প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৭

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৭
সাইয়্যারা খান

“আদিত্য? অ্যই আদিত্য।”
পেছন থেকে ডাকতে ডাকতে পৌষ দৌড়ে আসার চেষ্টা করছে কিন্তু পায়ের অবস্থা ততটা ভালো না বিধায় দৌড়টা সঠিক ভাবে দেয়া যাচ্ছে না। দূরত্ব বেশি হওয়ায় আদিত্যও ডাকটা শুনে নি। পৌষ দাঁত খিটমিট করতে করতে এগিয়ে আসছে। এক প্রকার খোঁড়াচ্ছে ও। পৌষ তারাহুরো যেতে যেতে গালির ঝড় উঠালো বিরবির করে। আদিত্য বাইকে উঠবে এমন সময় অদ্ভুত কিছু বাক্য কর্ণগোচর হলো। সঙ্গে সঙ্গে পা দুটো থেমে গেলো ওর।

” চামচিকা একটা। শজারুর কাঁটা গায়ে নিয়ে ঘুরে। কানের ভেতর চিকা ঢুকেছে তোমার?”
ভাঙা পা নিয়ে পথটুকু আসতে ভালোই কসরত গেলো। আদিত্য’র মুখে সামান্য অবাকতা। পেছনে না ঘুরেই সে বুঝলো এহেন বাক্যালাপ কে ই বা করতে পারে। পৌষ’র দিকে তাকাতেই দেখা মিললো রাগে গজগজ করা এক মুখাবয়। আদিত্য কিছুটা অবাক হয়েই প্রশ্ন করলো,
” কি হয়েছে পুষি? আর তুমি এভাবে ভাঙা পা নিয়ে ভার্সিটিই বা কেন এসেছো?”
“আলগা পিরিত পরশু হবে আদিত্য। এখনই আমার সাথে গাছ তলা চলো।”
“গাছ তলায়?”
আদিত্য দুষ্টামি করে হাসা মাত্রই পৌষ দিলো এক খ্যাঁকানি। ব্যাস। আদিত্য শান্ত, সভ্য হয়ে ওর পিছনে হাঁটা দিলো পৌষ’র পেছনে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সময়টা দুপুর দুটো। আজ ভ্যাপসা এক গরম। টানা চারদিন বৃষ্টি গেলো। সারাটা দিন রাত টুপটাপ ফোঁটা আকাশ থেকে পড়েছে অবিরত। ক্লান্তিহীন ভাবে। আজও আকাশটা মেঘের দখলে কিন্তু সাময়িক জোর খাটাতে সূর্য উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। মেঘ, সূর্য আর বৃষ্টির এক শব্দহীন দ্বন্দ্বের ফলাফল এই ভ্যাপসা গরম। শরীর কেমন কিড়মিড় করে ওঠে। আপাতত হালকা বাতাস ছেড়েছে। প্রকৃতির আবার মায়া মহব্বত বেশি। দয়ার ভান্ডার খুলে এই বাতাসের আগমন।
পৌষ তাকিয়ে আছে আদিত্য’র পানে। আদিত্য ঘনঘন ঢোক গিলছে। কপালে বেছে বুঝে এক বান্ধবী জুটিয়েছিলো ও। নাম তার পৌষরাত। ভারিক্কি নামটাকে হালকা করতেই পুষি ডাকে আদিত্য। এ নিয়েও ঝামেলা কম হয় না। পৌষ প্রায়শই ক্ষেপে যায়। শত্রুর শত্রু হিসেবে তাদের বন্ধুত্ব। খুঁটিটা মজবুত বটে নাহয় এতদিন টিকে থাকতো না। পৌষ জহুরী চোখে তাকিয়ে আছে দেখে আদিত্যই জিজ্ঞেস করলো,

