প্রেমসাগরের উত্তাল ঢেউ শেষ পর্ব || লেখিকা-লাবিবা নুসরত

প্রেমসাগরের উত্তাল ঢেউ শেষ পর্ব 
লেখিকা-লাবিবা নুসরত

এরইমাঝে কেটে গিয়েছে অনেকগুলো মাস। পরিবর্তন হয়েছে অনেক ঋতু। পরিবর্তন হয়েছে সময়। একইসাথে প্রাচীর জীবনেও পরিবর্তন এসেছে। আঁধারের পরে আলোর দেখা পেয়েছে সে। এখন পুরোপুরি সুস্থ সে। মানসিক আর শারীরিক ভাবে সে একদম ঠিক আছে।
আজ পুরো বাড়িতে আনন্দের বন্যা। আজ কতোদিন পরে বাসায় এতো হাসি-আনন্দ তা গুনে রাখা মুশকিল। প্রাচীর আর জাহিনের বিয়ের দিন আজ। সারা বাড়িতে সবাই ব্যস্ত।

বাচ্চারা এদিক-সেদিক দৌড়ে বেরাচ্ছে। বাইরে লোক জনে ভর্তি। ড্রয়িংরুমে বসে কিছু লোকের সাথে কথা বলছিলেন ইজাজ। তার ব্যস্ততা অনেক বেড়ে গিয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে শ্বাস ফেলার সময়টুকু পাচ্ছে না।
মিসেস লারারও একই অবস্থা। বেশ ব্যস্ত তিনি। মেয়ের বিয়ে বলে কথা।
নিজের ঘরে বসে ছিল প্রাচী৷ কিছুক্ষণ আগে তাকে সাজানো শেষ হয়েছে। সত্যি বলতে নিজের বিয়েতে অনেক কম সেজেছে সে। জাহিন বলে দিয়েছে যাতে করে কম সাজে। বেশি সাজলে নাকি পেত্নির মতো লাগবে।
এসব কথা ভাবছিল প্রাচী তখন তার ফোনে একটা কল আসে। স্ক্রিনে জাহিনের নাম। প্রাচী মুচকি হেসে কল রিসিভ করে।
ওপাশ থেকে জাহিন বলে,

“প্রমত্ততা?”
প্রাচী~”হুম বলুন।”
জাহিন~”তোমাকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে তাই না? একদম অপ্সরার মতো! অবশ্য পুরো দুনিয়ায় একমাত্র তুমি অপ্সরা!”
প্রাচী~”আচ্ছা একটা কথা বলুন তো?”
জাহিন~”হুম?”
প্রাচী~”আপনি যে আমাকে ভালোবাসেন সেটা বলেন নি কেন? আমাকে যেভাবে ইগ্নোর করে চলতেন!”
জাহিন~”ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয় না প্রমত্ততা!”
প্রাচী~”ওমা? তাই নাকি?”
জাহিন~”হুম! এই তুমিই দেখো যেখানে ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে তোমার অবস্থান কিন্তু সেখানে নেই।”
প্রাচী~”জাহিন?”
জাহিন~”হুম বলুন!”
প্রাচী~”ধন্যবাদ আমার জীবনকে নতুন রঙে রাঙানোর জন্য!”
জাহিন~”রাগ করেছি কিন্তু।”
প্রাচী একটা হাসি দেয়। জাহিন বলে,
“এভাবে হেসো না গো প্রমত্ততা! তাহলে তো বিয়ের দিনই বিধবা হতে হবে! পরে তোমাকে আর কেউ বিয়ে করবে না। অবশ্য আমিই করতে দিব না। ভূত হয়ে ঘাড় মটকাবো।”
প্রাচী~”হুম হুম ডক্টর ভূত!”
জাহিন~”আসছি আমি আমার প্রমত্ততাকে নিজের করে নিতে। অপেক্ষা করো তুমি।”
প্রাচী~”করবো! আমি আপনার অপেক্ষায় জীবনও পার করে দিতে পারবো।”

