প্রেমসুধা পর্ব ৩৭
সাইয়্যারা খান
দুপুর গড়িয়ে সময়টা বিকেল। বাড়ীর আশপাশ ঘুরে ঘুরে তৌসিফ’কে দেখালো তার শালা শালীরা। ইনি,মিনি এখন কোল ছেড়ে দুলাভাইয়ের আঙুল ধরে হাটছে। দুটো দুই পাশে। তাদের তোতলা তোতলা কথা শুনতে তৌসিফে’র ভালোই লাগছে। মন চাইছে দুটোকে বুকে নিয়ে রাখতে। বাচ্চা দেখলেই তার এমন লাগে। তার নিজেরও এই বয়সী বাচ্চা থাকা দরকার ছিলো। আদর, যত্নে ফুলিয়ে রাখতো তৌসিফ। বাইরের মানুষের সামনের রাগী,বদমেজাজী মানুষটা যে আসলেই কতটা নরম তা তার বাড়ীর লোকজন ছাড়া কেউ জানবে না৷ পিহা সাইডে যাওয়াতে চৈত্র ডাক দিলো,
— পিহু এদিক আয়। হেমু ভাই দেখলে বকবে।
তৌসিফ ওই দিকেই এগিয়ে গেলো। পৌষদের বাড়ীর পেছন দিকটা এটা মূলত। শেষ সীমানাও বলা যায় কিন্তু বাউন্ডারি নেই। কাটা তার দিয়ে বেড়া দেয়া। বেড়ার পাশ ঘেঁষে অসংখ্য গাছ লাগালো। সবগুলোই হাবিজাবি গাছ। তৌসিফ একটু কৌতুহল গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— এখানে এরকম করা কেন? দেয়াল টেনে দিলেই হয়।
জৈষ্ঠ্য ভাবুক হলো। আনমনে বললো,
— একবার তো ইট আনা হলো কিন্তু কাজ ধরলেই তারা চিল্লাপাল্লা শুরু করে। পৌষ আপা সেবার ওনার ছেলের মাথা ফাটিয়ে দিলো এরপর থেকে লেগেই থাকে ওরা। তাই হেমু ভাই তার দিয়ে বেড়া দিলো। আর গাছগুলো পৌষ আপা লাগিয়েছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
তৌসিফ দেখলো। বিছুটি পাতা সহ কাটা যুক্ত গাছগুলো এখানে লাগিয়েছে। তৌফিক বুঝে নিলো তার বউ একটা বিচ্ছু। ইনি,মিনির হেলদুল দেখে চৈত্র বললো,
— কিরে ঘুমাবি?
দুটোই মাথা নাড়লো। তারা ঘুমাবে না। চৈত্র ওদের কাছে আসতে আসতে বললো,
— চল দিয়ে আসি ভেতরে। চোর দুটো জেগে আছে কেমন ফইট্টার মতো!
ইনি,মিনি তবুও যাবে না৷ তারা তৌসিফে’র হাত আঁকড়ে ধরলো। দুটোকেই টেনে কোলে তুললো তৌসিফ। চৈত্র’র দিকে তাকিয়ে বললো,
— চলো ভেতরে যাই।
ওরা মাথা নাড়লো। ভেতরে ঢুকা মাত্র ই খেয়াল করলো তৌসিফে’র কাঁধে মাথা গুজে দুই বোন ঘুমে কাঁদা। তৌসিফ পুলকিত হলো। তার ভালা কাজ করলো যেন। কোল ভরা বাচ্চাকাচ্চাই না মানায় তাকে। এই বয়সে এখন খুব করে দরকার বাচ্চার। মন ভরা বউ আর কোল ভরা বাচ্চা৷ সুখের একটা জীবন। আর কি চাই?
পিহা ছোট চাচিকে ডেকে আনতেই তিনি অস্থির হলেন। নতুন জামাইয়ের কোলে মেয়ে দুটো ঘুমে কাঁদা। তৌসিফ হাসিমুখেই প্রস্তাব দিলো,
— কোন রুমে রাখব আমাকে দেখিয়ে দিন। রেখে আসছি।
চাচি বিব্রতই হলেন। পিহা রুম দেখালো। তৌসিফ পিহার সাথে যেতেই পেছনে থাকা মানুষ গুলো যেন কথা ছাড়লো। ছোট চাচি তো বড় চাচিকে বলেই ফেললেন,
— দেখলেন আপা, বয়স বা অতীত দেখে মানুষ চিনা যায় না। পৌষ’র মুখ দেখেই আমি বুঝেছিলাম ও সুখে আছে। তৌসিফ খারাপ মানুষ না। লোকমুখে শোনা কথায় কান দেয়াই উত্তম। বড় ভাই যা করেছিলেন ঠিকই ছিলো। সোনার কপাল আমার পৌষ’র।
বড় চাচির মুখটা হাসি হাসি। স্বামীর মুখে কথা বলেন না তিনি তবুও পৌষ’র কথা তুলেছিলেন৷ কথা তার একটাই ছিলো পৌষটা ভালো থাকুক। সুখে থাকুক। আর কি চাই?
