনাকে বলেছি চাবি তোমার কাছে রেখে যাব। আমি রান্না করে রেখেছি। ”

নাহার বেগম চাবির গোছা এগিয়ে দিলে সুরাইয়া চাবিটা নিয়ে বলে,“অনেক বেশি জ্বর?”
“হ্যাঁ বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। খাওয়া দাওয়া করতে পারছে না। তাই আমি গিয়ে দুদিন থেকে আসি মেয়েটার কাছে। মেয়েটাকে খুব মনে পড়ছে। সময়মতো কিছু রান্না করে খাওয়াতে তো পারব। ”
সুরাইয়া নাহার বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে,“ আপনি এক মিনিট দাঁড়ান। আচার রেখেছিলাম ওর জন্য, নিয়ে যান। জ্বরমুখে খেতে ভালো লাগবে।”

“ঠিক আছে দাও।”
সুরাইয়া দৌঁড়ে রুমে গিয়ে তখনই ফিরে আসে। একটা মাঝারি আকৃতির আচারের বৈয়ম নাহার বেগমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,“ সাবধানে যাবেন কিন্তু কাকি। আমি এখানে সবকিছু দেখে রাখব, আপনি একদম চিন্তা করবেন না।”

নাহার বেগম সুরাইয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,“ তুমি সাবধানে থেকো।”
নাহার বেগম চলে যেতেই সুরাইয়া গেইট আটকে ভেতরে চলে আসে।
আশরাফ তখনো গোসল শেষ করে বের হয়নি। সুরাইয়া আলমারি থেকে সাদা রঙের একটা শার্ট বের করে বিছানার ওপর রেখে ফোনটা নিয়ে বিছানার একপাশে বসে। ওয়াশরুমের ছিটকিনি খোলার শব্দ হতেই সেদিকে তাকায়।
আশরাফ চুল মুছতে মুছতে বের হয়ে সুরাইয়াকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৃদু হেসে বলে,“ পুরুষ মানুষের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে লজ্জা লাগে না? এই আপনি সুশীল নারী? নজর সামলান মিসেস শেখ। ”

সুরাইয়া হেসে বিছানা ছেড়ে উঠে আশরাফের দিকে এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়।
মৃদু হেসে বলে,“ পুরুষ যদি তার নারীর কাছে নির্লজ্জ হতে পারে তাহলে নারী কেন তার পুরুষের কাছে লজ্জায় নুইয়ে পড়বে? নিজে যখন আমাকে সবসময় টিজ করেন তখন কিছু না আর আমি তাকালেই দোষ তাই না? সুন্দর হতে কে বলেছে আপনাকে? ”

আশরাফ সুরাইয়াকে হাত ধরে টেনে নিজের দিকে এগিয়ে নিয়ে মাথা ঝাঁকায়। চুলের পানির ফোটা সুরাইয়ার মুখে পড়ে। সুরাইয়া চোখ বন্ধ করে নেয়।
আশরাফ নিজের ঠান্ডা গাল সুরাইয়ার গালে ঠেঁকিয়ে বলে,“ বউয়ের নজর যেন অন্য পুরুষের দিকে না যায় তাই সুন্দর হতে হয়। সেজন্যই হয়তো সুন্দর হয়েছি।”

সুরাইয়া আশরাফের দিকে তাকিয়ে বলে,“আমি এক পুরুষে আসক্ত নারী। আপনার চেহারা, আপনার টাকা কোনোকিছুই আমার কাছে বড়ো কোনো বিষয় না। আমার এসব প্রয়োজন নেই। পুরুষ মানুষ দেখতে যত খারাপ হবে ততো ভালো, অন্য নারীর নজর যেন না লাগে। এখন মেয়েদের নজর খারাপ। আপনার মুখে তো কালি মেখে রাখা উচিৎ। ”

প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব ১১

আশরাফ সুরাইয়ার কথায় হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে বলে,“ আমি ওরকম সুন্দরও নই যে কালি মেখে ঘুরতে হবে।”
সুরাইয়া আশরাফের হাসি একপলকে তাকিয়ে থাকে। আশরাফ হাসি থামিয়ে সুরাইয়ার তাকানো খেয়াল করে বলে,“কী?”
সুরাইয়া মৃদু হেসে বলে,“আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরি?”

প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব ১৩