প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ১৪ (২)
সাইয়্যারা খান
হক বাড়ীতে বৈঠক বসেছে। ড্রয়িং রুমে জুড়ে নীরবতা। জমিনের সাথে পা দুটো শক্ত করে এঁটে আছে হেমন্ত। বাইরে থেকে এসেছে ঘন্টা খানিক হলো। বাড়ীতে পা রাখতেই ওর কাছে ছুটে এসেছে পাঁচজন। ইনি, মিনি থেকে আদো আদো আর জৈষ্ঠ্য থেকে পুরো ঘটনা শুনে হেমন্ত প্রথমেই হতবাক হয়ে গেলো। এত সাধারণ একটা ঘটনা ঘিরে ওর মা যে পৌষ’র গায়ে হাত তুলেছে এটা বিশ্বাস করতেই যেন হেমন্তর কষ্ট হচ্ছে। জৈষ্ঠ্য যতটুকু যা বললো তাতে বোঝা গেলো, বাড়ীতে মেহমান ছিলো। স্বাভাবিক বিষয় বিয়ে বাড়ীতে মেহমানের ঢল থাকবেই।
শ্রেয়ার সামান্য মাথা ব্যথা থাকায় পৌষ ওকে রুমে থাকতে বলে নিজে চায়ের মধ্যে লবন দিয়ে গুনে গুনে ছয়জন মহিলার সামনে দিয়েছে। তারা সবাই কুটনী সমাজের চাচি। পৌষ’র তাদের সাথে কোন এক কালের শত্রুতা আছে তাই লবন দেওয়ার মতো কাজটা ও করেছে। চা মুখে দেওয়ার আগেই তাদের মধ্যে সবচাইতে মোটা দেখতে চাচিটা মুখ বাঁকিয়ে বলেছিলেন,
“হ্যাঁ গো হেমন্তের মা, পৌষই তো ছিলো। বাইরে থেকে মেয়ে নিলে যে।”
বড় চাচির রাগের সূত্রপাত সেখান থেকেই। এরপর যখন চায়ের ঘটনা ঘটলো তখনও বড় চাচি সামাল দিয়েছিলো কিন্তু শেষ দিকে তাদের মাঝে একজন যখন জোর দিয়ে বলেছিলেন,
“বউ দেখালে না হেমন্তের মা। ডাক দাও দেখি একটু।”
বড় চাচি বলার আগেই পৌষ বলেছিলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ভাবীর মাথা ব্যথা। সকাল থেকে কেউ না কেউ দেখতে আসছে তাই এখন একটু আরাম করছে।”
“বাড়ীর বউ আরাম করছে আর ঝি খাটছে, তাহলে বউ দিয়ে কি কাম? পৌষ দিয়েই তো চলে যাচ্ছে।”
কটাক্ষ করে নিজেরা নিজেরা হাসাহাসি করলেন তারা। বেশ খানিকটা সময় বসে থেকে আরেকটু বিষাক্ততা ছড়িয়ে দিয়ে গেলেন। তারা বিদায় নিতেই বড় চাচি পৌষ’র সাথে জঘন্য ব্যবহার করেছে। সেই ব্যবহারের সাক্ষী দিয়েছে ইনি, মিনি। বড় ভাইকে সবটুকু বলেছে, তাদের পরিপূর্ণ কথা না হওয়াতে একটু সময় লেগেছে কিন্তু তারা মুখস্থ করে ভাইকে জানিয়েছে।
হেমন্ত এখন পর্যন্ত পৌষ’র কাছে যায় নি আর শ্রেয়া এই বিষয়ে এখনও কিছু জানে না। বড় চাচা হেমন্ত’র দিকে তাকিয়ে বললেন,
“এভাবে কতক্ষণ বসে থাকব হেমন্ত?”
“যতক্ষণ উত্তর না পাচ্ছি।”
“কিসের উত্তর চাইছো তুমি?”
“বুঝেও অবুঝ সাজতে হলে সাজতেই পারে সবাই। আমার তাতে সমস্যা নেই। আম্মু আজ এই কাজটা কেন করেছে তার উত্তর চাই। এখনই চাই!”