“কি হয়েছে, বললে না।”
” কি হবে? হওয়ার বাকি আছে কিছু? শা’লা জীবনটাই ভাঙাচোরা ছিলো এখন ম’রার উপর খাঁড়া এই পা। ভেঙে বসে আছি। মাথায় আমার মহাভারত চলে। চিন্তায় চিন্তায় খেতে পারি না।”
এক ধ্যানে এতগুলো কথা বলে পৌষ’র মনে হলো চা খাওয়া দরকার। আদিত্য’র দিকে তাকাতেই আদিত্য বলে উঠলো,
“আসছি আমি৷ এখানেই বস বইন। তুর তুর করো না।”

নিজের ব্যাগটা পৌষ’র কাছে রেখে আদিত্য ছুটলো চা আনতে। এটা পৌষ’র বিশেষ এক রোগ। দুপুরে নাকি ওর চায়ের নেশা জাগে। এই নেশা সচরাচর জাগে না। যখন ও খুব চিন্তায় থাকে তখন জাগে। এই যে এখন পৌষ চিন্তিত। ভীষণ চিন্তিত। সম্রাট চেয়ারম্যানের মতো চোখ ওয়ালা ঐ পুরুষটা আসলে কে? তার সাথে আদিত্য’রই বা কিসের সম্পর্ক যে আদিত্য তার পেছনে সেদিন দাঁড়িয়ে ছিলো আর ভোট চাইলো? পৌষ’র হাত পৌঁছালো গাছের শিকড়ে। টেনে কতগুলো ছাল বাকল তুললো। হাত-পা ওর স্থির থাকতে চায় না।

আদিত্য ফিরলো দুই কাপ চা নিয়ে। পৌষ লম্বা এক চুমুক দিয়ে প্রশ্নের বান ছুঁড়লো। আদিত্য’র মনে হচ্ছে এগুলো সব বিষে ভরা বান তাই তো পৌষ’র চোখ গুলো ওকে খোঁচাচ্ছে। প্রথমেই সরাসরি পৌষ প্রশ্ন করে,
” ঐ দিন কে ছিলো তোমার সাথে? যে আমার হাতে পোস্টার দিলো আর ভোট চাইলো কে সে?”
“আমার মেঝ চাচ্চু।”
“ওনার চোখ সম্রাট চেয়ারম্যানের মতো। আমি ভুল নই, এটা তুমি জানো।”
আদিত্য চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,
” ভুল কেন হবে? মেঝ চাচ্চুর চোখ অনেকটাই বড় চাচ্চুর মতো।”
পৌষ চোখ গরম করে তাকালো। পায়ের চপ্পল হাতে তুলতে যাবে তার আগেই আদিত্য ধেই ধেই করে বলে উঠলো,
” জুতা খুলছো কেন পুষি? মা’রবে নাকি?”

পৌষ জুতাটা খুলে পা গুটিয়ে ভাজ করলো। সামান্য তালু চুলকালো। আদিত্য শান্ত হলো। পৌষ মুখটায় মাত্রাতিরিক্ত জিজ্ঞাস্য ভাব। ও পুণরায় বললো,
” কয় চাচা তোমার?”
“তিনজন।”
“তোমার বাবা তুরাগ তালুকদার সবচাইতে বড়। তাহলে বড় চাচ্চু কে?”
“সম্রাট চাচ্চু।”
পৌষ’র মুখের চা ছিটকে এলো আদিত্য’র গায়ে। সাথে সাথে মুখ দিয়ে বের হলো,
“কিহ!”
আদিত্য নিজের এত শখের শার্টার দিকে একবার তাকালো অতঃপর পৌষ’র দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বললো,
“তুমি জানতে না?”

“তোমার দাদা কয় বিয়ে করেছে?”
আদিত্য একটু ভেবে উত্তর দিলো,
“দুটো কিন্তু সঠিক বলতে পারছি না৷ হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“সম্রাট তোমার সৎ চাচা?”
“আরে না না৷ আব্বুর আপন চাচাতো ভাই। ভাইদের মধ্যে সবচাইতে বড়ই তো সম্রাট চাচ্চু।”
পৌষ পিটপিট করে তাকালো। বললো,
” আচ্ছা, আচ্ছা কিন্তু…”
ওকে থামিয়ে আদিত্য বললো,

