প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১১

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১১
ফিজা সিদ্দিকী

“আর বড্ডো কম দিন। তোমার উড়তে থাকা ডানা যে কেটে ফেলার ব্যবস্থা আমি করে ফেলেছি এডভোকেট তুর্জয় আহসান। তাও আবার কিনা তোমারই ঘরের লোককে দিয়ে!”
কথাটুকু শেষ করে বিলাসবহুল এক হুঁকোতে সুখটান দেয় অজ্ঞাত সেই লোক। অতঃপর সাথে সাথেই উল্লাসে উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। যে হাসির ঝংকারে কেঁপে ওঠে বিলাসবহুল ঘরের প্রতিটা দেয়াল, প্রতিটা ইট, পাথর। গগনবিদারী এক চিৎকার দিয়ে যেন তারা বলে ওঠে, মুক্তি দাও আমাদের এবার। এই নৃশংসতার সাক্ষী আমরা মুক্তি চাই। চার দেয়ালের মাঝে লুকায়িত সব গোপন কুকাজ ফাস করে দিতে চাই প্রকাশ্যে। তোমার ভালো মানুষীর মুখোশটুকু টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে দিতে চাই।

ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে নন্দিতাকে হাসিমুখে ফুলগুলো নিয়ে মেতে থাকতে দেখে ঠোঁটের কোন চওড়া হয় তুর্জয়ের। কিন্তু বরাবরের মতোই মনের কথাটুকু মুখে না এনে গাম্ভীর্যে ভরিয়ে রাখলো মুখটা। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এমনভাবে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো যেন সে ছাড়া অন্য কারোর উপস্থিতি এই ঘরে নেই। নন্দিতাকে একেবারে অগ্রাহ্য করে এবার কাবার্ড থেকে বেশ কিছু ফাইল নিয়ে বেডের একপাশে বসে পড়ল সে। নন্দিতা আড়চোখে তুর্জয়ের প্রতিটা গতিবিধি লক্ষ্য করে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

গম্ভীর মুখ করে বসে দরকারি কিছু ফাইল বেশ মনোযোগ দিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলো তুর্জয়। এমন সময় একজোড়া হাত এগিয়ে আসে তার মুখের সামনে, ফাইল আর তার চোখের মাঝে দেয়াল হয়ে। এরপর চিকন হাতে পরা লাল রঙা কাঁচের চুড়িগুলো শব্দ করে বাজিয়ে ওঠে। খুব অল্প পরিমানের কয়েকটা চুড়ি তার হাতে। একে অন্যের সাথে ঘর্ষণে ঝংকারী নৃত্যে মেতে উঠেছে। তার সবটুকু ধ্যান জ্ঞান নিজের দিকে আকর্ষণ করার এ যেন এক অনন্য পন্থা।
তুর্জয় মুখ তুলে কড়া চোখে নন্দিতার দিকে তাকায়। নন্দিতা ঠোঁট উল্টে বাচ্চাদের মতো মুখ করে আদুরে ভঙ্গিতে বলে ওঠে,

“পরিয়ে দাও!”
এই প্রথম নন্দিতার মুখে তুমি ডাক শুনে লাজুক হাসতে মন চাইলো তুর্জয়ের। কিন্তু পরিস্থিতি পুরোপুরি তার বিপক্ষে। এতসব ঘটনার পর এই সামান্য কিছু তার উপর প্রভাব ফেলতে পারে না। তাই আগের চেয়েও নিঠুর চোখে সে চেয়ে রইলো নন্দিতার দিকে। নন্দিতা বোধহয় ভয় পাবে খানিকটা, কিংবা ভড়কে গিয়ে গুটি গুটি পায়ে দূরে সরে যাবে, এমন এক মনোবাসনা নিয়ে বসে থাকা তুর্জয়ের জল্পনা কল্পনার পুরোপুরি গরম পানি ঢেলে দেওয়ার মতো করে নন্দিতা হো হো করে হাসতে শুরু করে। কোনরকম হাসি চেপে বলে উঠলো,
“আমার কি এখন একটু ভয় পাওয়া উচিৎ?”
তুর্জয় নিরুত্তর এখনও ঠাঁয় তাকিয়ে নন্দিতার দিকে। নন্দিতা এবার আগের চেয়েও হাসকৌতুক মনে দুই পাটি দাঁত বের করে বলে ওঠে,