সামনে থাকা টেবিলটায় হাত দিয়ে আঘাত করে কথাটা বললো হেমন্ত। বড় চাচি সামান্য কেঁপে ওঠলেন। মাঝে সেজো চাচি বললেন,
“বড় ভাবী বড়, মায়ের মতো। তিনি চাইলেই চড় থাপ্পড় মা’রতে পারেন তাই বলে কি পৌষও একই কাজ করবে? ভাবীকে তো ও আর ছেড়ে দেয় নি।”
হেমন্ত বেশ ঠান্ডা গলায় বললো,
“আপনার পেছনে কুকুর তাড়া করলে তাকে ইট ছুঁড়বেন না সেজ চাচি?”
সেজ চাচি থতমত খেয়ে গেলেন। উত্তর করলেন না৷ হেমন্তই উত্তর করলো,
“অবশ্যই ছুঁড়বেন। জান বাঁচানো ফরজ কাজ। তাই বলে তো বলা যাবে না আপনি ইচ্ছে করে কুকুরকে আঘাত করেছেন।”
বড় চাচি তখনও একদম চুপ করে আছেন। সেজ চাচা আর ছোট চাচা সহ চুপ। বড় ভাবীর নামে বিচার, তারা চাইলেও তো আর কিছু বলতে পারেন না। ভেবেচিন্তে বলতে হয়। হেমন্ত সবার মুখটা দেখলো অতঃপর বেশ ঠান্ডা স্বরে বললো,
” পৌষর ভাগ বাটোয়ারা হবে।”
একসাথে সকলে যেন চমকালেন। তাদের চমকানো ভাব আরেক ধাপ বাড়িয়ে হেমন্ত বললো,
“ওকে যেহেতু কেউ সহ্য করতে পারছেই না তাহলে আপনাদের কারো কষ্ট আর বাড়াব না আমি। যথেষ্ট কষ্ট করেছেন। আপনাদের কষ্ট তো আমি বাড়াতে পারি না তাই কষ্টের মূলকেন্দ্র উপড়ে ফেলব ভাবছি। পেছনের কোলিনির পুরো ভাড়া আজ থেকে পৌষ পাবে। কারণ আশা করি বলতে হবে না। বাড়ী থেকে মেঝ চাচ্চুর অংশ বাট করা হবে। পুরোটা ধরে পৌষ’কে দিয়ে দিব। আঠারো বছর পাড় হয়েছে ওর, সব সামলাতে পারবে আর বাকি রইলো আমাদের ব্যাবসা সেখান থেকে মেঝ চাচ্চুর অংশ আলাদা করে ঐ পরিমাণ টাকা পৌষ’কে দিয়ে দিব অথবা একেবারে বড় অংকের টাকা দিয়ে ভেজাল বিদায়। কি বলো? রোজ রোজ ঝামেলা থেকে কাহিনি একেবারে খতম। আপনাদের সবার কষ্ট লাঘব করে দিলাম। যত দ্রুত এখন থেকে বাট বাটোয়ারা হবে তত দ্রুত ঝামেলা মিটবে।”
এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে হেমন্ত আধ গ্লাস পানি খেলো। সবার আগে সেঝ চাচিই বলে ওঠলেন,
“পা’গল হয়েছো হেমন্ত? ওকে কোথায় পাঠাবে? একা থাকবে কিভাবে?”
“ওসব চিন্তা আপনার করতে হবে না সেজ চাচি। প্রেশার বাড়াবেন না।”
ছোট চাচা ভাতিজার কথা বুঝলেন। পৌষ’টাকে তিনি আদর করেন, ভালোবাসেন কিন্তু কেন জানি মেয়েটাকে কখনো ওভাবে আদর করাই হয় না। হেমন্তর বাবা তখন বললেন,
“ও একা এতসব সামলাতে পারবে?”
হেমন্ত সামান্য হাসলো। সরল গলায় উত্তর দিলো,
“ওর ভাই আছে না? ও আমার বাচ্চা। ওকে নিয়ে আমি আমার সংসার আলাদা করে ফেলব।”
এবারে যেন সকলেই বোধ হারা হলো। ইনি, মিনি কোথা থেকে ছুটে এসে হেমন্তের কোলে চরে বললো,
“আমিও দাব তোমাল সাতে হেমু বাই।”
পিহা নাক টেনে পেছন থেকে তখন বলে,
“আমিও।”
ছেলে জমজও তখন বলে ওঠে,
“আমরাও ভাই।”
হেমন্ত জৈষ্ঠ্য’কে বললো,
“ওদের ঘরে নিয়ে যা।”
জৈষ্ঠ্য এসে টেনেটুনে ইনি, মিনিকে কোলে তুললো। ওদের নিয়ে যেতেই বড় চাচি একপ্রকার ছুটে এলেন। হেমন্তের হাত চেপে বললেন,
“কি বলছিস তুই হেমন্ত?”
