প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১০

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১০
ফিজা সিদ্দিকী

গোধূলি আকাশে সূর্যাস্ত নেমে আসার মতো করে দপ করে অন্ধকার নেমে এলো নন্দিতার সুশ্রী মুখের আদলে। কিছুক্ষণ আগেই কুরিয়ার থেকে একটা পার্সেল এসেছে তার নামে। উপরে বড়ো বড় অক্ষরে লেখা “something special”। প্রেরকের নাম দেখামাত্রই এতক্ষণের হাসি খুশি চেহারার বদলে সেখানে স্থান পেয়েছে ভয়াতুর এক অসহায় রূপ।

তুর্জয়ের ফেরার সময় হয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে সে এসে যেতে পারে। তাই আর সময় অপচয় না করে ব্যস্ত হাতে প্যাকেটটা ওপেন করলো নন্দিতা। উৎকণ্ঠায় তার সরাসরি মৃদু কাঁপছে যেন। হাতে বল পাচ্ছে না। তবুও নিজের জেদি সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে পুরো প্যাকেটটা খুলল সে।
ছোটো একটা কাঁচের বোতলে খানিকটা ব্লাড প্রিসার্ভ করা, সাথে একটা ইনজেকশনের সিরিঞ্জ, বেশ কয়েকটা মেডিসিনের প্যাকেট। প্যাকেটে রাখা জিনিসপত্রের আগামাথা কিছু বোঝার চেষ্টা করার আগেই পাশে রাখা ফোনটা বেজে ওঠে শব্দ করে। নন্দিতা জানে এই অসময়ে কে তাকে ফোন করতে পারে। তাই লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে ফোনটা রিসিভ করে কানে চেপে ধরলো সে। কোনরূপ ভূমিকা ছাড়াই জিজ্ঞাসা করলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“পার্সেলের মধ্যে এগুলো কী? ফুল কই? আপনার তো আমাকে তাজা ফুল পাঠানোর কথা ছিল, এগুলো কী?”
“আমি তোমার ফুল পাঠানো প্রেমিক না, আইনত বিয়ে করা স্বামী। বাড়ি ফিরছিলাম, কিছু লাগবে কিনা জানতে ফোন দিয়েছিলাম। এখন তো দেখছি আমার গোপনে তোমার সব প্রয়োজন মিটিয়ে দেওয়ার মানুষ আছে। আমার জিনিসের আর প্রয়োজন নেই সম্ভবত।”

নন্দিতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই খট করে ফোন কেটে দেয় তুর্জয়। অতঃপর একপলক তাকায় ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটের উপর রাখা একগুচ্ছ স্নিগ্ধ রজনীগন্ধার মালার দিকে। অকারনেই আজ ফুলের দোকানের সামনে দাঁড়াতে মন চাইছিল তার। আর সেই ইচ্ছেকে খানিকটা প্রশ্রয় দিতে ফুলের দোকানে গিয়েছিল সে। চোখের সামনে ঝুঁকতে থাকা রজনীগন্ধার আর গোলাপের মিশেলে বানানো হাতের মালা দেখে নন্দিতার ফর্সা, চিকন হাতের কথা মস্তিষ্কে হানা দেয় তার। কোনরূপ ভাবনা ছাড়াই একজোড়া হাতের মালা প্যাক করতে বলে দোকাদারকে। দোকানদার তাকে বাড়তি হিসেবে একটা গোলাপও দেয়। তুর্জয় বারণ করলে তিনি হাসি হাসি মুখ করে বলেন,
“বাড়তি কোনো টাকা লাগবে না সাহেব। গোলাপ পেলে মাইয়া মানুষ মেলা খুশি হইয়া যায়। আর মাইয়া মানুষ খুশি থাকলে পুরো সংসারে খুশি থাহে। মাঝিমধ্যি শুধু একখান গোলাপ নিয়া গিয়া দেখবেন সাহেব, স্বর্ণের জিনিস পাওয়ার লাহান খুশি হই যাইবো তারা।”

