প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৩৪

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৩৪
সাইয়্যারা খান

ক্ষত স্থানের ব্যান্ডেজটার উপর লাল দাগ ফুটে উঠেছে। পৌষ নিজে সেই ব্যান্ডেজ খুলে নতুন করে বাঁধলো। তৌসিফ কপালে হাত ঠেকিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। একটু আগে পৌষই ওকে সাহায্য করেছে। গোসল করতে যাবে তখনও মাথা ঘুরছিলো। এই পৌষ মোটেই সুবিধার না। তৌসিফ একটু বলেছিলো যাতে ওর মুখে একটা মাস্ক লাগিয়ে দেয় কিন্তু বেয়াদব বউ তা তো করেই নি উল্টো গোসলের সাবান দিয়ে তৌসিফের মুখ ডলে দিয়েছে। এত পাজি মেয়ে হয় তৌসিফের জানা ছিলো না। চেহারাটায় কোন প্রভাব না পড়লেই হলো। কাল একটু ডার্মাটলজিস্টের কাছে যেতে হবে। পৌষ তৌসিফের পায়ের গিয়ে টাউজার টেনে তুললো হাঁটু পর্যন্ত। সামান্য চামড়া উঠেছে। তৌসিফ বলে নি৷ পৌষই ওর পায়ের টলমলে ভাব দেখে বুঝেছিলো। তুলা দিয়ে পরিষ্কার করতে করতে পৌষ জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি বললেন সভায় যাচ্ছেন। আপনার গাড়ি অক্ষত তাহলে আপনি কিভাবে চোটপাট পেলেন?”

তৌসিফ চুপ করে আছে। চোখের উপর এখনও হাত। কালো এক আবছায়া ভাসছে যেন অক্ষিকোটরে। আজ সভাটা ছিলো উমায়েরের। তৌসিফ শুধু একাই যায় নি, তুরাগও গিয়েছিলো তবে প্রকাশ্যে না৷ সারাজীবন এক দল করে হঠাৎ বিপক্ষের দলে গেলে জনগণ ভালো দৃষ্টিতে দেখবে না এটাই স্বাভাবিক। তুরাগ কক্ষে থাকাকালীন তৌসিফ নিজের গাড়িতে উমায়েরকে তুলে দেয়। উমায়ের তখন সন্দেহের চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“তোমার গাড়িতে কেন উঠব আমি?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কারণ পূর্বের রেকর্ড ভালো না। এভাবেই গাড়িতে বোমা মেরে আজ প্রতিমন্ত্রীর এই ক্ষমতা। তুমি এঝন উপজেলা চেয়ারম্যান। সাফিনের কেস চলছে। জনগণের মধ্যে চাপা ক্ষোভ আছে কারণ তুমি কিছুই করছো না৷ তোমাকে নিয়ে আমার চিন্তা নেই উমায়ের কিন্তু উপর মহলে কথা দিয়েছি।”
উমায়ের মাথা নিচু করে তৌসিফের গাড়িতে উঠে। গাড়িটায় ভিন্ন শান্তি অনুভব করে সে৷ কোথায় ধাপ্পাবাজির টাকায় কেনা গাড়ি আর কোথায় হালাল টাকায় কেনা গাড়ি? ড্রাইভারকে বললো,
“টেম্পারেচারটা কমিয়ে দিয়ে একটা গান ছাড়ো তো।”

তৌসিফ গিয়ে বসে উমায়ের গাড়িতে। আজ সভার পরই শো ডাউন হবে। পুরো এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখে মতবিনিময় করবে। এটাই পরিকল্পনা। দুটি জায়গা ঘুরে গাড়ি যেই না একটু লোকালয় থেকে দূরে আসলো তখনই উমায়েরের গাড়িটার চাকা ব্লাস্ট হয়ে যায়। গাড়ি ব্রেক কষার আগেই সামনে থেকে একটি পিআপ ভ্যান এসে গাড়িটা উল্টে দিয়ে চলে যায়। দেড়শো বাইক, বিশটা মাইক্রো সহ তৌসিফ আর উমায়ের গাড়ি ছিলো। এতকিছু টপকে গিয়ে হামলা হয় উমায়ের গাড়িতে যেটায় ছিলো স্বয়ং তৌসিফ। সিট বেল্ট বাঁধা ছিলো বলে মাথায় আঘাত লাগে নি কিন্তু হাতে আর পায়ে ভালোই চোট পেয়েছে। উমায়ের সহ বাকিটা দৌড়ে এসে বের করেছে তৌসিফকে।

