প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৩৭
সাইয়্যারা খান
সূর্য আজ আলসেমি করে উঁকি দিচ্ছে ঠিক যেমন আলসেমি দেখাচ্ছে বড় কামড়ায় থাকা দম্পতি। তৌসিফ জিম থেকে ফিরে এসেছে মাত্র। রুমে এসে দেখলো পৌষ এখনও ঘুমাচ্ছে। তৌসিফ এক পলক ওকে দেখলো। কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ালো। গতরাতে পৌষের কাছে ভালোবাসা প্রকাশ করেছে তৌসিফ। পৌষ সেই ভালোবাসা সাদরে দুই হাতে গ্রহণ করেছে কিন্তু ফিরতিতে রিক্ততা বৈ কিছুই দেয় নি সে।
তৌসিফ জানে, ভালোবাসা হতে হয় বিনিময় সূত্রের বিপরীতে। সামনে থেকে কিছু পাওয়ার আশা বাদ দিয়ে ভালোবেসে যেতে হয় কিন্তু তবুও কোথাও গিয়ে তো ভালোবাসার মানুষটা থেকেও মানুষ কিছুটা ভালোবাসা চায়। হোক সেটার পরিমাণ তুচ্ছ তবুও চায়। তৌসিফও তেমন ভাবেই চাইছে। গতরাতে চেয়েছে। পৌষ কোনোভাবেই মানতে রাজি বলে মনে হচ্ছে না। মেয়েটা সংসার করছে, একসাথে থাকছে, যত্নও করছে কিন্তু ভালোবাসছে না৷ তৌসিফ যখন আবদার জুড়ে দিলো একটি সন্তানের তখনও মেয়েটা নিরদ্বিধায় রাজি হয়ে গেলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পাল্টা প্রশ্ন পর্যন্ত করলো না। এদিকে তৌসিফ নিজে পড়েছে বেকায়দায়। এই অনুভূতিহীন পৌষরাতের জন্য তার অনুভূতি জন্মেছে। কাঠখোট্টা, বেয়াদব, চঞ্চলা মেয়েটাকে মন দিয়ে বসে আছে সে। এমন বেকায়দায় পিছলে পড়বে তৌসিফ কোনদিন ভাবে নি। অন্য সময় হলে হয়তো এখন এগিয়ে পৌষকে দেখতো না কিন্তু আজ-কাল মেয়েটাকে এক মূহুর্তে চোখের আড়াল করতে মন সায় দেয় না বরং মনের ভেতর অদ্ভুত লোভ জাগ্রত হয়। প্রেমের লোভ। পৌষের সাথে প্রেম করার লোভ দিন দিন বাড়ছে শুধু। তৌসিফ এসে পৌষের ঘুমন্ত মুখটা কাছ থেকে দেখে হাত রাখলো কপালে। কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিতেই চোখ পিটপিট করে পৌষ। গালে নরম পাতলা চামড়ার একটা হাতের আদর তার ঘুম ভাঙাতে সক্ষম হয়। চোখের সামনে তৌসিফকে দেখে আবারও চোখ বুজে। তৌসিফ ওর পাশে বসলো। গলায় হাতের উল্টো পিঠ ছুঁয়ে দিয়ে বললো,
“উঠবে না হানি?”
“ঘুমাচ্ছি। আপনি উঠুন।”
“আমি জিম থেকে ফিরে এলাম মাত্র।”
“হুঁম।”
মাথাটা তৌসিফের ভাজ করে রাখা হাঁটুর উপর রেখে পৌষ ওর হাত ধরে। তৌসিফ হাত ছাড়িয়ে নেয়। চুলে বেশ খানিকটা সময় নখের আঁচড় কেটে দিতেই পৌষের আরামে ঘুম জড়ো হয় কিন্তু টেনেটুনে চোখ খুলে পৌষ। ক্লান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“কি খাবেন?”
