প্রেমসুধা পর্ব ৬২

প্রেমসুধা পর্ব ৬২
সাইয়্যারা খান

— এই কাজটা আপনি কেন করলেন মেহেদী? আমাকে কোন দায়ে ফেলতে চাইছেন আপনি? আর কত মাফ চাইব আমি? আমি কি এত বড় ভুল করলাম যার মাফ নেই?
সোহা একনাগাড়ে বললো কথাগুলো। তার বুকটা ওঠা-নামা করছে। মেহেদী বাসা পাল্টাতে চাইছে। নতুন বছরে নাকি নতুন বাসায় উঠবে। সোহা তখন থেকেই নানান ভাবে ওকে নিষেধ করছে কিন্তু মেহেদী শুনতে নারাজ। ও কিছুতেই শুনছে না। অগত্যা সোহা তাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে। মেহেদী বরাবরই শান্ত। আজও শান্ত ভাবে সোহা’র হাতদুটো নিজের হাতের মাঝে নিলো। ঠান্ডায় জমে আছে তা। মেহেদী ওর কপালে চুমু খেয়ে বললো,

— আমি নিজের সাথে ওয়াদা করেছি সোহা যেই পর্যন্ত আমার সন্তানকে ভালো রাখতে না পরব ঐ পর্যন্ত তাকে ছুঁয়ে দেখব না। আমি ওকে ছুঁতে চাই সোহা। তুমি আমাকে সেদিন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছো আমার অসহায়ত্ব। সেদিন আমার এত বছরে প্রথম মনে হয়েছিলো আমি গরীব। আমরা কখনো না খেয়ে থাকি নি সোহা। সবই তো আছে শুধু উচ্চ বিলাসিতা নেই। আমি জানতামই না গরীবদের বাবা হতে নেই। একদমই জানতাম না৷ আমি তো ভাবতাম গরীবরাও বাবা হয় যেমন আমার বাবা। গরীব আমি যেভাবেই হোক টাকা কামাব সোহা। যতদিন আমার শরীরে বল আছে ততদিন আমি কাজ করব৷ আমার সন্তানকে আমি ভালো রাখতে চাই সোহা।
সোহা মেহেদী’র হাত ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে ওর পায়ের কাছে বসলো। দুই পা চেপে ধরে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— আমাকে কি মাফ করা যায় না?
— পা ছাড়ো সোহা। উঠো।
— বলুন, মাফ করা যায় না?
— তুমি ভুল করো নি।
— মেহেদী, আমার ভুলের শাস্তিটা এত বড় কেন হচ্ছে? আপনি কি বুঝতে…..
কাকুতি করা সোহা’র শরীর টলতে লাগলো৷ মেহেদী ওকে পা ছাড়তে বললেও সোহা ছাড়ছে না। ও ধীরে ধীরে ঢলে পরে। মেহেদী ঘাবড়ে গেলো। তারাতাড়ি বসে সোহা’কে কোলে তুললো। জোরে ওর মা’কে ডাক দিতেই তিনি দৌড়ে এলেন৷ সোহা’কে দেখে চমকালেন প্রচুর। তারাতাড়ি বিছানায় শুয়িয়ে দিলো সোহা’কে। মেহেদী অস্থির হয়ে বললো,
— মা, মা ওর কি হলো?
— ডাক্তার ডাক। তারাতাড়ি যা।
মেহেদী যায় না। ও সোহা’কে কোলে তুলতেই ওর মা ধমকে উঠে। মেহেদী ভরা চোখে তাকিয়ে বলে,
— হসপিটালে নিতে হবে আম্মু।
— রাখ ওকে। এখন এসব স্বাভাবিক। ফার্মেসী থেকে ডাক্তার ডাক শুধু।

