প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৭
সাইয়্যারা খান
পরন্ত বিকেলে আজ রোদ নেই একরত্তি। ভোর থেকে বৃষ্টি। আকাশে মেঘ জমা তবে বর্ষণ হচ্ছে না। কেমন গুমোট ধরে আছে। প্রকৃতি দুই হাত বাড়িয়ে আজ উদারতা দেখাচ্ছে। রোদ নেই আবার বৃষ্টিও নেই কিন্তু অফুরন্ত শরতের বাতাস আছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে পৌষ এদিক ওদিক অবলোকন করলো কিছুক্ষণ অতঃপর ওরনা মাথায় দিয়ে বেরিয়ে গেলো ফ্ল্যাট থেকে। সেই যে উঠলো বিয়ের রাতে, আজ নামলো এককথায়। মাঝে তুহিনের ঘটনার সময় নামাটা অবশ্য কোন নামা না কারণ সেদিন সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতি ছিলো। পৌষ চাইলো উড়াল দিতে। সিঁড়ি শেষ হতেই গ্যারেজ। দুইজন দারোয়ান সেখানে। পৌষকে দেখেই সালাম জানালো।
উত্তরে মিষ্টি হাসি সহ সালাম দিয়ে পৌষ বাইরে এলো। ওকে আটকানোর সাহস তাদের নেই। পেছনে হাত বেঁধে এদিক ওদিক তাকিতুকি করে পৌষ গেলো সামনের দিকে। এখানের বড় গেইটটা বন্ধ থাকে। খুলে শুধু গাড়ি ঢুকা অথবা বের হওয়ার সময়। পকেট গেট দিয়ে পৌষ চুপচাপ বেরিয়ে এলো একদম বরাবর পুকুর ঘাটে। আশেপাশে নানান গাছপালা। শাকসবজি, ফলমূল বাদেও নানান অপরিচিত গাছ। পৌষ বেশখানিকটা সময় তাকিয়ে রইলো। এখানে পিহা থাকলে খুশি হতো। ওর ফুলগাছ পছন্দ। পৌষের আবার ফুল গাছ পছন্দ না ততটা। যেই গাছ দিয়ে কিছু পাওয়া যাবে না সেই গাছ লাগানোও পছন্দ না ওর। সৌন্দর্য দিয়ে কিইবা হবে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অক্সিজেন তো বটগাছও দিবে। একা একা বকবক করলো মনে মনে। ঘাটের কাছে এগিয়ে এসে বসলো। সুন্দর পাকা করা চারপাশ। সিঁড়ি গুলো ধীরে ধীরে পানিতে ডুবেছে। পৌষের ভালো লাগলো। ভাবলো একটু নামবে কিন্তু পিচ্ছিল দেখে আর নামলো না। ঘাট থেকে বাড়িটা বেশ সুন্দর দেখালো। একপাশে কৃষ্ণচূড়া গাছ আরেক পাশে সোনালু গাছ। ঘাটের পানিতে কচুরিপানা দিয়ে ভরা। ফাঁকে ফাঁকে আবার কি জানি গাছ বেড়ে উঠেছে। মনোযোগ দিয়ে দেখলো পৌষ। এখানে এক কাপ চা হলে বেশ জমতো সাথে যদি পাকবাহিনীটা থাকতো তাহলে তো কথাই নেই। কেমন হয় যদি ওরা দৌড়ে চলে আসে? দূরত্ব তো খুব কম। ছাদ থেকে হয়তো ওদের বাড়ীর ছাদটাও দেখা যাবে। মনটা নিমিষেই খারাপ হয়। চোখদুটো অসম্ভব জ্বালাপোড়া করে অথচ পানি আসে না। ঐ বাচ্চাগুলো পৌষের খুব কাছের। গায়ে ভীষণ এক কলঙ্ক নিয়ে হক বাড়ী ছেড়েছে সে।
ছাড়ে নি অবশ্য তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মুখের কথায় আঘাত দিয়ে সরাতে সমস্যা হচ্ছিলো বিধায় মুখে চুনকালি মাখিয়ে ভাগিয়ে দিয়েছে তারা পৌষকে। প্রলয় হক নিশ্চিত কোন খারাপ সময়ে কন্যা জন্ম দিয়েছিলো নাহয় তার মেয়ের কপাল এমন কেন? খাপছাড়া।