“এনিথিং মাই লাভ।”
পৌষ ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। তৌসিফ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। মেয়েটার হাসি গুলো মারাত্মক। তাকে একদম খুন করে দিতে সক্ষম। পৌষ উঠে বসে। পা দুটো আসাম করে কাঁথা ভাজ করতে করতে বলে,
“আপনি আজকে ফিরবেন কখন?”
“এখনও গো গেলামই না।”
“ঐ তো। যাওয়ার পর আসবেন কখন? তারাতাড়ি নাকি দেড়ী হবে?”
তৌসিফ হাত বাড়ায়। পৌষ ওর বাড়ানো হাতে আধ ভাজ করা কাঁথা দিয়ে নিজে উঠে দাঁড়ায়। চোরা হেসে শুধায়,
“এটা ভাজ করুন।”
আজকেও পৌষকে ভার্সিটিতে তৌসিফই নামিয়েছে। ক্লাস করার ফাঁকে পৌষ ফোনটা বের করলো। তৌসিফের নাম্বারে ফটাফট ম্যাসেজ লিখলো, ‘কখন ফিরবেন?’
তৌসিফ উত্তর করার বদলে সরাসরি ফোন দেওয়াতে পৌষ একদম অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। মেজাজ ভয়ংকর খারাপ হলো। এই লোককে কে বলেছে ফোন দিতে? ক্লাসের সকলের মনোযোগ কেন্দ্র এখন পৌষ। ফোন সাইলেন্ট করে পৌষ আবারও মনোযোগ দিলো ক্লাসে। তৌসিফ ততক্ষণে দুইবার কল দিয়েছে। পৌষ ফটাফট ম্যাসেজ লিখলো, ‘ক্লাসে আছি। মরার কল দিচ্ছেন কেন?’
তৌসিফ এবারে ম্যাসেজে লিখলো, ‘আমাকে এত মিস করছো হানি?’
পৌষের রাগ উঠলো। সোজা প্রশ্নের সোজা উত্তর না দিয়ে এভাবে পেঁচাচ্ছে কেন তৌসিফ? রাগ হচ্ছে পৌষর। সরাসরি লিখলো, ‘আদির সাথে বাসায় চলে যাব আমি। ড্রাইভার আসতে না করিয়েন আর বিকেলে ফিরলে এখনই বলুন৷ কিছু রান্না করে রাখব।’
এবারে কাজ হলো। তৌসিফ বউকে খাটাতে চাইলো না বিনাকারণে। জানালো তার রাত হবে। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কোন এক নতুন সাইড উদ্ভোদন হচ্ছে। সেখানেই সময় যাবে।
পৌষ শুনেই হাফ ছেড়ে বাঁচলো। আজ তাহলে কাজটা হয়েই। রহস্যময় সেই বাগান বাড়ীর ভেতরে পৌষ আজ ঢুকবেই। ক্লাস শেষ হতেই পৌষ তারাহুরো করে যখন বের হতে গেলো তখনই ধাক্কা খেলো রাফিদ শিকদারের সাথে। দুই কদম পিছিয়ে গিয়ে ঝাঁঝালো গলায় ঝাড়ি দিলো পৌষ,
“চোখ নাকি বুত্তাম হ্যাঁ? চোখের মাথা খেয়েছে। ধাক্কাটা দিলো কিভাবে?”
বাজখাঁই গলায় কথাগুলো বলে যখনই সামনে তাকালো তখনই সামান্য থমকালো পৌষ। রাফিদকে এখানে আশা করে নি ও। সেদিন ওর কলার ধরে টানলেও আজ যখন জানে উপজেলা চেয়ারম্যানের ছোট ভাই সে তখন কিছুটা তেজ কমেছে অবশ্য। পৌষ আবার ভাঙলেও মচকায় না তাই কণ্ঠে রাগী ভাব এনে বললো,
“দেখে চলতে পারেন না৷ সরুন সামনে থেকে।”
রাফিদ বাঁকা হাসলো। ওর হাসিমুখ দেখে পৌষ অবশ্য ভেতর ভেতর সামান্য চমকালো তবুও পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলো। ও যাওয়ার আগেই রাফিদ শিস বাজিয়ে বললো,
“এত তারাহুরো করে কোথায় যাচ্ছো আদির পুষি?”