তৌসিফ ইনি,মিনিকে বিছানায় শুয়িয়ে দিতেই তারা ওর হাত আঁকড়ে ধরলো। তৌসিফ হাসলো মিষ্টি মুখো হয়ে। পা থেকে স্লিপার খুলে বিছানায় উঠে বসলো। মিনি হাত বাড়ালো এর অর্থ কোলে তুলো আমাকে। ঘুম কাতুরি মিনিকে কোলে তুলে হেলান দিলো তৌসিফ। পাশেই ওকে ঘেঁষে ইনি ঘুম৷ চৈত্র আর জৈষ্ঠ্যও উঠে বসলো। পিহার দিকে আদেশ ছুঁড়লো আবদারের স্বরে,
— পিহু সোনা? চাচিকে বল চা দিতে।
পিহা উঠে দাঁড়ালো। বের হবে তখনই দেখলো হেমন্ত চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে ঢুকছে। পিহা ভাবলো এখন সেও আড্ডা দিবে দুলাভাইয়ের সাথে কিন্তু তার কপালে বুঝি আড্ডা সয়? হেমন্ত গমগমে স্বরে বললো,
— পিহু সোনা, চাচি ডাকে যা তো।
নিচের ঠোঁটটা বের করে হাটা দিলো পিহা। হেমন্ত সবার আগে তৌসিফের হাতে চা দিয়ে বললো,
— সম্পর্কে কিছুটা ভাই হলেও এখন কিন্তু একদম সমন্ধী লাগি৷
— অবশ্যই।
জৈষ্ঠ্য আর চৈত্র বললো,
— দুলাভাই কাল পদ্মায় যাবেন? সকালে ইলিশ ধরব।
তৌসিফ চায়ে চুমুক বসিয়ে বললো,
— আজ চলে যাচ্ছি। আবার আসব তখন যাব। তোমার বোনকেও নিয়ে যাব। ওর এসবে ইনট্রেস অনেক।
তিন ভাই মুখ চাওয়া চওয়ি করলো। পৌষ’কে আজ পিটালেও পৌষ নড়বে না৷ চালাক তৌসিফ তালুকদার কি তা জানে?
ওদের মাঝেই পিহা উঁকি দিলো। তার হাতে একটা ট্রে। একদমই হালকা কিছু নাস্তা তাতে। মা পাঠালো। ওদের সামনে দিতেই তৌসিফ জিজ্ঞেস করলো,
— তোমার আপা কোথায়?
পিহা বসে উত্তর করলো,
— ভাবীর সাথে দুলাভাই। ডাকব?
তৌসিফ একটু ভেবে বললো,
— খেয়েছে?
পিহার জানা নেই আপা খেলো কি না তাই মাথা নেড়ে বললো,
— না মনে হয়।
তৌসিফ নিজেই উঠে দেখতো। গতরাতের পর বউটা দূর্বল দূর্বল কিছুটা। না খেয়ে এখন আবার কোথায় জানি বসে আছে। বুকে মিনি থাকায় উঠে যেতে পারলো না তৌসিফ। হেমন্ত অবশ্য দুই বার বললো মিনিকে তাকে দিতে কিন্তু তৌফিক দেয় নি। পিহার দিকে তাকিয়ে শুধু বললো,
— তোমার আপাকে খেতে বলে আসবে শালী সাহেবা?
“শালী সাহেবা” ডাকটা শুনা মাত্র লজ্জা পেলো পিহা। উঠে যেতে যেতে বললো,
— কেন নয় দুলাভাই।
শ্রেয়ার সাথে সেই যে ফুঁসুর ফাঁসুর শুরু হলো এখনও থামার নাম নেই। পিহা দরজা ঠেলে ঢুকলো। দেখলো শ্রেয়ার বিছানায় শুয়ে আছে পৌষ পাশেই বসা শ্রেয়া। পিহা ঢুকেই বললো,
— আপা দুলাভাই তোমাকে খেতে বলেছে।
পৌষ কপাল কুঁচকে বললো,
— কোথায় উনি?
–নিচেই আছে। ইনি,মিনি ঘুমালো ওদের নিয়েই বসে আছে। আপা জানো দুলাভাই কত্তো ভালো।
পিহার চোখে মুখে উপচে পড়া উচ্ছাস। শ্রেয়া কৌতুহল গলায় বললো,
— কি কি করলো দুলাভাই যে এত ভালো হয়ে গেলো?
