প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৮

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৮
সাইয়্যারা খান

টানা দুই দিন বেশ ভালো কাটলো পৌষের। তৌসিফ নামক উটকো ঝামেলাটা নেই এখানে। তায়েফা যতক্ষণ এখানে থাকে পৌষের সময় কাটে ওর সাথে। তায়েফা তুরাগের বাসায় গেলেই বিকেল পৌষ বেরিয়ে যায়। তাহমিনার সাথে বেশ ভালো একটা সম্পর্ক হয়েছে ওর। সাহারা আর তাহমিনা দু’জনই ওকে আদর করে। সম্রাটের গল্প করে। তবে একপলক সম্রাটের দেখা পৌষ পায় নি। একটু ভেতর দিকে গেলেই দেখাটা পেতো কিন্তু একেবারেই সম্ভব হয় না আর সেঁধে গিয়ে পৌষও বলতে পারে না দেখা করার কথা। গতকাল বাসায় ফেরার সময়ই পলককে দেখেছে পৌষ। টেনে নিজেদের ফ্ল্যাটে এনেছে। দুজন রাত বারোটা পর্যন্ত আড্ডা দিয়েছে, একসাথে খেয়েছে। পৌষের আড্ডার শুরু থেকে শেষ ওর ভাই-বোন। পৌষ বলতে পছন্দ করে আর পলক শুনতে। তাই তো পৌষের খুব পছন্দের একজন হয়ে উঠেছে পলক। রাতে পৌষ রেঁধে পলককে নিয়ে খেয়েছে। বেশ ভালো সময় কেটেছে তাদের।

ভোরের সূর্য উঠেছে বেশ খানিকটা সময় আগে। বিছানায় গড়াগড়ি খেতে খেতে পৌষ উঠে নি আর। ফজরের নামাজের পর ঘুমিয়েছে। পৌষ এই দফায় আর টিকতে পারলো না। ঘরের ভারী পর্দা ঠেলে আলো ঢুকছে ভেতরে যেন। পৌষ পর্দা টানতে ভুলে গিয়েছিলো। সুযোগ নিলো রোদ, ঘুমাতে আর দিলো না। আড়মোড়া ভেঙে উঠে মাত্রই বাথরুমে যাবে তখনই দরজায় ধুপধাপ শব্দ হলো। পৌষ তারাতাড়ি গিয়ে দরজা খুললো। চোখের সামনে মিনু দাঁড়িয়ে। পৌষ ওকে দেখেই দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে? কাকে গাড়তে যেতে হবে?”
“মামা।”
“চটকানা মারব একটা৷ আমার জামাইকে কেন গাড়ব?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিনু হাতের ফোন দেখালো। ফোনের ওপাশ থেকে কাশির শব্দ শোনা গেলো। পৌষ কানে তুলেই মিনুর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে লম্বা সুরে সালাম দিয়ে বললো,
“কেমন আছেন, জামাই?”
তৌসিফ আরেকবার কাঁশি দিলো। পৌষ জিজ্ঞেস করলো,
“জাহাজ থেকে পড়ে গিয়েছেন? পানিতে পড়ে ঠান্ডা লাগলো নাকি?”
তৌসিফ হা করে শ্বাস টানলো। একটু দম নিয়ে সালামের উত্তর দিয়ে বললো,
” ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম তোমার?”
হাই তুলে পৌষ উত্তর দিলো,
“নাহ। আমিই উঠেছিলাম।”

“ওহ। মিনুর সাথে রাগারাগি করলে যে। কিছু করেছে?”
“করেছে মানে? কাল আমাকে হুমকি দিয়ে বললো আপনার কাছে নালিশ করবে। আজ নাকি কে আসবে বাড়ীতে।”
“হ্যাঁ, শুনো। যেই আসুক তার সাথে তুমি খারাপ ব্যাবহার করো না পৌষরাত।”
“কি বলতে চাইছেন, আপনি চব্বিশ ঘণ্টা সবার সাথে খারাপ ব্যাবহার করি?”
“বোকা, সেটা বলি নি।”
“তো কি বলেছেন?”
তৌসিফ একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। একমাত্র এই মেয়েটাই ওকে কথায় আটকে দেয়। একটু ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে বললো,
“আমার আরো দু’দিন লেগে যাবে হানি।”