পৌষ উঠে আশেপাশে হাঁটছে। তৌসিফদের বাড়ীর গেইট পেরিয়ে বাম পাশে হাঁটছে। এখানে গাছগুলো বেশ বড় বড়। উঁচু উঁচু গাছের নিচে আবহাওয়া যেন শীতল হলো। হীম হওয়া এক পরিবেশ। পৌষ বুক ভরে শ্বাস নিলো। যতটুকু জানে এখানে সম্রাটের বাসা। এই পুরাতন দেখতে গেইটা সম্রাটদের। ফাঁকা ঢোক গিলে পৌষ। তার স্বপ্নের পুরুষের বাড়ী এটা। পৌষ যখন সদ্য তরুণী তখন থেকে সম্রাট নামটা তার বুকে গাঁথা। কেউ যেন নিজ হাতে সেখানে বসিয়েছে। ঝাঁকড়া চুলের অধিকারী পুরুষটাকে আজ ভীষণ মনে পরলো। কি হতো যদি পৌষ তার স্ত্রী হতো? খুব কি ক্ষতি হতো তালুকদার নামটা যদি সম্রাটের বৌদলতে তার সাথে জড়িত হতো? পৌষ আজীবন বলে যাবে তার প্রথম ভালোবাসার কথা। মান্নার মতো আদলের সম্রাট। শৌর্যবান, দৃঢ়কান্তি এক পুরুষ। দীপ্তিময়, সৌম্য এক পুরুষ যাকে পৌষ বুকে লালান করেছে। এখনও করছে। এই জায়গাটায় এসে পা দুটো যেন আটকে গেলো। তাকিয়ে রইলো শ্যাওলা জমা দেওয়ালে। তার অপর পাশে কে? ঐ পুরুষটা পৌষের স্বপ্ন পুরুষ। দাপুটে সম্রাট। যাকে ঘিরে হাজার নারীর বুনা স্বপ্ন ধূলিসাৎ সেই ভীরে পৌষ অন্যতম।
“তুমি এখানে?”
নারী কণ্ঠে পৌষ পিছু ঘুরলো। সামান্য চমকেছে তবে তা চোখের চাহনিতে প্রকাশ করছে না। নিজের দূর্বলতা কাউকে দেখাতে নেই। পৌষও দেখায় না। দূর্বল মানুষের ঘাড় মটকাতে সবাই পছন্দ করে। তাহমিনাকে এই মূহুর্তে দেখে পৌষের মনমেজাজ প্রচুর খারাপ হলো। আভিজাত্যপূর্ণ এই নারীটির সাথে তার দেখাশোনা ঐ একবারই। সেই একেবারে ঘটনাইতো পৌষ ভুলতে পারে না। দ্বিতীয় বার সাক্ষাৎ এর ইচ্ছেটাও মৃত অথচ কপাল, দেখাটা হয়েই গেলো। ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে পৌষ বললো,
“এমনিতেই হাঁটছিলাম। চলে যাচ্ছি।”
বলেই পা বাড়ায় পৌষ। ততক্ষণাৎ ওর হাত ধরে তাহমিনা। ভীষণ নরম অথচ নিচু স্বরে বলে,
“আপার উপর রেগে আছো?”
“জি না। আপনি আমার আপন কেউ নন৷ পরের সাথে কিসের রাগ?”
তাহমিনা যেন মেয়েটার কথায় মুগ্ধ হলো। এত বছরেই না কেউ যোগ্য বউ হয়ে এলো তালুকদার বাড়ীতে। বাকি দুটোর যেই অবস্থা। খুবই শোচনীয়। তাহমিনার মনে ধরেছিলো পৌষকে সেই প্রথম দিন যখন তেজী স্বরে ও প্রতিবাদ করলো, যখন নিজের দুই বোন তৌসিফের চুল, দাঁড়ি টানিয়ে মুখের উপর উত্তর দিলো। তাহমিনার মুখের হাসি সরে নি। পৌষের আরেক হাতও ধরলো ও। নরম স্বরে বললো,
“মনে রাখবে কোন কিছুই এভাবেই হয় না।”
এই একই কথা তৌসিফও বলেছিলো পৌষকে। পৌষ আমলে নেয় নি। আজ সুযোগ বুঝে জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
“এমন কি ঘটলো যে আপনারা বাড়ীর বউকে এভাবে দেখে আনেন?”
“আবহাওয়া তো সুন্দর। চা খাবে পৌষ?”
“সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। বাসায় যেতে হবে।”
“আমাদের বাসায় নামাজ পড়বে। সমস্যা তো নেই। এসো।”
এমন ভাবে তাহমিনা বললো আর হাত দুটো ধরলো যে না করার সুযোগ পৌষ পেলো না। তাহমিনা ওর ছটফট দেখেই বললো,
“কি, আমাদের টিনের ঘর দেখে বুঝি আসবে না।”
পৌষ কথা বললো না। তাহমিনার সাথে হেঁটে গেলো। মুখেই এটা টিনসেড অথচ জমিদার বাড়ী থেকে কোন অংশেই কম না। মাগরিবের আজান দিলো তখন। পৌষ এদিক ওদিক তাকালো যেন খুব করে খুঁজলো কাউকে কিন্তু দেখতে পেলো না। আলো জ্বালাচ্ছে না কেন? পৌষের চোখ দুটো যে দেখার জন্য খুব তৃষ্ণার্ত। পায়ে পায়ে তাহমিনার সাথে ভেতরে চলে এলো পৌষ। নামাজটাও পড়া হলো। তখনই মধ্যবয়স্ক এক নারীর আগমন ঘটলো। ঢোক গিললো পৌষ। এটাই তাহলে সম্রাট চেয়ারম্যানের মা। সাহারা এগিয়ে এসেই পৌষকে জড়িয়ে ধরলো। পৌষ সালাম জানাতেই ভীষণ আবেগাপ্লুত হলেন তিনি। তার খুব ইচ্ছে ছিলো পৌষ তার ছেলের বউ হবে। পৌষের এসব কথা ভালো লাগলো না। তাহমিনা চা এনেছে। এই পর্যায়ে এমন চা দেখে পৌষ চমকালো। ঘন দুধে টি ব্যাগ ডুবিয়ে এনেছে তাহমিনা। পৌষ এসেছিলো শুধু মাত্র কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে। কিন্তু সাহারার কান্নায় আর জানা হলো না। সাহারা কিছুটা এলোমেলো কথা বলে। এই বর্তমান তো এই অতীত। হঠাৎই বলতে লাগলো,
“সম্রাটটা যে আমাকে কি পরিমাণ জ্বালাতো তুমি জানো না মেঝ বৌ। এই রাত দুইটা বাজে এত বন্ধু নিয়ে হাজির। কি করব আমি? ঘুমাতে দিব কোথায়? কি তো নিজের ঘরে ঢুকেই ঘুম। এই তোশক চাদর বিছিয়ে দিলাম মেঝেতে। কি খাওয়াব এত রাতে? ওরাই আবদার ধরতো খিচুড়ি খাবে। আমি বড় ডেগচিতে চাল, ডাল একসাথে ঢেলে দিতাম। বুয়ারা হাতে হাতে কাজ করতো। কি যে দুষ্ট ছিলো ও। সারাক্ষণ আমার সাথে দুষ্টামি। ওর লাল গাড়িটা ওর জানের চাইতেও প্রিয় ছিলো। বাড়ীর পেছনের বাগান বাড়ীটা নিজে করেছে। আমাকে যে কত কি বলে ও। ভীষণ আদরের ছেলে আমার। দেখতেও হয়েছে সবচাইতে সুন্দর।”
পৌষ মনে মনে উচ্চারণ করলো,
“ভীষণ সুন্দর।”
হেমন্ত বাসায় কথাবার্তা একদমই বন্ধ করেছে। সেই সাথে নিয়মিত কোর্টে যাচ্ছে। পৌষের হক সে ছাড়বে না। এতদিন জুলুম হবে ভেবে চুপ থাকলেও এখন যেন হেমন্ত ক্ষেপেছে প্রচুর। কারো কথার তোয়াক্কা সে করছে না৷ এরমধ্যেই বড় চাচার সাথে এক দফা লেগেছে আজ। হেমন্ত এতটা উচ্চস্বরে কথা বলে না। ও কিছুটা শান্ত ধরণের। ঠিক বাড়ীর বড় ছেলেরা যেমন হয় তেমন। এই হেমন্ত বদলে গেলো সহসা। বড় চাচি ছেলের সাথে কথা বলার চেষ্টা চালাচ্ছেন অনেক কিন্তু লাভ হচ্ছে না। হেমন্ত বলেছিলো তাকে সন্তানহীনা হওয়ার কষ্ট দিবে। কথাটা কড়ায়-গণ্ডায় আমল করছে হেমন্ত। পিহার সাথেও দূরত্ব বাড়ছে। পিহার একমাত্র বন্ধু ছিলো পৌষ। বড় বোন কম বন্ধু বেশি। ছোটখাটো খুটিনাটি সব কথা পৌষকে বলতো। সমাধানটাও পৌষই করতো। কখনো ফলাফল নিয়ে ভাবতো না। বাড়ীতে এক আগাছার মতো পড়ে থাকা পৌষটা যে এতটা জুড়ে ছিলো তা কেউ টের পায় নি। হিংসা, অহংকার, অহমিকা আজ এই পর্যন্ত নিয়ে এলো।
ক্লান্ত হেমন্ত বাড়ীতে ঢুকতেই বড় চাচি ডাকলেন,
“হেমন্ত?”