পিহা পা তুলে বসলো। হাতে থাকা কাটা পেয়ারা মাখা ওদের সামনে দিয়ে বললো,
— মিনিকে বুকে নিয়ে ঘুম পাড়ালো। কত সুন্দর সুন্দর কথা বলে। চৈত্র ভাই আর জৈষ্ঠ্য ভাই বলেছে পদ্মারপাড়ে যাবে৷ দুলাভাই বললো আজ নাকি থাকবে না। ও আপা থাকো না আজকে।
পিহা’র চোখ মুখ উজ্জ্বল, আশাদীপ্ত। পৌষ খিটমিট করে বললো,
— আগামী এক সপ্তাহেও আমি নড়ছি না।
পিহা দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। খবরটা দুলাভাই’কে দিতে হবে। শ্রেয়া হাসতে হাসতেই বললো,
— তুই এভাবে কতক্ষণ লুকিয়ে থাকবি?
— যতক্ষণ না ব্যাটা রাজি হয়।
শ্রেয়া পেয়ারা মুখে দিলো এক পিস। বললো,
— ভাগ্য করে পেয়েছিস পৌষ। যত্ন করে রাখিস।
— আমার বুকের ভিতর রাখি তাকে ভাবী। একদম ভারী সিন্দুকে তালা দিয়ে রাখি। সে আমার না পাওয়া সুখ। আকাশস্পর্শী প্রেম।
শ্রেয়া খেয়াল করলো পৌষ’র চোখ দুটো চিকচিক করছে। পৌষ’র হাত ধরে বললো,
— সুখী হ।
শ্রেয়া একটু থেমে জিজ্ঞেস করলো,
— একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
— এভাবে কেন বলো? বলো।
— ঐ কাজের মেয়েটা মানে যাকে নিয়ে এত বদনাম তার আচরণ কেমন দেখলি?
পৌষ ভাবুক হলো। সোহার আচরণ সে কোন কালেই সুবিধার দেখি নি। শ্রেয়াই বললো,
— আমি তৌসিফ ভাইকে এখন সন্দেহ করতে পারি না পৌষ। কিন্তু বিনা কারণে এত বড় কুৎসা রটলো?
— ওনার সৎ বোন সোহা ভাবী। ওমন কিছু নেই কিন্তু সোহা বা মিনু এদের প্রতি ওনার আচরণ ততটা বুঝি না আমি। যথেষ্ট নরম।
— তুই প্রশ্ন করিস নি?
— করেছি।
— উত্তর দেয় নি?
— দিয়েছে।
একটু চুপ থেকে পৌষ বললো,
— উনি মেয়েবাজ পুরুষ না ভাবী এটা আমিই বলতে পারি ভাবী তবে ঐ মেয়ে সোহা, ও সুবিধার না৷
শ্রেয়া কিছু একটা ভেবে বললো,
— এটাকে বিদায় করলেই হলো।
— বলেছি আমি।
কথাটা মিনমিন করেই বললো পৌষ। দরজায় দাঁড়ানো তৌসিফ সবটা শুনলো। মুখে তার বাঁকা হাসি। বউটা কাল বড়সড় একটা সারপ্রাইজ পেতে চলেছে। তৌসিফকে দেখেই শ্রেয়া বলে উঠলো,
— আরে দুলাভাই, ভেতরে আসুন।
তৌসিফ ঢুকেই বললো,
— পৌষরাত, রাতে কিন্তু চলে যাচ্ছি আমরা।
পৌষ মুখ ঘুরালো। এর মানে জানা আছে তৌসিফে’র। চালাক পুরুষ সে তাই বললো,
— আচ্ছা একটু দরকার। তোমার রুমে এসো তো।
বলেই অপেক্ষা না করে চলে গেল তৌসিফ। পিছুপিছু পা ফেলে গেলো পৌষ। রুমে ঢুকা মাত্রই দরজাটা আলগোছে বন্ধ করে দিলো তৌসিফ। পৌষ ছটফট করে বলে উঠলো,
— দরজা খুলুন। এই দরজা খুলুন মিয়া।
যেই না দরজা খুলতে যাবে তখনই তৌসিফ ওর হাত টেনে ধরলো। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
— লাফালাফি করছো কেন হানি? কথা শুনো।
— মানে কি? দরজা লাগালেন কেন?
— আহা কি হলো? কিচ্ছু করব না।
— আজব! লজ্জা লাগে না আমার? কেমন দেখালো এটা? চাচারা বাসায়। তাদের সামনে দরজা কেন লাগালেন আপনি?
তৌসিফের মাথায় এতক্ষণ কথাটা ঢুকলো। বক্র হেসে দুই হাতে পৌষ’র গাল দুটো ধরলো। অতি সন্তপর্ণে ঠোঁটে চুমু দিলো একটা। ব্যস! ঠান্ডা পৌষরাত। সুযোগটা লুফে নিলো তৌসিফ। পৌষ’র মুখে লেপ্টে দিলো প্রেমময় সুধা। বোধহারা হলো পৌষ৷ মুখ লুকালো তার পুরুষটার বুকে। দুই হাতে আগলে নিলো তৌসিফ। প্রশ্ন করলো,
প্রেমসুধা পর্ব ৩৬
— আরেকবার হবে?
— উহু।
— হুয়াই হানি?
— উমমম।
তৌসিফ হাসলো। ফিসফিস করে বললো,
— আমার লজ্জাবতী।