অতিরিক্ত চিন্তায় জ্ঞান হারিয়েছে সোহা। ডাক্তার শুধু বিশ্রাম করতে বলেই বিদায় নিয়েছে। মেহেদী’র মা ওর পাশে বসে গরম ভাত খাওয়ালেন। সোহা চুপচাপ খেয়েছে। পাশেই মেহেদী মাথা নিচু করে বসা৷ ওর মা বুঝলেন স্বামী- স্ত্রী’র মাঝে দন্ধ চলছে। কারণ তিনি জিজ্ঞেস করলেন না শুধু যাওয়ার সময় বললেন,
— মেহেদী, বাইরে আয়। দুধ গরম করে দেই সোহা’র জন্য।
চুপচাপ মায়ের পিছু গেলো মেহেদী। সোহা তখন পেটে হাত দিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। ঠান্ডা বাতাস যাতে না আসে তাই বন্ধ করা। সোহা’র মন চাইলো জানালা খুলে দিতে। একটু ঠান্ডা বাতাস গায়ে মাখতে।
মেহেদী’র মা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন,
— তুই কি ঝগড়া করেছিস সোহা’র সাথে? জ্ঞান কেন হারালো মেহেদী? দেখ, এই সময় মেয়েদের মন এমনিতেই ভালো থাকে না। ওর সাথে সময় কাটাবি কি উল্টো তুই রাতভর বাইরে থাকছিস। সময় থাকতে মূল্য দে মেহেদী নাহয় পস্তাবি।
মাথা নিচু করে কথাগুলো শুনে মেহেদী চলে গেলো। সোহা’র পাশে দুধ রেখে দরজা আটকে এলো মেহেদী। দু’জন চুপচাপ। মেহেদীই বললো,

— দুধটা খেয়ে নিতে।
— ভালো লাগছে না।
— খেতে হবে।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে সোহা বললো,
— আপনি কি বের হবেন?
মেহেদী মাথা তুলে তাকালো। বললো,
— তুমি কি চাও?
— না।
— তাহলে যাচ্ছি না৷
— আমাকে বুকে নিবেন মেহেদী?
— হুঁ।
মেহেদী পা তুলে কম্বলের নিচে ঢুকে গেলো। বুকে টেনে নিলো সোহা’কে৷ সোহা অল্প স্বরে কেঁদে ফেললো৷ মেহেদী সোহা’র কাঁধে মুখ গুজে কেঁদে ফেললো৷ সে সুখে থাকতে চায়। ছোট্ট একটা কুঁড়ে ঘরই যথেষ্ট সুখে থাকতে।

পৌষ আর কিছুতেই এখানে থাকবে না। তৌসিফ এত বুঝালো কিন্তু না ওর দফা এবং দাবি একটাই আর সেটা হলো অস্ট্রেলিয়া ত্যাগ। যে করেই হোক সুন্দর এই দেশটায় ও থাকবে না৷ তৌসিফ দুই দিনের সময় চাইলো কিন্তু পৌষ তাতেও নানান ভাবে জ্বালাতন করছে। ওর নাকি এখানে গা চুলকাচ্ছে। তৌফিক হতাশ চোখে তাকালো। পৌষ তখন ইচ্ছে করে গলা চুলকাচ্ছে। তৌসিফ কফির মগে চুমুক দিয়ে বললো,
— চামড়া উঠে যাবে। কি শুরু করলে?
— সত্যি বলছি চুলকাচ্ছে। এখানে থাকা যাবে না৷
— হোটেল বদলাই তাহলে।
— দেশ বদলান।
— আগামী কাল লাস্ট একটা হেয়ারিং আছে। থাকাটা একটু জরুরী হানি নাহয় তোমার কথাই শুনতাম।
পৌষ বুঝে গেলো ডাল এখানে গলবে না। ইচ্ছে করে চুলকে গলাটা লাল বানালো ও। তৌসিফ মগটা সাইড টেবিলে রেখে বিছানায় উঠলো। নিজের ঠান্ডা হাতটা পৌষ’র গালে রাখতেই ও ত্যাড়া হলো। সরে গিয়ে বললো,

— ঠান্ডা।
তৌসিফ বাঁকা হাসে। তার চোখে দুষ্টামি। পৌষ’কে টেনে নিজের একদম কাছে নিয়ে ঠোঁটে চুমু দিয়ে খুব ধীরে সে থুতনিতে ঠোঁট রাখলো। চাপ দাঁড়ির স্পর্শে কাতর হয় পৌষ। তৌসিফ অতি যত্নে গলায় দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। উষ্ণতায় চারপাশ ভরে উঠে। পৌষ তৌসিফে’র কাঁধ আঁকড়ে ধরে বলে,
— কি করেন?
তৌসিফ যথেষ্ট থেকেও চালাক পুরুষ। সে উত্তর করলো না বরং পৌষ’র পিঠটা নিজের বুকে লাগালো। পেছন থেকে গলায় আদর দিতেই পৌষ খেই হারিয়ে ফেললো। বরাবরের মতো এবারও তৌসিফ তাকে ঘায়েল করে ছেড়ে দিলো। ঠিক মাঝ সমুদ্রে। পৌষ খেই হারিয়ে ফেললো। ঘুরে বসে তৌসিফে’র দুই গালে নিজের হাত রেখে যথারীতি গালে, ঠোঁটে চুমু খেলো৷ তৌসিফ আদর নিতে তখন ব্যাস্ত। পৌষ হাপিশ নয়নে তাকাতেই তৌসিফ তার হৃদকম্পন জাগানো হাসিটা উপহার দিলো।