“কিন্তু আমার ভয় আসছে না। অভিনয় করি ভয় পাওয়ার?”
“চোখের সামনে থেকে দূর হও।”
চিবিয়ে চিবিয়ে তুর্জয়ের বলা কথাটুকু শুনে আচমকা হাসি থেমে গেল নন্দিতার। হাস্যোজ্জ্বল মুখের আদলে আচমকাই বেশ গভীর চিন্তা ভীড় জমিয়েছে, এমন একটা ভান ধরে চিন্তিত সুরে তুর্জয়ের দিকে খানিকটা এগিয়ে যেতে যেতে বলল,

“তোমার কী দাঁত ব্যথা করছে? দেখি দেখি দাঁতে পোকা হয়েছে কিনা! আ করো তো। ভালো করে দাঁত ব্রাশ না করলে এমনই হবে। কাল থেকে সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ হাতে আমার কাছে আসবে, ভালো করে ব্রাশ করিয়ে দেব।”
নন্দিতা ননস্টপ বকবক শুনে বিরক্ত বনে যায় তুর্জয়। হাতের ফাইলটা শব্দ করে ফেলে উঠে দাঁড়ায় সে। খানিকটা তেড়ে এসে রাগান্বিত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“আমি তোমাকে বলেছি, আমার দাঁতে ব্যথা করছে?”

নন্দিতা ভ্রু কুঁচকে ইনোসেন্ট ভাব ধরে তুর্জয়ের দিকে আঙুল তাক করে বাচ্ছাসুলভ কণ্ঠে বলে ওঠে,
“তুমিই তো চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলছিলে। তুমি জানো, দুটো কারনে মানুষ চিবিয়ে চিবিয়ে কথা হবে। হয় তার দাঁত ব্যথা করছে আর নাহয় তার যে দাঁত নেই এটা লুকাতে। তুমি কোনটা?”
“আমি তোমার চিবিয়ে খাব বলে আগে থেকে দাঁত দুই পাটি ধার দিচ্ছিলাম। একে অপরের সাথে ঘষাঘষি করলে ধার বাড়ে, এটা জানো না?”
তুর্জয় অন্যদিকে ফিরে বিরক্তিমাখা কণ্ঠে কথাটুকু বললেও আচমকা চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকায় নন্দিতা। কৌতুক ভরা কণ্ঠে বলে ওঠে,

“কোথা থেকে খাওয়া আগে শুরু করবে? ঠোঁট, গলা, নাকি…..”
“স্টপ” তুর্জয় দুই হাতে মাথা চেপে ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে। নন্দিতার মধ্যে এবারও চুপ থাকার লক্ষণ খুব একটা দেখা গেল না। সে আগের মতোই বকবক করতে করতে বলা শুরু করলো,
“আপনার ওই সিগারেট পোড়া কালো কালো ঠোঁট এমনিতেও আমার পছন্দ না। রিপ্লেসমেন্ট দরকার।”
আচমকা তুর্জয় নন্দিতার হাত ধরে একটান দিয়ে তাকে ফেলে দেয় বিছানায়। আকস্মিক আক্রমণে হতভম্ব নন্দিতার মুখ এবার আপনাআপনি থেমে যায়। আচমকা ধাক্কায় কোমরে ব্যথাও পায় খানিকটা। কিন্তু এই মুহূর্তে তার হুঁশ নেই সেসবের প্রতি। দৃষ্টি তার চঞ্চল। শরীর জুড়ে মৃদু কাঁপুনির পৈশাচিক খেলা। হৃদস্পন্দনের থেমে থেমে বিট করছে। আবার মাঝে মাঝে দুই ঠোঁটের মাঝে সামান্য ফাঁক সৃষ্টি করে হা করে শ্বাস নিচ্ছে সে। শরীরে রক্তের তাপমাত্রা কমতে শুরু করেছে আচমকা। উষ্ণ রক্তের স্রোত শীতল শিহরণে ডুবিয়ে দিচ্ছে শরীরকে। নন্দিতা থেমে থেমে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তার নিঃশ্বাসের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে তুর্জয়ের পুরুষালী নিঃশ্বাস। খুব কাছ থেকে ভেসে আসা পুরুষালী শরীরের গন্ধ কেমন যেন নেশা ধরানো, ঝিম ধরে যাচ্ছে।

