প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১৪
ফিজা সিদ্দিকী
মধ্যরাত। রুমের ড্রিম লাইটের আলোয় স্পষ্ট তুর্জয়ের মুখ। এলোমেলোভাবে শুয়ে আছে বিছানায়। নন্দিতা সেই থেকে এক ঠাঁয় বসে তাকিয়ে তার দিকে। কী যেন এক ভাবনা চলছে তার মাথায়। মূলত ভয় পাচ্ছে। না পাওয়া জিনিস হারানোর চেয়ে পেয়েও হারানোর ব্যথা ঢের বেশি। তুর্জয় কী তবে তার সাথে ছলনা করলো? তার মতো তাকেও ছলনা করে মাত দিলো এই খেলায়? এতো নিখাদ অনুভূতির ঝড় শুধুই যে ছলনা, এটা বিশ্বাস করতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। কিন্তু ঘোরের মাঝে তুর্জয়ের বলা কথাগুলো, কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে তবে?
নিস্তব্ধ রজনীর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকছে নন্দিতার চিন্তার প্রহর। অবশেষে হাঁপ ছেড়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো সে। সন্ধিহান চোখে পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে খোঁজার চেষ্টা করলো হিডেন ক্যামেরা। যার দ্বারা শত্রুপক্ষের পক্ষে খুব সহজে তাদের উপর নজরদারি সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু বরাবরের মতোই হতাশ হয়ে আলমারির দিকে এগিয়ে গেল সে। চেঞ্জ করার কাপড় নেওয়ার বাহানায় খুব সন্তর্পনে কাপড়ের মধ্যে ঢুকিয়ে নিলো দুটো ব্লাডের স্যাম্পল, যেটা আজ আর বিগত দিন এসেছিলো। সাথে নিলো একটা ইনজেকশনের সিরিঞ্জ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শিকদাররা যতই ধুরন্ধর হোক, ওয়াশরুমে ক্যামেরা লাগানোর মতো নীচ কাজ অন্তত করবে না। সেই ধারণায় বদ্ধপরিকর হয়ে নন্দিতা ওয়াশরুমে ঢুকে হাঁপ ছাড়ল। ওয়াশরুমের মধ্যে থাকা বেসিনের ক্যাবিনেটের গায়ে ঠেস দিয়ে একে একে সাজিয়ে নিলো তার সকল পরিকল্পনা। তাড়াহুড়ো না করে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে আস্তে ধীরে নন্দিতা হাতে তুলে নিল একটা ব্লাড স্যাম্পেলের টিউব। যেটাতে বড়ো বড়ো করে লেখা 6 সংখ্যাটা। অর্থাৎ এটা কালকের স্যাম্পলটা। এই রকম নামারিং করে সবগুলো টিউব একে একে সে সাজিয়ে রেখেছিল।
বেসিনের ট্যাবটা আলতো করে ছেড়ে দিলো নন্দিতা। সেই সাথে ছয় নম্বর টিউবটা খুলে তাতে সংরক্ষণ করা ব্লাড স্যাম্পলটা আস্তে আস্তে ফেলে দিলো বেসিনের সিঙ্কে। ট্যাপ হতে প্রবাহমান পানির সাথে ধীরে ধীরে মিশে গেল সেই রক্ত। অতঃপর সাদা পানির ফোয়ারা লালে রঞ্জিত হয়ে ভরে গেল সাদা সিঙ্কে। এরপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল ড্রেনেজের দিকে। নন্দিতা আস্তে আস্তে পুরো ব্লাডটুকু ফেলে ভালো করে ক্লীন করে নিলো টিউবটা। কেবিনেটের উপরে রাখা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে বারবার করে পরিষ্কার করলো টিউবের ভেতরের অংশ। এরপর স্যানিটাইজার দিয়ে বার কয়েক স্যানিটাইজ করে বন্ধ করলো বেসিনের ট্যাব।