” কি বলেছি?”
“তুই.. তুই কই যাবি?”
“আজ বিয়ে হয়েছে, বউ আছে। কাল বাচ্চা হবে। আমার বাচ্চা তোমাদের মাঝে ভালো থাকবে না৷ এই পরিবেশ ওকে বাঁচতে দিবে না তাই আগে থেকেই আলাদা হয়ে যাব। শ্রেয়াকে বলে দিব এখন। এই সপ্তাহে অনুষ্ঠান শেষ হতেই পৌষ আর শ্রেয়া নিয়ে আলাদা হব।”
“কি বললি তুই? তোর বাচ্চা আমরা পালব না? আমি ওকে বাঁচতে দিব না?”
হেমন্ত উঠে দাঁড়ালো। বেশ শান্ত ভাবেই বললো,
“পৌষটা আমার বাচ্চা, ওকে যখন সামলে রাখতে পারলে না তাই আর বেশি আশা রাখলাম না৷ আর আব্বু, উকিল ডাকো, নাহয় কাল আমি ডাকব।”
হেমন্ত যেতে যেতে আবার থামলো। মায়ের দিকে তাকিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললো,
” ওর গায়ে আর একটা টোকা কেউ দিবে, তার সাথে সেই মূহুর্ত থেকে আমার সম্পর্ক শেষ।”
পৌষর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে হেমন্ত। দুই বার টোকা দিলেও পৌষ দরজা খুলে নি। হেমন্ত জানে পৌষ ভেতরে কাঁদছে না৷ হয়তো ঠিট লেগে আছে নাহয় কোন কাজ করছে। দরজাটা আরেকবার নক করলেও পৌষ সাড়া দিলো না। হেমন্ত থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে বাকি পাঁচজন। শ্রেয়া তখনও বেখবর। হেমন্তর ভেতরটা তখন অস্থির লাগে। দরজার সাথে হেলান দিয়ে ডাকে,
“পৌষ? পৌষ?”
উত্তর আসে না। হেমন্তের বুকটা তখন ধুকপুক করে। দরজায় ঠকঠক শব্দ করে আবারও ডাকে,
“ভাইয়ের বাচ্চা, দরজাটা খোল না বাচ্চা। ভাই সারাদিন পর বাসায় এসেছি পৌষ। কতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখবি? ভাই মাফ চাইছি তার মায়ের তরফ থেকে। খোল না পৌষ।”
হেমন্ত নাক ভারী হয়ে আসে। ওর কেমন একটা অনুভূতি হয়। মনে হচ্ছে ওর ছোট্ট পৌষটা এখানে আটকে। ওর ছোট্ট ঐ বাচ্চাটা অভিমান করে এখানে বসে আছে। গলাটা ভারী হয়। হেমন্ত পুণরায় ডাকে,
“ও পৌষ, খোল না রে বাচ্চা। ভাই তোর পায়ে ধরে মাফ চাইব। একটু খোল, তোকে দেখব শুধু… ”
কথাটা শেষ করার আগেই দরজা খুলে গেলো। হেমন্তর দিকে তাকিয়ে আছে হাসোজ্জল একখানা মুখ। ভুবনমোহিনী গোলাপের ফুলটা যেন ফুটে আছে ঐ মুখটায়। হেমন্ত অপলক তাকিয়ে রইলো। পৌষ’র মুখটা ভরা মায়া, কেউ কি তা দেখে না? এই মুখের দিকে তাকিয়ে শতশত ভুল অনায়াসে ভুলা যায়। মানুষ ওকে দেখে কি বুঝে না ও যে এই বিষবাষ্প ভর্তি পৃথিবীর বুকে এক টুকরো স্বস্তি। এই হাসি টুকু কি কারোই পরাণ জুড়ায় না? শুধু কি হেমন্তেরই এমন লাগে?
পৌষ তুড়ি বাজিয়ে বললো,
“কিতা?”
“কতক্ষণ ধরে ডাকছি?”