“কিন্তু কি? মেঝ চাচ্চু কেন সম্রাট চাচ্চুর মতো চোখ পেলো? এটা জিজ্ঞেস করবে? এর উত্তর দিতে আমাকে বিজ্ঞান ঝাড়তে হবে। ঝাড়বো? জেনেটিক্স নিয়ে আইডিয়া আছে?”
“কষিয়ে একটা মা’রব। আমি কি মূর্খ?”
“যাক তাহলে। চাচাতো ভাইদের চোখের মিল থাকতেই পারে। এটা স্বাভাবিক।”
” কাল তোমার মেঝ চাচ্চু.. উম.. নাম কি উনার?”
“তৌসিফ তালুকদার।”
“ওহ হ্যাঁ। মনে পরলো। শুনেছিলাম আগেই। কথা হলো উনি যেই পোস্টার দিলো। যার নামে ভোট দিতে বললো সে তো বিপরীত দলের। সম্রাট চেয়ারম্যানের দল তো এটা না। নাকি তোমার বাপ-চাচা পল্টি খেলো সুবিধা বুঝে নিতে?”

আদিত্য একটু মাথা ঝুকালো। ফিসফিস করে বললো,
“এটার উত্তর মেঝ চাচ্চুই ভালো দিতে পারবে। তুমি তাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো।”
“আশ্চর্য! আমার ঠ্যাকা?”
“তাহলে এতক্ষণ যে বললে।”
“কিউরিওসিটি। বাংলা অনুবাদ ঝাড়ব?”
আদিত্য সহ পৌষ হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে আদিত্য বললো,
“মেঝ চাচ্চু এবার নিজেই দায়িত্ব নিয়েছেন বিপরীত দল জিতিয়ে দিবেন। কারণ এর পিছনে অসংখ্য। একটা কারণ আমি জানি।”
পৌষ’র চোখ উৎসাহী। আদিত্য তা বুঝে বললো,

“উমায়ের এলাকার পাতি নেতা গুলোকে পকেট ভারী করে দিয়েছিলো। যখন যা চেয়েছে সব দিয়েছে কিন্তু গত নির্বাচনে ভোট পেয়েছে অতি নগন্য। ওদের দলের তেমন কোন ছেলেপেলে ছিলোই না৷ উমায়ের শিকদার কিন্তু স্কুলের কক্ষে ভোটের পর আসিফ’কে আটকে রেখেছিলো। সবার সামনে নাকি গালিগালাজ করে চড় দিয়েছে। ঈদের জন্য পাঠানো সেমাই সহ বাকি রিলিফের মালপত্র সব গায়াব করে দিতো। সব শুনে উমায়ের শিকদার আর জয়নাল ক্ষেপেছিল। আসিফকে ধমকে বলেছিলো দল থেকে বের করবে।
এজন্য মেঝ চাচ্চু এবার নিজে ওদের জিতিয়ে দিবে যাতে ওরা বুঝে ওরা নিজেরা যা না করতে পারবে তা একা তালুকদারই করতে পারবে। বুঝলে কিছু?”

“বুঝলাম”
একটু থেমে পৌষ বললো,
“আসিফের হঠাৎ বাড়ী গাড়ি তাহলে এভাবেই হলো?”
“তা আর বলতে? স্কুলের সামনে ড্যাগ ভরে বিরিয়ানি বিক্রি করতো। এখনও বিয়ে করলো না।”
পৌষ ক্ষুদ্র ঢোক গিললো। আসিফের জন্য তার সমন্ধ এসেছিলো। ঐ গলির একজন দিয়েই প্রস্তাব পাঠিয়েছিলো। পৌষ ভাবলেই গা কেমন কাটা দিয়ে উঠে। আসিফে’র বয়স না হলেও চল্লিশ ছুঁড়েয়ে। তার উপর কেমন একটা দেখা যায় ওকে। ফর্সা মানেই কি শুধু সুন্দর?