সদ্য খোলা ইনজেকশনের সিরিঞ্জ হাতে দাঁড়িয়ে আছে নন্দিতা। মনের মাঝে চলছে হাজারো দ্বিধাদ্বন্দ্বের পশরা। শিকদারদের কাজে হাত ঢোকানোর ফল যে কত ভয়ানক হতে পারে, এটা নন্দিতার চেয়ে ভালো আর কে বা জানে। যার জন্য আজ সে অনাথ, তাদের রূপ দেখার আর কি বা বাকি থাকে। তারা যদি একবার জানে কতো ভয়ানক একটা বেইমানি সে করতে চলেছে শিকদারদের সাথে, তবে তুর্জয়ের গোটা পরিবার সহ তাকেও শেষ করে দিতে একটাবার হাত কাঁপবে না তাদের। যে হাত অস্ত্র ধরে ধরে কালশিটে, যে হাত খুনের রক্তে লালচে হয়ে গেছে, সেই হাতে মায়া আশা করা নির্বুদ্ধিতা ব্যতীত আর কিছু না। শিকদারদের অবৈধ সব কাজের একে একে খোঁজ পেয়ে যাচ্ছে তুর্জয়, আর তাইতো তাকে বদনাম করার এতো পরিকল্পনা তাদের।
হাতের কাছে কিছু না পেয়ে গলায় প্যাঁচানো ওড়নাটা খুলে নেয় নন্দিতা। দুই পাট করে সেটা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দেয় বাম হাতের কনুইয়ের উপরে বাহুতে। অতঃপর অনভিজ্ঞ হাতে হদিশ করতে থাকে হাতের শিরার। ফুলে ওঠা শিরার দেখা মিললেও নিজের শরীর থেকে ইনজেকশনের মাধ্যমে ব্লাড সংগ্রহ করা রীতিমত একটা চ্যালেঞ্জিং কাজ। দক্ষ হাত ছাড়া কখনোই সম্ভব নয় যা। ওয়াশরুমের মধ্যে পায়চারি করতে করতে নন্দিতা ভাবনায় মত্ত হলো। তার শরীর থেকে ব্লাড নিয়ে এই টিউব ভর্তি করতে হবে যেকোনোভাবে। কিন্তু কিভাবে করবে মাথায় আসছিল না। পায়চারি করতে করতে আচমকা নন্দিতার নজর গেল ওয়াশরুমের ভেন্টিলেশন জানালার দিকে।
কাঁচ দিয়ে বানানো সাইডিং জানালা থেকে বহু কষ্টে একটা কাঁচ নামিয়ে আনলো সে। অতঃপর ধপাস করে সেটা ফেলে দিলো ওয়াশরুমের মেঝেতে। গভীর ঘুমে থাকার ফলে এটুকু শব্দে যে তুর্জয়ের ঘুম ভাঙ্গবে না, এটা তার বেশ ভালো করেই জানা। টেনশনে রীতিমত ঘেমে চুপচুপে অবস্থা নন্দিতার। কপালে জমা হওয়া বিন্দু বিন্দু ঘাম গাল বেয়ে গলা পেরিয়ে পরণের জামায় এসে মিশছে। আর নন্দিতা একের পর এক কাজ করে যাচ্ছে তাড়াহুড়ো করে।
ভাঙ্গা কাঁচের একটা তীক্ষ্ণ, সরু গলি হাতে তুলে নিল নন্দিতা। অতঃপর লম্বা একটা শ্বাস টেনে দুই চোখ বন্ধ করে সেটা দিয়ে টান মারল বাম হাতের তালুতে। না চাইতেও তীব্র চিৎকার দিয়ে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো সে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ডান হাত দিয়ে বাম হাতের কব্জি ধরে চোখ বুঁজে হিশহিশিয়ে উঠলো যন্ত্রণায়। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল বেসিনের পাশে কেবিনেটের উপর রাখা সেই ছোটো টিউবটার দিকে।
গলগল করে বের হওয়া রক্তে রাঙা হাতটা উঁচু করে ধরলো সেই টিউবের উপর। একফোঁটা, দুইফোঁটা করে রক্ত পড়ছে সেই টিউবের মধ্যে। সময়ের সাথে ধীরে ধীরে সেই রক্ত দিয়ে পূর্ণ হলো শিশিটা। ব্যথায় নন্দিতার শরীর ছেড়ে দেওয়ার জোগাড়। তবুও দেয়ালে ঠেস দিয়ে নিজেকে ধরে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে সে। শিশিটা পূরণ হয়ে গেলে ওড়নাটা বাহু থেকে খুলে জড়িয়ে নেয় হাতের ক্ষত অংশে। এই মুহূর্তে ড্রেসিং করার মতো সময় তার হাতে নেই। বারোটা বাজতে আর ঠিক দশ মিনিট মতো বাকি।
