প্রেমসুধা পর্ব ৫৪

প্রেমসুধা পর্ব ৫৪
সাইয়্যারা খান

হাতে, পায়ে মুজা পরে গায়ে মোটা এক সোয়েট শার্ট পরা সত্বেও ঠান্ডায় যেন পৌষ’র দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। এয়ারপোর্টে নামা মাত্রই পৌষ’র শরীর অচল হয়েছে। প্লেনে ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতা হলো ওর। বমি করেছে তিনবার। ফ্লাই করার সময় যখন প্রথম ধাপে বমিটা হলো তখন তৌসিফ বেচারা প্রতিপক্ষ থেকে নিজেকে বাঁচাতে সময় পায় নি। হুটহাট করেই যেন বমির দৃশ্যটা হলো। পৌষ হয়তো নিজেও বুঝতে পারে নি এমন কিছু হবে। তৌসিফ খুঁতখুঁত করা পুরুষ। সে নাক কুঁচকালো না।

বমির টক গন্ধেও তার যেখানে নিজের বমি পাওয়ার কথা সেখানে কি না তৌসিফ ছিলো বিচলিত। কতক্ষণে পৌষ’কে ধরবে এটাতেই মগ্ন ছিলো ও। দ্বিতীয় দফায় প্লেন একবার ঝাঁকি খেলো তখন পৌষ তলিয়ে দিলো যদিও ততটা না। তৃতীয় বমি হলো ল্যান্ডিং এর সময়। শরীর কহিল হলেও সদা সচেষ্ট ছিলো পৌষ তার জামাই এর টাকা উসুল করতে। এই যেমন প্লেনে যতবার খাবার সার্ভ করা হয়েছে ততবারই একটার জায়গায় দুটো নিয়েছে ও। তৌসিফ যা খাবে না তা সহ নিয়েছে। নিজের ব্যাগে যতটা পেরেছে শুকনো খাবার ভরেছে। মাঝে চকলেট সার্ভ করা হয়েছিলো পৌষ দুটো নিয়ে আবার ডেকে দুটো নিলো। তৌসিফ না পেরে একবার চাপা স্বরে ধমকালেও পৌষ দ্বিতীয় বেগে বলে উঠে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— লাখ টাকার সোধ আমি তুলব না? আমি তো পারলে এদের দিয়ে হাত-পা টিপিয়ে নিতাম। আশ্চর্য আমার আর বমি কেন আসছে না? ওরা পরিষ্কার করবে। টাকা আমি উসুল করেই যাব। আমার জামাই এর হালাল টাকা।
তৌসিফ এহেন পা’গলামি দেখে বিরক্ত হয় না। তার ভালোলাগে সবটা৷ এই দুষ্ট পাখি কতক্ষণই বা টইটই করবে? একটু পরেই ক্লান্ত হয়ে যাবে। তৌসিফ তখন অতীত থেকে ঘুরে আসে একটু আকটু। পিয়াসী অবশ্য এসবে কোনরূপ পাত্তা দিতো না। দুই মাস অন্তর তাদের একটা করে ট্রিপ দেয়া হতো। প্রতি মাসে তাকে স্বর্ণ দেয়া হতো। মূলত পিয়াসী ছিলো বিলাসীতা প্রিয়। তৌসিফও দুই হাত খুলে উজাড় করে দিয়েছিলো। নিজের সবটা ভালোবাসা দিয়ে ফেলেছিলো। হাজার চেয়েও ছোট্ট একটা তৌসিফ ও পায় নি। হয়তো ভাগ্যে ছিলো এই দুর্দান্ত পৌষরাত যার ঔরসে আসবে তৌসিফে’র সন্তান।

আপাতত তৌসিফে’র এক বাহুর ভাজে পৌষ’র এক হাত ঢুকানো। তৌসিফ অন্য হাতে ফোনে কাউকে কল দিচ্ছে। পৌষ পরপর দুটো হাঁচি দেয়া মাত্রই তৌসিফ ওকে টেনে কাছে নিলো। নিজের পরণে থাকা জ্যাকেটের জিপ এক টানে খুলে পৌষ’র মাথাটা নিলো সেখানে। উষ্ণ, তপ্ত একখানা বুক। শক্ত অথচ অতি কোমল পৌষ’র জন্য। পৌষ নাক টেনে শ্বাস নিলো। তৌসিফে’র ঘ্রাণ তখন পৌষ’র নাসারন্ধ্র ভেদ করে হৃদপিণ্ড দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তৌসিফ ওকে ওভাবে নিয়েই ফোনে গম্ভীর কণ্ঠে শুধু বললো,

— কাম ফাস্ট।
অপর পাশের ব্যাক্তির কথা শোনা গেলো না। পৌষ কাঁপতে কাঁপতে বললো,
— কে আসবে নিতে? এখানে কেউ চেনা আছে আপনার?
তৌসিফ বউয়ের লাল হয়ে আসা নাকটা টেনে ধরে। বরফের মতো ঠান্ডা সেটা। তৌসিফ ঝুঁকে আলতো চুমু দিলো তাতে। পৌষ সরে যেতেই ওকে টেনে কাছে নেয় ও। পৌষ কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
— এখানে কত মানুষ।
— ইটস অস্ট্রেলিয়া হানি।
— তাতে কি? লজ্জা শরম ভুলে গুলিয়ে খেয়ে ফেলবেন আপনি?
— যার যার হক বুঝে নিতে হয়।
— শুনেছি বুড়োরা বউ আদর করে বেশি।