“আপনাকে বলতে বাধ্য না। রাস্তা ছাড়ুন।”
“বাহ, তুই থেকে আপনি৷ আমার তো চরম উন্নতি হয়ে গেলো পৌষ। এই উন্নতির কারণ কি?”
“*লের উন্নতি হয়েছে। সর নাহয় পিছনে দুটো লাত্থি মারব।”
মুখ কুঁচকালো রাফিদ। কণ্ঠে বিরক্ত ভাব টেনে বললো,
“তোমার সব ভালো শুধু ভাষা বাদে। এই যে এত সুন্দর একটা মুখ, এটা দিয়ে সুন্দর কথা বের করতে পারো না? সবসময় রেগে থাকো। তোমার কি রোগ আছে কোন পৌষ? রাগের রোগ? কেউ তোমাকে বলে নি তোমার মুখের ভাষা খুবই পঁচা?”
“আমার মুখে নিশ্চিত তুই সিন্নি তুলে দিবি না তুই? তাহলে ভালো, খারাপ দিয়ে তোর কি রে শালা? যাহ সর।”
এই দফায় রাগে রাফিদের বাহুতে ধাক্কা দিয়েই চলে গেলো পৌষ। সেদিকে তাকিয়ে নিজের বাহু ডলে বাঁকা হাসলো রাফিদ শিকদার। তার খুব মনে ধরেছে মেয়েটাকে। এই মাসে তার জন্মদিন। ভাইয়ার কাছে একটা উপহার চাইবে রাফিদ। উমায়ের ভাই নিশ্চিত তাকে ফিরাবে না৷ আজ পর্যন্ত কখনো ফিরায় নি৷ এবারেও ফিরাবে না রাফিদ জানে। এই পৌষটাকে তার উপহার হিসেবে চাই। এমন ঝাঁঝালো মেয়েই তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম। রাফিদ হেলেদুলে চলে গেলো করিডর থেকে। সেদিন যেই কিকটা মেরেছিলো এই পৌষ, একদম জান গলা পর্যন্ত উঠে এসেছিলো।
আদিত্যকে পৌষ পেলো গেটের সামনে। একদল ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে কোন বিষয়ে হাসিঠাট্টা করছে। পৌষ তাদের মাঝখান থেকে ওকে ডেকে নিলো। আদিত্য কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই পৌষ বললো,
“সোজা বাসায় চলো।”
আদিত্য অবুঝ গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু কি হয়েছে?”
“কচু হয়েছে। সম্রাট চেয়ারম্যানের বাগান বাড়ী যাব।”
“তুমি এখনও ভুলো নি পুষি৷ আমার তো ভয়ই হয়।”
“ভয়ের কিছু নেই। থাকলে তো তাহমিনা আপা নিজের না করতো যেতে।”
“হুঁ।”
আনমনে বললো আদিত্য। দু’জন একসাথে বাড়ীতে ফিরার পথে পৌষ রাস্তা থেকে দুটো আইসক্রিম কিনলো। আদিত্য টাকা দিতে চাইলেই পৌষ বললো,
“চাচির সাথে ঘুরতে এসেছে আদি। ভাজিতা মানুষ তুমি, শান্ত থাকো।”
বলেই পৌষ হাসতে লাগলো। এদিকে আদিত্য কিছুটা লজ্জা পেলো। পুষি সম্পর্কে তার মেঝ চাচি এখন থেকে কিন্তু চাইলেও কেন জানি বিষয়টা উলোটপালোট লাগে।
ওদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয় রাফিদ শিকদার। চোয়ালে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“ভোমরা তুমি শতফুলে ঘুরোফিরো, স্থায়ী ভিটা গাড়ো আমার আঙিনায়।”
আজকাল মিনুর সাথে খুব ভালো সম্পর্ক যাচ্ছে পৌষের। দুপুরে ওকে সাথে নিয়ে খেতে বসেছে পৌষ। খাওয়ার মাঝেই তৌসিফ ফোন দিয়েছে। খাচ্ছে শুনে সুন্দর করে বলেছে, খেয়ে যাতে ঘুমায় পৌষ। পৌষ সম্মতি দিয়েছে। তৌসিফ যা বলে তার বেশিরভাগই পৌষ শুনে তবে আজ হয়তো শুনবে না৷ আজ বের হতে হবে। বাগান বাড়ী যেতেই হবে। এই অনুসন্ধানস্পৃহা তাকে বারবার আগ্রহী করে তুলছে। মিনুকে নিয়ে পৌষ সোজা নিজের ঘরে এলো। ব্যাগ থেকে দুটো চকলেট বের করে ওর হাতে দিতেই মেয়েটা খুশি হলো। পৌষ এবার সরাসরি জিজ্ঞেস করলো,
“সোহা এখানে কখনো থাকতো না মিনু? তোর আপা কি অন্য জায়গায়ই থাকতো?”