এই অবস্থায় আর হাসপাতালে নেয় নি বরং সরাসরি গিয়ে উঠেছিলো উমায়ের বাড়ীতে। সেখানে ঘন্টার ব্যাবধানে উপস্থিত হয় জয়নাল সহ পল্লবের বাপ,চাচা। ডাক্তার আনিয়ে চিকিৎসা হয়। জয়নাল নিজে থেকে তৌসিফকে তদারকি করে। তুরাগ জানা মাত্রই ছুটে যায় সেখানে। ভাই গুলো কাউকে ছাড়া কেউ থাকতে পারে না। আজ তুহিন থাকলে এখানে লন্ডভন্ড করে দিতো। তৌসিফ তাদের সাথে বেশ খানিকটা সময় কথা বলে অতঃপর তুরাগকে বাড়ী পাঠিয়ে দিয়ে নিজে সেখানে থাকে বেশকিছুক্ষণ। এই সময়টুকু তৌসিফের বানানো ঘটনাকে বেশ বেগ পেতে সাহায্য করবে তা তৌসিফ জানে। বিপক্ষের দলকে ঘোল খাওয়ানো অতটাও সহজ না। একটা পুরুষ থেকে নারীর বুদ্ধি অনেকটাই নিচে তাই তো তাহমিনা আপা ওমন বোকামি করতে চাইছিলো। ডাল দুইদিন পরপর কাটা থেকে উত্তম হলো শিকড় তুলে ফেলা। তৌসিফ আপাতত গোড়া ধরে টান দিয়েছে। শিকড় তোলাটা বাকি।

“আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?”
তৌসিফ পৌষের কথায় চোখ থেকে হাত সরালো। আলো চোখে বিঁধছে দেখে চোখ ছোট ছোট করতেই পৌষ গিয়ে সাদা বাতি বন্ধ করে সেই সোনালী আলো জ্বালালো। এগিয়ে এসে তৌসিফের কপালে হাত দিয়ে দেখে বললো,
“জ্বর নেই কিন্তু হালকা গরম। আপনার চোখ এমন দেখাচ্ছে কেন?”
“কেন মনে হচ্ছে রেগে আছি?”
“মুখ ঘষামাজা করতে দেই নি বলে।”
“রেগে নেই আমি।”
“যাক, সুখ পেলাম আপনার কথা শুনে। এখন বলুন তো কি খাবেন? যা চাইবেন সব পাবেন আজ।”
“সব পাব?”
কপাল কুঁচকে তৌসিফ জিজ্ঞেস করে। পৌষ মাথা নেড়ে সায় জানায়। তৌসিফ সরাসরি মুখের উপর বলে বসলো,
“তোমায়। তোমায় চাইলাম আজ।”
পৌষ দুই সেকেন্ড সময় নিয়ে একটু থেমেই বললো,
“আমি তো আছিই। কি খাবেন তা বলুন নাকি দুপুরের গুলো দিয়েই দিব?”
“ভর্তা আছে?”
“আছে।”

পৌষ যেন চোখের ভাষা বুঝেই উঠে গেলো। ভাত নিয়ে আসতে আসতে তায়েফাকে জানিয়ে এলো খবরটা। মূহুর্তেই হায় হায় লেগে গেলো তৌসিফের ফ্ল্যাটে। তায়েফা দৌড়ে এসে ভাইকে জড়িয়ে কাঁদছে। তৌসিফ বোনকে জড়িয়ে ধরে থামাচ্ছে। চিল্লাপাল্লাতে মীরা সহ আদিত্য আর অদিতিও চলে এসেছে। তুরাগ বাসায় ফিরে নি এখনও। উপর তলা থেকে পলকও চলে এসেছে তবে এক কোণায় দাঁড়িয়ে থেকে চলে গিয়েছে। তাকে দেখলে যে কেউ এখন প্রশ্ন তুলবে। তৌসিফ পৌষের দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকায় একবার। পৌষ পাত্তা দেয় না সেসবে। পৌষ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিলো কি হয়েছিলো, কিভাবে হয়েছিলো। তৌসিফ খোলাখুলি কিছুই বলে নি৷ নিজের অন্যান্য কাজ নিয়ে বললেও এই রাজনৈতিক ব্যাপার গুলো খুব সূক্ষ্ম ভাবে আড়াল করে যাচ্ছে তৌসিফ। উত্তর জানতে পৌষের মন উতলা তাই তো আপাকে জানিয়ে দিলো। একেবারে ঘুম থেকে তুলে জানিয়ে এলো।