ছেলেকে কোলে করে রেখেছে ফারহান। প্রহর রেডি হচ্ছে। এইদিকে ছোট্ট ফাহিম কান্না করেই যাচ্ছে। ফারহান তাকে থামাতে পারছে না। এখন আশেপাশে সবাই ব্যস্ত কেউ তো আসতেও পারবে না।
ছেলেকে ফারহান বলছে,
“এই যে! বাবা আছে তো! কান্না করে না ফাহিম।”
এই সেই বলে যাচ্ছে আর বার বার ঘরের দিকে তাকাচ্ছে। তখনই ফারহানা আসে। ফাহিমকে কোলে নিয়ে বলে,
“ছেলেটাকে সামলাতে পারিস না এখনো?”
ফারহান~”হুম এখন তো দোষ আমার। তোমার বউমা যে সেই কখন থেকে রেডি হচ্ছে?”
ফারহানা~”তো কি রেডি হবে না? বলি ছেলেকে জন্ম দিয়ে মানুষ কে করে? এই মা করে। আর এমনি সময় সব দোষ মায়ের। যেমন বাপ তেমন ছেলে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আনোয়ার এই কথা শুনে হেসে চলে যান। ফারহানও চলে যায়। জাহিন তখন বাইরে বের হয়।
ফারহানা তাকে বলেন,
“কিরে? যেতে হবে তো।”
জাহিন~”হুম মা যাবো। ভাইয়া কোথায়?”
ফারহানা~”গেলো তো ওর আব্বুর সাথে। কেন তুই ওকে দিয়ে কি করবি?”
জাহিন~”না এমনি।”
তখনই প্রহর সেখানে আসে। ফাহিমকে কোলে নেয়। জাহিনের দিকে ঘুরে বলে,
“কি? দেওর সাহেব? রেডি হয়েছেন?”
জাহিন~”মেয়েদের মতো অতো টাইম লাগে না আমার।”
প্রহর~”আমাকে বললে তো? দেখবো বউকে নিয়ে কি করো!”
জাহিন~”হি হি দেখা যাবে।”
ফারহানা~”হুম সব দেখা যাবে। এখন সবাই রওনা দেও।”

ইজাজ বাইরে খাবারের জায়গার কাছে যাচ্ছিলেন। তখনই লারা আসে।
“শুনো?”
ইজাজ~”হুম বলো? কিছু লাগবে?”
লারা চোখের কোণে পানি মুছে বলে,
“মেয়েটা অবশেষে একটু সুখ পেল।”
ইজাজ~”আহা! কান্না করছো কেন?”
লারা~”আমি তো মা। কান্নাও করতে পারবো না?”
ইজাজ~”তুমি বরং প্রাচীর কাছে গিয়ে বসো। ভালো লাগবে। ও তো একা।”
লারা চলে গেলেন প্রাচীর কাছে। প্রাচী আনমনে তাকিয়ে ছিল বাইরের দিকে।
“মা?”

মায়ের ডাকে প্রাচী পিছনে ফিরে তাকায়। প্রাচী বলে,
“মা? আসো।”
লারা প্রাচীর পাশে বসেন।
“মা দোয়া করি জীবনে অনেক সুখি হ! জাহিন অনেক ভালো ছেলেরে! দ্বিতীয় বার আমরা ভুল করি নি।”
প্রাচী লারাকে জরিয়ে ধরে। লারা কান্না সামলাতে পারেন না। হঠাৎ বাইরে থেকে শোরগোলের আওয়াজ পাওয়া যায়। বর এসেছে। লারা প্রাচীকে বলে,
“ওই ওরা এসেছে বোধহয়। আমি যাই মা।”
লারা চলে গেলেন নিচে। আসলেই বর এসেছে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে জাহিনরা। আশ্চর্যজনক ভাবে কোনো গেট ধরার ব্যবস্থা নেই। সেখান থেকে সবাইকে স্বাগত করা হয়। বরযাত্রীর জন্য স্পেশালভাবে জায়গা করা হয়েছে। সেখানে সবাই বসে। বরযাত্রী বলতে মোটে ত্রিশজন এসেছে।

প্রাচী নিজের ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। জাহিনকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ক্রিম কালারের শেরওয়ানী পরেছে সে। প্রাচী চেষ্টা করেও চোখ ফেরাতে পারছে না। হঠাৎ জাহিনের চোখ পরে প্রাচীর দিকে। দোতলা থেকে খুব ভালো করেই সে প্রাচীকে দেখতে পাচ্ছে। দুজনের চোখাচোখি হতেই জাহিন মুচকি হাসি দেয়। প্রাচী লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়।
এইদিকে ফারহান ইজাজের সাথে রাগ করে আছে। সাহস করে সে বলেই ফেলল,
“শ্বশুর মশাই?”
ইজাজ~”হুম বলো?”
ফারহান~”কাজটা কি ঠিক? আমার সময় গেট ধরে টাকা নেয়া হয়েছিল। প্রাচী নিজেই টাকা নিয়েছিল। আর এখন জাহিনের বেলার মাফ?”
ইজাজ~”সেটা প্রাচীকে জিজ্ঞেস করো! গেট ধরার মতো কেউ নেই তো। আর এটা তো প্রাচীর বিয়ে। প্রাচী কি নিজেই গেট ধরবে?”