“কি ভাবছো?”
আদিত্য’র প্রশ্নে পৌষ হকচকালো। উত্তর করলো না। শুধু বললো,
“তোমার মেঝ চাচ্চুর কেরামতি দেখব ভোটের দিন।”
আদিত্য হাসতে হাসতে বললো,
” চোখ খুলে দেখিও।”
” বহুত টিডিং টিডিং করেছো। যাও বাড়ী যাও। হুঁশ.. হুঁশ।”
” কাজ হাসিল হতেই একথা বলো তুমি।”
পৌষ মুখ বাঁকিয়ে ভেঙালো। সেভাবেই বললো,
“উপকারের কোন বাড়ী, ধরে আনো জুতা মা’রি।”
আদিত্য চোখ ট্যারা করে বললো,
“খাঁটি কথা বলেছো।”

“আমি আবার খাঁটি ছাড়া কিছু করি না৷”
পৌষ উঠে দাঁড়ালো। বহুত ভংচং চললো আজ। মাথায় কিছু কথা ঘুরপ্যাঁচ তার এখনও খাচ্ছে। পা টান করার চেষ্টা করতে করতে বললো,
“তোমার ছোট চাচ্চু….. ”
“আজ তালুকদার বাড়ী প্রত্যাহার করো নাহয়। এত চাপ একেবারে নিও না।”
“তোমাদের বংশের লাল বাত্তি, নীল বাত্তি আমি দেখেই ছাড়ব। শা’লার এত প্যাঁচ থাকে? আশ্চর্য!”
খোঁড়াতে খোঁড়াতে পৌষ যেতে নিলেই আদিত্য সাহায্য করতে চাইলো কিন্তু লাভ হলো না। পৌষ কখনোই ওর সাথে যাবে না৷ ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো।

এলাকা জুড়ে পোস্টার। যেখানে এই এলাকার সকলে তালুকদার বাড়ীর ভক্ত সেখানে সরাসরি প্রচার চলছে বিপরীত দলের। তাও কি না তালুকদার বাড়ী থেকে এই কাজ করা হচ্ছে। তৌসিফ নিজে বাড়ী বাড়ী গিয়েছে। পোস্টার গুলো চোখের সামনে টাঙানো। সম্রাট চেয়ারম্যানের ভক্তকুল তখন মনে মনে ভীষণ ক্ষেপে গেলো কিন্তু জোর গলায় কি ই বা বলবে? সম্রাট চেয়ারম্যানের আপন চাচাতো ভাই তৌসিফ। সম্রাট নিজে তৌসিফ’কে নেতৃত্ব দেয়া শিখিয়েছে। বড় ভাইয়ের হাত ধরে আজ তালুকদার বাড়ীর ছেলেরা এতদূর। কিছু নেতাকর্মী যারা তৌসিফে’র বাবা-চাচা থাকাকালীন সময় থেকে আছে তাদের মধ্যে থেকে দুই চারজন উপস্থিত হলো সম্রাটের মায়ের নিকট। তাহমিনা তাদের বাইরের ঘরে বসতে বলে নিজে গেলো মায়ের কাছে। নামাজের পাটিতে তখন থম ধরে ইবাদতে মশগুল সম্রাটের মা সাহারা। তাহমিনা অপেক্ষা করলো না। ও জানে আম্মা এখন উঠবে না। তাহমিনা নিজেই মাথায় বড় ঘোমটা দিয়ে বেরিয়ে এলো। কাজের মেয়েকে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

“ওনাদের নাস্তার ব্যবস্থা করো।”
মেয়েটা যেতেই নিজের মুখে আরেকটু ভারিক্কি ভাব আনে তাহমিনা৷ পরণে তার মাখনের মতো রঙের থ্রি পিস। চোখ মুখের দ্যুতিই যেন চিৎকার করে জানান দিচ্ছে, সে সমশের চেয়ারম্যানের মেয়ে, সম্রাটের আপন বোন। মধ্যবয়স্ক, বয়স্ক পুরুষ বসা চার পাঁচজন। তাহমিনা তাদের থেকে ছোট অথচ এই মেয়েটার চাল, চলন, কথার ভঙ্গি সবকিছুতেই যেন রাজকীয়তা। ফুল হাতার বাইরে শুধু চিকন হাতের কব্জিটুকু দেখা যাচ্ছে। হাতের শিরা গুলো তখন আবছা দেখা যাচ্ছে। না চাইতেও তারাই প্রথমে সালাম দিয়ে ফেললো। তাহমিনা হেঁটে আসতে আসতে উত্তর নিলো,