মিনু মাথা নাড়লো। বললো,
“আপা থাকতো তো। এখানেই থাকতো।”
কপাল কুঁচকে পৌষ বললো,
“এখানে থাকতো? রাতেও থাকতো?”
“হ্যাঁ।”
“কোথায় থাকতো? এই ঘরে?”
“না, আমার ঘরে থাকতো। আমি আর আপা থাকতাম।”
“রাতে ঘুমাতো তোর সাথে?”
এবারেও মিনু মাথা নাড়লো। পৌষের ভেতরে খচখচ করতে লাগলো। একটা অববাহিত মেয়ে একটা অবিবাহিত পুরুষের ফ্ল্যাটে রাতে থাকতো। কথাটা ঠিক পছন্দ হয় না পৌষের। তৌসিফ সম্পর্কে তার ধারণা বেশ ঘোলাটে এখন অব্দি। পৌষ চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ভাবে কিছুক্ষণ। নিজেকেই সান্ত্বনা দেয়, এখানে বুয়ারা থাকতো, মিনু থাকতো। মাঝেমধ্যে তো আপাও আসতো। বাকি দুই বোন আসতো। নিশ্চিত কোন কুকাম করে নি তৌসিফ। করলেই বা পৌষের কি? পৌষ তাকে ভালোবাসে না। নিজেকে সাত-পাঁচ বুঝ দিয়ে পৌষ বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। আদিত্য ফোন ধরছে না। পৌষ রাগে ফেটে পরছে যেন৷ সিঁড়ি দিয়ে নামছে তখনই ফোন এলো। আদি নাম দেখেই রিসিভ করে ধমকালো পৌষ,
“কোথায় তুমি? জানো না আমাদের যেতে হবে?”
“পুষি, আম্মুর মামা মারা গিয়েছে। আমরা সেখানে যাচ্ছি। ফিরে এসেই তোমার সাথে যাব প্রমিজ।”
পৌষ আর কিছু বললো না তবে থেমেও থাকলো না। এখন দিনের আলো স্পষ্ট। পৌষ একাই পা বাড়ালো।
মাত্র দুপুর তিনটা বেজে ত্রিশ মিনিট। পৌষ বেশ খানিকটা পথ চলে এসেছে। তেমন ভয় তার লাগছে না অবশ্য। এই বাড়ীতে আসার পর সম্রাটকে কয়েকবার কল্পনা করেছিলো সে। মনে হতো তার লাল গাড়িটায় করে আসছে সে। সেই কল্পনা গুলো আবার ভেঙেও যেতো। পৌষ পেছনের সেই মাগুর মাছের ঘাট পাড় হতেই মনে হলো কেউ পেছনে আছে। তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই। কাটা গুলো ছড়ানো ছিটানো। বাড়ীর সামনে এসেই দম ফেললো শব্দ করে। সরাসরি চলে এলো সেদিনকার দেয়ালের কাছে। এখানেই কিছুটা সন্দেহ ছিলো পৌষের। হাতাতে লাগলো এদিক ওদিক। হঠাৎ বাম পাশের একটা ইটে হাতটা লাগতেই শব্দ হলো কট করে। ছিটকে দুই পা সরে গেলো পৌষ। বুকে থুতু দিয়ে তারাতাড়ি ইটটাকে ধাক্কা দিতেই আচমকা নড়েচড়ে উঠলো সেই দেয়াল। পৌষ অবাক হয়ে গেলেও তেমন ভয় পেলো না। ছোট থেকেই কিছুটা সাহসী গোছের সে অথবা ভয় পাওয়ার পর হয়তো কেউ ভয় কাটাতেই আসে নি তাই নিজ থেকে ভয় গ্রাস করে নিয়েছে সে।