নন্দিতাকে অবাক করে দিয়ে আচমকা তুর্জয় তার পুরু, সিগারেট পোড়া কালচে ঠোঁটটা ডুবিয়ে দিলো নরম দুই ঠোঁটের ভাঁজে। নন্দিতার পুরো শরীর অবশ হয়ে গেল যেন কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই। শক্ত পুরুষালী হাত দ্বারা আবদ্ধ তার নরম হাত ক্রমশ পিষ্ট হচ্ছে। ঠিক যেমন করে পিষ্ট হয়ে চলেছে অধর।
উষ্ণ চুমুর আবেশ থেকে মুক্ত হয়েছে নন্দিতা বেশ কিছুক্ষণ হলো। অথচ ওই তুখোড়, নেশালো দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলানোর সাহস করে উঠতে পারছে না বলে এখনও বন্ধ করে রেখেছে চোখ। অথচ এই পুরো সময়টাকে সদ ব্যবহার করার সুযোগ হাতছাড়া করলো না তুর্জয়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো নন্দিতার দৈহিক সৌন্দর্য। ঘন পাপড়ি, সরু নাক থেকে শুরু করে গলার পাশের ছোটো তিল, কোনোটাই বাদ পড়ল না আর। আচমকা তুর্জয় নন্দিতার কানের কাছে এগিয়ে যায়। নিভু নিভু কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে ওঠে,

“কালো ঠোঁট হোক বা কালো কলিজা, এটার কোনো রিপ্লেসমেন্ট হবে না। প্রয়োজনে তোমার নরম ঠোঁট দিয়ে রোজ একটু একটু কালো শুষে নিয়ে এটাকে সুন্দর করে তুলতে পারো।”
নন্দিতার বাড়তে থাকা নিঃশ্বাসের গতিবিধি আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিতে আচমকা তুর্জয় মুখ ডোবায় নন্দিতার গলার পাশের তিলে। দুইপাটি দাঁতের সবটুকু শক্তি দিয়ে জোরে কামড় দেয় সেখানে। নন্দিতা ব্যথায় ছটফট করতে করতে “ও মা গো” বলে চিৎকার দিয়ে উঠলে গলা থেকে মুখ তুলে আগের মতই নন্দিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে নিভু কণ্ঠে বলে ওঠে,

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৯

“এভাবে চিৎকার কোরো না, পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন অন্যকিছু ভাববে।”
“কী ভাববে?” ছলছল চোখে, ব্যাথাতুর কণ্ঠে বলে ওঠে নন্দিতা।
“ভাববে, বউকে আমি দিনের বেলায়ও ছাড় দিইনা।”
মৃদুমন্দ বাতাসের সাথে উড়তে থাকা পর্দার গা ঘেঁষে মেঝেতে লুটোপুটি খাওয়া দিনের শেষ আলোর মতো করে আচমকা নন্দিতার ফোনের স্ক্রিন জ্বলে উঠলো। ছোটো একটা বার্তা ঢুকলো মৃদু কম্পন ঘটিয়ে। বেশ গুছিয়ে লেখা,
“প্ল্যান চেঞ্জড। ড্রাগ নয়, সরাসরি এইডস ইঞ্জেক্ট করতে হবে। কাজটা করার জন্য মাত্র এক সপ্তাহ পাবে। এন্ড ইওর টাইম স্টার্টস নাও।”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১২