ঝলমলে, গ্লোয়িং তৌসিফে’র মুখটায় আচমকাই আঁধার ছেঁয়ে গেলো। সুন্দর ঠোঁটটায় থাকা হাসিটুকু যেন গিলে ফেললো ও। পৌষ অবাক হয়ে সেকেন্ডের ব্যবধানে তৌসিফে’র পরিবর্তন দেখে। অবাক হতে গিয়েও যেন হয় না। জামাই তার এসব নিয়ে খুবই সচেতন। পৌষ হাত উঁচু করে তৌসিফে’র গালের দাঁড়িতে রেখে হেসে দিয়ে বললো,
— মাফ চাইছি ভাই। আপনি জোয়ান। আমি বুড়ি। কুড়িতে এমনিতেই মেয়েরা বুড়ি। আমার তো কুড়ি পার হয়েছে।
তৌসিফে’র আধার সরলো না। পৌষ হাসতে হাসতে লুটিয়ে পরে বুকে। তৌসিফ এক হাতে ধরে ওদের সামনে থামা গাড়িতে উঠলো। পৌষ তৌসিফে’র গা ঘেঁষে বসে একদম। তৌসিফ মানুষটা গরম গরম। আশেপাশে প্রচুর ঠান্ডা সাথে বাতাস বইছে। সুন্দর রাস্তা দেখে পৌষ অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। বাড়ী-ঘর খুব কম এখানে। মাঝে শুধু গাছপালা। রাস্তাটাও ফাঁকাই বলা চলে। মাঝেমধ্যে দুই একটা গাড়ি যাচ্ছে। তৌসিফে’র বাহু বন্ধনে থেকে এতটুকুই দেখে পৌষ।

হোটেলে পৌঁছাতেই পৌষ অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়। এটা মূলত তার কাছে হোটেল লাগছে না। আলিসান বাড়ীই বলা চলে। চার নাম্বার ফ্লোরে লিফট থামতেই পৌষ দেখলো কিচেন সহ একটা এক রুমের বিশাল জায়গা। বাথরুম দেখে দুটো ঢোক গিলে ও। কাঁচের গ্লাসের বাইরে দৃষ্টি দিয়ে আরেক দফা অবাক হলো পৌষ। চোখ জুড়ানো এক সুন্দর দৃশ্য। সময়টা রাত হওয়াতে আগুন জ্বালিয়ে কেউ কেউ ড্রিংক করছে। খাওয়া দাওয়াও চলছে। তৌসিফ গায়ের কোর্ট খুলতে খুলতে ডাকলো,

— হানিই?
— হুঁ?
অমনোযোগী উত্তরে তৌসিফ এগিয়ে এলো। জুতা খুলে দিতে বলতেই পৌষ ফিরে ওর দিকে। পিটপিট করে তাকিয়ে বসে জুতা খুলতে খুলতে বলে,
— হানিমুনে বউ দিয়ে কেউ কাজ করায়?
— আমার বউ করে।
— জামাই করায়।
— বাইরে কি দেখছিলো আমার তোতাপাখি?
— ওখানে পার্টি হচ্ছে মনে হয়।
— হ্যাঁ। আমরাও ইনভাইটেড। হোটেলের তরফ থেকেই এটা।
পৌষ এক জুতা খুলেই লাফিয়ে উঠে। ঝলমলে গলায় বলে,
— চলুন তাহলে।
তৌসিফ এক ভ্রুঁ উঁচু করে বললো,

প্রেমসুধা পর্ব ৫৩

— হুয়াই?
— পা*গল আপনি? দাওয়াত দিলো যাব না? ওখানে খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে। রাতে ওখানে খেলাম তাহলে টাকা বাঁচলো তো নাকি? এখানে আর খাব কেন?
তৌসিফ নাক কুঁচকে হাসলো। পৌষ সেইদিকে তাকিয়ে রইলো। এভাবে তৌসিফ যখন হাসে তখন তাকে মারাত্মক লাগে। পৌষ অবাক হয়ে তখন সেই হাসি গিলে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। এই পুরুষ এত সুন্দর কেন? কোন কপাল পুড়ি একে ছেড়ে গেলো? তার কি মন চায় না এই হাসি আজন্মভর তাকিয়ে দেখতে? তার কি বুকে উত্তাল প্রেমের ঢেউ উঠতো না এই হাসি দেখে? পৌষ তো পা’গল বনে যায়। তার আত্মাটা কেমন ছলকে উঠে। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়। মন চায় সেই অনুভূতি পুষে রেখে দিতে। বড়ই সুন্দর এক অনুভূতি। প্রমময় অনুভূতি।

প্রেমসুধা পর্ব ৫৫