যখন পুরো দেয়াল ঘুরে গেলো তখনই পৌষের মাথায় এলো একটা শব্দ, প্যানেল ডোর’। কোথাও শুনেছিলো এমন কিন্তু একটা বাগান বাড়ীতে এমন কি ই বা থাকতে পারে যার জন্য এই প্যানেল ডোর? পৌষ বিরবির করে বললো,
“বড়লোকের বড় কারবার।”
বলেই আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে ভেতরে ঢুকলো। প্যাঁচানো সেই জমিদার গোছের সিড়ি। ডগ টেইল লোহার সিঁড়ি বেয়ে চলতে লাগলো পৌষ। এদিকটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। ফোনের লাইটে খুব কদাচিত দেখা গেলো। হঠাৎই হলদেটে আলোর ছটাক চোখে পড়ে ওর। এই হলুদ আলো কেন জানি সহ্য হয় না পৌষের। বড়লোকদের বাড়ীঘর থাকবে সাদা ফকফকা আলোয় আলোকিত। বিশাল বড় এক হলরুম চোখের সামনে আসতেই পৌষ থমকে দাঁড়ালো। অভিভূত চোখে দেখতেই থাকলো। এত সুন্দর হাতে নকশা করা দেয়াল আগে কখনো পৌষ দেখে নি৷ ঠিক জমিদার বাড়ীর আদলে করা এক বাড়ী যার পুরোটা আবার আধুনিকতার ছোঁয়ায় ভরপুর। পৌষ এদিক ওদিক দেখতে লাগলো। বিভিন্ন দরজায় গিয়ে খুলতে চাইলো কিন্তু খুলতে পারলো না। হঠাৎ চোখ আটকালো এক ভিন্ন দরজায়। এত এত দরজার মাঝে সবচাইতে বড় দরজা এটা। শিল্পীর হাতে খচিত এক অদ্ভুত নকশা এখানে। কেন জানি এটা দেখে গা শিউড়ে উঠে পৌষের। কেন জানি মনে হয় এই দরজার নকশার পেছনেই এক জীবন গল্প পড়ে আছে অবহেলায়। ধুলোয় মাখা এক রচনার পৃষ্ঠা হয়তো খুব অযত্নে পড়ে আছে। কেউ হয়তো কখনো পৃষ্ঠা উল্টে পড়তে যায় নি৷ কেউ গুরুত্ব দেয় নি কারণ তার জীবন খুব গুরুত্ব দেওয়ার মতোই ছিলো না।
পৌষ কেন ভাবলো জানে না কিন্তু ওর ভেতর হাহাকারে ভরে উঠলো। হঠাৎ ভারী লোহার শব্দে ধ্যান ভাঙলো ওর। কোথা থেকে জিঞ্জিরের শব্দ আসছে। কান খাড়া করতেই পৌষের টনক নড়লো এই তো সামনে থেকেই আসছে। সেই বড় দরজা পেরিয়ে যখনই সামনের দিকে গেলো তখনই দেখলো হালকা ভেরানো এক দরজা৷ হাত দিয়ে ধাক্কা দিতেই তা খুলে গেলো। অন্ধকারে যখন পৌষ ফোনের আলোটা ধরলো তখনই পা দুটো আটকে গেলো জমিনে। শক্ত হয়ে গেলো পা দুটো যেন রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে চাইছে। হাতের তালু ঘামতে লাগলো ক্রমাগত। একটা জলজ্যান্ত পুরুষ দেহ পড়ে আছে এখানে। দেহে শুধু মাত্র একটা খয়েরী রঙের ভেলভেটের প্যান্ট। উদাম দেহটার পিঠ দৃশ্যমান। পুরুষটার দৈহিক কাঠামো শুকনো, রোগা লাগলেও তৌসিফের ন্যায়ই দেখালো। আচমকা দেহটা নড়ে উঠলো। পৌষের মুখ দিয়ে অস্পষ্ট শব্দ বেরিয়ে আসতেই গুঙিয়ে ডেকে ওঠে সেই পুরুষ,
“কে.. তাহমি?”