“সত্যিই?”
ভীষণ উত্তেজিত হলো পৌষ। তৌসিফ বুঝলো না বউ তার দুঃখ পেলো নাকি খুশি হলো। তৌসিফ অদূরে তাকিয়ে রইলো। সামনেই সমুদ্র। একটু গম্ভীরতা আনলো কণ্ঠে। বললো,
“বাড়ীর বাইরে যেও না।”
“যাই না।”
“তোমার ফোনটা আজ হেমন্ত দিয়ে যাবে দারোয়ানকে। বাসায় ফোন দিয়ে কথা বলো। ভালো লাগবে।”
“ফোন লাগবে না আমার।”
“এত রাগ করতে নেই হানি।”
“রাগ করছি না। আমি বাথরুমে যাব। ফোন রাখব?”
“রাখছি তাহলে। খাবার দাবার ভালো মতো খাবে।”
বিদায় জানিয়ে দরজা খুলে ফোনটা টেবিলে রেখে পৌষ ঘরে চলে এলো। মেজাজ খারাপ হচ্ছে কোন কারণ ছাড়াই।
তায়েফা আজ একটু বাইরে যাবে। পৌষকেও নিতে চেয়েছিলো কিন্তু তৌসিফ না করেছে। নিজে ছাড়া একা বউ ছাড়তে সাহস পাচ্ছে না ও। তার উপর পৌষের মন মেজাজের নেই ঠিক। তাই তৌসিফ নিজেই না করলো।

পৌষ সকালের খাবার শেষ করে দুপুরের জন্য রান্না বসাবে তখনই কলিং বেল বাজে। পৌষ ভাবে হয়তো পলক এসেছে। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলবে তার আগেই মিনু দরজা খুলে। ঝাপিয়ে পড়ে কারো বুকে। পৌষ আধ রাস্তা এসে হা করে তাকিয়ে রইলো। লম্বা দেখতে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। আধুনিকতার ছাপ চোখে মুখে কিন্তু পোশাক যথেষ্ট শালীন মনে হলো। মিনুর মুখে আপা ডাক শুনেই পৌষ বুঝলো এটাই তাহলে মিনুর আপা। এগিয়ে আসতেই দেখলো দু’জন ভেতরে ঢুকেছে। মেহমানটাকে পৌষের ততটা পছন্দ হলো না। মেহমানকে পৌষই না বলবে বসতে। ওর বলার আগেই মেয়েটা বসেছে। ওখান থেকেই ডাকছে,

“বুয়া, এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিয়ে যান।”
পৌষ এক ভ্রুঁ উঁচু করে মুখ এদিক ওদিক করলো। আজ-কাল মেহমানও ডিজিটাল হয়ে গিয়েছে। নিজে বেড়াতে এসে নিজেই বুয়া ডেকে পানি চায়। একটু পর নিশ্চিত খাবারও চাইবে। বুয়া পানি এনে দিতেই পৌষ এগিয়ে এসে ঠিক বরাবর বসলো। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলো,
“আপনিই মিনুর আপা?”
সোহা মুখ তুলে তাকালো। পৌষের আগাগোড়া দেখে সোহা বেশ দাম্ভিক ভাবে বললো,
“তৌসিফ কি দেখে বউ করে আনলো তোমাকে? এর জন্যই আমাকে দূরে সরালো?”
পৌষের চোখের চাহনি বদলাতে মিনিটও লাগলো না। আচমকাই গলার স্বর পরিবর্তন হলো ওর।
“পা থেকে মাথা পর্যন্তই দেখে এনেছে। আপনিও কি দেখবেন নাকি? চাইলেও দেখাতে পারছি না। তারচাইতে বড় কথা, কাজের মেয়ের বোন আপনি। আপা ডাকলো শুনলাম। সুতরাং আপনার পরিচয়ও আমি পেয়ে গিয়েছি। কাজের মেয়ে হয়ে আমাকে এই জাতীয় কথা বললেন, বলতে হবে আপনার জিহবায় ধার আছে।”
সোহা ক্ষুদ্ধ চোখে তাকালো। এই মেয়ে ওকে কাজের মেয়ে বললো? সোহা দাঁড়িয়ে যেতেই পৌষ পা তুলে বসলো বিছানায়। গা ছাড়া ভাব নিয়ে বললো,