হেমন্ত ভেতরে ঢুকলো। পিছু পিছু ঢুকলো তার বাহিনী। হেমন্তের মনটা চাইলো পৌষ’কে ঝাপটে বুকে জড়িয়ে রাখতে। তার ভেতরে প্রচুর অস্থিরতা কাজ করছে। সম্পর্কের বাধ্যতামূলক সমীকরণ এটাকে এতই জটিল করেছে যে চাইলেও পৌষ’কে জড়িয়ে ধরা যাবে না। হেমন্তের মন বলছে ওর পৌষ ঠিক নেই। কিছু একটা এখনও ঠিক নেই। ঐ নিষ্পাপ হাসির পেছনে কিছু তো লুকিয়ে আছে। হঠাৎ যখন ইনি, মিনি পৌষ’র বুকে লাফিয়ে উঠতে চাইলো তখনই তড়িৎ বেগে ওকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেললো পৌষ। দুই বোন ডাগরআঁখি দিয়ে তাদের আপাকে দেখতেই পৌষ বিরক্ত হয়ে বললো,
“সারাক্ষণ টিকটিকির মতো চিপকে থাকিস? কেন আমি কি দেয়াল? তোরা কি টিকটিকি?”
দুই বোন হাসছে। মুখে টিক টিক শব্দ করছে। পৌষ হেমন্তের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললো,
“নয়া দামান ইয়ানে কিতা খরো?”
“কয় জেলা মেশালে আপা?”
চৈত্র’র প্রশ্নে পৌষ হাসলো। উত্তরে বললো,
“যতটুকু পারা যায়।”
তাদের বিশাল সমাগম শুরু হলো। রাতের এক চমৎকার আয়োজন পরিকল্পনা করলো ওরা৷ তখনই হেমন্ত পৌষ’কে ইশারায় বাইরে ডাকে। পৌষ আসা মাত্রই হেমন্ত ছোট্ট একটা প্রশ্ন করলো,
“কি হয়েছে, বল?”
“বুকে যেই চা ছুঁড়েছিলো ওটা সামান্য গরম ছিলো। চামড়া লাল হয়ে গিয়েছে।”
হেমন্ত আর দাঁড়ালো না। পৌষও ঘরে ঢুকলো। আজ রাতে শ্রেয়া আর হেমন্তের জন্য তাদের সখের ছাদ ত্যাগ করবে ওরা৷ ভাই-ভাবীর জন্য ডেট প্ল্যান হচ্ছে।
কিছুক্ষণ পরই হেমন্ত হন্তদন্ত পায়ে নিজের ঘরে ঢুকে। শ্রেয়া ওকে দেখে কিছু বলার আগেই হেমন্ত ওকে একটা প্যাকেট দিয়ে শুধু বললো,
“এটা পৌষ’কে দিবে। হাতে দিবে না৷ বুকে আঘাত পেয়েছে। একটু আস্তেধীরে দিও।”
শ্রেয়া প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গেলো। হেমন্ত যথেষ্ট ক্লান্ত তা বোঝা যাচ্ছে। শ্রেয়া যখন যেতে পা বাড়ালো তখনই পেছন থেকে ওর হাতটা ধরলো হেমন্ত। শ্রেয়া চেয়ে রইলো ওর পানে। হেমন্ত যথেষ্ট সুন্দর একটা ছেলে। যেমন ভদ্র, তেমন আচার-আচরণ। এক দেখায় পছন্দ হওয়ার মতো। শ্রেয়া’র হাতটা ধরা অবস্থায়ই হেমন্ত বললো,
প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ১৪
” যদি মনে কোনদিন কোন প্রশ্ন জাগে তা জিজ্ঞেস করবে শ্রেয়ু। আমার পৌষ’র বিষয়ে কোনদিন মনে সংশয় রাখবে না৷ আজও তোমার মনে প্রশ্ন আসবে, তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করবে। আমি উত্তর দিব। শুধু মনে রাখবে পৌষ নামের মেয়েটাকে চাচাতো বোন ভাবি না আমি। ও আমার বাচ্চা। আমার খুব ইচ্ছে ওর বাবা হওয়ার৷ পরের জন্ম বলে কিছু তো নেই নাহয় ওকে আমার মেয়ে হিসেবে চাইতাম। চাচাতো ভাই হয়ে কত যে আটকে গেলাম শ্রেয়ু তা তুমি বুঝবে না৷ শুধু মনে রাখবে তোমার স্বামীর বাচ্চা ঐ পৌষ। আমার খুব আদরের।”
শ্রেয়া অপলক তাকিয়ে রইলো। আশ্চর্য! ওর দুটো ভিজে উঠেছে।