দোকানদারের কথার পিঠে দ্বিরুক্তি করেনি আর তুর্জয়। হয়তো মনে মনে সেও নন্দিতার মুখের নির্মল হাসিটুকু, প্রাণখোলা খুসিটুকুই দেখতে চায়। আজকাল মাঝে মধ্যেই তার অসভ্য রকমের এক অসুখে ধরে। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলেই পাশে শুয়ে থাকা নন্দিতাকে বুকে টেনে নিতে মন চায়। আবার কখনও কখনও তার গোল গোল ঠোঁটদুটো নিজের আয়ত্বে এনে আশ্লেষে শুষে নিতে মন চায়। আরও এক অসভ্য ইচ্ছে উঁকি দেয় তার মাঝে। সেটা হলো সেদিন রাতের মতো আরও অনেকগুলো রাত সে চায়। দুটো শীতল শরীরের মাপঝোপ করে একে অন্যকে উষ্ণতা বিলিয়ে দেওয়ার মতো রাত, একে অন্যকে ডুবে অন্য এক সুখের সাগরে ভেসে যাওয়ার মতো রাত, সুখের, আমোদের, আহ্লাদের, তাকে খুব করে কাছে পাওয়ার মতো রাত।

ফুলগুলো গাড়িতে রেখে আচমকাই ফোন লাগায় সে নন্দিতাকে। কোনো কথা নেই, নির্দিষ্ট কিছু বলার নেই, তবুও নির্বোধ মনের চাহিদা পূরণের খোরাক জোগাতে ফোন লাগায় সে। রিং হওয়ার সাথে সাথে অবশ্য যথেষ্ট অস্বস্তিতে ভুগতে হচ্ছিল তাকে। কেটে দিতে চেয়েও কেটে দিতে পারেনি কেটে দেওয়ার কারণ খুঁজে না পেয়ে। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা আজ সে করেছে। ফোন করাটা উচিৎ হয়নি একদমই। যদি না ফোন দিত, তবে এমন এক ঘটনা, এমন এক সত্যর মুখোমুখি অন্তত তাকে হতে হতো না।

মন জিনিসটা আসলেই বেইমান। তার চাওয়া পাওয়াগুলো অযাচিত। এরচেয়ে তার মস্তিষ্ক ঢের ভালো। অন্তত এ পর্যন্ত এমন অস্বস্তিতে ডোবায়নি তাকে। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অস্বস্তির এক সূঁচালো কাঁটা নিয়ে বাকিটা পথ পাড়ি দিল সে। মনের মাঝে চলতে থাকলো একঝাঁক প্রশ্নের হুড়োহুড়ি খেলা। যার কোনটার উত্তর তার কাছে নেই। নন্দিতার কাছে সে উত্তর চাইবেও না। যেটুকু কাছে এসেছিল, অনুভূতির ঢেউয়ে নিজেকে এলিয়ে দিয়েছিলো, সেটুকু পিছিয়ে যাবে শুধু। আজ সে উপলব্ধি করলো, সব ঢেউয়ে শরীর এলিয়ে দিতে নেই। কিছু ঢেউ সমুদ্রকে গভীর থেকে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো হয়। কিছু ঢেউয়ের আর এক নাম সাইক্লোন, নন্ড ভন্ড, তোলপাড়, ছিন্ন ভিন্ন করা যার তথাকথিত স্বভাব।

নন্দিতার সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখে আঁধারি ছায়া আরও গাঢ় হলো যেন। অমাবস্যার চেয়েও ঘোর অমাবস্যা বলে যদি কিছু থাকে, আজ নন্দিতার মন আকাশে তার বিচরণ। এই অসময়ে তুর্জয়ের ফোন আসাটা একেবারেই অনাকাঙ্খিত ছিলো। অন্যসময় হলে বেজায় খুশি হতো সে। কিন্তু আজ বেখেয়ালে ঘটে যাওয়া অঘটনে একটু একটু করে সাজানো গোছানো ঘরটা সমুদ্রের নোনা বাতাসের দাপটে তাসের ঘরের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে দেখতে পাচ্ছে সে। তুর্জয়ের মাঝের এই সূক্ষ্ম পরিবর্তনটুকু সে ইদানিং লক্ষ্য করেছে। কিন্তু আজ যখন তা প্রগাঢ় রূপে ধরা দেওয়ার সময় এলো, এমনটা না হলে কি হতো না? সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা জিনিসগুলোর দিকে একপলক নজর বুলিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে অভিযোগের সুরে বলে উঠলো,