একহাতে কোনরকম ড্রেস চেঞ্জ করে হালকা পাতলা একটা ড্রেস পরে রুমে ঢোকে নন্দিতা। ইচ্ছে করেই একটা কাপড় বেশি নিয়ে গিয়েছিল সে যাওয়ার সময়। যাতে সেটা রাখার বাহানায় আলমারি খুলতে পারে, আর সেই সুযোগেই ব্লাড স্যাম্পেলটা রেখে দেবে জায়গা মতো। যেন ভিডিও ফুটেজ দেখেও কেউ সন্দেহ করতে না পারে।
সাজানো পরিকল্পনামাফিক আলমারি খুলে ড্রেস রাখার বাহানায় সদ্য ভর্তি করা ব্লাডের শিশিটা কাপড়ের মধ্যে থেকে সরিয়ে রেখে নেয় ডান হাতের মুঠোয়। অতঃপর কাপড়ের ভাঁজ সরিয়ে নতুন একটা সিরিঞ্জ নিয়ে আলমারি বন্ধ করে এগিয়ে যায় তুর্জয়ের কাছে।
বেঘোরে ঘুমাবো তুর্জয়ের এলোমেলো চুলগুলো অগোছালোভাবে ঢেকে রেখেছে তার চোখের অর্ধেকটা। আলতো হেসে চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দেয় নন্দিতা। অতঃপর মলিন কণ্ঠে বলে ওঠে,
“আপনাকে খুন করতে গিয়ে ভালোবেসে নিজে খুন হলাম। আপনার চোখে ঘৃণা দেখার চেয়ে খুন হওয়াও যে সুখের, মিস্টার সাইলেন্সার।”
অন্ধকার ঘরে একটা মাত্র ক্ষীণ আলো। সেই আলোয় অস্পষ্ট একটা মুখ নিশ্চল দৃষ্টিতে ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে। বিগত ত্রিশ মিনিট ধরে একইভাবে তাকিয়ে রয়েছে সে মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায়। পাশের ঘরে চলছে বিলাসবহুল ওয়াইন পার্টি। যার হোস্ট সে নিজেই। নিজের জিতের খুশিতে দেওয়া এই পার্টিতে উপস্থিত বেশ কিছু লোক, যারা প্রত্যেকে তাকে সাহায্য করেছে এডভোকেট তুর্জয় আহসানকে হারাতে। শুধুই হারাতে নয়, বরং তাকে বরবাদ করে দিতে। তুর্জয়ের আগামী দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে ঠোঁটের কোণে পৈশাচিক হাসি ফুটে ওঠে তার। চেয়ারের হাতলে আঙুল ঘোরাতে ঘোরাতে ভাবলেশহীন ভাবে বলে ওঠে,
“তোর ঘরওয়ালী দিয়েই তোর ঘর পোড়ালাম। আমার পাপের সাম্রাজ্যে হাত বাড়ানোর দুঃসাহসের তোর সবকিছু তছনছ করে দিলাম।”
তীব্র এক হাসির ঝংকারে কেঁপে ওঠে ঘরের প্রতিটা দেয়াল। অজ্ঞাত ব্যাক্তিটা হাসতে হাসতেই শেয়ার ছেড়ে ওঠে। আলো ছায়া পরিবেশে একটা লোহার চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা জরাজীর্ণ এক নারী দেহের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বলে ওঠে,
“এখনও সময় আছে, সবকিছু আমার হাতে তুলে দে। নাহলে এরচেয়ে করুণ পরিণতি করবো তাদের।”
লোকটার কথার পিঠে ক্লান্ত এক কন্ঠস্বর রুদ্ধশ্বাসে বলে ওঠে,
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১৩
“আখেরি জামানার ফেরাউন তুই, সব পেয়ে গেলেও কাউকে বাঁচতে দিবি না তুই। তোর মতো জানোয়ারের পরিণতি দেখার মত হায়াত আমাকে দিও খোদা।”