“ওয়ালাইকুমস সালাম চাচা। আসসালামু আলাইকুম।”
তারাও জবাব দিলেন। তাহমিনার চোয়াল শক্ত। মানুষের চোখ পড়ার মতো এক ঐশ্বরিক ক্ষমতা তার আছে। এরা যে সাধারণ কুশলাদি করতে আসে নি তা বোঝাই যাচ্ছে। তাহমিদা ভারিক্কী স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“হঠাৎ আপনারা চাচাজান। আব্বা চলে যাওয়ার পর তো এমুখো হন না ততটা।”
“তোমার আব্বা ছিলো আমাদের সহচর। এলাকাটাকে নিজ হাতে শক্ত একটা অবস্থান দিয়েছিলো। সম্রাট তারই পদচিহ্ন অনুসরণ করে ক্ষমতাটা আরো শক্তপোক্ত করেছে। তোমাদের তালুকদার বাড়ীর ভরসায় কতগুলো মানুষ তাকিয়ে থাকে। যেই ক্ষমতা এতগুলো যুগ ধরে টিকিয়ে রেখেছে এতগুলো প্রজন্ম সেই ক্ষমতা নিয়ে তোমার চাচাতো ভাইরা যা করছে তা কতটুকু ঠিক? বিপক্ষের হয়ে যেভাবে ভোট চাইছে, মানুষ না দিয়ে পারবে বলো? তালুকদার বাড়ীর নুন সবার পেটে। নিমকহারাম তো আর কেউ না।”

” আমার চাচাতো ভাইরা যখন পলাতক ছিলো তখন যে টানা কয়েকবার ওদের বাড়ী হামলা হয়েছিলো মনে আছে চাচা?”
একজন উত্তর করলো,
“হ্যাঁ। মনে না থাকার মতো তো কথা না।”
“জি চাচাজান। ভুলবার মতো না৷ আব্বা নিজ হাতে পেলেপুষে আমাদের ঐ দারোয়ানটাকে বড় করেছিলেন৷ সেই দারোয়ানকে গলা কে’টে হত্যা করা হয়েছিলো চাচা। লা’শ দেখেছিলেন?”
নীরবে মাথা নাড়লো সকলে। কি বিভৎস সেই স্মৃতি। বৃষ্টির সেই রাতে দারোয়ানের গলা কে’টে হামলা দিয়েছিলো দস্যুরা তালুকদার বাড়ী অথচ তারা ছিলো এই বিপরীত দল। সকলে জানতো। তাদের মুখ সবার চেনা। সেই হত্যাকারী এখনও মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিচ্ছে অথচ ইতিহাস থেকে যেন মুছেই গেছে কতশত বীরত্বের গাঁথা।
তাহমিনা আবারও বললো,

“প্রতিমন্ত্রী ওই বাড়ী আসতে চেয়েছিলো। তুরাগ না করেছিলো। বাড়ী না এনে ফাইবস্টার হোটেলে গিয়েছিলো তুরাগ। ও বাড়ীতে ফেরার জন্য মাত্র গাড়িতে উঠেছিলো তার আগেই বাড়ীতে পুলিশ। একথা জানেন চাচাজান?”
তাদের চোখই যেন উত্তর দিলো তারা জানে। এই ঘটনার পরে তৌসিফ, তুহিন বাড়ী ছাড়া ছিলো কতগুলো দিন। তাহমিনা এবার শক্ত মুখে বললো,
“আমাদের নুন খাওয়া সেই এলাকাবাসী সেদিন আসে নি খোঁজ নিতে। আজ যখন বিপক্ষের হয়ে কাজ করছে তখন ছুটে এলেন? সেদিন কোথায় ছিলেন চাচা? কোথায় ছিলো দলের প্রতি এই মায়া, মহব্বত? তালুকদাররা রক্ত দিতে ভয় পায় না চাচাজান৷ র’ক্ত আমরা রঙের মতোই দেখি। ছোট বেলায় যখন আপনাদের বাচ্চারা লাল রঙ বেলুন দেখে শিখতো তালুকদারের সন্তানরা শিখতো বাপ-চাচা, ভাইদের র’ক্ত দেখে। সুতরাং আসতে পারেন। চা তো শেষই। উঠি আজ তাহলে চাচাজান। আসসালামু আলাইকুম।”