পৌষ লজ্জা পেলো। তৌসিফ উঠেপড়ে তখন লেগেছে বউয়ের লজ্জা ভাঙাতে। অতি যত্নে। খুব নীরবে।
ফেরী টেইলের মতো খুবই রোম্যান্টিক এক রাত কাটলো তাদের। আজ তৌসিফ ছিলো বেপরোয়া। তার আদর সামলাতে গিয়ে বড়ই ক্লান্ত আজ পৌষ। চোখ বুজে এখনও ঠাই শুয়ে আছে। ঠান্ডার এই শীতের রাতে প্রিয় পুরুষের বুকে ঘুমানো আসলে একটা ফ্যান্টাসি। প্রতিটা নারী এটা অনুভব করতে চায়। আস্ত একটা মানুষে’র উষ্ণতা নিছক কম নয়। একটি দেহের ভাজে আরেকটি দেহ যখন লুকিয়ে পরে তখন কিন্তু মুহুর্তটা কাটানো কঠিন। শীতের রাতে এই ইচ্ছে, আকাঙ্খা যেন বৃদ্ধি পায়। পৌষ আরামে গুঙিয়ে উঠে। তৌসিফ ওর মাথায় চুমু খায়। দৃষ্টি তার সম্মুখে। কাঁচের জানালা ভেদ করে বাইরে ঝলমলে দৃশ্য নজর কাড়ছে তার কিন্তু বুকে থাকা এই সুখের দলা যেন তার সকল ইচ্ছে ত্যাগ করাতে বাধ্য করে। মন চায় এখানেই সমাধি হোক। প্রিয় মানুষটার বুকে।

— আমিও চলি?
এই নিয়ে তৃতীয় বার প্রশ্নটা করলো পৌষ। তৌসিফ’কে তৈরী হতে দেখেই ও সাথে যেতে চাইছে। তৌসিফ বুঝলো বউ তাকে একা ছাড়তে চাইছে না৷ পৌষ’র মন পড়া শিখেছে তৌসিফ বহু আগে৷ ওর ভাবনা পিয়াসী। ওর সাথে তৌসিফে’র দেখা হোক সেটা কিছুতেই মানতে নারাজ পৌষ। না চাইতেও তৌসিফ বললো,
— কানটুপি পরে নাও পৌষরাত।
পৌষ’র মুখটা চকচক করে উঠলো। খাট থেকে এক লাফে নেমে তৌসিফ’কে জড়িয়ে ধরলো৷ তৌসিফ আগলে নেয়। কপালে চুমু দিয়ে বলে,
— লাফিও না হানি।
— ঠিক আছি আমি।

হাসিমুখে জানায় পৌষ। তৌসিফ তবুও ভরসা পায় না৷ ওর আয়োডিনের ঔষধ চললেও ওর দূর্বলতা তৌসিফ টের পায়। হয়তো চঞ্চলতার ভীরে কেউ টের পাবে না কিন্তু তৌসিফে’র চোখেও ফাঁকি দিতে পারবে না।
ওদের গাড়ি থামলো কোর্টের সামনে। পৌষ বেশ অবাক হলো। কোথায় ওদের কোর্টের সামনে তো এমন দৃশ্য থাকে না৷ কত সুন্দর নীরব একটা জায়গা। কোন কালো পোশাক পরা লোক নেই। ওরা ভেতরে যেতে অবশ্য পৌষ কালো পোশাকের লোক দেখলো। তৌসিফ একহাতে পৌষ’কে ধরে আরেক হাতে কিছু পেপার সাইন করলো৷ তারা বেশকিছুক্ষণ কথা বললো। আগামাথা ততটা পৌষ বুঝে না৷
হঠাৎ পিয়াসী উপস্থিত হলো সেখানে। বড় বড় চোখে তাকিয়ে এক চোখ ঘুরানি দিলো পৌষ। পিয়াসী অবাক হলো৷ এই মেয়ে একটা বদর তা বুঝতে দেড়ী হলো না৷
পিয়াসী নরম স্বরে বললো,
— তৌসিফ ওর শাস্তিটা একটু কমাতে চেষ্টা…