সবাই হেসে ফেলে। জাহিন মনে মনে বলে,
“সে এভাবে গেটে আসলে আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারতাম না। অবশ্য আসলে ক্ষতি ছিল না। অপেক্ষা অনেক যন্ত্রণাদায়ক। যেটা আমি সহ্য করছি৷ সেটা আর সহ্য করা লাগতো না।”
কিছুক্ষণ পরে খাওয়াদাওয়া শেষ হয়৷ প্রাচীকে আর জাহিনকে সামনাসামনি বসানো হয়েছে। কাজি কবুল বলতে বলেছে জাহিনকে। জাহিন বলে দিয়েছে। এবার পালা প্রাচীর। জাহিন ভেবেছ হয়তো প্রাচী টাইম নিবে অনেক। কিন্তু এমন কিছুই হলো না। খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রাচী কবুল বলল। বিয়ে পরানো শেষ হলো।
এই মুহূর্ত থেকে প্রাচী আর জাহিনের সম্পর্ক একটা পবিত্রতার চাদরে ঘিরে গেলো। তাদের সম্পর্ক একটা নাম পেল। একই সাথে জাহিন নিজের ভালোবাসাকে একদম আপন করে পেল।

এবার আসে বিদায়ের পালা। বিদায়ের সময় প্রাচী কান্না করে নি৷ মা-বাবার সামনে গিয়ে বলে,
“আমি কিন্তু আবার আসবো হুহ। কান্না করবো না। কারন একেবারে তো চলে যাচ্ছি না।”
ইজাজ কান্না না করলেও লারা নিজেকে সামলে রাখতে পারেন না। কিছুক্ষণ পরে প্রাচীরা রওনা দেয় জাহিনের বাড়ির উদ্দেশ্য।
বাড়িতে আসার পরে প্রহর তাকে জাহিনের রুমে দিয়ে আসে। কোনো অপ্রয়োজনীয় কালচার তারা পালন করে নি। জাহিন নিষেধ করে দিয়েছিল। সেই জন্য আর কেউ নিজ থেকে কিছুই করে নি।

জাহিনের রুমে বসে আছে প্রাচী। এই রুম সে আগে একবার দেখেছে। এখন আবার দেখলো অনেক দিন পরে। ভাবতেই অবাক লাগছে তার কাছে। ভাগ্য কোন দিকে নিয়ে এসেছে! প্রাচী কোনোদিন ভাবেই নি এই ঘরের মালিকের সাথে তার জীবন এক সূত্রে বেধে যাবে!
দরজা খোলার আওয়াজে প্রাচীর ঘোর ভাঙে। জাহিন এসেছে। সে ধীর পায়ে প্রাচীর কাছে গিয়ে বসে। হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে পরে। দাঁড়িয়েই প্রাচীকে কোলে নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। প্রাচী বেশ ঘাবরে যায় এতে। মনে মনে নিজেকে শান্তনা দেয়।
“আআপনি আমাকে নিয়ে কোথায় যান? এই? আপানকে কি ভূতে ধরলো নাকি?”
জাহিন~”হুম ধরেছে তো।এখন বারান্দা দিয়ে তোমাকে নিচে ফেলে দিবো।”
প্রাচী~”হুহ বললেই হলো? আমাকে বলদ ভেবেছেন?”

জাহিন~”না তো। গাধি ভেবছি।”
তারা বারন্দায় চলে আসলো। প্রাচীকে নামিয়ে দিতেই সে বলল,
“তো গাধীকে কেন বিয়ে করলেন? ওই মেয়েকে বিয়ে করতেন? ওই যে ডাক্তার সাহেবা।”
জাহিন~”বাবাহ! সেটাও দেখেছো? আসলে আমি অনেক সুন্দর তো! তাই সবাই আমাকে চায়।”
প্রাচী~”হুহ জানা আছে আমার।”
জাহিন~”ঝগড়া বাদ দাও! এমন ঝগড়ুটে বউ আমার!”
এই বলে জাহিন প্রাচীকে পিছন থেকে জরিয়ে ধরলো।
“তুমি জানো আজ তোমাকে কতো সুন্দর লাগছে? তোমার সাজার দরকার পরে না। আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় সাজ তোমার বিপরীতে অবস্থান করে। তুমি এমনিতেই সুন্দরী!”
প্রাচী~”পাম দিচ্ছেন?”
জাহিন~”মোটেও না। তোমাকে দেখলে একটা গান মনে পরে জানো?”
“তুমি আকাশের বুকে বিশালতার উপমা!
তুমি আমার চোখেতে সরলতার প্রতিমা!
আমি তোমাকে গড়ি, ভেঙে-চুরে শতবার!”
গানের এই তিন লাইন গেয়ে জাহিন বলে,
“এর মানে কি জানো?”
প্রাচী~”না!”