তায়েফা থেমেছে তবে চোখের পানি থামে নি। এতগুলো মানুষের সামনে বউয়ের হাতে ভাত খাচ্ছে তৌসিফ। পৌষ বাকি সবাইকেও জিজ্ঞেস করে কেউ খাবে কি না৷ সবাই শোকে থাকলেও অদিতি জানায় সে খাবে। রাতে এখনও সে খায় নি। তৌসিফের মুখে শেষ লোকমা তুলে পৌষ ভেজা হাতে ঠোঁট মুছে দিলো। ওরনায় মুখটা মুছে দিয়ে অদিতিকে নিয়ে যায় ড্রয়িং রুমে। পেছনে আদিত্য এসেছে, সেও খাবে। পৌষ ওদের নিয়ে খেতে বসে। তৌসিফ তেমন কিছুই বলে নি। একই কথা গাড়ি উল্টে গিয়েছিলো। পৌষ বিরক্ত হলো বেশ। ব্যাটা রাতে কাছে আসলেই পৌষ দেখাবে মজা। পেট থেকে কথা না বের করে ছাড়বে না৷

“আপনার মুখ থেকে গন্ধ আসছে।”
কথাটা বলেই ওরনা দিয়ে মুখ,নাক চেপে ধরে পৌষ। তৌসিফ হতভম্ব হয়৷ দিকবিদিকশুন্য হয়ে বলে,
“ব্রাশ করে আসব?”
“ফালতু কথা বলবেন না। আপনার মুখে কিসের গন্ধ?”
“মাউথ ওয়াশটা দাও আমাকে।”
“উত্তর দিবেনই না?”
“আগামী কাল তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে পৌষরাত।”
“গুল্লি মারি ঐ সারপ্রাইজে।”
“রেগে যাচ্ছো শুধু শুধু।”
তৌসিফ উঠে যেতে নিলেই পৌষ আটকালো। মুখ এগিয়ে নিলো তৌসিফের দিকে। নাক উঁচু করে শুঁকে শুঁকে বললো,

“নেশাপানি খেয়েছেন?”
“কি বলো এসব?”
“আমি গন্ধ পাচ্ছি। এই গন্ধ যদিও অচেনা তবুও ধারণা করছি। আপনার কাছাকাছি থাকাতো দূরের কথা, এই বিছানায়ই থাকব না আমি। নেশাখোরের সংসার আমি করব না৷”
বলেই সরে গেলো। তৌসিফ নিজেও উঠে বসলো। বিয়ের পর হাজার যাই হোক বউ ছাড়া সে থাকে নি। রাতটায় বউকে টেনে কাছে নিয়ে ঘুমায়। বউ কি না খাটে তো দূর তার সংসারই করবে না? তৌসিফ নাকি নেশাখোর? এহেন অভিযোগ শুনার ছিলো তার? তারাতাড়ি গিয়ে পৌষকে ধরতে গিয়ে পায়ে টান খেলো। মুখে ব্যথাতুর শব্দ তুলে তৌসিফ ডেকে ওঠে,

“হানি, প্লিজ ডোন্ট গো।”
“নেশা করার সময় মনে ছিলো না হানির কথা?”
ঝাঁঝালো স্বরে বলে পৌষ বেরিয়ে যেতে নেয়। তৌসিফ পেছন থেকে হাত ধরতেই পৌষ মোচড়ামুচড়ি করে। ছাড়াতে চায়। তৌসিফ ছাড়ে না। এই মেয়ে বুঝের না তাই বেশ গম্ভীর কণ্ঠে ধমক দিলো তৌসিফ,
“চুপ! একদম চুপ! প্রচুর কথা বলো তুমি পৌষরাত।”
“মিথ্যা বলি না আমি।”
“আমি বলেছি মিথ্যা?”
“সত্যিও বলেন নি।”
“কি শুনতে চাইছো?”
“নেশা করেছেন?”
“কতটা বাজে শোনালো পৌষরাত। আমি কেন নেশা করব?”
“এই লাল চোখ, মুখের গন্ধ। এগুলো মিথ্যা? আপনার মুখে কখনো গন্ধ পাই নি আমি। বিয়ের এতগুলো দিনে অন্তত না৷”