— প্রশ্নই উঠে না। আমাকে তুমি খুব ভালো করে চিনো। ঠিক ততটা ভালো করে চিনো যতটা চিনলে এটা জানো যে শাস্তি কমাব না আমি। সো সময় অপচয় করো না এখানে।
উঠে যেতে নিলেই তৌসিফে’র হাত ধরে পিয়াসী। তড়িৎ বেগে খামচে ধরে পৌষ ওর হাত৷ ব্যাপারটা ঘটলো কারেন্টের গতিতে। পিয়াসী আর্তনাদ করে উঠে৷ তৌসিফ দেখলো পৌষ আরেক হাত বাড়াচ্ছে। চট করে বুঝে নিলো ও চুল টেনে ধরবে। পেছন থেকে ওর কোমড় চেপে সরালো তৌসিফ। পৌষ তবুও হাত ছাড়লো না। পিয়াসী নিজের আরেক হাত দিয়ে পৌষ’র বাহু শক্ত করে ধরে ছাড়াচ্ছে। উকিলটা অবাক হয়ে আছে। তৌসিফ এবার ধমক দিলো,
— ওর হাত ছাড়ো পৌষরাত।
— ছাড়ব না৷ ওর সাহস কত আমার জামাই’র হাত ধরে। তোর হাত ভেঙে আরেক হাতে ধরিয়ে দিব৷ চিনিস আমাকে? পৌষরাত হক আমি!
বহু কষ্টে হাত ছাড়ালো তৌসিফ। পিয়াসী দেখলো ওর হাতের অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে এই মেয়ে। তৌসিফ পৌষ’কে নিজের সাথে ঝাপ্টে রেখে বললো,
— পিয়াসী, দূরে থাকার চেষ্টা করো। তোমার কৃতকর্ম তোমাকে আজ এখানে এনেছে। স্টে এওয়ে।
তৌসিফ পৌষ’কে নিয়ে চলে গেলো। পিয়াসী সেদিকে তাকিয়ে রইলো৷ এই তৌসিফ তার ছিলো। তার কথায় চলতো এই তৌসিফ। পিয়াসী হারিয়েছে। স্বেচ্ছায় সবটা হারিয়েছে।

গাড়িতে চুপচাপ দু’জন। পৌষ ভীতু দৃষ্টিতে তাকালো একবার। এক হাত বাড়িয়ে তৌসিফে’র হাতে রাখতেই তা সরিয়ে দেয় ও। পৌষ’র মনে মনে রাগ হয়৷ রাগী কণ্ঠে বলে,
— কি প্রাক্তন’কে খামচি দেয়ায় রাগ হলো বুঝি?
তৌসিফ শান্ত দৃষ্টিতে তাকাতেই দাঁত বের করে হাসে পৌষ। ডাকে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে,
— অ্যাই মামাতো ভাই।
আচমকা গাড়ি ব্রেক কষলো। হুমড়ি খেয়ে পরতে নিয়েও বেঁচে গেলো পৌষ। তৌসিফ ওর সিট বেল্ট খুলে নিজের কোলে টেনে বসালো। পৌষ’র হাত কাছে নিয়ে বললো,

প্রেমসুধা পর্ব ৬১

— এটার দরকার ছিলো?
— ব্যথা পাই নি।
— হ্যাঁ, আমি তো কানা৷
পিয়াসী শক্ত করে ধরে ছাড়াতে গিয়ে নিজেও নখ বিঁধিয়ে দিয়েছে পৌষ’র হাতে। তৌসিফে’র শক্ত হওয়া চোয়ালে পৌষ চুমু দিলো। বললো,
— অ্যাই জামাই, সতীন আমাকে খামচি দিয়েছে।
বলেই খিটমিট করে হাসতে লাগলো পৌষ। তৌসিফ ও হেসে ফেললো। এই মেয়ে এত পাঁজি কেন?
তৌসিফ ওর চুলের পেছনে হাত দিয়ে মুখোমুখি করলো। ফিসফিস করে বললো,
— সারাটা হানিমুন আদর খেলে তবুও মামাতো ভাই লাগে আমাকে?

প্রেমসুধা পর্ব ৬৩