“দরজা ঐ দিকে। বেরিয়ে যান।”
“তুমি কে হও আমাকে বের করার?”
পৌষের গলার স্বর উঁচু হলো সোহা থেকেও। বলে উঠলো,
“তৌসিফ তালুকদারের বউ আমি।”
সোহা চমকে গেলো পৌষের ধমকে। বুয়ারা সহ চলে এসেছে এদিকে। পৌষ বুয়াকে দেখেই বললো,
“আপনার মামাকে ফোন লাগান তো খালা। বলুন বাড়ীতে নতুন কাজের মেয়ে এসেছে যাকে আপাতত দরকার নেই।”
সোহা ধমক দিলো,
“এই মেয়ে তুমি চেনো আমাকে?”
“কে? কে আপনি যে চিনতে হবে?”
সোহা প্রশ্নের উত্তর দিলো না। বললো,
“তোমার সাহস কি করে হয় মিনুকে ধমকানোর?”

“দেখাব কিভাবে হয়? দুটো চড় দিয়ে দেখাই? আপনার বোন বেশ বেয়াদব। আমার সাথে আরেকবার লাগতে আসলে দুই গাল লাল বানিয়ে দিব।”
বুয়া দেখলো পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। তারাতাড়ি তৌসিফকে ফোন দিলো আড়ালে গিয়ে। মিনিটের ব্যবধানে ফোন এলো সোহার নাম্বারে। রিসিভ হতেই সোহা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো অতঃপর বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে। দরজা পর্যন্ত যেতেই মিনু ওর হাত ধরে। থাকতে বলে। সোহা ওকে রেখেই চলে যায়। পিছনে আর তাকায় না। মিনু ওভাবেই দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো।
এদিকে পৌষ ভাবছে ভিন্ন কথা। কে এই মেয়ে? মিনু ওকে থাকতে বললো। তাহলে কি এই মেয়ে এর আগেও এখানে থেকেছে? একটা খালি ফ্ল্যাটে? পৌষের মনের ভেতর সন্দেহ ঢুকে গেলো ঠিক তখনই। একদম হুল ফুটানো সন্দেহ।

বিকেলে দারোয়ান এসে ফোন দিয়ে গেলো পৌষকে। এরমানে হেমু ভাই এসেছিলো। দৌড়ে বারান্দায় গেলো পৌষ। হেমন্ত ততক্ষণে ঘাট পাড় অতিক্রম করে ফেলেছে। তুহিনের মিলের সামনে ও। পৌষের বুকের ভেতর খাবলে উঠলো তৎক্ষণাৎ। একবার ভাইটাকে দেখা হলো না। পৌষের ভেতরে কিছু চাপ সৃষ্টি হয়। এমন হলেই অস্থির লাগে শুধু। অনেকের মুখেই শুনেছে কাঁদলে বুক হালকা হয়। ভারী ভাব কমে কিন্তু পৌষের চোখে পানিই আসে না। কোন কিছুতেই ওর কান্না আসে না। রেলিং শক্ত করে ধরে রাখলো পৌষ। হেমন্ত আজ সাদা পাঞ্জাবি পরেছে। পিঠটা তখনও দেখা যাচ্ছে। মেইন রোডে গিয়ে হেমন্ত দাঁড়িয়ে সরাসরি তাকালো পৌষের বারান্দায়। হয়তো জানতো তার পৌষ দাঁড়িয়ে থাকবে। এক পলক দেখা চাইবে ভাইয়ের। এতদূর থেকে দৃষ্টি ততটা পরিষ্কার বুঝা গেলো না কিন্তু পৌষ হাত মুঠ করে চলে এলো সেখান থেকে। হেমন্ত পাঞ্জাবির হাতায় চোখ ডললো। দাঁড়িয়ে রইলো এই বাজারের মাঝে ঘন্টাখানিক। ও জানে পৌষ রাগী। রাগ করে ও আসবে না কিন্তু হয়তো কোথাও একটা আশা বাকি ছিলো। হয়তো ভেবেছিলো পৌষ আসবে।