“দুটো বিয়ার শুধু আর কিছুই না।”
“কিহ! দুই বোতল মদ গিলে এইকথা বলছেন?”
“ছিঃ ছিঃ বিয়ার খেয়েছি।”
“নেশা করেছেন।”
তৌসিফ বউকে নিয়ে জোর করে বিছানায় গেলো। মেয়েটা এত জেদি। কথা শুনে না। প্রচুর ঘাড়ত্যাড়া। তৌসিফ হাসতে হাসতে ওকে নিয়ে বসলো। ফুলিয়ে রাখা নাকে টোকা দিয়ে বললো,
“বিয়ার খেলে কেউ নেশাখোর হয়ে যায় না৷”
“খুব ভালো কিছুও খান নি যে প্রশংসা করব।”
“কথা সত্য।”
“কেন গিলেছেন এসব? হারাম জানেন না?”

তৌসিফ পৌষের চোখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো। তিড়িংবিড়িং করা পৌষ থেমে গেলো। ঐ চোখটায় খুব সময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতে সে অক্ষম। তৌসিফ ভালো হাতে পৌষকে নিজের কাছে টেনে নিলো। আজ উমায়ের খুব বিশেষ এক জায়গায় তাকে নিয়ে গিয়েছিলো। সেখানেই নিজ হাতে তৌসিফকে এক ক্যান বিয়ার খুলে দেয়। ইতিহাস খুব খারাপ এই বিষয়ে। আপন মানুষ পিঠে ছুরির আঘাত দিয়েছিলো। তৌসিফ সেটা উমায়েরকেই খাওয়ায়। নিজে তুলে নেয় বিয়ার কেস থেকে ইন্টেক ক্যান। কথা চালিয়ে যেতে যেতে দুই ক্যান তৌসিফ সাবাড় করেছে। আজ যদি দশ ক্যানও নিতে হতো, তৌসিফ নিতো। তার এতদিনের পরিকল্পনার আজ অর্ধেকই সফল। গুটি সব তৌসিফের দিকে। শুধু অপেক্ষা আর একটুর৷ মাথায় বসে কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার ফল তৌসিফ দেখাবে। সবাইকে দেখাবে।

“অ্যই মামাতো ভাই।”
“আমার মন চায় মাঝেমধ্যে একটা ব্যাক্তিকে খু’ন করে ফেলতে।”
পৌষ হাসছে। খিটখিট করে হাসছে। তৌসিফ ওকে রেখে উঠতে উঠতে বলে,
“বসো। ব্রাশ করে আসছি।”
“লাভ নেই৷ আমার পেট উল্টে নাড়িভুড়ি বেরিয়ে আসবে। প্রচুর বাজে গন্ধ। ব্রাশে যাবে না।”
মুখটা ছোট করে তৌসিফ তবুও ব্রাশ করে আসে। পৌষ নিজের জায়গায় শুয়েছে ততক্ষণে। তৌসিফ আসতেই পৌষ বেশ আদুরে স্বরে বলে,

“কি সারপ্রাইজ বললেন না?”
“বলে দিলে তো থাকলো না। অপেক্ষা করো, কাল তোমার খুশির দিন হবে।”
বলেই পৌষের কাছে এসে বলে,
“সেই খুশিতে এখন আমাকে খুশি করে দাও তোতাপাখি।”
“অত ঠ্যাকা আমার নেই। দূরে যান৷ ছাইপাঁশ গেলার শাস্তিই যদি না পেলেন তাহলে শুধরাবেন কিভাবে?”
তৌসিফ দেনামোনা করে। মনে মনে গালি দেয় উমায়ের সহ বাকিদের। আজ না গিললে বউটাকে কাছে পেতো। তৌসিফ চিৎ হয়ে শুয়ে বলে,

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৩৩

“পৌষরাত, দেখো তো বুকে ব্যথা পেলাম কি না৷ জ্বলছে হঠাৎ।”
তড়িৎ বেগে লাফিয়ে পৌষ দেখতে যেতেই ধরা খেলো। তৌসিফ তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। রাতটায় বাইরে ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকলো। পৌষ তা কান পেতে শুনলো তৌসিফের বুকে।

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৩৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here