জাহিন~”তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা অনেক। আকাশের থেকেও বেশি জায়গা নিয়ে তুমি আমার মনের মধ্যে রাজত্ব করো। তোমার ওই মায়াবী দর্শনের সরলতার ছড়াছড়ি। এই পুরো ভুখন্ডে একমাত্র আমি তোমাকে অভিমানি করে আবার সেই অভিমান ভাঙানোর অধিকার রাখি। তোমাকে ভেঙে-চুরে শতবার গড়ি। তোমার সেই সরলময় মুখখানী দেখার জন্য। তবুও তোমায় দেখায় তৃষ্ণা মেটে না।”
প্রাচী হা হয়ে জাহিনের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা কি সুন্দর করে কথা বলে!
জাহিন আবারও বলতে শুরু করে,

“মনে আছে আমি বলেছিলাম যে এক দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত আমি? সেই রোগ হচ্ছে তোমায় ভালোবাসাত রোগ! তোমাকে বার বার দেখার ইচ্ছার করার রোগ! জানো প্রাচী তোমার ওই কুহকি আঁখিতে আমি প্রেমসাগর দেখেছিলাম। সেই #প্রেমসাগরের_উত্তাল_ঢেউ পেরিয়ে আজ আমি আমার একমাত্র প্রিয় প্রমত্ততাকে নিজের করে পেয়েছি। আজ আমি সেই কথাটা কি বলতে পারি, যেটা বলার জন্য হাজারো দু:খ,কষ্ট সহ্য করেছি?
তুমি আজ বারন করতে পারবে না! আজ নির্দ্বিধায় আমি বলবো যতনে বাধিয়া রাখিব তোমায় আমারই বন্ধনে!”
প্রাচী মুচকি হেসে বলে,

“ডাক্তার সাহেব আপনার তো কবি হওয়া উচিৎ ছিল! রমনীদের মনের সেবা করার কথা সেখানে মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন!”
জাহিন কিছু বলতে যাবে তার আগেই একটা কল আসে। কিছুক্ষণ কথা বলে সে প্রাচীকে বলে,
“আমার যেতে হবে প্রাচী! একটা ইমার্জেন্সি পেসেন্ট আছে।”
এইবলে জাহিন চলে যেতে নিলে প্রাচী বলে,
“এবাবে বাসর রাতে আমাকে একা ফেলে চল যাবেন?”
জাহিন প্রাচীর কাছে এসে বলে,

প্রেমসাগরের উত্তাল ঢেউ পর্ব ১৪

“এভাবের হুটহাট করে আমায় যেতে হবে! তাই রোমান্সটাও হুটহাট করবো।”
এইবলেই জাহিন প্রাচীর গালে একটা চুমু দিয়ে দিলো।
“আমি সকালের মধ্যে চলে আসবো ইনশাআল্লাহ। আর আগামীকালের সব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবো৷ আর আমাদের জীবনে আরও অনেক স্পেশাল রাত আসবে। প্রতিদিন প্রতিটি মুহূর্ত স্পেশাল হবে। বুঝেছো?”
জাহিম চলে গেলো। প্রাচী শকড হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে মনে মনে বলে,
“পাগল ডাক্তার সাহেব আমার!”
এইবলে সে মুচকি হেসে বারান্দায় চলে যায় আবার। অপেক্ষা করতে থাকে সকালের। যখন জাহিন এসে আবারও পাগলামি শুরু করবে।

_________________সমাপ্ত __________________

(আজকে অবশেষে শেষ হলো গল্পটি। ধন্যবাদ সবাইকে এতো গুলো দিন গল্পের পাশে থাকার জন্য। আজ নিজেদের মতামত জানাবেন আশা করি। আর কিছুদিনের মধ্যে নতুন গল্প আনার চেষ্টা করবো। সবাই ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফিজ! ??)