পায়ের গতি কমলো না। চাচি আবার ডাকলেন,
“হেমন্ত, বাবা কথাটা শুনে যা।”
হেমন্ত চলে গেলো। শ্রেয়াকে দেখেই বললো,
“ঠান্ডা পানি এনে দাও শ্রেয়ু।”
শ্রেয়া তখন ছুটলো পানি আনতে। বড় চাচি ওকে দেখেই শরবত এগিয়ে দিলেন। শ্রেয়া পানি সহ শরবত নিয়ে আসতেই হেমন্ত একটু হাসলো। পানিটুকু পান করেই বললো,
“কষ্ট করে এখনই নিচে রেখে এসো।”
শ্রেয়া কথামতো কাজ করলো। বুঝলো, হেমন্ত ওর মাকে দেখাতেই কাজটা করেছে। গোসল করে শ্রেয়ার সাথে রইলো ও। মাথাটা শ্রেয়ার কোলে দিয়ে বললো,
“টিপে দাও তো।”
শ্রেয়া হাত চালালো। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“কোর্টে গিয়েছিলেন?”
“হুঁম।”
“কাজ কবে হবে বলে নি?”
“কাগজপত্র কিছুই আমার হাতে না শ্রেয়ু। পৌষের নামে দলিল করা সম্পদ। আমি শুধু ভাবি মানুষ কতটা অমানবিক হলে এই কাজ করে। যার হক তাকে তো দিলোই না এতটা বছর। নিজেরা ভোগ করলো। এখনও দিতে চাইছে না।”
“উকিল কি বললো?”
“যেই উকিলের কাছে কপিটা ছিলো সে মা’রা গিয়েছে। তার ছেলে সামলায় এখন। খুঁজছে। কপিটা পেলে খুব সহজ হতো শ্রেয়ু। আমার বাচ্চাটার মুখ দেখি না কতদিন। তুমি ওকে দেখলে জড়িয়ে ধরো তো এরপর আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরব। সরাসরি জড়িয়ে ধরার অধিকার নেই। আচ্ছা, শ্রেয়ু একটা কথা বলো তো, তুমি কি কোনভাবে আমার উপর বিরক্ত?”
শ্রেয়া হেসে ফেললো। হেমন্তের কপাল টিপে দিতে দিতে বললো,
“আ’ম প্রাউড অব ইউ হেমন্ত।”
হেমন্ত হাসলো। চোখ বুজতেই শ্রেয়া বাঁধা দিয়ে বললো,
“ওরা অপেক্ষায়। আগে দেখে আসুন।”
অনুমতি পেতেই হেমন্ত উঠে গেলো। শ্রেয়া নিজ থেকে যতক্ষণ না বলে ততক্ষণ হেমন্ত যায় না। এটা শ্রেয়ার অধিকার। সে চাইবেই তার স্বামী সবার আগে তার কাছে থাকুক। হেমন্ত যখন দরজার নবটা ঘুরালো তখনই একসাথে দুটো পাখি উড়ে এলো তার বুকে।
প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৬
এই দুটোর জ্বর উঠেছে। খাওয়া দাওয়া ঠিক ভাবে হচ্ছে না। ছোট চাচি মেরেছে পর থেকেই জ্বর। হেমন্ত শুনেছে থেকে রেগেছিলো বেশ। ছোট থেকে নিজেদের রংঢং বাদ দিয়ে সন্তান পাললে তো সন্তান পৌষের ন্যাওটা হতো না। তখন ঠিকই মা-বাবা চিনতো ভালো মতো। পৌষের ঘরটার জৌলুশ কমে নি এক ছটাক। কেউ কমতেই দেয় নি। আগলে রেখেছে সযত্নে।