“তোমার থেকে যাওয়া দরকার ছিলো মা।”
শুধুই কী অভিযোগ? অভিমানের দোষরে সিক্তও বটে। এ অভিযোগ সৃষ্টিকর্তার উপর। এ অভিযোগ তাকে নিঃস্ব করার, অচেনা জগতে আচমকা তাকে একেবারে অপরিচিত মানুষদের মাঝে একা ছেড়ে দেওয়ার। এ অভিযোগ তার মায়ের শীতল কোলের অভাববোধের। আকাশ চিরে গগনবিদারি বিদ্যুৎ সহিত নেমে আসা বৃষ্টি কনার ন্যায় ঝুপ করে কয়েক ফোঁটা বর্ষণ তখন নন্দিতার কোলেও গড়ালো। বুকটা ভার হলো অসম্ভব রকম। চেনা ঘর, চেনা সংসার হুট করে অচেনা লাগলো। বেদনার্ত মনে শূন্যে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলো,
“এই ভুল বোঝাবুঝি মেটাতে পারবো তো?”
বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে তুর্জয়ের খুলে রাখা সাদা টি শার্ট, কালো কোর্ট, দুমড়ে মুষড়ে যাওয়া টাই। ঘরে ঢোকামাত্র নন্দিতা একপলক সেগুলোর দিকে তাকালো। অতঃপর ঠোঁটের কোণে ফিচেল হাসি টেনে বিড়বিড়িয়ে বললো,

“এতটুকু রাগের কারন যদি আমি হই, নট ব্যাড।”
বিছানা থেকে একে একে সব উঠিয়ে ওয়াশিং ব্যাগে রাখলো নন্দিতা। এরপর এলোমেলো হয়ে যাওয়া বিছানার চাদর পরিষ্কার করে টানটান kor দিতে গিয়ে আচমকা তার নজর পড়ল বেড সাইড টেবিলের উপর। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই টাকা ফুলের ঘ্রাণ তার নাকে এসে বাড়ি দিচ্ছিলো। কিন্তু ব্যাপারটাকে সেভাবে আমলে নেয়নি সে। অথচ টেবিলের একদম সামনেই রাখা ধবধবে সাদা দুই রজনীগন্ধার মালা। যার সৌন্দর্যকে ত্বরান্বিত করতে মাঝে চুপটি করে বসে আছে একটা করে লাল টকটকে গোলাপ। মালা দুটো হাতে উঠিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে পলকবিহীন তাকিয়ে রইলো সে। যেন চোখের পাতা ফেললেই হারিয়ে যাবে। ভেসে যাবে সব উচ্ছসিত ঢেউয়ের সাথে। থেকে যাবে এক স্মৃতি অলীক স্বপ্নের ন্যায়।

হাত দুটো নাকের কাছে এগিয়ে এনে চোখ বুঁজলো সে। আবেশে, উন্মাদনায় লম্বা এক শ্বাস টেনে নিলো। একবার, দুইবার করে বারবার শ্বাস টানলো সে। যেন এই ফুলের সবটুকু শুদ্ধ ঘ্রাণ সে নিজের মাঝে টেনে নিতে চায়। শুধুই কী ফুল তার পছন্দ বলে? নাকি প্রিয় মানুষের হাতে করে এসেছে বলে, তার এতো আহ্লাদ, এতো আদর, এতো রূপ, এতো যত্ন। ফুলগুলোও কি খানিকটা ঈর্ষান্বিত হলো, তাদের রূপ, ঘ্রাণের চেয়ে অন্যকেউ বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে বলে!

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৯

টেবিলে পড়ে থাকা অযত্নের গোলাপ খানা ততক্ষণে অভিমানে ক্ষিপ্ত হয়ে মুর্ঝা যেতে বসেছে। অথচ সে হুশ নন্দিতার নেই। শেষবারের মতো প্রিয়তমের বাছাই করে আনা অমুল্য, অসামান্য, পৃথিবীর সবচেয়ে সুশ্রী ফুলগুলোর মাঝে নাক ডুবিয়ে আশ্লেষে মোহাচ্ছন্ন কণ্ঠে বলে ওঠে,
“তারা সবচেয়ে সুন্দর, কারণ তারা আপনার ছোঁয়ায় সিক্ত।”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১১