বারান্দার থাই টেনে পৌষ ফোনটা খুললো। ওদের সাত ভাই-বোনের হাস্যজ্বল একটা ছবি৷ পৌষ তাকিয়ে রইলো। ছবিটা কিছুদিন আগে জীবন্ত ছিলো তবে এখন মৃত। তাদের সাত জনের মধ্যে পৌষ নামটা এখন মৃত। আর কখনো পৌষ তাদের এভাবে পাবে না৷ সম্ভব হলেও পৌষ নিজেকে জীবিত করবে না আগের মতো। যত দিন যাবে ওরা ভুলবে। একদিন সবটা ঠিক হবে শুধু বিলীন হবে পৌষরাত হক নামটা। পৌষ হারিয়ে যাবে তাদের মাঝখান থেকে। মেঝেতে হাত-পা মেলে পৌষ বসেই রইলো। গান গাইলো আজ ক্ষীণস্বরে,
“এই যে দুনিয়া, কিসেরও লাগিয়া
এত যত্নে গড়ায়াছেন সাঁই।”
কল্পনায় পৌষ ভাবলো বেশখানিকটা সময় অতঃপর উঠে চলে গেলো সেখান থেকে। আসরের নামাজ পড়েই পৌষ বেরিয়ে গেলো। বদ্ধ জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতে পারে না ও। নিচে নামতেই আজ কৃষ্ণচূড়া গাছটার ওখানে তাহমিনার দেখা পেলো পৌষ। হেসে ওখান থেকেই হাত নেড়ে ডাকলো,

“আপা?”
তাহমিনা তাকালো। চোখে হাসলো। পৌষ এগিয়ে এসেই ওর হাত ধরে বললো,
“বাসায় চলুন। আজ আমার হাতে চা খাবেন।”
তাহমিনা ওর গালে হাত বুলিয়ে বললো,
“একটু হাঁটতে বের হলাম। পেছন দিকটা দেখা হচ্ছে না আজ অনেকদিন৷ জংলা পরিষ্কার করাতে হবে।”
“পেছন পরিষ্কার আপনি করান?”
তাহমিনা পৌষকে নিয়ে হাঁটছে। পৌষ আজ ওর সাথে হাঁটতে হাঁটতে এলো তালুকদার বাড়ীর পেছন দিকে। ততটাও পেছনে না। পেছন ঘাটেও আসে নি। এখান থেকে সামনে গেলেই সেই জঙ্গল। পাশেই বিছুটি পাতা গাছ। সূক্ষ্ম কাটা দিয়ে ভরা। পৌষ বললো,

“বিছুটি পাতা গাছ কতগুলো আপা। এগুলো ফেলবেন না?”
“ওগুলো মাঝেমধ্যে লাগে।”
পৌষ হাসতে হাসতে বললো,
“এই পাতা একবার লাগিয়ে দিয়েছিলাম এক বুড়োর টাক মাথায়৷ চুলকাতে চুলকাতে বুইড়ার জান শেষ।”
তাহমিনা অবাক হয়ে বললো,
“ওমা, ভারী দুষ্ট তো তুমি।”
পৌষ হাসির মাঝেই বললো,
“পোলাপান দেখলেই টিটকারি মারতো।”

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৭

ওরা ওখানে দাঁড়িয়েই কথা বলছিলো। তাহমিনা ওকে নিয়ে আরেকটু সামনে গেলো। পুরাতন একটা বিল্ডিং দেখতেই পৌষ তাকিয়ে রইলো। কিছুটা অদ্ভুত দেখতে একটা বাড়ী। তাহমিনা ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে বললো,
“এটা সম্রাট ভাইজানের বাগান বাড়ী। আজ তো সময় নেই নাহয় নিয়ে যেতাম। গিয়ে ঘুরে দেখে এসো। ভালো লাগবে। একা বাসায় তো সময় কাটে না তোমার।”
পৌষের কানে শুধু বিঁধলো বাগান বাড়ী। সম্রাটের বাগান বাড়ী।

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here