ভারিক্কি গুঙানো সেই শব্দে পৌষের শরীর হিম হয়ে আসে। দেহটা এদিক মোচড় দিতেই পৌষ যখন তাকালো তার পানে তখনই জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পেলো তার। কণ্ঠনালী চেপে এলো। শুকিয়ে যাওয়া, অযত্নে গড়া এক মুখ। হয়তো এই মুখে দাড়ি আছে কিন্তু পৌষের চোখ ভুল দেখছে না। মোটেও না। পৌষ গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। পুরুষটা অচেনা মেয়ে দেখে তেমন কিছু বললো না যেন মেয়ে মানুষ এখানে আসা যাওয়ার মধ্যেই থাকে। পৌষের মুখ ছিটকে বেরিয়ে এলো,
“সম্রাট! সম্রাট চেয়ারম্যান।”
নামটা শুনেই রাগে ফেটে আর্তনাদ করে উঠে সেই দেহটা। পায়ে শিকল থাকায় বোধহয় বেঁচে গেলো জানে। এই মহলে আজান শোনা যায় না তাই তো পৌষ জানলোই না এশারের আজান হয়েছে বহুত আগে। ভয়ে দৌড়াতে লাগলো পৌষ। দিকবিদিকশুন্য হয়ে দৌড়াতে লাগলো। তৌসিফের দেওয়া নুপুর গুলো তখন ঝনাৎ ঝনাৎ শব্দ তুললো। থমথমে এই জনশূন্য মহলে এই শব্দ শোনা যায় না বহু বছর হলো। সেই শব্দের সাথে মিশে যাচ্ছে এক পৌচাশিক চিৎকার যার সাথে তাল মিলিয়ে আসছে জিঞ্জিরের সেই অদ্ভুত শব্দ। মহল থেকে বেরিয়ে পৌষ দেখলো ঘুটঘুটে আঁধারে ঢাকা চারপাশ। কোন দিকে দৌড়াবে বুঝতে পারলো না তবে ও দৌড়ালো।
প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৩৬ (২)
হোটচ খেয়ে এই পর্যন্ত কয়েকবার পড়েছে ও। হাঁটু দিয়ে গলগল করে রক্ত ঝড়ছে। পৌষ আতঙ্কিত মুখে দৌড়াতে গিয়ে হঠাৎ দেখলো ওর দিকে দৌড়ে আসছে কেউ পাগলের মতো। একদম উন্মাদ হয়ে দৌড়ছে আসছে তৌসিফ। দুটো দেহ দুজনকে জায়গা দিলো নিজেদের মাঝে। পৌষ শুনলো ওর তৌসিফের বুকের ভেতরের শব্দ। তৌসিফ ওকে নিজের থেকে সরিয়ে সপাটে চড় মারলো গালে পরপরই সারামুখে চুমু খেলো। কি মনে করে পৌষের সারা শরীর দেখতে লাগলো। নিজের মতো দেখেই গেলো। কিছুটা আবারও চমকালো সে। তার বুকে ঢলে পড়েছে পৌষ। তৌসিফ কাঁপছে। তার সবল দেহটা টলছে। পেছন থেকে রনি আর টনি সহ কিছু ছেলেপেলে দৌড়ে আসছে। কেউ জানতো না আজ চাইলেই একটা খুন হয়ে গেলো তালুকদার বাড়ীতে। যার সমাধি হতো নিঃশব্দে।