এক বাঘিনী যেন উঠে ভেতরের ঘরে চলে গেলো। আভিজাত্য তখন চুয়ে চুয়ে পড়ছে। তারা যেন সেই বাঘিনীর থাবা থেকে বেঁচে উঠলেন৷ মুখ কালো করে বের হলেন সকলে। হয়তো কাজের মেয়েদের মুখে শুনেছিলেন চাচাতো ভাই-বোনদের সম্পর্ক ততটা মজবুদ না কিন্তু তাহমিনা’র যেভাবে চাচাতো ভাই এর নামে একটু কথা শুনেই খোলস ছাড়লো। আর কিছু বললে যে এই মেয়ে গলা চেপে ধরতো তা নিশ্চিত।

তাহমিনা ফিরে এসে দেখলো সাহারা’র নামাজ শেষ। মায়ের খাটে উঠে জানালা দিয়ে তাকালো। বাড়ীর পেছন দেখা যাচ্ছে। অগভীর এক জঙ্গল। তাহমিনা সেদিকটায় তাকালো। আকাশটা আবছা আজ৷ মায়ের ঘুমানোর সময় এটা। সাহারা ঘুমাতেই তাহমিনা উঠে এলো। মুখের উপর ঘোমটা টেনে আরেকটু দীর্ঘ করে রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে এলো বাড়ীর পেছনে। একবার অবশ্য তাকালো তৌসিফদে’র বাড়ীর দিকে। সেখানটায় অন্ধকার কিন্তু আলোকসজ্জার দাপটে তা বুঝা মুশকিল। তাহমিনা ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে ভেতর দিকে ঢুকছে। হাতে একটা টর্চ। আরেকটু সামনেই সম্রাটের বাগান বাড়ী। তার সামনে ছোট এক পুকুর। তাহমিনা লাইট দিতেই শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো সেখানটায়। এই পুকুরের পানি অস্বচ্ছ। ঘোলাটে। এখানে সম্রাট মাগুর মাছ চাষ শুরু করেছিলো। অস্ট্রেলিয়ার মাগুর গুলোকে বাড়ীতে আনা সব মুরগীর চামড়া খাওয়ানো হয়। ওরা আবার এসব ততটা পছন্দ করে না৷ যেই মুখে একবার মানুষের গোস্তের স্বাদ পেয়েছে, সেই মুখে কি আর মুরগীর চামড়া রুচবে?

তাহমিনা আরেকটু সামনে গেলো। কাটা গাছগুলোর ভেতরে রাখা বিশাল বড় দুই হাজার লিটারের নীল রঙা ড্রাম৷ তামহিনা কাটা পেরিয়ে সেখানে গিয়ে টর্চরা মুখে নিয়ে ড্রামের ঢাকনা খুলে ভেতরে উঁকি দিলো। তার চোখে মুখে সন্তুষ্টি স্পষ্ট।
আশেপাশে তাকিয়ে ফেরত যেতে যেতে তামহিনা ধ্যানহীন ভাবে আওড়ালো,

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৬

“পৃথিবীর মায়া সবচাইতে নিকৃষ্ট মায়া। না আছে বেঁচে শান্তি আর না আছে ম’রে শান্তি। সারাক্ষণ শুধু বাঁচা-মরার মাঝে লড়াই তার চাইতে উত্তম কেউ তার জানটা টেনে বের করুক। সে অন্তত মুক্ত হোক।”

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৮